দানবেরা জেতে না কখনও – সুকুমারী ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

প্রায় দুমাস ধরে চলছে গুজরাতের গণহত্যা। যেখান থেকে এর সূত্রপাত সেই গোধরার‌ ব্যাপারে একটা প্রশ্ন থেকে গেছে। রাতের অন্ধকারে একটা ট্রেন ছোট একটা স্টেশনে দাঁড়াতেই কয়েকজন মুসলমান (?) নির্দিষ্ট একটি কামরায় অভ্রান্তভাবে অগ্নিসংযোগ করল; তারা বন্ধ কামরাগুলি বাইরে থেকে দেখে কেমন করে জানল কোনটাতে করসেবক আছে?

খবর যা বেরোচ্ছে তাতে দেখছি অন্তত পাঁচ ছ’ মাস আগে থেকে এর জন্যে সক্রিয় প্রস্তুতি চলছে, এমনকি দীক্ষার দিনেই দুর্গাবাহিনীর প্রত্যেকের হাতে ত্রিশূল, ভোজালি তুলে দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চার, পাঁচ বছর আগে থেকে আরও নানাভাবে প্রস্তুতি, সবটাই লোকচক্ষুর অগোচরে। এত সুদূরবিলম্বিত ও সুপরিকল্পিত এ আয়োজন, এত হাজার হাজার মুসলমান মারা হবে, যে তার জন্যে প্রতিপক্ষকে (অন্তত তাদের মধ্যে গুন্ডামস্তানদের) খবর দিয়ে স্বপক্ষের ৫৭ জনকে নিকেশ করে দেওয়া হিসেবের দিক থেকে কম খরচে বেশি লাভ। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এত নিপুণভাবে আয়োজিত ধর্মকর্মের কর্মসূচিতে এটা অসম্ভব নয়।

গুজরাতে কেন? নানা কারণেই; প্রথমত, ওখানে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশই মুসলমান; আরও বড়ো কারণ এঁদের মধ্যে অনেকেই ধনী, গোটা গুজরাতের হীরের ব্যবসার কর্মচারীরা সবাই মুসলিম, ওদের খতম করে দিলে ওই লাভজনক ব্যবসাটা পুরোটাই হিন্দুর হাতে আসে। এছাড়া ওখানে সম্পন্ন শিক্ষিত মুসলিমের সংখ্যাটাও সঙ্ঘ পরিবারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল বহুদিন থেকে। মুসলমানদের আরও অমার্জনীয় দোষ আছে, তারা স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে বহুকাল যাবৎ একান্ত সৌভ্রাত্র্যে বাস করছিল। এ ব্যাপারটাই ‘গণতন্ত্রী’ সঙ্ঘীদের কাছে অসহ্য ঠেকছিল। তাই দাও ওদের শেষ করে। কিন্তু একথা ভাবলে নেহাৎ ভুল হবে যে গুজরাতেই ওদের কর্মসূচির শেষ; না, ওখানে শুরু। নির্বিরোধে গুজরাতের কাজ সমাধা হলে একে একে নানা অঞ্চলে নরমেধযজ্ঞ চলতে থাকবে, এই ছিল হিসেব। আছেও।

গুজরাতে দুমাসের বেশি হল যা ঘটছে তা একেবারেই দাঙ্গা নয়, গোধরার প্রতিশোধও নয়। গোধরা ছুতো মাত্র, যে ছুতো না হলেও ওদের চলত। এতদিন চলেওছে। কিন্তু এ ছুতো দিয়ে ওরা নিজেদের গুন্ডাদের আরও পাশবিক আচরণে প্রবৃত্ত করতে পারছে। এখন ওদের কর্মীরা ত্রাণশিবিরে গিয়ে বলছে, তোমরা এফ.আই.আর.-এ যেসব নাম দিয়েছ এগুলো তুলে নিয়ে বল, উন্মত্ত জনতা আক্রমণ করেছিল! স্পষ্টই বোঝা যায়, এটা দূরদর্শিতার ফল। ওরা বুঝেছে দেশের মানুষ এর বিচার একদিন দাবি করবে। তখন নাম থাকলে দণ্ড হবে, কিন্তু জনতার দণ্ড হতে পারে না।

এক একটা ঘটনা বলা সম্ভব নয় কারণ তা অগুন্‌তি। কিন্তু শ্রেণিভাগ করে দেখা যায় লুঠ, চুরি, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবিকার সমস্ত অবলম্বন ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে সম্প্রদায় হিসেবে মুসলিমরা গুজরাতে আর কোনোদিন মাথা তুলতে না পারে। মুসলিমদের মারতে মারতে বলেছে, বল ‘রাম’। এভাবে প্রাণ বাঁচাতে কোনো লোক যদি ‘রাম’ নাম বলেও, (কেউই প্রায় বলেনি) তাতে কি হিন্দুর সম্মান বাঁচে, না তাদের রামের? এরাই মোগল আমলের ধর্মান্তকরণ নিয়ে নিন্দায় পঞ্চমুখ এবং খ্রিস্টানরা ধর্মান্তরণ করে থাকে বলে সমানে তাদের ধনেপ্রাণে ধ্বংস করে চলেছে।

বাজপেয়ী বলেছেন, “হিটলার ইহুদিদের ওপরে যে অত্যাচার করত তা গোপন করত। আমরা গোপনে করার কোনো চেষ্টাই করিনি।” শুনেই মনে আসে কোনো লোক সদর রাস্তা দিয়ে যায়‌… এরাও তাই। প্রথমত, সমস্ত গুজরাতকে একটি বৃহৎ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে এবং বাজপেয়ীর সাধ্য ছিল না এত বড়ো ঘটনাকে গোপন করা কারণ একটা প্রদেশকে পাঁচিল তুলে ক্যাম্পে পরিণত করার সাধ্য ছিল না বাজপেয়ীর। দ্বিতীয়ত, এযুগে গণমাধ্যম সংখ্যাতে এত বেশি ও এত সক্রিয় যে, তাদের কাছ থেকে এই গণহত্যা গোপন করা সম্ভবই ছিল না। তৃতীয়ত, হিন্দু ধর্ম গ্ৰহণে দ্বিধা আছে যেসব মুসলিমের, চতুর্দিকে নিত্যদিন চলতে থাকা বিভীষিকা তাদের মধ্যে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করবে। এজন্য আশপাশের লোকদের সামনেই অত্যাচার ঘটানো দরকার ছিল। চারপাশ থেকে বিশ্বাসী হিন্দুরা ‘পাকড়ো উস্‌কো’, ‘মার ডালো’, ‘আগ জ্বলা দো’ বাণীতে উৎসাহিত করতে থাকে ঘাতকদলকে। মনে রাখতে হবে গণহত্যার ক’মাস আগে থেকেই গুজরাতে পেট্রল, ডিজেল ও কেরোসিনের আকাল লেগেছিল। অত্যাচারের বিভিন্ন পর্যায়ে অমানবিক নৃশংসতারও প্রকারভেদ আছে। দীর্ঘকাল আগে থেকে এর পূর্বপ্রস্তুতি: ভোটার তালিকা থেকে টুকে রাখা খবর, কোন্ এলাকায় কত মুসলিম আছে এবং কোন্ বাড়িতে ক’জন নারীপুরুষ আছে। এবারে মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ছেলেমেয়ের সামনে মুসলিম নারীকে গণধর্ষণ, যারা সামাজিকভাবে হিন্দুর স্পর্শেরও অযোগ্য। আত্মীয়দের বাধ্য করা হয় ওই ধর্ষণ দেখতে। তৃষ্ণার্ত শিশু জল চাইলে মুখে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া। কোথাও বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে পুরো বাড়ির সকল সদস্যকে একসঙ্গে পুড়িয়ে মারা। কোথাও বা তলোয়ার দিয়ে মুণ্ডচ্ছেদ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গচ্ছেদ, কখনও ত্রিশূল দিয়ে বিঁধে নানাভাবে দীর্ঘসময় ধরে যন্ত্রণা দেওয়া। ‘রামনাম’ নামক ছোট্ট তথ্যচিত্রে প্রৌঢ়া নারী মিনতি করে বলছে, ‘আমার বাড়ির সব সম্পত্তি নাও, শুধু আমাকে ও ছেলেমেয়েদের প্রাণে বাঁচতে দাও’; উত্তর ‘তুমকো মরনেই হোগা’। বহু শ্রমিকের হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে, হাসপাতালে প্লাস্টার করা অবস্থায় তাঁদের দেখা গেল। খেটে-খাওয়া মানুষের দুটো হাত তার জীবিকা অর্জনের উপায়। এভাবে প্রকারান্তরে তাদের জীবন্মৃত অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হল বাকি জীবনের জন্য। আহ্‌মেদাবাদের হাসপাতালে যে পাঁচশো-র বেশি রোগীর চিকিৎসা চলছে, তাদের অধিকাংশেরই পুরো সুস্থ হয়ে উঠতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগবে। ধনী মুসলিমদের অনেকেই রক্ষা পেয়েছে বিত্তকৌলীন্যের জোরে, তাদের সঙ্গে ব্যাবসা করা চলবে তারা বেঁচে থাকলে। এখন যে দেড়শো কোটি টাকা ত্রাণ বাবদ বরাদ্দ করা হল, নরেন্দ্র মোদীর হাত পেরিয়ে তার ছিটেফোঁটাও মুসলিমদের কাছে পৌঁছবে, এমন আশা করা বাতুলতা। এবারে নতুন একটা কূটনীতি প্রত্যক্ষ করা গেল: গরিব আদিবাসী ও দলিতদের বোঝানো হল, মুসলমানরা ওদের ধ্বংস করতে দৃঢ়সঙ্কল্প। কাজেই টাঙি থেকে তলোয়ার, কেরোসিন থেকে পেট্রল, সব কিছু দিয়ে ওই দলিতদেরই লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুসলিম-নিধনে। যাদের মধ্যে কোনো শত্রুতাই ছিল না, বরং সৌহার্দ্যের সম্ভাবনাই ছিল, তাদের জোর করে পরস্পরের শত্রু করে তোলা হল, ভবিষ্যতে কাজে লাগাবার জন্যে।

