|

রাজনৈতিক কবিতা : কবির রাজনীতি – রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

উইলিয়াম বাটলার ইয়েট্‌স্-এর মৃত্যুর পর (১৯৩৯) তাঁর স্মরণে একটি কবিতা লিখেছিলেন ডবলিউ. এইচ. অডেন। কবিতাটির তৃতীয় ভাগে এই তিনটি স্তবকে বলা হয়েছিল:

“Time that is intolerant
Of the brave and innocent,
And indifferent in a week
To a beautiful physique.

Worships language and forgives
Everyone by whom it lives:
Pardons cowardice, conceit,
Lays its honours at their feet.

Time that with this strange excuse
Pardoned Kipling and his views.
And will pardon Paul Claudel,
Pardon him for writing well.”

সব পাঠক হয়তো পল ক্লোদেল (১৮৬৮-১৯৫৫)-কে চিনবেন না। ইনি হলেন ফরাসি কবি ও নাট্যকার। গোঁড়া ক্যাথলিক ও রাজনৈতিক মতামতে ঘোর দক্ষিণপন্থী। স্পেন-এর গৃহযুদ্ধের (১৯৩৬-৩৯) সময়ে তিনি সমর্থন করেছিলেন রাজতন্ত্রী জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে। ক্লোদেল-এর তুলনায় রাডিয়ার্ড কিপলিং আমাদের বেশি চেনা (১৮৬৫-১৯৩৬); ভারতে তাঁর জন্ম আর সাংবাদিক হিসেবে সাত বছর (১৮৮২-১৮৮৯) কাটিয়েছিলেন ভারতেই। ব্রিটিশ তথা বিশ্বের সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সপক্ষে তিনি শিঙে বাজাতেন। অথচ একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে দুজনেই ছিলেন দক্ষ কবি। ছন্দর কান ছিল অসাধারণ, আর শব্দর ব্যবহারে আশ্চর্য রকমের সচেতন। অডেন বলতে চান : তাঁদের রাজনৈতিক মতামত যতই আপত্তিকর হোক, মহাকাল তাঁদের ক্ষমা করে দেবে, যেহেতু তাঁরা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন : …by whom it lives.

ইয়েট্‌স্ প্রসঙ্গে ক্লোদেল ও কিপলিং-এর মতো কবির নাম আসাটা, বিশেষ করে ১৯৩৯-এ (যে বছর কবিতাটি লেখা হয়েছিল), একটুও আশ্চর্য নয়। ১৯৩০-এর দশকে ইয়েট্‌স্‌ কিছুদিন ফ্যাশিবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন।১ সে-কথা মনে রেখেই ইয়েট্‌স্‌-এর সপক্ষে এই সাফাই গেয়েছেন অডেন।

কথাটা কি ঠিক? অডেন নিজেও এ ব্যাপারে পরে তত নিশ্চিত ছিলেন না। তাই তাঁর কবিতাসংগ্রহ থেকে এই তিনটি স্তবক তিনি ছেঁটে ফেলেন।

—ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। নিজের কবিতায় যোগ-বিয়োগ করার অভ্যেস অডেন-এর ছিল। নিজের কবিতাসঙ্কলন থেকে কিছু কিছু কবিতা তিনি পুরোপুরি বাদ দিয়েছিলেন। তার কারণ: পরে তাঁর মনে হয়েছিল সেইসব কবিতার বক্তব্য ঠিক নয়। এর সেরা নমুনা “স্পেন” কবিতাটি। প্রথমে কিছু কিছু রদবদল, শেষে পুরো কবিতাটি প্রত্যাহার: “স্পেন”-এরও এই পরিণতি হয়েছিল।

কিন্তু ইয়েট্‌স্‌ বিষয়ক শোকগাথা থেকে বিশেষ করে এই চরণগুলিই অডেন তুলে নিলেন কেন? কবিতাটির দ্বিতীয় ভাগে ছিল হতাশের আক্ষেপ :

“… Mad Ireland hurt you into poetry.
Now Ireland has her madness and her weather still.
For poetry makes nothing happen”

এই চরণগুলি অডেন কিন্তু বদলাননি। অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধর পর থেকে অডেন-এর নিজের রাজনৈতিক মতামত কিপলিং বা ক্লোনেল-এর মতোই দক্ষিণপন্থী হয়ে পড়ে। আগের কবিতাগুলোর রদবদল তিনি করেছিলেন এই পর্বে।

তার মানে, ১৯৩৯-এ ইয়েট্‌স্‌-এর ফ্যাশিস্ত ঝোঁক সম্পর্কে অডেন সচেতন ছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল: এই ব্যাপারটিতে ইয়েট্‌স্‌-এর সাফাই গাওয়া যায় না—অন্তত সেই মুহূর্তে, যখন ইওরোপে নাৎসি ও ফ্যাশিস্ত শক্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধর ডঙ্কা বাজাতে শুরু করেছে। ইয়েট্‌স্‌-এর শোকগাথায় তিনি সে ঘটনার কথা লিখেছেন:

“In the nightmare of the dark
All the dogs of Europe bark.
And the living nations wait.
Each sequestered in its hate;

Intellectual disgrace
Stares from every human face.
And the seas of pity lie
Locked and frozen in each eye.

অথচ কবি হিসেবে ইয়েট্‌স্‌-কে বাতিল করার কথা অডেন স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। বিচারের ভার মহাকালের ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি যেন রেহাই চেয়েছিলেন।

রাজনৈতিক বিচ্যুতি কবির জীবনের একটি অংশ—আরও বহু আশ্চর্য দিকের মধ্যে একটি দিক। কবিতায় যদি সে বিচ্যুতি প্রকাশ পায় তবে সেটি আর নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে না। ইয়েট্‌স্ কখনোই অ-রাজনীতিক মানুষ ছিলেন না। আয়ারল্যান্ড ও তার স্বাধীনতার স্বপ্ন মিশে আছে কবিতার পরতে পরতে। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের বাইরের অন্যান্য উপনিবেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে ইয়েট্‌স্‌ ছিলেন উদাসীন। ওসব বিষয়ে চুপ করে থাকাই ভালো—এই ছিল তাঁর মত।২

১৯৩৯-এ অডেন-এর কাছে এই মত বোধহয় গ্রাহ্য হয়নি। ইয়েট্‌স্‌-এর ফ্যাশিস্ত ঝোঁক তাঁর কাছে আপত্তিকর বলেই মনে হয়েছিল। তার জন্যেই দরকার পড়েছিল ইয়েট্‌স্‌-এর সপক্ষে যুক্তি খোঁজার। ভালো কবি হলে মহাকাল তার সবকিছু ক্ষমা করে—এমন একটা আশ্রয়বাক্য থেকে শুরু করেছিলেন অডেন। কিপলিং ছিলেন এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টান্ত। সেই ভরসায় অডেন বলতে পারলেন: ক্লোদেল, আর তারই অনুষঙ্গে ইয়েট্‌স্‌-ও মহাকালের ক্ষমা পেয়ে যাবেন।

তবু, এই যুক্তিটাও শেষ পর্যন্ত অডেন-এর কাছে খুব টেকসই মনে হলো না। তার জন্যে পরে তিনি ওই তিনটি স্তবকের ১৬টি চরণ বাদ দিয়ে দিলেন।

রাজনৈতিক মতামতের দিক দিয়ে যাঁরা অডেন-এর উল্‌টো মেরুর লোক, এই ঘটনাটিকে কি তাঁরা ঠিক চোখে দেখবেন? ‘ঘটনা’ বলতে বোঝাতে চাই:
১। পরে মত বদলালে আগের মত প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত কিনা।
২। কবির মূল্যায়নের সব দায়িত্ব মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় কিনা।

প্রথমটির উত্তর তুলনায় সহজ। যে-কোনো মানুষেরই মত বদলানোর অধিকার আছে। সুতরাং নিজের পাঁঠা ন্যাজে বা মুড়োয় যে-কোনো দিক থেকেই তিনি কাটতে পারেন। দ্বিতীয় প্রশ্নটি তার চেয়ে অনেক কঠিন। কবির পরিচয় তাঁর কবিতা দিয়ে। তাই কবিতার বিচারই আসল কথা। কবি হিসেবে তাঁর দক্ষতার দিকও সে-বিচারের অঙ্গ। কোনো কবিতার বিষয়বস্তু যদি বামপন্থী পাঠকের কাছে সব দিক থেকে সমর্থনের যোগ্য হয়, তাহলেও রচনাটি কবিতা হয়ে উঠেছে কিনা—এ প্রশ্ন থাকবেই। এ হলো কবিতা বিচারের নান্দনিক দিক।

সমস্যা দেখা দেবে ঘটনা উল‌্টো হলে। নান্দনিক বিচারে যে-কবিতা নিখুঁত বা প্রায় নিখুঁত, বিষয়বস্তুর দিক থেকে সেখানে বামপন্থী পাঠকের প্রতিঘাত (রেসপন্‌স্) প্রতিকূল হতে বাধ্য। এখানে উঠবে ঐতিহাসিক বিচারের প্রশ্ন। সাধারণ ভাবে বললে পুঁজিবাদ-পূর্ব যুগের কবিতায় গণ-আন্দোলনের কথা থাকবে না, স্থিতাবস্থা ছাড়িয়ে অন্য ভবিষ্যতের গভীর স্বপ্ন দেখা দেবে না—একথা মেনে নিতে হবে। ধানের ক্ষেতে বেগুন খুঁজে হতাশ হয়ে তাই লাভ নেই।

অরাজনৈতিক কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। সব কবিতায় রাজনীতি থাকতে হবে—এ দাবি অচল; সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞান থাকলেও কোনো বামপন্থী পাঠক সে দাবি করবেন না। সুতরাং ইয়েট্‌স্-এর যে-সব কবিতার কেন্দ্রে রাজনীতি নেই সেগুলির বিচারেও তাঁর রাজনীতিক মতামতকে টেনে আনার কোনো মানে হয় না।

সমস্যা দেখা দেবে রাজনৈতিক কবিতার ক্ষেত্রে। যেখানে কবির রাজনীতিক মত খুব স্পষ্ট করে প্রকাশ পেয়েছে, যেমন ধরা যাক, “ইস্টার ১৯১৬”। আমি আইরিশও নই, জাতীয়তাবাদীও নই; তবু কবিতাটির নিখাদ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। কিন্তু ওই ইয়েট্‌স্‌ই যখন লেখেন “Politics” বা “On Being Asked for a War Poem”–তখন বানপন্থী পাঠকের প্রতিঘাত অন্যরকম হতে বাধ্য। নন্দনসর্বস্ব পাঠক হয়তো আপত্তি তুলবেন, কিন্তু মার্কসীয় সাহিত্য বিচারের জোড়া মাপকাঠি হলো একই সঙ্গে ঐতিহাসিক ও নান্দনিক (ঐতিহাসিক শব্দটির মধ্যে ‘রাজনৈতিক’ও পড়ে)। তাই মহাকালের ওপর বিচারের ভার ছেড়ে দেওয়া আসলে সমস্যাটি এড়িয়ে যাওয়া।

আলাদা আলাদা কবিতার প্রতিঘাতে এমন হেরফের হবেই। কোনো কবির সমস্ত রচনার বিচারে বামপন্থী পাঠকের নিজস্ব বিবেচনার ছাপ পড়বে। কবিতার মধ্যে যে রাজনীতি বা ভুল রাজনীতি (অবশ্যই বামপন্থার বিচারে) প্রকাশ পায়, বামপন্থী পাঠকের প্রতিঘাত সে-ক্ষেত্রে দুরকমের হতে বাধ্য। ইয়েট্‌স্-এর কবিতার আলোচনায় বামপন্থী পাঠক তাই সব কবিতার বিষয়বস্তুর বিচারে সায় না-ও দিতে পারেন।

এর পরেও একটি প্রশ্ন থাকে। ধরা যাক, কোনো কবির রাজনৈতিক মতামত ছিল (বামপন্থী বিচারে) চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল, কিন্তু কবিতায় তার কোনো প্রকট বা প্রচ্ছন্ন ছাপ পড়ে নি; কবিতা লেখার সময় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তিনি একেবারেই আনেন নি। এমন কোনো কবির কবিতা আলোচনার সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামতকে জোর করে টেনে আনা কি ঠিক? আমার মনে হয় : না, সেটা একেবারেই অনুচিত। এ হলো যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় যাকে বলে ব্যক্তিমুখী যুক্তি, আরগুমেন্তুন আদ হোমিনেম। এর থেকেই ঝোঁক আসে যেখানে কোনো রাজনীতির প্রসঙ্গ নেই সেখানেও রাজনীতি আবিষ্কার করার, নান্দনিক দিককে একেবারে অগ্রাহ্য করে সেই কবিকে একেবারে নস্যাৎ করা। কবিতার বিচার না করে, কোন শ্রেণীতে কবির জন্ম হয়েছিল—এমন অ-বিচারের অপকর্ম এককালে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের ও তার বাইরের অতিবাম সমালোচকরা বহুবার করেছেন।৩ সে-দোষ এখনও মাঝে মাঝে এখানে ওখানে অজ্ঞ তরুণ বামপন্থীদের মধ্যে দেখা যায়। তাঁরা ধ্রুপদী মার্কসবাদ পড়েন নি। হোরেস ও হাইনে সম্পর্কে মার্কসের মত, লেনিন-এর তলস্তয়-বিচার ইত্যাদির কথা তাঁরা বোধহয় জানেন না। তার জন্যেই এমন ভূত বারে বারে ঘাড়ে চাপে। ইয়েট‌্স্‌ সম্পর্কে অডেন-এর কবিতা নিয়ে এই আলোচনা আশা করি তাঁদের ভাবাবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সঞ্জীবন সরকার, রিঙ্কু চৌধুরী, সিদ্ধার্থ দত্ত, প্রতীতি ঘোষ।

টীকা :

১. ফ্যাশিবাদ-এর সঙ্গে ইয়েট্‌স্-এর যোগ অবশ্য একেবারেই আয়ারল্যান্ড-কেন্দ্রিক। সেখানকার নীল কুর্তা (ব্লু শার্টস)-ওয়ালাদের দিকে ১৯৩৩-৩৪-এ তাঁর সমর্থনের ঝোঁক দেখা দেয়। তাদের জন্যে তিনি তিনটি কুচকাওয়াজের গানও লিখেছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তৃত তথ্যর জন্যে ফস্টার, খণ্ড ২, ৪৭১-৭৬, ৪৮২-৮৩ দ্র.। জীবনের একেবারে শেষে অবশ্য ফ্যাশিবাদ ও কমিউনিজম—দুটি মতবাদকেই তিনি যথেষ্ট নয় বলে মনে করতেন (ঐ, ৬১৩)।
২. ফস্টার, ৫১৯ দ্র.।
৩. এ ধরণের অপকর্মর নমুনার জন্যে ফ্লোরস সম্পা, বইটি দ্র.।

রচনাপঞ্জি

Flores. Angel (ed.), Literature and Marxism. A Controversy by Soviet Critics. Allahabad : India Publishers, 1945.

Foster, R. F. W. B. Yeats: A Life. II : The Arch-Poet, 1915-1939. Oxford : Oxford University Press, 2003.

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *