হারানো লজেন্সগুলো – রূপায়ণ ঘোষ
ছেলেটার বয়স পাঁচ কি ছয়! ভরদুপুর-প্রাচীন ভাড়া বাড়ির কাঠের দরজা ঠেলে সে নেমে পড়ল নুড়ি-মোরাম বিছানো পাড়ার গলিতে। ছোটো ছোটো পায়ে লম্বা নির্জন গলিটা পেরিয়ে সে এসে দাঁড়ায় একটা মনোহারী দোকানের সামনে। হরেকরকম জিনিসের দোকান। সেখানে কাচের বয়ামে থরে থরে সাজানো কতরকমের লজেন্স। ছেলেটা জুলজুল করে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে আর মাঝে মাঝে হাফ-প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে আট আনা দুটোকে নেড়েচেড়ে নিচ্ছে। দোকানের মালিক মহাদেবজেঠু ঝুঁকে পড়ে গোল-চশমার ভিতর দিয়ে একবার চেয়ে দেখেন তারপর ভ্রূ-জোড়া কপালে তুলে বলে ওঠেন, ‘কী চায় রে ছোঁড়া?’–এতদূর পড়ে পাঠকের নিশ্চয়ই মনে হতে পারে একটা গল্পের ভেতরে প্রবেশ করছেন এবং বিশ্বাস করুন আপনি একবারে ঠিক ভাবছেন, এটা গল্পই। ওই ছোট্ট ছেলেটার, আমার, আপনার এবং তাঁদের সকলের গল্প— যাঁদের আশ্চর্য এক শৈশব কেটেছে গত শতকের নব্বই দশকের দিনগুলিতে। যে নব্বইয়ের কথা আমি বলছি, সেখানে তখন আইফোন, অ্যান্ড্রয়েড এমনকি মোবাইল এসে একটা ঘরের মধ্যে চারটে ঘরের জন্ম দেয়নি।
খুব উচ্চবিত্ত কিছু মানুষের ঘরে ল্যান্ডফোন থাকত, বহু দূরের কোনও আত্মীয়ের ফোন এলে তার কণ্ঠস্বরে যেন ভেসে থাকত সাত সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। কারও কারও বাড়িতে দেখা যেত সাদাকালো টিভি, এক-একটা ক্লাবে টিভি থাকলে মনে করা হত সেই ক্লাব সবার সেরা। রঙিন টিভির উল্লাস তখনও শহর ছাড়িয়ে গ্রাম-মফস্বলের বাতাসে ভেসে আসেনি। পাড়ার দোকানগুলোতে এসে পড়েনি দুনিয়া কাঁপানো ব্র্যান্ডের চকোলেট। একটা মাত্র টাকায় তখন দু-দিনের লজেন্স খাওয়া যায়। ছোটো ছোটো হলুদ রঙের ‘ম্যাঙ্গো লজেন্স’—সবুজ ও হলুদ মোড়কে ঢাকা কুড়ি পয়সায় একটা। লাল-হলুদ-সবুজ-কমলা-সাদা রঙের মার্বেলগুলির আকারে চুইংগাম পাওয়া যেত আট আনায় দশটা। কেউ একজন কিনে নিয়ে গেলে ছয়-সাত বছর বয়সি একদল ছেলে ডাংগুলি ও মার্বেল খেলতে খেলতে তা মুুখে ভরে দেয়।
প্রথমে শনিবার পরে রবিবার রবিবার ‘শক্তিমান’ হয় টিভিতে। ক্লাবঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসলে ক্লাবের দাদারা মাঝে মাঝে হাতে দিয়ে দেয় ‘লেবেনচুষ’। ছোটোরা অবাক দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে দেখে, আশ্চর্য একজন রূপকথার নায়কের মতো কেউ, ঘটিয়ে চলেছে অসম্ভব সব ঘটনা। রূপকথার এই জগৎ জুড়ে শক্তিমান ছিল, ছিল ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘ঠাকুমার ঝুলি’, ‘আলিফ লায়লা’।
শৈশবের সকাল-সন্ধ্যাগুলোও কেটে যাচ্ছে তখন ‘বর্ণপরিচয়’, ‘সহজপাঠ’ আর ‘এক-এ চন্দ্র’-র মিঠে অভ্যাসে। কেউ কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে বলছে না, দৌড়তে শুরু করো। ইংরেজি, অঙ্ক, কম্পিউটার, কোডিং শেখো— শিখে ফ্যালো অসংবেদনশীলতা। যন্ত্র হয়ে ওঠো, বিশ্রাম নয়, শৈশব নয়, সরলতা নয়—কেবল রোবটের মতো কথা বলবার জৌলুস অর্জন করো। ছয়-সাত বছরের শিশুরা হেসো না, কেঁদো না, মাটিতে গড়িয়ে পোড়ো না, ধুলো মেখো না—ঘরে বন্দি থাকো, আয়ত্ত করো যান্ত্রিকতা, বিস্ময়ের স্পর্শ ভুলে যাও।
নাহ্ কেউ বলেনি এসব, কেউ ভাবেওনি। কেউ ছেলেমেয়েদের হাতের লেবু লজেন্স সরিয়ে নিয়ে ডার্ক চকোলেটে ভরিয়ে দেয়নি হাত। ঘরের সামান্য আয়োজনের খাবার সরিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়নি ফাস্ট ফুডের অযৌক্তিক বিলাসিতা। যা কিছু সামান্য তাকেই মহৎ করে দেখেছে তারা। হাতের লেবু লজেন্স মুখে পুরে ভুলে গিয়েছে বড়োদের কঠোর শাসন কিংবা খেলতে গিয়ে পেয়ারার ডালের উইকেট হারানোর কষ্ট। কখনও দু-পাশে দুটো চটি রেখে তৈরি হয়েছে হাওয়াই চটির গোলপোস্ট; কিন্তু ফুটবল নেই কীভাবে খেলা হবে? ক্লাস টু-এর ছেলেরা স্কুলের এখানে-ওখানে পড়ে থাকা প্লাস্টিক জড়ো করে একসঙ্গে জুড়ে গোল বলের আকার দেয় তারপর ছিঁড়ে পড়া বটের ঝুরি দিয়ে বেঁঁধে ফেললেই তা হয়ে ওঠে সজীব গ্রামীণ ফুটবল! কী আশ্চর্য আনন্দোল্লাস- পায়ে পায়ে ফুটবল ঘুরছে, মুখে মুখে ‘বিগ-বাবুল’। প্রাণপণে চিবুতে চিবুতে গোল লক্ষ করে শট্ নিচ্ছে ছোট্ট ছেলেরা। স্কুলের মাঠে ধুুুলো উড়ছে, ঘাম ঝরছে, কারোর জামায় ধুলোর দাগ। কেউ একজন খেলার মাঝে ছুটে এসে বলে যায়, ‘দিদিমণি অফিস ঘর থেকে তোদের ঝগড়া করতে দেখেছেন, টিফিনের পর অঙ্ক ক্লাসে কিন্তু খুব বকা দেবেন’। ছেলেরা ভয় পায়, শাস্তি দিলে কাঁদে কিন্তু মুঠো বাগিয়ে দিদিমণি-শিক্ষকদের দিকে তেড়ে যায় না। এ এক আশ্চর্য প্রশান্তির দিন।
পুুজোর ঠিক তিনদিন আগে চতুর্থীর আকাশে সাদা মেঘ ভেসে উঠলে স্কুল ছুটি হয়। একমাস ক্লাসরুমগুলো বন্ধ, কোনও কোনও বন্ধুর সঙ্গে একমাস দেখা হবে না। তার মধ্যেই পুজো এসে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। বাবার কোলে চড়ে ঠাকুর দেখতে গেলে পাওয়া হয়ে যায় আট আনার ‘কাঠি লজেন্স’। ছোট্ট সাদা প্লাস্টিকের নলের উপর হরেক রঙের গোল চাকতি, কখনও কখনও নানান আকারের পাখি—ময়ূর, বক, টিয়া। চিনির মতো মিঠে সে-সব লজেন্স নিয়ে ঘুমোতে যায় ছেলে। টিনের চালের নীচে এক চিলতে ঘরের আধো-অন্ধকারে জীর্ণ বালিশে মাথা রেখে যে শিশুটি ঘুমোয়; রাত্রি গভীর হলে তার বালিশের নীচ থেকে বেরিয়ে আসে চিনির ময়ূর—অদ্ভুত সবুজ আলোর পাশে জ্বলজ্বল করে ধবধবে সাদা আলোর সারস! ধীরে ধীরে তার অঘোর ঘুমের ভিতর ছড়িয়ে যায় সেই সব সুমিষ্ট আলোর দল, বড়ো মিঠে ঘুম হয় রাত্রি জুড়ে।
স্মৃতি জুড়ে ভেসে থাকে ‘কান্না-হাসি লজেন্স’—দশ পয়সায় একটা। ছোট্ট গোল কমলা রঙের লজেন্স, খেলেই নাকি পেট ফুঁড়ে খিলখিলিয়ে হাসি বেরিয়ে আসবে। ওই একইরকম শুধু রংটা কালচে—সেটি খেলে নাকি এসে যাবে ভয়ানক কান্না! মহাদেবজেঠু দু-হাতে সেই লজেন্স নিয়ে ম্যাজিক দেখাত, ‘গিলি গিলি হোকাস-ফোকাস, বল তো ছোঁড়া আমার কোন হাতে হাসি আর কোন হাতে কান্না’?
ছেলেটা বুঝে উঠতে পারে না, জুলজুল করে তাকায়। মহাদেবজেঠু বন্ধ হাতের মুঠো খুলে লজেন্সগুলো ছেলেটার হাতে ঢেলে দেয় আর হাসতে হাসতে বলে, ‘আমার দু-হাতেই হাসি, দু-হাতেই কান্না’। দেখতে দেখতে বছর গড়ায়, নতুন শতক এসে পেরিয়ে যায় আরও তিনটে বছর। ছেলেটার ক্লাস ফোর শেষ হয়ে আসে আর শেষ হয়ে আসে নিয়ম করে ম্যাজিক দেখার দিনগুলি। সাদা কাপড়ে মোড়া মহাদেবজেঠু শেষ যেদিন পাড়ায় ঢোকে ছেলেটা তখন ইস্কুল থেকে ফিরছে, তার মুখের ভেতর খেলা করছে সেই কান্না-হাসি লজেন্স। মৃত্যুকে সে বুঝতে পারে কিন্তু জেঠুর শূন্য হাত দেখে থমকে যায়। সে-হাতে ম্যাজিক নেই, লজেন্স নেই! ছেলেটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, আতি-পাতি করে খোঁজে—কিন্তু পায় না কিছুই। বিষণ্ণ মুখের মাঝে বেদনার ছায়া। মা হাত রাখেন মাথায়। ছেলের চোখ থেকে অভিমান গলে গলে পড়ছে, ‘মা, মানুষ মরে গেলে তার ম্যাজিকও মরে যায়? হাসি-কান্নাগুলোও মরে যায়’? মা চুপ করে থাকেন। নিঃশব্দ মহাকাল এসে মুহূর্ত সরিয়ে নিয়ে যায়।
ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে চরাচর, ততদিনে ছেলেমেয়ের দল হাইস্কুলের সুবিশাল গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কার কাছে যেন তারা দেখে ফেলেছে সুইচ টেপা ফোন, ঘরে রাখতে হয় না—পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়! ক্লাবের রঙিন টিভির দৌলতে জেনে গেছে শচীন-সৌরভ আকাশি রঙের জার্সি গায়ে খেলতে নামে। হাইস্কুলে শিখছে খাতা-রং-তুলি ছাড়াই ছবি আঁকা হয়ে যায় কম্পিউটার নামে অদ্ভুত এক মেশিনে। এদিকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পাড়ার ছোটো ছোটো দোকান। বড়ো রাস্তার মোড়ে যে বিরাট দোকানগুলো খুলছে সেখানে লজেন্সের বয়াম নেই, কীসব শক্ত শক্ত ইংরেজি নামের চকোলেট। দু-টাকার মামুলি কয়েন নিয়ে ছেলেমেয়েরা ওখানে যেতে পারে না, ওখানে যায় বয়েজ অ্যান্ড গার্লসরা। কারা যেন চারপাশে অবিরাম ফিসফিস করছে দৌড়তে হবে, দৌড়তে হবে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন ঘুম নামে চোখের পাতায়, তখন আর আগের মতো বালিশের তলায় কোনও মিষ্টি গন্ধ নেই, আলোর ময়ূর নেই, ম্যাজিক নেই। সবকিছু কীভাবে যেন মুছে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! কেবল একটা লোক ঘুমের নদী থেকে উঠে আসে, তাঁর দু-হাতে কাগজের নৌকো। সে চিৎকার করে, ‘গিলি গিলি হোকাস-ফোকাস বল তো দেখি ছোঁড়া, কোন হাতের নৌকো ডুববে না’?
ছেলেটা নির্ভুল আঙুল নির্দেশ করে—সেই নৌকো জুড়ে অসংখ্য লজেন্স, মার্বেলগুলি, আলোর ময়ূর, ছেলেবেলা। নৌকোর কাঠামো থেকে ফুলের মতো ফুটে উঠছে স্মৃতির মাস্তুল। ছেলেটার বয়স আটাশ কি ত্রিশ—তবুও সময়ের বেড়া ঠেলে ম্যাজিসিয়ান লোকটার হাত ধরে নেমে যাচ্ছে স্মৃতির অতলে, সে নিশ্চিত অনন্তকাল পরেও এ নৌকো ডুববে না।