ছ বি ক থা – এণাক্ষী রায়

শেয়ার করুন

তুষারপাতের মতো মৃদু ভঙ্গিতে নেমে আসছে মৃত্যু। চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে মৃত্যুভয়। প্রিয়জনের মৃত্যুভয় ছাপিয়ে যাচ্ছে নিজেকে। সেও তো দুঃসহ কষ্ট নিয়ে নিজের বেঁচে থাকারই ভয়। জীবনের মানেই বদলে যাচ্ছে রোজ। তারপরেও আমরা নিজেকে খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে কত পথ পার হই। আলপথের সারল্য, গলিপথের অন্ধতা, রাজপথের অ্যাস্ফল্ট বিছানো মসৃণতা—কিচ্ছু বাকি রাখি না। পার্কের শূন্য চেয়ার থেকে ডাক আসে খুঁজে দেখার। ছাদের আলসে, দুপুরের তেতে থাকা দাওয়া, এমনকি বাঁশের বেড়া দেওয়া উঠোন থেকে ডাক আসে। খুব ধীরে, ক্যাচক্যোচ শব্দ না করে যদি খুলে ফেলতে পারি আলকাতরা মাখানো টিনের গেটটা, সামান্য মণিমুক্তো জুটেও যায়।

গোটা জন্ম ধরে নিজেকে খুঁজে যাওয়া, বয়ে বেড়ানো নিজেকেই। এ তো সত্যিই। আয়নায় ছবি হয়ে ভাসে যে-আমিটা, তার হাড়-পাঁজরের ভেতরে, রক্ত-মজ্জার ভেতরে খুঁড়ে চলা অন্য এক আমিকে, জীবনভর। অন্ধকার জলভর্তি কুয়োয় ঝুঁকে পড়া একটা মুখ দু-বেণী দুলিয়ে যখন ডেকে ওঠে, তাকে উজ্জ্বল আলোর নীচে, আয়না থেকে আলাদা করে একটা নাম দিই। কাঠের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে সে ডাক দেয়—চই চই চই চই। ঠিক যেমন করে পুকুরপাড়ের হাঁসদের ডাকত সপ্তমীর মা। ওই চই চই ডাক, বুকের ভেতর থেকে একান্ত নদীটাকে ছিটকে বের করে নিয়ে নিরুদ্দেশ হতে চায়। নদীটাও যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতে, পাড় বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা জারুল, কৃষ্ণচূড়া, অমলতাসদের সাক্ষী রেখে দোষারোপ করে আমাকেই। কেন আমার খাতায় কোনো পাতা নেই? কেন মলাটের খোলস ছাড়া কিচ্ছু পড়ে নেই আর? কেন নেই কলম? কেন কালিও নেই? কেন আমি আর নৌকো ভাসাই না খাতার পাতার। কেন? কেন? কেন? পাতা নেই কেন? খাতা কেন মলাট সর্বস্ব? নদীটার নাম নেই কেন? কেন? কেন? কেন? প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে করতে অন্য দিকে ছুট লাগায় নদী। আমার ভেতরের আমিটা উজ্জ্বল আয়না থেকে কিছুতেই আর ফিরতে পারে না কুয়োর কালো জলের কাছে। সময়ের পর্দা সরিয়ে দেখি, সব জল মরে গেছে। মৃদু মৃদু তুষার কণিকা হয়ে হাওয়ায় ভাসছে মৃত জল।

তারপরেও কিছু থাকে। নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে তৈরি নিজস্ব কুয়ো, তার শান বাঁধানো ঘাট, আর শ্যাওলা। কিন্তু শ্যাওলায় পা পিছলানোর ভয় থাকে না। জল তো ততদিনে মৃত। জলে না ভিজলে শ্যাওলারও কোনো প্রাণ নেই। নেই কাউকে পিছলে দেওয়ার জাদুভঙ্গিমা। শেষ পর্যন্ত ওই শুকনো খটখটে শাঁসটাই হাতে। তারপরেও অন্ধকার কুয়োর নীচে ব্যাঙ ডাকার শব্দ, গোপন ঝিঁঝির বাসা দৈবাৎ পেয়ে যায় কেউ কেউ। তখন চোখ বন্ধ করে এই সব শব্দের আবহ শুনতে শুনতে তারা চারদিকে জঙ্গল বুনে ফেলে। যেমন শঙ্খয় কান পাতলে পাওয়া যায় সমুদ্র গর্জন। তেমনি জঙ্গলের আবহে বাজতে থাকে ঝিঁঝির ডাক। চোখে গান্ধারীর মতো পট্টি বেঁধে ফেললেই আর সেই জঙ্গল থেকে বেরনো যায় না। ক্রমশ আবহে ভাসতে ভাসতে নিজেকে বন্যজন্তু বলে বোধ হয়।

এসব ঘটনা অলীক এবং অলৌকিক, জীবন ও মৃত্যুর চেয়ে ভারী। কিন্তু মসৃণ, মৃদু। দেশলাই নেভানোর গন্ধের মতো যার রেশ থেকে যায় খানিক। নিজেকে খুঁড়ে দেখার ভয় ও লজ্জা পেরিয়ে এলে আত্মকথনের কান্না গলে গলে পড়ে। মৃত শরীরকে জাগাতে, শ্যাওলায় পুনর্বার পা পিছলে পড়তে সেই কান্না গিলতে থাকে কুয়ো। আলোর উলটোদিকে পিঠ রেখে, সে, সব ভয়ের চোখে চোখে জ্বালিয়ে দেয় একটু একটু আগুন। তারা জুনিপোকা হয়ে ওড়ে।

ওদিকে নদীর পাড়ে, অমলতাসের আঙিনা দিয়ে পারাপার করে মোটরবাইক। অমলতাস কৃষ্ণচূড়াকে, জারুল রাধাচূড়াকে ফিসফিস করে বলে, পরাগ মিলনের দিন শেষ হয়ে যায়, মধুমক্ষিকাদের প্রতীক্ষায়। আর এভাবেই আমরা ছবি হয়ে উঠি।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *