করোনাকালে অনলাইন ব্যবসার দাপটে কোণঠাসা ক্ষুদ্র ব্যবসা – দীপক সাহা
দুয়ারে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। কিন্তু গড়িয়াহাট থেকে জেলার দোকানে সেরকম ভিড় চোখে পড়ছে না। সারা বছর দোকানদাররা অপেক্ষা করে থাকেন আগমনি বার্তার। কিন্তু এবার করোনার মারণ ছোবলে আগমনি বার্তায় কোনো সুখবর নেই। পুজো মরসুমে দোকানদারদের মুখে হাসি উধাও। সারাদিন মাছি তাড়াচ্ছেন। কর্মসংস্থানের আকাল বাজারে করোনার প্রকোপে ব্যবসায়ী, দোকানদারদের বেহাল অবস্থা। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া—অনলাইন ব্যবসা। লক ডাউনের অনেক আগে থেকেই অনলাইন ব্যবসার সূচনা। কিন্তু করোনাকালে ই-কমার্সের বাড়বাড়ন্ত অনেক বেশি। হাল আমলে অনলাইন ব্যবসা মফস্সলেও থাবা বসিয়েছে। পুজো মরশুমেও শহর ও মফস্সলের দোকানদারদের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। ঝাঁ-চকচকে আলো ঝলমলে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলও ধুঁকছে।
করোনা অতিমারির প্রকোপে একদিকে যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, দোকান তখনই অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে উঠছে ই-কমার্স। মার্কেট রিসার্চ ফার্ম রেডসিয়ার-এর করা সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, গত বছরের তুলনায় ই-কমার্স ব্যবসা বাড়তে পারে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বছর পুজো মরশুমে ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে ই-কমার্স ব্যবসা। আসন্ন উৎসবের মরশুমে ৭০ শতাংশ বাড়তে পারে গ্রাহক। ডিজিটাল বায়ার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন-এ। অনুমান করা হচ্ছে ২০২১ সালের উৎসব মরশুমে ব্যবসা হতে পারে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের।
করোনাকালে বাইরের বেরোনোর নানা বিধিনিষেধের ঘেরাটোপ, আবার বাজারে এসেও পচ্ছন্দমতো জিনিস অমিল। ফলে অল্পবয়সিদের পাশাপাশি বয়স্করাও ই-কমার্সের প্ল্যাটফর্মে পা ফেলছেন। করোনা আবহে অনেক মানুষই গতানুগতিক কেনাকাটার বদলে হাত বাড়াচ্ছেন বিভিন্ন অনলাইন শপিং পোর্টালের দিকে। পছন্দমতো জিনিস সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে বসে। মুদিখানার পণ্য, দুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অত্যাবশকীয় পণ্যের জন্য ই-কমার্সের দিকেই ঝুঁকছেন যুবক-যুবতী থেকে বয়স্করাও। শুধু নতুন প্ল্যাটফর্মে কেনাই নয়, নগদের বদলে ডিজিটাল পেমেন্ট ওয়ালেট বা ইউপিআই ব্যবহারে বয়স্করা ক্রমশ অভ্যস্ত হতেও শুরু করেছেন। সমীক্ষা বলছে, ৫৫-৬৫ বছর বয়সি ক্রেতাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই এই ডিজিটাল কেনাকাটার দুনিয়ায় পা রেখেছেন লকডাউনের বাজারে।
আধুনিক স্মার্টফোনের দৌলতে ঘরে বসেই ক্রেতা মনমতো হালফিলের জিনিস পেয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে নানা অফারের হাতছানি। আঙুলের টোকায় একের পর এক হরেক ব্র্যান্ডের জিনিস মোবাইলের পর্দায়। সোফায় বা বিছানায় শুয়ে সহজেই পছন্দসই জিনিস অর্ডার করা যায়। নির্ঝঞ্ঝাট ব্যবস্থা। কয়েক দিন পরে ডেলিভারি ম্যান আপনার বাড়ির দরজায় কলিং বেলে হাজির। টাকাও ডেলিভারির পর। পছন্দ না হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়ারও সুযোগ থাকছে। কাঁহাতক ছুটির দিনে ভাতঘুম ছেড়ে চড়া রোদ মাথায় নিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঘর্মাক্ত হয়ে এ-দোকান সে-দোকান ঘোরাঘুরি! তার চাইতে আঙুলের কেরামতিতে গোটা পৃথিবীর বাজারটাই তো বেডরুমে হাজির।
ই-কমার্সের রমরমা বাজারে পুজো মরশুমে হাতে স্মার্টফোনের দৌলতে অনলাইনের বাজার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে গ্রামগঞ্জে, মফস্সলেও৷ কিন্তু এর ফলে অফলাইন দোকান এবং খুচরো ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনলাইনে সস্তার কেনাকাটার নেতিবাচক প্রভাব পুজোর মরশুমে বস্ত্র ও হোসিয়ারি, জুতো ব্যবসায়ীদের উপরেও পড়েছে৷ দোকানে ব্র্যান্ডেড হোসিয়ারি সামগ্রী, কাপড়, জামা, জুতোর বিক্রি অনেক কমে গিয়েছে৷ এমনিতেই করোনার গুঁতোয় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন স্থবির হয়ে গেছে। স্বভাবতই উৎসবের মরশুমে দোকান বাজারে আগের থেকে বিক্রি অনেক কমে গেছে।
করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের চালচিত্রের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং এসবের প্রভাব সমাজে পড়ছে। আজকাল বাজারে নামীদামি কোম্পানির হলুদ, লঙ্কার গুঁড়ো প্যাকেটজাত অবস্থায় পাওয়া যায়। মধ্যবিত্ত এখন ঝামেলা পছন্দ করে না। পাড়ার দোকানে দাঁড়িপাল্লায় মেপে তেল-নুন-হলুদ-লঙ্কা-ডাল কেনে না। সময়ের বড্ড চোখরাঙানি। তারা মেগাশপ থেকে হলুদ-লঙ্কার গুঁড়ো, লাল আটার প্যাকেট কিনতে পছন্দ করে যদিও দাম বেশ চড়া। এমনকি অনলাইনে মুদিখানা, কসমেটিক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ছড়াছড়ি। ওষুধ, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল, এসি মেশিন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের জিনিসপত্র এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। আর সঙ্গে লোভনীয় অফার। মানুষ সবকিছু রেডিমেড চায়। ব্যস্ততার যুগে এখন বাড়িতেও অনেকে খাবার তৈরি করছে না। অনলাইনে ফুডঅ্যাপে খাবার চলে আসছে বাড়িতে। আগামীদিনে হয়তো বাড়িতে রান্নাঘর থাকবে না। আগে বাজারে হলুদের গুঁড়ো, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো করার মেশিন ছিল। একে অবলম্বন করে ছোটো ছোটো ব্যবসায়ীরা সংসার চালাত। ওসব মেশিনওয়ালা দোকানে গমও ভাঙানো যেত। দিনকে দিন এসব ব্যবসায় মন্দা নামছে। আগের মতো রমরমা এই ব্যবসায় এখন আর নেই। ফলে পাড়ার ও বাজারের দোকানে বিক্রিবাটা অনেক কমে গেছে। টান পড়ছে রুজিরোজগারে। করোনাকালে সমাজে একটা অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
অনলাইনে কেনাকাটায় বিপুল ছাড়ের জন্য ছোটো দোকানদাররা প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠছে না। অনলাইনে সস্তায় কেনাকাটার সুযোগের কুফল বেশি ভোগ করতে হচ্ছে মাঝারি ও ছোটো ব্যবসায়ীদের৷ মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারের মানসিকতা ও অনলাইন সংস্থাগুলির ওয়্যারহাউজ ও ক্যুরিয়র সংস্থার দ্রুত পরিষেবার সুবিধাও এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অনেকে। অভিযোগ উঠছে, মাঝারি ও ছোটো মাপের খুচরো বিক্রেতাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই অনলাইন সংস্থাগুলির উদ্দেশ্য। লক্ষ্য একটাই যেমন করে হোক ক্রেতাদের মধ্যে অনলাইনে কেনার প্রবণতার জন্ম দেওয়া ও অভ্যাস তৈরি করা৷ একবার অনলাইনে কেনাকাটার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে ব্যস্ততার মধ্যে দোকানে গিয়ে একই পণ্য কেনার মানসিকতাই লোপ পাবে৷ খুচরো ব্যবসায়ীদের দোকানের ভাড়া গুনতে হয়, সরকারকে যুক্তমূল্য কর দিতে হয়, বিজ্ঞাপনের খরচ বহন করতে হয়৷ অনলাইনে সেই খরচ নেই। ফলে অসম এই প্রতিযোগিতায় অফলাইন ব্যবসা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। অনেকের আশঙ্কা, ক্রেতাদের মধ্যে একবার অনলাইনে পণ্য কেনার নেশা সওয়ার হলে পরবর্তীকালে বাজারমূল্য যাচাই না করেই কেনাকাটা জারি রাখার প্রবণতা দেখা দিতে পারে৷
বড় বড় কোম্পানি যাকে আমরা আজকাল ‘কর্পোরেট হাউস’ বলে ডাকি তারা এখন দেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মূলধনও প্রচুর। রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাশীল। ফলে ব্যাঙ্ক থেকেও সহজেই ঋণ পায় তারা। সামাজিক কাঠামোতে তারা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনা-বেচার একটা বড়ো অংশ চলে যাচ্ছে বড়ো বড়ো কর্পোরেট হাউসের কাছে। এতে পাইকারি ও খুচরা বাজারের ধরনেও পরিবর্তন আসছে। ছোটো ব্যবসায়ীরা কর্মচারীতে পরিণত হচ্ছে। গ্রামে হাজার হাজার মানুষ বেকার হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের অনেক পেশার মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত তাঁতিরা, কর্মকাররা, জেলেরা, কুম্ভকাররা। পেশাজীবী সমাজ তাই ধীরে ধীরে ভাঙছে। ‘সূত্রধরের’ ছেলে আজ ‘টুকটুকি’ চালায়। গ্রামের যুবকরা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে পাড়ি দেয় কেরলে।
কোভিড-১৯ অতিমারী লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যক্তিগত পুঁজি কেড়ে নিয়েছে। দেশের জিডিপি গত ৪০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে তলানিতে। কোভিডের কামড় এবং লকডাউনের জেরে গত ছয় মাসে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৪১ লাখ মানুষ। এদিকে অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সংস্থগুলির মূলধন বহুগুণ বেড়েছে। অনলাইনের দাপটে অসম প্রতিযোগিতায় একপক্ষ ধরাশায়ী। এ যেন মাৎসান্যায়। পুকুরের সব ছোটো মাছ খেয়ে নিচ্ছে বড়ো মাছ। পাড়ার মুদির দোকান থেকে বাজারের জুতো-কাপড়ের দোকান—সব অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। ‘ধনপতি পাল’ আর ‘দামোদর শেঠ’-দের দাপটে সবই চাপা পড়ে যায়। আর্থসামাজিক কাঠামোয় দেখা দিচ্ছে পরিবর্তন। অবিলম্বে এ ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত এক হতাশাজনক জটিল সমীকরণের সূচনা হতে আর দেরি নেই।