কে বলে হিন্দুরমণী কোমলস্বভাবা, দয়াবতী, ধর্মপরায়ণা? দুর্গাবাহিনীর মেয়েদের বাড়িতে স্থান আঁতুড়ঘরে ও রান্নাঘরে, কিন্তু দীক্ষার পরে তারা পায় একটি করে ধারালো ত্রিশূল। গত আগস্ট মাসে ‘ত্রিশূল-সমারোহ যজ্ঞ’ সম্পাদন করে বজরঙ দল; তার পর থেকেই ক্ষিপ্ত কূকুরের মতো হয়ে ওঠে দুর্গাবাহিনীর অধিকাংশ বীরাঙ্গনা। কেরোসিন পেট্রল ঢালতে, আগুন লাগাতে, ত্রিশূল-তলোয়ার ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে যবন নিপাতে তারা উদগ্ৰ হয়ে উঠেছে। রান্নাঘরে বসেও তারা গল্প করে মুসলমান অত্যাচারের এবং যথাকালে পরস্পরকে উদ্দীপিত করে আসন্ন তাণ্ডবলীলায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্যাপারটা অভিনব। বাবরি মসজিদ ধ্বংসকালেও সাধ্বী ঋতম্ভরা ‘মার ডালো, তোড় দো’ ইত্যাদি জ্বালাময়ী উদ্দীপনাবাক্যই উচ্চারণ করেছিলেন শুধু। কিন্তু স্বহস্তে মন্দির ধ্বংসে কোনো অংশগ্ৰহণ করেননি। এবার এরা বাকি কিছুই রাখল না।

ভারতবর্ষে হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন করতে গেলে অহিন্দুকে হয় ধর্মান্তরিত করতে হয়, নয়তো তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সম্পত্তি লুঠ করতে হয় এবং ফাউ হিসেবে তাদের কিশোরী-যুবতী-প্রৌঢ়া নারীদের গণধর্ষণ করতে হয়। হিন্দুশাস্ত্রেই বলে শূদ্রা ম্লেচ্ছ রমণীকে ধর্ষণ করা অশাস্ত্রীয় নয় এবং তাদের ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করাও অন্যায় নয়। কাজেই এক হিসেবে এরা শাস্ত্রসম্মত আচরণই করছে। হিন্দুশাস্ত্র একাধিকবার উচ্চারণ করে নারীরা সম্বন্ধে বলেছে, ‘তস্যাঃ পণ্যসধর্মত্বাৎ’—নারী পণ্যসদৃশ, অতএব ভোগ্যবস্তু। কাজেই বিধর্মী নারীও ভোগ্যবস্তু। ধর্ষণই যথেষ্ট নয় সঙ্ঘীদের পক্ষে। সেটা নিকট আত্মীয়দের সামনে ঘটা চাই। শিশুহত্যাও মা’র দৃষ্টিগোচরে করা চাই। অঙ্গচ্ছেদও আত্মীয়দের দেখতে হবে। তাহলে এ নৃশংসতার দুটো দিক আছে—শারীরিক বা ব্যবহারিক এবং মানসিক। অত্যাচারিতের মনোবল ধ্বংস করাও পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটছে যাতে ভবিষ্যতে মুসলিমরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এত বিচিত্র নৃশংসতার দৃশ্য জোর করে দেখানোও এই উদ্দেশ্যে।

গণহত্যা পর্বের বহু বিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর সময় হল, গুজরাতে গিয়ে মাত্র দুটো বিধ্বস্ত অঞ্চল ওপর ওপর দেখে আসার। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীকে প্রহেলিকার ভাষায় বললেন, ‘রাজধর্ম অনুসরণ কর।’ রাজধর্ম! মহাভারত শান্তিপর্বে বিস্তৃত অংশ হল রাজধর্ম, প্রায় সবকটি ধর্মশাস্ত্রে, রাজধর্ম নামে একটি করে অধ্যায় আছে। সর্বত্রই বলা আছে, প্রজাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধান করা রাজার কর্তব্য। এই রাজধর্ম গত আড়াই মাস ধরে গুজরাতে কীভাবে পালিত হচ্ছে, এবং ওই সদুপদেশের পরেও, তাও দেশবাসী দেখছে।

ওদের সব বিজ্ঞপ্তি প্রচার পুস্তিকাতেই থাকে এটা হিন্দুরাষ্ট্র। (অন্তত ওরা সেটা গড়ে তোলবার জন্য বদ্ধপরিকর) এবং এখানে হিন্দুই প্রথম শ্রেণির নাগরিক। বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণির। তাই গোধরায় মৃত করসেবকদের ক্ষতিপূরণ মাথাপিছু দু লাখ টাকা, আর গুজরাতে মৃত, অর্ধমৃত, সর্বস্বান্ত মুসলিমের জন্যে বরাদ্দ এক লাখ; অর্থাৎ তথাকথিত ‘গণতন্ত্রী’ হিন্দু রাষ্ট্রে জীবনের বাজারদরে আপেক্ষিকতা আছে। আর আছে ধনী ও দরিদ্রের প্রাণের দামের। নইলে ‘ভুজ’-এর ভূমিকম্পে যেখানে বড়ো বড়ো প্রাসাদ অট্টালিকা পড়েছে, আর পড়েছে অজস্র গরিবের ঝোপড়ি, সেখানে যে কয়েকশো কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিল কেন্দ্র তার অধিকাংশই পেল প্রাসাদের মালিকরা। এখানে ক্ষতিপূরণ কতটা দেওয়া হবে এবং তার কতটুকু দঃস্থ মুসলিমের হাতে পৌঁছবে তা এখনও বলবার উপায় নেই।

হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে গুজরাতি মুসলিমরা আবার কতকটা সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু এক প্রৌঢ় মুসলিম যেমন বলেছেন, “দু পুরুষ হিন্দু মহল্লায় থেকে এসেছি, তাদের হাতে এত ক্ষতি ও নিগ্ৰহ কল্পনাও করতে পারিনি। এবারে মুসলিম এলাকাতেই ঘর বাঁধব, সৌভ্রাত্র্যের জন্য এই দাম দেবার সাহস আর নেই।” এইটে একটা অপূরণীয় ক্ষতি। ঘর ভাঙলে আবার ঘর বাঁধা যায়। কিন্তু বিশ্বাস ভাঙলে আর তা গড়ে ওঠে না; এই ব্যাপক বিশ্বাসভঙ্গ এবারে গুজরাতে স্থায়ী ক্ষতি।

আর ক্ষতি গুজরাতের বাইরের অন্য প্রদেশের ভারতবাসীর। নিত্যদিন, কাগজে, দূরদর্শনে, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে পড়ে, দেখে শুনে যতই মর্মযন্ত্রণা হোক, ধীরে ধীরে মনের ওপর একটা কড়া পড়ে যাচ্ছে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা পূর্ববৎ চলছে, এমনকি কোথাও কোথাও উৎসব-অনুষ্ঠানেও অব্যাহত আছে। আমাদের এ ক্ষতি অপূরণীয়।

এখন বুদ্ধি বেড়েছে ওদের, বলছে, “দাঙ্গা তো হয়নি, করসেবকদের হত্যা করেছে মুসলিমরা। এই উত্তেজনায় ইতস্তত অশান্তি দেখা দিতে পুলিশ শান্ত করতে গিয়ে দুজনকে মেরেছে এবং ১৪৭ জন পুলিশ আহত হয়েছে।” ওয়েবসাইটে এই কথা সঙ্ঘীরা বলেছে বাকি পৃথিবীকে। এবং একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সমবেত প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কাছে। পোপ ও এমেরিকাও হয়তো প্রতিবাদ জানাতেও পারে। পৃথিবীর কাছে এত বড়ো মিথ্যা বলার সাহস হল ওদের সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এর দরকারটা কী ছিল? দেশটাকে যে এমেরিকার কাছে টিকিসুদ্ধ বিক্রি করে দিচ্ছে তাদের কিছু শর্ত আছে। নির্বিচারে দরিদ্রনিধন করতে হবে। এরই সঙ্গে এদের নিজেদের লক্ষ্য; দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে হবে। তাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলিম নিধন, তাদের সম্পত্তি লুঠ, বাড়িতে আগুন লাগানো ও তাদের নারীদের ধর্ষণ করা চলছে এবং এসবই ঘটছে খ্রিস্টানদের ওপরেও। এই দুই প্রধান বিধর্মী শত্রুকে ক্রমে ক্রমে নিশ্চিহ্ন করতে পারলে, বাকিদের ঘুষ দিয়ে, ধর্মান্তরণ করে বা পায়ের তলায় পিষে হিন্দুরাষ্ট্র গড়া যাবে।

এই প্রক্রিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নির্মিত হল গুজরাতে। সারা পৃথিবীর মানুষ চেয়ে দেখছে হিন্দুত্বের এ ধর্মযুদ্ধ। হিন্দু নাকি পরমতসহিষ্ণু—এই তার নমুনা? হিন্দুর আছে বেদের মতো ধর্মগ্ৰন্থ যেখানে সৌভ্রাত্র্য সম্বন্ধে অনেক উচ্চমানের কথা আছে, হিন্দুর আছে মহাভারতের মতো মহাকাব্য যেখানে পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে অত্যন্ত চরম এক কথা বলেন, ‘একটি গোপন কথা তোমাকে বলি, যুধিষ্ঠির; মানুষের চেয়ে বড়ো কিছুই নেই।’ মুসলিম মানুষ নয়? এদের কাছে তার চেয়ে বড়ো হিন্দুরাষ্ট্র, তাই অক্লেশে এতদিন ধরে এত নৃশংসভাবে মুসলিম বলি চলে। এই দানবলীলার জন্যে মাইনে করা জহ্লাদটিকে তাই কোনোমতেই বর্জন করা যাবে না, সর্বপ্রযত্নে তাকে আড়াল করতে হবে।

কিন্তু আর কতদিন? সুস্থমনা মানুষের মনে যতই কড়া পড়ুক এই গণহত্যার প্রতিবাদ ধীরে ধীরে সংহত হচ্ছে। কংসেরও ঘাতক আছে। সহমত ও অনুরূপ সব প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সহযোগী সব মানুষ সমন্বিত হচ্ছে দানবের সঙ্গে সংগ্ৰামের জন্যে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এ সংগ্ৰামে দানব কোনোদিনই জেতেনি।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *