দরাজ—দরজার ইতিকথা – বিপ্লব বিশ্বাস
পঁয়ষট্টির কোঠায় জিরেন দিচ্ছে মোহিত। ‘রিটায়ার্ড-জনের আবার কাজ কী?’–এমন আলগোছা মন্তব্য যারা ছুঁড়ে দেয় মোহিত তাদের বলতে চায়, ‘তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ’–ওই অনেকটা সুনীলকে ধার করে। অবসরের মানুষের যে সারাদিনই টুকটাক কাজের বহর তা তাদের বোঝায় কে! ভোর-ঘুমের দফারফা করে সেই যে শুরু হয়, থামে সেই বেলা একটা নাগাদ। ডাক্তার বলে, বয়স বাড়লে এদিকে দুপুর বারোটা আর ওদিকে রাত সাড়ে নটার মধ্যেই খ্যাঁটন পর্ব মিটিয়ে নেবেন। সে ব্যাটা তো বলেই খালাস। ফুকফুক করে সিগ্রেটে টান দিতে দিতে যেমন বলে, ধূমপান একদম নয়। তা মোহিতের সব মিটতে দেড়টা, পৌনে দুটো তো বেজেই যায়। তারপর মুখশুদ্ধি দাঁতে চিপে বেলা দু’টোর ভুল বানানের দূরদর্শন সংবাদ শুনতে শুনতেই চোখর পাতা লেগে আসে। পরক্ষণেই কপাত বিছানায়।
দুপুরের ভাতঘুমটিও যথাযথ হবার জো নেই। তিনটে পঞ্চান্ন নাগাদ ফ্ল্যাট-দরজার ছিটকিনি খুলে রাখতে হয়। নইলে রান্না-নাচুনি বাইরে থেকে ল্যাচ মুচড়ে ঢকাস ঢকাস জুড়ে দেবে, ঠিক চারটে পাঁচ দশ নাগাদ। ঢুকেই এক ওভেনে রুটি অন্যটিতে কোনওরকমে লাল চায়ে লেবু কচলে টেবিলে দিয়ে যাবে। আর সেই ফাঁকে মোহিত টয়লেট সেরে, চোখমুখ ধুয়ে নেবে। ঠিক তার আগের মিনিট দশেকই মোহিতের নিজস্ব সময়। জানালার বাইরে চোখ ফেলে আশপাশে কিছু নারকোল, আম, কাঁঠালের গাছ, সামনের বাড়ির প্রোমোটারের ছাদের বিচিত্র ফুল-চর্চা আর আকাশ বেয়ে উড়ে যাওয়া লাল, সাদা রঙের প্লেনের চলাচল একঠাঁই দেখে চলে। প্লেনে না চড়লেও মোহিতের ভালো লাগে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে। এইসব উড়ানকে সঙ্গী করে কত কত জায়গায় চলে যাওয়া যায়! ভি আই পি সংলগ্ন এই এলাকায় এখনও কিছু গাছপালা দেখা যায়, উদার তাকিয়ে থাকা যায় আকাশপানে। আবার এই একান্ত সময়ে চলে যাওয়া যায় অনেকটা পেছনে—দরাজ দরজার মুগ্ধ দিনক্ষণে।
—ও কেরণ, কেরণ, সদরদোরে খিল দিয়িছো?
রোজকার সাঁঝ-ধুনো বাড়ির এ-কোণ ও-কোণে দিতে দিতে হাঁক পাড়ে মুরারি বিশ্বিস। গোয়ালঘরে পোয়াল ধরিয়ে সাঁজাল দেবার পরেই এই ধূপচি-চলন। দুই ধোঁয়ায় মিলেমিশে একাকার ধোঁয়াশা তৈরি হত আলিশান বাড়িময়। দিন ফুরানের ক্লান্তি মরে এক মোহময় সান্ধ্য আবেশ ছড়িয়ে পড়ত বাড়ির আনাচকানাচে। পাড়ারও বটে। এর মধ্যেই কুপি জ্বলে গেছে হেঁসেলে। হ্যারিকেন ধরিয়ে রোয়াকে বসবে বিশ্বিস—রোজ হিসাবের জাবদা খাতাটি নিয়ে। সঙ্গে কাঠ-ডাণ্ডার আগায় নিব লাগানো কলম আর এক অদ্ভুত কালি-দোয়াত যা উলটে দিলেও কালি পড়ে না। তার আগে বিকেল বিকেল রোজকার হ্যারিকেন কাচের কালি-মোচন করে, সব কটির পলতে ঠিকঠাক করে তাদের খাবার অর্থাৎ কেরোসিন পেটে ভরে রেডি রাখবে বাড়ির মেয়েরা। বউ-বিহীন বিশ্বিসমশাই নিজেও এসব কাজে দক্ষ। আবার লক্ষ্মীথানের প্রদীপ-সলতেও পাকিয়ে রাখতে হত হররোজ। শিমুলতলি মাঠের জমিতে ক’ আড়ি ভাসামানিক হল, জবাইকুলির জমিতে ক’ কাঠা বিছন পড়ল, বাগানকোলের আফাতে কতটা কাঠমাছ উঠল, ঘর ছাওয়ার জন্য ঝাড় থেকে কটা বাঁশ কাটা পড়ল, সুধেন( সুধন্য) পরামানিকের বছরকাবারি ধান-চৈতালি দেওয়া হল কি না, আরও আছে বাঁধা রাখাল মুনিষ, বিমলির মা, নগেন হলদারের পাওনাগণ্ডার হিসাব, পাই পয়সা ধরে; এসবই ছিল বিশ্বিসের জাবেদা খাতার চলচ্ছবি। এমন লেখালেখির পাশে চলত পাশ-কৌটোয় রাখা ভাজা ছোলা মুখে ফেলে কটরমটর আর লালসুতো বিড়ির পাছায় আগুন ঠেকানো। এরই ফাঁকে সাঁঝঘোর হবার আগে পাড়ার এক দুজন এসে পড়লে টুকটাক গল্পগাছা—না, দেশোদ্ধার জাতীয় কোনও রাজনীতি-টাজনীতি নয়, নেহাতই পাড়া-গাঁ, এটা ওটা, পুজোটুজোর ভাঙনি নিয়ে খানিক নির্বিষ কথাবার্তা-বিষহীন ফসলের পারা। সাঁঝ ঘোর হলে দুটো গরম ভাত, ঘরের ঘি, আলুসেদ্ধ, খানিক সবজি দিয়ে খেয়ে শেষপাতে এক জামবাটি লাল টকটকে দুধ। তারপর গড়াতে গড়াতেই ঘুম আর তারই ফাঁকে শিয়রে থাকা পিপুল, হরিতকী চাবানো। আবার সেই ভোর-ভোর উঠে সদরের খিল খুলে বাড়িময় গোবরজল ছিটোনো। তালাটালা দু চারটে থাকত বটে, আলিগড়ি জাতীয়। তবে তা লাগানোর দরকার পড়ত না তেমন।
এই মুরারি বিশ্বিস হল গিয়ে মুরারিমোহন বিশ্বাস। মোহিতের দাপুটে ঠাকুর্দা। গৈ-গাঁয়ের হাঁকডাকে মুরারি বা মুরালি বিশ্বিস বা সামনাসামনি পড়লে বিশ্বিসমশাই, কাকা, জ্যাঠা, দাদু ইত্যাদি। আবার গালিগালাজ খাওয়া ফচকেদের আড়াল-ডাকে উলটো ফচকেমিও থাকত। মোহিত জন্মাবধি তার ঠাকুমাকে দেখেনি। ছেলে বিয়োতে গিয়ে বাড়ির পশ্চিমদিকের সারাঘরে শুয়েই নাকি অস্ত গিয়েছিল মাঝবয়েসি আন্নাকালী। মোহিত দেখেছে এই সারাঘরেই হালামালা, ধানকোঠা, সার দেওয়া খেজুরগুড়ের মুখ-আঁটা ঠিলি থাকত। আর ছিল ভাঙাচোরা একটি জোত-চষা হাতমেশিন। সেই আমলে এ জাতীয় যন্ত্র গ্রামগঞ্জে বিরলদৃষ্ট ছিল। সম্পন্ন চাষিবাড়ি ছাড়া। তবে ওই ঘরটির নাম ‘সারাঘর’ কেন তা আজও উদ্ধার করতে পারেনি মোহিতচন্দ্র। পরিত্যক্ত, সারানো হয়নি বা হবে বলেই কি? আর ওই কেরণ ছিল কিরণবালা। মোহিতদের এক বাড়তি পিসি বিশ্বাসবাড়ির সঙ্গে যার সম্পর্ক বিষয়ে কিছুই জানত না রক্তসম্পর্কের মোহিতরা। জানতে চায়ওনি কোনোদিন। ঠাকুর্দাকে মামা বলে ডাকত এই বিধবা ছোটোখাটো মানুষটি। আপন তিন পিসি থাকলেও সংসারের যাবতীয় কাজকামে এই কিরণবালার কথাই ছিল শেষকথা। তা নিয়ে কোনও বিবাদ, কানাঘুষো চলত না। ঝুঝকি আঁধারের ভোর থেকে রাত-শোয়া অব্দি তার কাজের অন্ত ছিল না। ঠাকুমার অভাবটি যেন তীক্ষ্ণ কিরণে পুষিয়ে দিয়েছিল এই উটকো পিসি কিরণবালা। আবার পান থেকে চুন খসলে মামার খ্যাচখ্যাচানিও কান পেতে শুনতে হত তাকে। তা নিয়ে কখনও কোনও গজরগজর শোনেনি কেউ। এই বাঁজা মানুষটির নীরব প্রয়াণের পর মোহিত জেনেছিল, পিসি ছিল লতাপাতা সম্পর্কের আন-জন। পাশ-গাঁ রতনপুর থেকে এই অমূল্য রতনটি জোগাড় করে এনেছিল মুরারিমোহন, তার বৈধব্যের পর। এমনটি তখন হত, হামেশাই হত।
যেমন পাড়া বলতে ছিল এক টান সেলাইয়ের বুনট। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, ও বাড়ি থেকে সে বাড়ি হুটহাট ঢুকে পড়া যেত বিনা নোটিশে। এ বাড়ির চালকুমড়ো ও বাড়িতে, ও বাড়ির লাউ এ বাড়িতে কিংবা অমুক বাড়ির বানে ওঠা ফনফনে পুঁইডগা তমুক বাড়ির হেঁসেল দাওয়ায় পৌঁছে যেত অনায়াস প্রেমছোঁয়ায়। আবার কারিকরপাড়ার অবিশ্বিস কারিকরের মুরগি-ডিম মধ্যেমাঝেই চলে আসত বিশ্বিসবাড়িতে। উল্লসিত হত মোহিত। ডিম যে তার বড্ড প্রিয় ছিল। আজও আছে। শুধু ছিল না সংশয়, ডিমকে ঘিরে আজ যা প্রকট। ঝগড়াঝাটি যে হত না তা নয়। জোয়ারের জলের মতো ছিল তা। খানিক তুইথুলি মুইথুলি শেষে ভাটার টানে মিইয়ে যেতে সময় নিত না। আবার শোলোকের মজাদার পুর দেওয়া ঝড়ুর বউয়ের ঝগড়া খাড়িয়ে শুনতে হত। কত রকম যে ঝুলিতে থাকত তার! তেমনটি হয় না আর! তা এই যে বেপরদা যাতায়াত সেখানে বাধা বলে যা থাকত তা এখন হাস্যকরই ঠেকবে। কারও বাঁশবাতার, কারও ক্যানেস্তারার বা কারও পাটকাঠির একটা ঠেকনো দরজা। দড়ির আঁকশি আঁটা। মানুষ নয়, গরু ছাগল ঠেকানোর জন্য। মোহিতদের ছিল একটা আমকাঠের আধ-খাওয়া দরজা। আগল বলতে কাঠেরই খিল যা কিনা ভোরবেলায় খুলে যেত আর আটকানো হত সাঁঝঘোরে। সারাদিন থাকত হাট-খোলা। বাড়িটির চারদিকে বিশ ইঞ্চি পুরু বাংলা ইটের দেওয়াল ছিল বটে, চুন সুরকিতে গাঁথা। কিন্তু তারও ছিল শতেক ফাঁকফোকর। প্লাস্টার বলতে ছিল ঠাকুর্দার লেপে দেওয়া গোবর-মাটির মিশ্রণ। তাই নিয়েই ছিল পাকাবাড়ির সটান পরিচয়।
—গাড়িতে কে আসে গো?
—গয়েসগাঁর পাকাবাড়ির বড়ো বউ গা; বাপের বাড়ি থেইকে শউর বাড়ি এইলো।
গড়ে বলদের পিঠে লড়ির সাট বসিয়ে হ্যাটহুট বকতে বকতে বাঁধা গাড়োয়ান হাফেজ চেঁচিয়ে উত্তর করে। ছই-ছাউনির গো-গাড়ি। ভেতরে বিচালি বিছিয়ে কাঁথা পাড়া। সেখানে বসে মোহিতের শহুরে মা আসত শ্বশুরঘরে। গরুবাথান গাবতলা থেকে পাক্কা আড়াই ক্রোশ পথ সাবধানে এলেও গাঁপথে খানাখন্দ তো কম নয়। হাবড়-টাবড় হলে হাফেজ আগেভাগেই সাবধানবাণী শোনায়, ‘মাঠান, টুকুন সামলে বইসেন। ছুমুবাঁকে…’
এভাবেই তিন তিনটে গাঁ মাড়িয়ে আসতে হত আর সারাটা পথ জুড়ে সওয়ারের পরিচয় দিতে হত তাকে–ওই মাঝবয়েসি হাফেজ গাড়োয়ানকে। মুখে ফেনা উঠে গেলেও বিরক্ত হত না, বরং পাকাবাড়ির বউকে নিয়ে আসছে বা যাচ্ছে, এই ব্যাপারটি তাকে ফুলিয়েই রাখত। এ রকমই ছিল তখনকার চলাচল; পথজুড়ে চেনা অচেনা উৎসুকজনের সঙ্গে কথাচারিতা, খবর দেওয়া-নেওয়া।
পাকাবাড়ির পরিচয়টি বেশ মজাদার লাগত মোহিতের। আসলে গয়েসগাঁ ছিল আড়ে-লম্বায় বিশাল। সে গাঁয়ের উত্তর-দক্ষিণ-পুব-পশ্চিম জুড়ে নানান পাড়া—চাঁইপাড়া, ঘোষপাড়া, নাথপাড়া, কারিকরপাড়া, নমপাড়া ইত্যাকার সব জাত পদবির পরিচয়ে ঘেরা এক একটি পাড়া।
আবার চাকলা বিলের গা ঘেঁষে যে বসতি তা চাকলাপাড়া। মাঠপুকুরের ধারে যাদের বাস তারা মাঠপাড়ার বাসিন্দা। মোহিতদের ছিল বিশ্বিসপাড়া—মাহিষ্য বিশ্বাসদের আধিক্য সেখানে। তা এতবড়ো গয়েসগাঁয়ে পাকাবাড়ি বলতে ওই একটিই। তাই সহজ পরিচয়ে বাড়ির উল্লেখ।
আর একটি বিষয়ও এন্তার মজা ছড়াত মোহিতের বালকবেলায়। তাই বা কেন? এখনও ভাবলে বুকের কোথাও যেন গর্বের বেলুনটি ফুলে ওঠে। মোহিতের বাবা রোহিতাশ্ব ছিল বাড়ির বড়ো ছেলে। এক জীবনে মেদিনীপুর এস্টেটের তহসিলদার রোহিতের বাবা নানাস্থলে ঘোরাঘুরির সুবাদে চাইত তার ছেলে দুটি লেখাপড়া শিখুক। যদিও বড়োটির হলেও ছোটোটিকে ধরেবেঁধেও করানো যায়নি। সে অন্য কথা। গাঁঘরে তখন ইস্কুলের বড্ড অভাব। মাইলপাঁচেক দূরে একটা প্রাইমারি থাকলেও হাইস্কুল দূর অস্ত। আবার রোহিতের মায়েরও বছরভর এখন তখন। যাই হোক, রোহিতের বড়ো মেসো ছিল অবিভক্ত খুলনার কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ইন্সপেক্টর। আর মাসিও সন্তানহীনা। সেই মাসিই দায়িত্ব নিল বোনপোর পরবর্তী পড়াশোনার। সে ভর্তি হল আর কে বি কে হরিশ্চন্দ্র বিদ্যালয়ে। অবশ্য মেসোমশায়ের বদলি-চাকরির কারণে রোহিতাশ্ব ম্যাট্রিকুলেট হয়েছিল তৎকালীন খুলনারই অন্তর্গত আলমডাঙ্গা হাইস্কুল থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছেঁড়াফাড়া শংসাপত্রটি এখনও রক্ষিত আছে মোহিতের কাছে—নেই শুধু মানুষটি। যেমন নেই আত্মীয় অনাত্মীয় অনেক অগ্রজজনই। কালস্রোতে ধুয়েমুছে গেছে। যেমনটা যায় ঢেউ পরম্পরায়। যা হোক, মোহিতের বাবা রোহিতাশ্বর মুখ থেকে যে কটি গর্ব-কথা প্রায়ই শুনতে হত তা হল:
১) পৌরাণিকমতে কাকতালীয় হলেও রোহিত ছিল হরিশ্চন্দ্রের জ্ঞানজ পুত্র অর্থাৎ আর কে বি কে হরিশ্চন্দ্র স্কুলের ছাত্র। আর পিতার নামাঙ্কিত এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। গর্বের কথাই বটে!
২) রোহিতাশ্ব ম্যাট্রিক পাশ করেছিল স্বাধীনতার বছরে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে।
৩) সেইই প্রথম গয়েসগাঁয় ম্যাট্রিকুলেট যাকে দেখতে গাঁ ভেঙে মানুষ জড়ো হয়েছিল বিশ্বিসবাড়িতে। আশপাশের গাঁ থেকেও। তখনকার দিনে এমনটি হত বই কি!
মুরারি শুয়ে আছে দুপুরছ্যাকের শীত-রোয়াকে। গায়ে ফরেস্টার ছেলে রোহিতের বাতিল খাঁকি কোট। ম্যাট্রিক পাশ দিয়ে রোহিত চলে গিয়েছিল উত্তরবঙ্গে। বনদপ্তরে চাকরি জুটিয়ে। আবার বেশ ক’ বছর পর ফিরেও এসেছিল গাঁ-টানে। প্রাইমারিতে মাস্টারি জুটিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী শীলা পালচৌধুরী। সেই সময়েই সঙ্গে এসেছিল উত্তরকন্যা সীতা। বউ হয়ে। এখন অন্য কথা।
—কে যায়?
চোখ বুজে থাকলেও মুরারি পদশব্দ টের পায়।
—আমি কাকা। মহিমের বউ। এট্টু জল নেব।
এই বিশ্বিসবাড়িরই একমাত্র কুয়ো গোটা পাড়ার পান-জল জোগায়। আর স্নান-জলের জন্য আছে বাইরের পুকুরটা। তাই কাঁখে পেতল-ঘড়া ঠেসে পাড়ার বউ-ঝিদের আনাগোনা লেগেই আছে অন্দর চত্বরে। অনর্গল দরজা ফুঁড়ে। পুকুরজলে ডালসেদ্ধ যুতসই হয় বলে স্নান, কাপড় কাচার সঙ্গে সেখানেও এই ঘড়াচারিতা। আবার নগেনের খ্যাপলা জালে মাছটাছ উঠলে তাও পৌঁছে যেত পাড়ার হেঁসেলে, ভাগে ভাগে। দামটামের কথা কেউ ভাবতই না সে আমলে।
এভাবেই চলতে চলতে মোহিত এল, এল তার একটি বোনও। তাদের পড়াশোনার কী হবে! বাবার স্কুল থেকে মোহিত বৃত্তি পেয়ে চার ক্লাস পাশ করলেও হাইস্কুল তো সেই গরুবাথানে। রোদ-জল-কাদা মাড়িয়ে এতটা পথ রোজ যাওয়া-আসা সম্ভব নয়, ছেলেমেয়ের পক্ষে। মেয়ে না হয় অনেকটাই ছোটো। কিন্তু মোহিতকে তো দিতেই হবে। এই ভেবে রোহিত একদিন বাবাকে বলে:
—কিমতপুরে আমাদের খানিক জমি আছে না?
—আছে তো। ভবিষ্যৎ ভেইবি কিনি রেইখিছিলাম কাঠা পুনেরো। ক্যানে?
—না, ভাবছি সেখানে একটা ছোটোখাটো ঘর তুলে যদি ওদের নিয়ে যাই…জাগাটা জমে উঠছে; হাইস্কুল, থানা, বাজার-টাজার সবই আছে। আবার মেয়েদের একটা জুনিয়র হাইও গড়ে উঠেছে কিছুদিন হল। তাই…
—ও, এই ব্যাপার। তা দ্যাখ। ওদের কথা ভেবিই তো… অ্যাখুন যদি কাজে লাগে…
টুকুন দম নিয়ে কথাকটি বলে রোহিতের বিষয়ী বাবা। ভাবে, এগোতে হলে তো একসময় ঠাঁইনাড়া হতেই হয়। সবই যে হাতের নাগালে জুটে যাবে, তা তো নয়! একদিন না একদিন ঘর ছেড়ে তো…!
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ঝাড়ের বাঁশ, বাগানের আম কাঁঠালের গাছ-কাঠ, জমির খড়—সব কেটেকুটে গাড়ি বোঝাই করে একদিন রওনা করে দিল কিমতপুরের উদ্দেশ্যে। মুনিষ-টুনিষও গেল গাঁ থেকে। তৈরি হল মাটির দেওয়ালের উপর চারচালা, সঙ্গে আর যা যা লাগে। কাঠাদশেক ফেলে রেখে চারধারে বেড়া পড়ে গেল। সামগ্রী হল, জংলা জামালকোটা, ঢোলকলমির সঙ্গে বাঁশবাতা, পাটকাঠি। দরজা একটা থাকল বটে, নমোনমো। ওই গোরুটোরু, কুকুর-টুকুর ঠেকানোর জন্য। অবশ্য গা লাগোয়া পাটজমি থেকে রাতবিরেতে হায়না শেয়ালের উৎপাতও ছিল। যাই হোক,পাকা বাড়ির পাকা দেওয়ালের বংশধরের অগ্রগতির জীবন শুরু হল অনেকটা পিছিয়ে।
এ পাড়ায় ঠাঁইনাড়া মানুষই বেশিরভাগ। কেউ সাতচল্লিশ পরবর্তী তো কেউ বর্ডার-অত্যাচারিত। শুধুই পড়ালেখার তাগিদে সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে চলে এল রোহিতাশ্বর পরিবার। আলোক-বিশ্বের পথে এগোতে হলে যে বারংবার উৎক্ষিপ্ত হতে হয় তা মোহিতের মতো কম জনই জানে। তাই সে ঘটি হয়েও ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু। সে অন্য পর্ব। যা হোক, নতুন মাটিতে মিলমিশ হতে সময় নিল না। পাড়াচারিতা, এ-বাড়ি ও-বাড়ি রান্নাপদের লেনদেন এখানেও যথারীতি। সাঁঝ-আলোর জোগান হ্যারিকেন হলেও সে আলোয় পুলকিত হয় অমল-বিমল-কমল। এক আলোয় সাঁঝ-পাঠে মন দেয় মোহিত ও তার বান্ধবকুল। টুকটাক দেখিয়ে দেয় মোহিতের বাবা। না, এখনকার ট্যুইশন জাতীয় কিছু নয়। মজার কথা, পাড়াতুতো এক ভাইকে সঙ্গী করে রোহিতও শুরু করল পড়াশোনা। দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছরের অ-চর্চার পর ঘষেমেজে পাশ করল তৎকালীন প্রি-ইউনিভার্সিটি, পরবর্তীতে বিএ টাও। প্রাইভেটে। গয়েসগাঁ স্কুলে জলকাদা ভেঙে, তাপটাপ মাথায় নিয়ে যাওয়া-আসার মাইল দশেক সাইকেল ঠেঙানো আর সন্ধেরাতে ছেলেপিলের সঙ্গে পড়তে বসা। ঘ্যানর ঘ্যানর নয়, মনে মনে। এভাবেই এগোনো, এভাবেই স্নাতক হওয়া। না, কর্মজীবনে কোনও লাভালাভ হয়নি তাতে, শুধুই নেশার তাগিদে। বাড়িতে গোরু, ছাগল ছিল। ছিল তাদের দেখভাল। আর ছিল বৈকালিক মাচান-আড্ডা। সেখানেও নানাবিধ একান্ত আলাপন। পরস্পর খোঁজখবর লেনদেন। সরল স্বাভাবিক কথাচারিতা। তখনও দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্পে ঘোলাটে হয়নি মানুষের রোজনামচা। এর মাঝে কেউ কেউ গ্রাম্য হাস্যরসের জোগান দিয়ে মাতিয়ে রাখত আসর। তার মাঝেই টুকটাক বিড়ি ফোঁকা, অবরে-সবরে ব্রিজ, ব্রে, টোয়েন্টি নাইন। পাড়ার মহিলাদের আলাদা আড্ডা। সেখানেও রোজকাজের হিসাব পেশের সঙ্গে আবশ্যিক কিছু পরচর্চা, পরনিন্দা যে থাকত না, তা নয়; কিন্তু তা কখনোই অপার মেলামেশায় বাধ সাধেনি। সাদামাটা যাপনে নিষ্ঠার সঙ্গে জুড়ে ছিল পারস্পরিক তালমিল।
এভাবেই একদিন শেষ হল মোহিতের স্কুলজীবন। সত্তর দশকের শুরু। বজ্রনির্ঘোষের আগুনপাট সময়। নস্যাৎ শিক্ষা, নস্যাৎ সমাজজীবন। সেই উথালপাথাল দিনে মোহিত পড়তে চলে গেল জেলা সদরের সরকারি কলেজে। পরিবেশ ভিন্ন, প্রতিবেশে থম-ভয়ের আঁকড়া। কিমতপুর অবশ্য সে আগ-হলকার বাইরেই ছিল।
কলেজে যাবার পর মোহিত, মোহিতরা আবার পাকাবাড়ি পেল। যদিও কমে গেল ক্ষেত্র। ঘরের, মনের নয়। নয় চুন- সুরকির। পড়ে থাকা জমিতে ভাটা জমিয়ে ইট পোড়াল রোহিতাশ্ব। আমদানি হল সিমেন্ট, সঙ্গে সাদা বালি। আর বি সি ছাদের নীচে দুটি ছোটো ঘর। বাড়িটাকে বেড়ে একটা নীচু দেওয়াল। বসল খানিক বড়ো আকারের কাঁঠাল কাঠের দরজা, সাদামাটা নক্সাদার। তা বসল সদরে, আর অন্দরে থাকল একটা ছোট্ট টিনের দরজা। কিন্তু খুব একটা হেরফের হল না সেই দরজা চরিত্রের। সারাদিন ভেজানো থাকলেও ছিটকিনি লাগত সেই রাত-শয়নের আগে। এর মধ্যে চেনা অচেনা জনেদের অগণন আনাগোনা। অবাধ ঢঙে।
দিন বয়ে যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জীবনের স্থির জলে টালমাটাল ঢেউ। গড়ে ওঠে নতুন দেশ, নতুন রাষ্ট্র। ওদেরই গা ঘেঁষে। তার আগে আছড়ে পড়ে উৎপাটিত মানুষ সব। বিশেষত হিন্দুরা। টান পড়ে বাসভূমিতে। টান পড়ে সম্পর্কে। মানুষ পায়, সচেতন-অচেতন রাজনীতির কুটিল ছোঁয়া। একই অস্থিরতা মোহিতের মনপবনে। বিয়ে-থা করেছে। সময়-চলনে বাবা হয়েছে দুই সন্তানের। নানাবিধ চাকরি মাড়িয়ে বাবার পথেই পা রেখেছে শেষতক। কিন্তু পায়ের নীচে তার সর্ষে। নিজ স্কুলের মাস্টারি ছেড়ে তাই একসময় চলে যায় আর এক সদর শহরে। এবারে জেলা মুর্শিদাবাদ। এক মনখারাপের সকালে চারশো দশ ম্যাটাডোর ভিড়িয়ে মালপত্র, বউ-বাচ্চা নিয়ে পাড়ি জমায় বহরমপুরের শহুরে মাটিতে। এবারে আর রোহিতাশ্ব নয়, ঠাঁইনাড়া হয় মোহিতকুমার। নিজ বাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে।
—এই মেয়ে, দরজা আস্তে ঠেলতে পারিস না? ভাঙলে কিন্তু…
এভাবেই একদিন স্কুলফেরত মেয়েকে চমকে দেয় ননীগোপাল। ননীগোপাল সেন। খাগড়া হরিবাবুর ঢাল এলাকার দাপুটে সেনবংশীয় উত্তরপুরুষ। জোতজমা, ব্যবসাপত্তর, ভাগীরথী বেয়ে হাজারমণী নৌকোর পাল-ঝাপটা মায় পুরনো দুধ-ঘি-ননীর জেল্লা চটে গেলেও ঝামটানো যায়নি অশীতিপর ননীগোপালের।
পেতলহাঁড়ার গচ্ছিত রুপোটাকা ফুটিয়ে বাড়ির সামনেটায় ছেলে প্রিয়গোপালকে বসিয়ে দিয়েছে বিজলিবাতির দোকান দিয়ে। মারের থান। বেচাকেনা ভালোই। অবশ্য প্রিয়র জীবনে তেমন আলো ফেলতে পারেনি বাপ ননীগোপাল। নন্দীরাজদের স্কুল থেকে কোনওরকমে দশক্লাস পার করিয়ে বসিয়ে দিয়েছে এই আলোঝলমল দোকানে। পুরোনো বাংলা ইটের পুরু দেওয়ালের চারটি ঘর। তার দুটিতে বাস করে বাকি দুটি ভাড়া দিয়েছে মোহিতকে। জানলা দরজা বুড়োর দাঁতের মতো। এদিক ঠেলতে ওদিক নড়ে যায়। দেশ-বাড়ির কথা মনে পড়ে মোহিতের। সেখানে অবশ্য এমন মুখ-ঝামটানি ছিল না। এমন বাড়িরই প্রবেশ পথে যে আগল-ঠেকনো তা কতই বা পোক্ত হবে! কিন্তু তাকে নিয়েই ননীবাবুর বিলাপ, প্রলাপ। ঝাপট, দাপট। কোনও রকমে এ পাল্লার খাঁজে সে পাল্লাকে গুঁজে আলতো করে রাখা। জেলার কোহিতুর আমের ঢঙে তার সঙ্গে আচরণ করতে হয়। বিড়ালপায়ের মতো আলগোছে। সড়গড় হাত যতটা সাবধানী হতে পারে, আনকা-জন তো তা পারে না। তাই ঢকাম শব্দে কেউ ঢুকলেই সটান বাক্যবাণ সইতে হয় তাকে। মোহিত বুঝতে পারে জায়গার ফেরে আর আগুয়ান সময়ের পশ্চাদগামিতায় দরজা-চরিত্রের বিবর্তন ঘটেছে। কুঁকড়ে যাচ্ছে মাখোমাখো মিলমিশের দিনকাল। তাই লজঝরে সদরদোরও চোখ রাঙায়, সঙ্গত করে অন্দরের সঙ্গে। উদারতা পিষে গিয়ে ভেসে ওঠে কুটিল পাঁক। ভাড়া থাকার দায় মোহিতকে সইতেই হয়। সইতে পারে না মেয়ে মুন্নি। সে-ও পালটা ঝামটিয়ে ওঠে। দাদু বলে ডাকে ননীগোপালকে। বলে:
—ভাঙা পচা দরজা পালটাতে পারো না? তোমার ছেলে শব্দ করলে কিছুটি বলো না তো? যত্তোসব পরের বেলায়। না?
ননীগোপাল উত্তর করে না। গজর গজর করে মাত্র।
এই বাড়ির দুটি অভ্যাস আগে কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারে না মোহিত। তখনও প্লাস্টিক ক্যারির এত রমরমা হয়নি। মুদিদোকান থেকে খবরকাগজের মাল পুরে সুতলি দড়ি দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় বেঁধে দিত দোকানি। বাড়ি এসে সেইসব দড়ি-টুকরো জড়ো করে লোহাগ্রিলে টাঙিয়ে রাখত ননীমেসো। কাজে লাগবে বলে। দুই, ল্যাংচানো মাসিমা ঠাকুরঘরে সাঁঝ-প্রদীপের সঙ্গে ধূপকাঠির অর্ধেকটা ভেঙে জ্বালত। সে-টুকুও খানিক পরে নিভিয়ে দিত কি না, খেয়াল করেনি মোহিত। তা দেখে খরখরে মুন্নি একদিন প্রশ্ন করেছিল:
—একটা কাঠি তোমার কদিন যায় দিদা?
এতে কটমট তাকিয়ে মুন্নিকে নজরশাসানি দিয়েছিল বুড়ি। মোহিতের সাতপাঁচে না থাকা বউ বিরক্তি স্বরে বলে উঠেছিল, মেয়েটিকে নিয়ে আর পারা যায় না! কবে যে উঠতে বলবে বুড়ো!
বলেও দিল একদিন। না, সরাসরি নয়। ঘুরিয়ে:
—মোহিত, ভাবছি ঘরদোরগুলি একটু সারাইটারাই করব। কবেকার বাড়ি…
—তা করেন। করা তো দরকার মেসোমশাই। নইলে সদর দরজাটা নিয়ে…
—তাই তো। তা বাপু, সামনের মাসের শুরুতেই মিস্ত্রিটিস্ত্রি লাগাব ভাবছি।
ওদিকে মোহিত ভাবছে কিপ্টে বুড়ো আবার আগাম- টাগাম চেয়ে বসবে কি না। ঢোকার সময় তো দু মাসের দিতে হয়েছিল। তবুও সাহসে ভর দিয়েই বলে ফেলে:
—তা লাগান না। আমরা না হয়…
আসলে মোহিত বলতে চেয়েছিল, একটা একটা করে ঘরের কাজ সারলে এক ঘরেই না হয় ঠুসেমুসে থাকবে ওরা। কিছুদিনের তো ব্যাপার। কিন্তু তার এই ছুঁড়ে দেওয়া কথাকে লুফে নিয়ে দুঁদে ননী বলে দিলেন:
—হ্যাঁ তাই-ই। তুমি ছেড়ে দাও। অন্য কোথাও একটু কষ্ট করে খুঁজে নাও। তাপ্পর সারাই টারাই হলে না হয়…
শেষ কথাটি ননী জেনেবুঝেই বললেন। একবার ছেড়ে দিলে উভয় পক্ষের কেউই আর আগের অবস্থানে ফিরবে না। ফেরে না।
মোহিতের এর পরের ঠিকানা গঙ্গাপাড়ে কুলদা রায় লেন- এ। প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন এক উকিলবাড়িতে। সে বাড়ির দরজা দুবলা কেউ ঠেলে ঢুকতে পারবে না। লোহার মোটা পাত সাঁটা পুরু কাঠের দরজা। তবে কিছুকাল বাসের পর মোহিত বুঝতে পারল, এ দরজা মোটেই দরাজ নয়।
প্রথমেই লাগল, কয়লা-আঁচের উনুন নিয়ে। উকিলপুত্র একদিন ঘুরিয়ে বলল,স্মিত হাস্যে:
—দাদার গ্যাস নেই?
এত সংক্ষিপ্ত অথচ সরাসরি প্রশ্নটা সামলাতে একটু সময় নিল মোহিত। পরক্ষণেই উত্তর করল:
—না, এখনও পাইনি। দরখাস্ত একটা দিয়ে রেখেছি। জানি না কবে হবে!
—এম পি কোটা-টোটা?
—আমার ওসব জানাশোনা নেই দাদা। কেন বলুন তো?
—না মানে, আঁচে ধোঁয়া হয় তো খুব। ডাক্তারবাবুরা বলছিলেন, খুব অসুবিধে হয়। আমার ছেলেটারও আবার টানের ধাত। তাই বলছিলাম..
—কী?
—বৌদিকে বলবেন, আঁচটা যেন বাইরের গলিতে যেন দেয়।
মোহিত বুঝল, আঁচের আঁচ ছড়াতে লেগেছে। আর এই ডাক্তারবাবুরা হলেন ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ। কেউ অ্যালেমবিক, কেউ গ্ল্যাক্সো, কেউ বা ছোটোমোটো মেনডাইন জাতীয়। ব্যাচেলারগুচ্ছ। কারোরই রান্নার ঝামেলা নেই। বাইরে খায়। বরং মোহিতের বউ-এর হাতের চা-টা ছুটিদিনে জোটে তাদের। তারা আপত্তি করেছে, এটা ভাবতে মোহিতের অবাক লাগছে! যাই হোক, পরদিন থেকে আঁচ-উনুন বাইরে। ধোঁয়া ছড়িয়ে মাঠমাঠ করে আঁচ গমকালে তবেই ভেতরে। আজকের দূষণ সচেতনতা জোরাল থাকলে তখনই হয়তো লেগে যেত বাইরের কারও না কারও সঙ্গে।
আর একদিন। লেগে গেল, কমন বাথরুম নিয়ে। মোহিতের বউ সুষমাই বেশিরভাগ দিন পরিষ্কার টরিষ্কার করত। তবুও কী এক অজানা কারণে উকিলপুত্র যা নয় তা শুনিয়ে দিল।
মন ভেঙে গেল মোহিতের, মোহিতদের। এরপরেও আর এক দুটি ভাড়া যা থেকেছে কোথাও স্বস্তি পায়নি। ছড়াতে পারেনি হাত পা। অথচ সে নিজে থেকে কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেনি। জীবনের পূর্ব পর্যায়ে ভাড়া থাকা জানত না। তাই বুঝতও না চালাকির প্যাঁচ পয়জার। এখন টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। ভাড়াটে-বাড়িওয়ালা সম্পর্কে কোথাও যেন প্রভু-চাকর মনোভাব আবার কোথাও অপ্রকট ছল-চাতুরির বিষ-ছোঁয়া। কোনও সমস্যা না থাকলেও বছর দুই যেতে না যেতেই খুটখাট শুরু হয়ে যায়। পায়ে পা বাধিয়ে। মূল কারণ ভাড়ার পরিমাণ। বছর বছর যা সামান্য বাড়ে, তুলে দিয়ে নতুন বসাতে পারলে একলপ্তে বসানো যায় অনেকটা। এভাবেই টাকার অঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করে সম্পর্কের ঘুড়ি-সুতো। অদ্ভুত!
বছর দশেক প্রায় এই ফেরেই কাটল মোহিতের।
ট্যুইশনহীন হেডগিরি করেছে সে। হাতে জমাও নেই তেমন। যা হোক, কষ্টেসৃষ্টে পি এফ-এ যা জমিয়েছিল তার সঙ্গে ব্যাঙ্কলোন যোগ করে একটা ঝুঁকি নিয়েই ফেলল সে। তখন সদয় ব্যাঙ্ক মাস্টারদেরও লোন দিতে হাত উপুড় করছিল। তা ছাড়া সুষমাও যেন সহ্য করতে পারছিল না আর এই অসম্মানের নির্বাহ। বেরোতে চাইছিল দমবন্ধ অবস্থা থেকে। কিন্তু জমি কিনে বাড়ি করা পোষাবে না মোহিতের। সময়েরও টান আছে। আবার দু কামরার খুপরিতেও কুলোবে না। তাই ঢুঁড়েপেতে একটা ছোট্ট দোতলা বাড়িই কিনে ফেলল সে। আসলে কিনতে বাধ্য হল। কিমতপুরে মা বাবা আর কদ্দিনই বা থাকতে পারবে! বয়স তো হচ্ছে। অসুখ বিসুখ, দেখভাল।
জায়গার নাম ইন্দ্রপুরী। মাছমারা বিল বুজিয়ে এই দেবরাজ-প্রাসাদের এলাকা। সকলেরই ওই দু কাঠা, তিন কাঠা। কাউকে কাঠা দেড়েকেই জমাতে হয়েছে। মোহিতেরটা দু কাঠা। ছত্রিশ-চল্লিশ মাপের। এ মাপের জমি নাকি খুব একটা মেলে না। বারো ফুট রাস্তার ওপর পুব-দক্ষিণ খোলা। মোহিত গুণে দেখল, এ বাড়ির ছোটো বড়ো দরজা পাঁচটি। জায়গা কমল, বাড়ল দরজার সংখ্যা। কোনওটা কাঠের, কোনওটা লোহার; আবার সিঁড়ির নীচে মূল দরজাটির দুটি ভাগ। বাইরের দিকে লোহার শাটার, ভিতরে কাঠের একপাল্লা। দরজা সব যেন চেপে বসতে চায় অবাধ চলাচলের শরীর জুড়ে। কোথাও যেন গুটোতে বাধ্য করে মেলে দেওয়া হাঁকুপাঁকু মনটাকে।
এ বাড়িতে এক ভাড়াটে সহই ঢুকল মোহিতরা। নীচে আড়াই জনের এক পরিবার আর ওপরে বাড়িওয়ালা মোহিত। তবুও মনিব হতে পারল না সে।
ভাড়ার টাকায় সামান্য সংসার-সুরাহা হলেও ক্ষতি হতে লাগল অনেক বেশি। মেঝেতে গরম স্টোভ-তাপ উগরে লাল শান ফাটিয়ে দিল, দেয়ালে দেয়ালে পেরেক ঠুকে দেওয়াল চটিয়ে দিল, অঝোরে পাম্প-জল খরচ করে বিদ্যুৎ বিল বাড়িয়ে দিল আর একদিন স্বামী-স্ত্রীতে ঠুকুমুকু করে দিল ভেঙে পায়খানার সাদা প্যানটা। তবুও কিছুই বলতে পারে না মোহিত। বলতে দেয়ও না সুষমা। খিটিমিটি ওর না-পসন্দ। তাই ওদের গা থেকে ভাড়াটিয়ার গন্ধ গেলই না। সিঁটিয়েই থাকল ক বছর।
এ পাড়ায় মিলমিশ ওই অনেকটা মুখোমুখি। সামনের বাড়ির সঙ্গে আনাগোনা কথালাপ থাকলেও পাশ বাড়ির ব্যাঙ্কবাবু প্রথম থেকেই শত্রুভাবাপন্ন। মোহিত সেটা বুঝল তখনই যখন বাড়িতে ঢোকার আগে বাইরেটায় রং প্রলেপ দিতে গিয়ে ঝাপটান খেল। একই দেওয়ালের আধাআধি দুই বাড়ির পরিসীমা। স্বাভাবিক রং ছিটা তার এক্তিয়ারে পড়তেই বিষমুখো ব্যাঙ্ক-বউ কথাচোটে সব ধুয়ে দিতে লাগল। তারপরেও কারণে অকারণে পায়ে পা বাধিয়ে দিত। আলগা অশান্তির ভয়ে চুপসে থাকত মোহিতরা। তা ছাড়া তার পেশাও তাকে যেন নিরস্ত করে রাখত অনেকটাই। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুন্নিও শান্ত হচ্ছিল। মোহিত উত্তরাধিকারসূত্রে দুটি নারকেল গাছ পেয়েছিল। সামান্য হলেও গয়েসগাঁ, কিমতপুরের ছোঁয়া। কিন্তু সেখানেও জ্বালা। পেছনবাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে বেয়াড়া গাছদুটি। ঝুরি-নোংরা ছিটোয়, গাছি এসে সাফসুতরো করলে আরও বেশি পাতাটাতা পড়ে সে বাড়ির ছাদে। বাড়ে খিসখিসানি। তবে খানিক পুষিয়ে দেয় গাছ নিজে থেকেই। জগদীশ বোসের কথা মেনে অবরে-সবরে ঝুনো নারকেল ফেলে দেয় তাদের এক্তিয়ারে। আবার বড়ো পুজোর আগে বেশ কয়েকটা দিয়ে আসে সুষমা। শুধুই পেছ-বাড়ির বউটার মুচকি হাসি দেখার জন্যেই নয়। অভ্যেস বশেও।
বাড়ি এখন মন খারাপের থান। বাস সেখানে স্বস্তিহীন। যতই নিজের হোক না কেন! ইতোমধ্যে বাড়ি করে উঠে গেছে ভাড়াটে। এমত অবস্থায় বছর আটেক পর মোহিতের বাবা দারুণ অসুস্থতা নিয়ে কিমতপুরের পাট গোটাতে বাধ্য হল। বরাবরের মতো সেও মোহিতের মাকে নিয়ে ঠাঁইনাড়া হল অশীতিপর বয়সে। তার আগে এক দু বার যে আসেনি তা নয়। অসুখে বিসুখে। তবে থাকেনি থিতু হয়ে। এক-দুদিন থেকেই চলে যেত মোহিত স্কুলে থাকাকালীন। বলত, এত দরজা তার ভালো লাগে না। সেই মানুষটাই যখন একেবারে চলে আসতে বাধ্য হল শহরের অস্বস্তিকর পথে তখনও সে ঘরবন্দি থাকত না। অজানা অচেনা জায়গায় চলে যেত যেদিক সেদিক। পথ খুঁজে খুঁজে। কাছাকাছি যেখানে এখনও মাঠ আছে, আছে টুকুন সবুজঘেরা জলাশয়, সে দিকে হাঁটা দিত যখন তখন। প্রথম প্রথম মোহিত বকাঝকা করত। কেন-না এদিক পানে বাবার অ্যালঝাইমার্স শুরু হয়েছিল। কিন্তু বাঁধন মানতে চাইত না আলিশান পথ হাঁটা মানুষটি। তাই মোহিত ঠিকানা লেখা চিরকুট বাবার পাঞ্জাবি-পকেটে রেখে দিত।
তাতেও শেষরক্ষা হল না। ঝরাপাতার এক রিক্ত দুপুরে খেয়েদেয়ে সেই যে বেরোল মানুষটি, আর হদিস মিলল না। না কোনও লাশ, না কোনও চিহ্ন।
মোহিতের অপেক্ষমান মা বছরকয় পর সধবা-চিহ্ন মুছে নিল। অপার প্রশ্নচিহ্নসহ।
এরপর কেটে গেল বেশ কিছু বছর, বেশ কিছু আগুয়ান কাল। মেয়ে, বিয়ে-থা হবার পর, বাপ ঠাকুর্দার পথে পা রাখল। সে এখন মাস্টারি নিয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে। ছেলে ম্যানেজমেন্ট করে সবে কলকাতার এক এম এন সি-তে। পুরোনো জেলাশহর বহরমপুরে আর ফিরবে না। এদিকে বয়স বাড়ছে মোহিতের, সুষমার; মা তো আছেই, প্রায় অক্ষম। এ সবই মোহিতকে অস্থির করে তোলে আবার। চলমান জীবনের বিদ্রুপ যেন ছুটিয়ে মারছে; জিভ বেরিয়ে গেলেও এ দৌড়ে থামা নেই। চলবে শেষ বিদায়ের আগে অব্দি।
তাই মোহিত সিদ্ধান্ত নেবার পথে পা রাখে। পুনরায় ঠাঁইনাড়া হতে হবে। এর শেষ কোথায়, জানে না। হয়তো এটাই শেষ, হয়তো নয়!
ডাক্তার শ্যালক বলল:
—দরজাটি কিন্তু জবরদস্ত, জামাইবাবু। পাক্কা সেগুন। প্যানেলের কাজটিও চোখে ধরার মতো। অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহো সব তুলে এনেছে যেন, একই জমিতে। বাঃ।
বছরদুই ধরে নানা জায়গায় পাত্তা লাগিয়ে সে, ছেলে, জামাই, শ্যালক মিলে পছন্দ করেছে এই ফ্ল্যাট। জি+ফোরের দুটি ব্লকের ছোট্ট কমপ্লেক্স। তারটি ব্লক টু, থার্ড ফ্লোর, ফ্ল্যাট নং ৩এ। ভি আই পি সংলগ্ন এই চত্বরে এখনও খানিক গাঁ-বাস লেপ্টে আছে। আশপাশে কিছুটা খোলা জায়গা, কিছু গাছগাছালি আর তাতে লুপ্তপ্রায় পাখপাখালি—শালিক, কাঠ-ঠোকরা, হাঁড়িচাচা, চড়ুই আর অবশ্যই দুপুর অবসরের মনখারাপি ঘুঘুডাক; টুকুন এলোমেলো বাতাস, খানিক মন ভালো করা আকাশ। আর আছে কিছু স্বল্পশিক্ষিত সরল অসরল মানুষ যাদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থান বোধগম্য নয়। ভি আই পি রোড জমকানোর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতলয়ে যাদের ধানিজমি, আগান-বাগান, পুকুর পালটে গিয়েছে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট কালচারে। অনেকেই ফুলেফেঁপে কোটিতে ব্যাজার না হলেও বাইরের চামড়ায় পালিশ লাগেনি তেমন। ভুঁইফোড় হলে যেমনটি হয় আর কি! সঙ্গে সঙ্গতদার বিগ বাজার, ও এস এল মটোকর্প, ফরেন লিকার অফ শপ জাতীয় অত্যাধুনিক হাতছানি—যাদের হাতসাফাই বেবাক মানুষের পকেট সাফাই করতে সময় নেয় না খুব একটা। এ যেন মজাদার মজে থাকা।
মোহিত তার প্রশংসিত ফ্ল্যাটের দরজাটি দেখতে দেখতে অন্যমনস্কতায় রোল ব্যাক করে। ভাবে, এই বিশাল নক্সালু পোক্ত দরজার ভেতরের অংশের পরিমাপটুকুর কথা। যে বাস-জীবন তার শুরু হয়েছিল বিঘে খানেকের আলিশান চত্বরে তা কাঠামাপে নেমে কমতে কমতে আজ স্কোয়্যার ফিটে বাঁধা হয়ে গেল। ‘কার্পেট এরিয়া’ নামক চতুর শব্দবন্ধে তা হল ১১৫০ স্কোঃ ফিঃ; থ্রি বি এইচ কে অর্থাৎ থ্রি বেডরুম, হল, কিচেন। না না, স্নান হাগা-মোতার জায়গাও আছে। দুটি। একটি মাস্টার বেডরুম সংলগ্ন, অন্যটি হলমুখো। অবশ্য তা আর বাথরুম নয়, টয়লেট। আছে দুটি বারান্দা, থুড়ি, ব্যালকনি। ছোট্ট, দুই ঘরের গা লাগোয়া। ঘরগুলি পরিসরে তেমন কিছু নয়, মাথায়ও খাটো। মোহিত ভাবে অত্যাধুনিক সংজ্ঞা-শব্দের চাদরে মুড়ে কেমন যেন গুছনো বাস। গুটিয়ে থাকা। তাকে অবাক করল যে বস্তুটি তা হল জাদুচোখ। মূল দরজার গায়ে একটি ফুটো, সুন্দর চাকতি মোড়া; আর বাইরেও আছে দরজাঘণ্টি। প্রথম বস্তুটি নতুন হলেও দ্বিতীয়টি তার আগের বাড়িতে ছিল। কিন্তু তা ওই নামেই। বেশিরভাগ জনই আগমন জানান দিত দরজা খটখটিয়ে। কখনও বা বিরক্তিকর হড়াম ধড়াম শব্দে। তবুও যেন তাতে একটা প্রাণ ছিল, অ-সভ্যতা সত্ত্বেও। তা যাহোক, ফ্ল্যাট-দরজা এতেই ক্ষান্ত দেয়নি। ভেতর ল্যাচ আর বাইরের লোহাহুঁকের সঙ্গে বাঁধা আছে এক ইস্পাত-শেকল। দরজা খুললেই কোনও আনজন কিংবা আপনজন যাতে হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে না পারে তার জন্য ইস্পাতকঠিন বাধা।
মোহিত দেখছে আর ভাবছে এই অস্বস্তিকর আপ্যায়নেই তাকে, তাদেরকে অভ্যস্ত হতে হবে। এটাই নাগরিক সংস্কৃতি, ক্যাপিটাল কালচার। আরও অভ্যেস করতে হবে কীভাবে মুখে ইঞ্চিফাঁকের স্মিত হাসি ঝুলিয়ে মনের গরল, হৃদয়ের হলাহল আড়াল করতে হয়। দরজাঘণ্টিতে নকল পাখিডাক শোনা গেলেও গাঁইয়া ঢঙে হাট করে খোলা যাবে না তা, জাদুচোখে চামড়াচোখটি রেখে ভালোমতো জরিপ করে ল্যাচ ঘুরিয়ে শেকল-ফাঁক ফুঁড়ে দেখেবুঝে নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত—আপনজন হলে পুরোটা খুলতে হবে, নইলে কথাবার্তা সারা হলে বাইরে থেকেই বিদায়। দরজা খুলেই ‘আসুন,আসুন’, ‘বসুন বসুন’, ‘কী খাবেন বলুন?’, ‘আজ কিন্তু যাওয়া চলবে না’, ‘দুপুরে খেয়ে যেতে হবে’—এ সমস্ত সাবেকি আপ্যায়ন বা স্বাগতম বাক্যবন্ধ এস্পারেন্তো ভাষা বা ডোডোপাখির মতো হয় অবোধ্য হয়েছে নয় উড়েপুড়ে গেছে—অগ্রগতির চটুল দেশে যেখানে ‘আলো আছে তবুও আলোয় ভরে রয়েছে অন্ধকার।’
এই অন্ধকারের আঁচ পেল মোহিত শিফটিং-এর সন্ধেয়। বহরমপুর থেকে মালপত্র ফুল পাঞ্জাব ট্রাকে গুটিয়ে এনে ফ্ল্যাটে গুছিয়ে তুলতে ঘড়িতে রাত বারোটা জানান দিলে নীচের ২এ থেকে সতর্কবার্তা এসে গেল:
—মাস্টারদা, খুব আওয়াজ হচ্ছে। ঘুমোতে পারছি না। থামলে ভালো হয়।
—ও আচ্ছা, দেখছি। কিন্তু…
পরের অংশ শোনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই ২এ-র মালিক। গোছানোর কাজ তখনও বেশ কিছুটা বাকি। তার মধ্যেই একরাশ ক্লান্তি শরীরে জড়িয়ে কাজ সারতে হল, বেড়ালপায়ের ঢঙে। তা করতেই রাত প্রায় দুটো।
এটাই শুরু। এরপর একদিন রে রে করে তেড়ে এল ২এ-র মালকিন:
—আপনি কিচেনের জানলা দিয়ে জল ফেললেন? আমার রান্নার হাঁড়িতে গিয়ে পড়ল।
সুষমা পরিষ্কার বাতিকের কোপে পড়ে জানলা-গোবরাট ধুয়েছিল আপন মনে। তারই অসংযত ছিটেফোঁটা পড়ে থাকতে পারে; ভাত-হাঁড়িতে বা হাঁড়ির বাইরে, কে দেখতে গেল! আর তাতেই কুপিত এই মহিলা। অপরাধ স্বীকার করে সুষমা বলে:
—বুঝতে পারিনি ভাই, আর হবে না।
তবে সে বুঝে গেল, তার মাত্রাজ্ঞান কোনো সীমায় বাঁধতে হবে। পরের ঘটনা ব্যালকনির। ছুটে চলে এল সকাল সকাল:
—দিদি, আপনি কাচা কাপড়টা অতটা ঝুলিয়ে মেলেছেন কেন? আমার ব্যালকনিতে জল পড়ছে?
সুষমা ভাবে, এ তো মহা মুশকিল! এখানেও মাপতে হবে!
এরপর থেকে ব্যালকনির বাইরে ভেজা কাপড় ঝোলালে তিনভাঁজে মাপ ঠিক করে নিয়েছিল সুষমা। আত্মীয়স্বজন কেউ এলে তাকেও মাপ বুঝিয়ে দিত। নইলে ২এ মাফ করবে না।
ছেলে সুহৃদ এর একটা হেস্তনেস্ত করতে চায়। তার প্রিয় বহরমপুরের বাড়িটা বিক্রি করে এত টাকা খরচ করে ফ্ল্যাট কিনে এতটা পরাধীনতা তার অসহ্য ঠেকছে।
ওদিকে অভিজ্ঞ মোহিত ভাবে, বিহিত আর কী করবে! এ বয়সে এসে মানিয়েই চলতে হবে। অ্যাডজাস্টমেন্টই জীবন। শুধু ভাবে, বহরমপুরের পাশবাড়িটা তাকে এখানেও চেপে দিচ্ছে যেন! নিস্তার নেই। আছে শুধু বিস্তার। সম্পর্কের নয়। বাহ্যাড়ম্বরের। মূল দরজার বিশাল বপু তারই প্রতিভূ যেন।
সময়ের পেঁয়াজ-খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে উধাও মোহিত গোঁত্তা খায় আরও বৃহদাকার এক সিংহদুয়ারে। সে দরজার গায়ে অজস্র চোখ। দেবরাজের শরীরের সহস্র চোখের মতো। কোনো জাদুচোখে যে চোখ রাখবে, ঠাওরাতে পারে না। বাইরে খাড়িয়ে চেনা-অচেনা-না চেনা মানুষের দল। কেউই যেন আপনার নয়, নয় সন্দেহের বাইরে, সংশয়ের ঊর্ধ্বে। প্রতিটি পদক্ষেপে চোরাবালি, অতল দ, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অসতর্ক পরিমাপ। এভাবেই দুঃসহ বেঁচে থাকা। এ যেন হাত পা গুটিয়ে ভ্রূণাবস্থায় ফেরত যাওয়া!
এই রুদ্ধশ্বাস জীবন থেকে খানিক স্বস্তি পেতে মোহিত ঝটকা মেরে ছড়িয়ে দেয় হাত। বেরিয়ে আসতে চায় মাপ-শেকল ভেঙে। আর তখনই…
যাঃ। ঠান্ডা চা ছিটিয়ে পড়ে বিছানাময়। নিবিষ্ট মোহিতকে ডেকে সাড়া না পেয়ে ব্যস্তসমস্ত নাচনি তার পেছনেই রেখে গিয়েছিল কাপটি। সেখানেও কোনও উষ্ণতার ছোঁয়া পেল না মোহিত। শীতলতা। বাকি জীবন জুড়ে শুধুই ধূসর শীতলতা।