জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ২৪ )
মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য
পর্ব–চব্বিশ
পরের দিন হাপি কাফেতে নিজেদের টেবিলে আবার যখন ফিরে এলাম তখনই একমাত্র উপলব্ধি করতে পারলাম তাঁর ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটির শূন্যতা ঠিক কতখানি। অনেকদিন ধরে আমরা কেউ সেই চেয়ারে বসার সাহস করিনি। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে সহমত হলাম যে সেখানে যিনি বসতে পারেন তিনি হেরমান। আমাদের বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল পুরোনো আড্ডার ছন্দে ফিরে যেতে। তারপরই এল দোন রামোনের চিঠি। সে চিঠিতে যেন তাঁরই গলার স্বর শুনতে পেলাম আমরা, শুধু লিখিত এই যা। খুদে খুদে অক্ষরে ও বেগুনি কালিতে। এইভাবে হেরমানের মাধ্যমে পুনরায় তাঁর সঙ্গে আমাদের বেশ ঘনঘন ও আবেগমথিত সংযোগ শুরু হল। সেই সব চিঠিতে তিনি নিজের কথা বলতেন খুব কমই। প্রধানত লিখতেন স্পেনের কথা যাকে একটি শত্রু দেশ হিসেবেই গণ্য করতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ফ্রাঙ্কো[১] বেঁচে আছে এবং কাতালুন্যিয়ার উপর স্পেনের প্রভুত্ব বজায় থাকছে।
সাপ্তাহিক কাগজ বের করার পরিকল্পনাটা ছিল আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োরের এবং সেটাও বেশ অনেক দিন আগের কথা। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল দোন রামোনের চলে যাওয়ায় যেন কাজটার গতি অনেক বেড়ে গেল। সেই উদ্দেশ্যে যখন তিন দিন বাদে আমরা সবাই রোমা কাফেতে জড়ো হলাম, আলফোনসো জানালেন কাগজ বের করার জন্য সব কিছু তৈরি। সেটা হবে একটা সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড, কুড়ি পাতার। তাতে থাকবে সংবাদ ও সাহিত্য এবং নাম হবে ‘ক্রোনিকা’। নামটা দিয়ে অবশ্য এর চরিত্র আন্দাজ করা যাবে না। আমাদের কাছে এ এক চূড়ান্ত পাগলামি বলে মনে হল। কেন-না চার বছর ধরে আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োর উপযুক্ত জায়গায় মানে যাদের প্রভূত সামর্থ্য আছে তাদের কাছে চেয়ে-চিন্তে কিছুই জোগাড় করতে না পেরে শেষপর্যন্ত কারিগর, গাড়ির মিস্ত্রী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কাছে গিয়েছিলেন। এমনকি শুঁড়িখানার মালিক যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে তাদের কাছ থেকেও টাকা নিলেন তাদের দোকানের রামের বিজ্ঞাপন ছাপানোর শর্তে। তবে এ পত্রিকা জনপ্রিয় হবে সেকথা ভাবার পেছনেও বিশেষ কিছু কারণ ছিল। একথা ঠিক যে এ শহরে অনেক কারখানা আছে। শহরের মানুষগুলোও খুব অহংকারী। কিন্তু এসবের পাশাপাশি এই শহরই তো কবিতার প্রতি আবেগকে জাগিয়ে রেখেছিল।
আমরা নিজেরা ছাড়া আর খুব কম মানুষই ছিলেন যাঁরা নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা করতেন। তাঁদের মধ্যে একমাত্র যিনি চাকুরিরত ছিলেন এবং প্রচুর অভিজ্ঞতাও ছিল তিনি হলেন কার্লোস ওসিয়ো নোগেরা, আমরা বলতাম ‘বাতে ওসিয়ো’ অর্থাৎ চারণকবি ওসিয়ো। তিনি কবি, সাংবাদিক ও অত্যন্ত অমায়িক বিশালদেহী এক মানুষ। সরকারি বড়ো অফিসার ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল ‘এল নাশিয়োনাল’ কাগজের সেন্সরের ব্যাপারটা দেখাশোনা করা। সেখানে তিনি কাজ করেছিলেন আলবারো সেপেদা ও হেরমান বার্গাসের সঙ্গে। আরেকজন ছিলেন রোবের্তো প্রিয়েতো, ডাকনাম বব, অভিজাত ঘরের ছেলে ও ব্যতিক্রমী পণ্ডিত। তিনি ঠিক যেমন করে স্প্যানিশে ভাবতেন তেমন করেই ইংরাজি ও ফ্রান্সে ভাবতে পারতেন। আর অসাধারণ পিয়ানো বাজাতেন। বিখ্যাত শিল্পীদের শ্রেষ্ঠ সুরগুলো মন থেকেই বাজাতেন, স্বরলিপি দেখতে হত না। এছাড়াও আলফোনসোর ভাবা তালিকায় যাঁদের নাম ছিল তাঁদের মধ্যে সবথেকে অভাবনীয় নামটি হল হুলিও মারিয়ো সান্তোদোমিঙ্গো। আলফোনসো মুক্ত মনে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তাঁর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের জন্য। তবে আমাদের মধ্যে খুব কম জনই বুঝতে পেরেছিলাম কেন তাঁর নাম রয়েছে সম্পাদকমণ্ডলীতে। কেন-না তাঁকে দেখে মনে হত তিনি জন্মেছেন একজন বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, মার্জিত ল্যাটিন উদ্যোগপতি হতে; কিন্তু ক্ষমতার পরিহাসের কাছে তাঁর হাত বাঁধা হয়ে আছে। পত্রিকার আমরা প্রধান চারজন ছাড়া খুব কম লোকই জানতেন যে গত ২৫ বছর ধরে সান্তোদোমিঙ্গো নিভৃতে যে আকাঙ্ক্ষাটি লালন করে আসছেন, তা হল একজন লেখক হওয়ার স্বপ্ন।
পত্রিকার মুখ্য পরিচালক অবশ্যই হবেন আলফোনসো। হেরমান বার্গাস সর্বাগ্রে একজন বিরাট সাংবাদিক। তাঁর সঙ্গে আমিও সে-কাজের অংশী হব এমন একটা আশা আমার ছিল। তবে আমার অবসর সময়ে সে কাজ করব, এমনটা নয়। কারণ আমাদের কখনোই সময় ছিল না। বরং কাজটি করব তখনই যখন সে কাজ শিখে নেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। অন্যদিকে আলবারো সেপেদা তাঁর অবসর সময়ে কাজ করে দেবেন নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তবে শেষ পর্যন্ত আমার থেকে বেশি আগ্রহী ও অঢেল সময় হাতে নিয়ে আর কেউ ছিলেন না এমন একটি স্বাধীন ও অনিশ্চিত সাপ্তাহিকের কার্যকরী সম্পাদক হওয়ার জন্য, তাই সেই কাজটা আমিই পেলাম।
বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই আলফোনসো তাঁর কাজ এগিয়ে রেখেছেন। তাছাড়াও গত ছ’ মাসে আরো অনেক কাজ গুছিয়ে ফেলেছেন, যেমন বিভিন্ন সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, সাহিত্য সংক্রান্ত উপকরণ, প্রধান প্রধান সাংবাদিক প্রবন্ধ এবং ধনী বন্ধুদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি। কার্যকরী সম্পাদকের কাজের কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই আর মাইনে যা নির্দিষ্ট করা হল তা সেই সময়ে আমার মতো একজন সাংবাদিকের পক্ষে খুবই ভালো, তবে তা অবশ্যই পত্রিকার ভবিষ্যতের আয়ের উপর নির্ভরশীল। এই সমস্ত ঠিক করা হয়ে গেল যাতে পত্রিকার মান খুবই উন্নত হয় ও সময়মতো প্রকাশিত হয়। শেষ পর্যন্ত পরের সপ্তাহের শনিবারে বিকেল পাঁচটার সময় আমি যখন ‘এল এরালদো’ পত্রিকায় আমার কাজের জায়গায় ঢুকলাম, আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োর সম্পাদকীয় লিখতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে চোখ তুলে তাকালেন না পর্যন্ত।
—‘আপনার কাজগুলো সব দেখে নিন, মায়েস্ত্রো,’ তিনি বললেন, ‘পরের সপ্তাহেই ‘ক্রোনিকা’ প্রকাশিত হচ্ছে।’
আমি ভয় পেলাম না, কারণ এই বাক্যটা এর আগে দু-দুবার শোনা হয়ে গেছে। তবে তিনবারের বার কিন্তু তা বাস্তবায়িত হল। সেই সপ্তাহের সবচেয়ে বড়ো সংবাদ – অন্য সব খবরকে ছাপিয়ে – ব্রাজিলের ফুটবল খেলোয়াড় এলেনো দে ফ্রেইতাসের ‘দেপোর্তিভো জুনিয়র’-এর হয়ে খেলা। কিন্তু সেই ঘটনাকে আমরা তুলে ধরলাম সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিক থেকে একটা বিরাট সংবাদ হিসাবে, নামকরা কাগজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সাংবাদিক রচনার মাধ্যমে নয়। ‘ক্রোনিকা’ ঠিক ওই ইঁদুর দৌড়ের অংশী হতে আত্মপ্রকাশ করেনি, বিশেষ করে সংবাদটি যখন ফুটবলের মতো একটা জনপ্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সর্বসম্মতভাবে এবং সেই অনুযায়ী পরিশ্রমটাও করতে হবে।
আমরা আগে থেকেই এত বেশি লেখা-পত্তর তৈরি করে রেখেছিলাম যে শেষ মুহূর্তে শুধু ওই এলেনোর সংবাদটিই বাকি ছিল। তা লিখলেন হেরমান বার্গাস, ক্রীড়াসাংবাদিকের জগতে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তাছাড়া নিজেও একজন ফুটবল পাগল। প্রথম সংখ্যা একেবারে নির্দিষ্ট সময়ে কাগজের স্টলে এসে হাজির হল – ১৯৫০ সালের ২৯ এপ্রিল, শনিবার। সেই দিনটা ছিল সন্ন্যাসিনী কাতালিনা দে সিয়েনার[২] দিন, যিনি ছিলেন সেই সব নীল চিঠির লেখিকা। ‘ক্রোনিকা’ ছাপা হওয়ার একেবারে শেষ মুহূর্তে তাতে যোগ করা হল আমারই সৃষ্টি একটি স্লোগান – ‘ইয়োর বেস্ট উইকএন্ড’। আমরা জানতাম যে সেই সময়ে কলোম্বিয়ার পত্রিকাগুলোর চলতি স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার যে অসহ্য প্রবণতা ছিল তার বাইরে আমরা বেরোতে চাইছি। কিন্তু ওই স্লোগানটার মধ্যে দিয়ে এটাই বলতে চেয়েছিলাম যে স্প্যানিশ ভাষায় এই ধরনের দ্যোতনা নিয়ে দ্বিতীয় কোনো কাগজ নেই। প্রচ্ছদে ছিল আলফোনসো মেলোর ইঙ্ক ড্রইংয়ে এলেনো দে ফ্রেইতাসের ছবি। আমাদের মধ্যে যে তিনজন শিল্পী ছিলেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র আলফোনসোই প্রতিকৃতি আঁকতে পারতেন।
শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করা এবং প্রচারে যথেষ্ট গাফিলতি সত্ত্বেও সব পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেল। আর তা হল সম্পাদকীয় দপ্তরের সমস্ত কর্মীর পরের দিন অর্থাৎ রবিবারে মিউনিসিপ্যালিটির স্টেডিয়ামে পৌঁছনোর অনেক আগেই। সেই দিন, ৩০ এপ্রিল, সেখানে খেলবেন দুই যুযুধান প্রতিদ্বন্দী – দেপোর্তিভো জুনিয়র ও স্পোর্টিং – দুটো দলই বাররানকিয়ার। পত্রিকার সম্পাদকরাই দ্বিধাবিভিক্ত হয়ে গেলেন। কারণ হেরমান ও আলবারো ছিল স্পোর্টিংয়ের ফ্যান, অন্যদিকে আলফোনসো আর আমি জুনিয়রের সাপোর্টার। কিন্তু এলেনোর নাম আর হেরমান বার্গাসের অসাধারণ সেই সাংবাদিক প্রবন্ধ এক ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিল যে কলোম্বিয়া এতদিন ধরে যে উচ্চমানের একটি খেলার পত্রিকার প্রতীক্ষায় ছিল শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশিত হয়েছে এবং সেটি হল ‘ক্রোনিকা’।
স্টেডিয়াম লোকে-লোকারণ্য। একেবারে পেছনের গ্যালারি পর্যন্ত ভরে গেছে। প্রথমার্ধের ছ-মিনিট পরে এলেনো দে ফ্রেইতাস কলোম্বিয়ার মাটিতে তাঁর প্রথম গোলটি করলেন মাঝমাঠ থেকে বাঁ-পায়ের একটা শটে। যদিও শেষ পর্যন্ত স্পোর্টিং ৩-২ গোলে জিতল, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এলেনো যেন একাই সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেন। আর তাঁর পরেই ছিল আমাদের সাফল্য এবং তার কারণ হল প্রচ্ছদে এলেনোর ছবি দেওয়ার পূর্ব-বিচক্ষণতা। যাই হোক, কোনো মানুষ বা ঈশ্বর কারুরই ক্ষমতা ছিল না জনতাকে বোঝানো যে ‘ক্রোনিকা’ খেলার পত্রিকা নয়, সেটা একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা যা এলেনো দে ফ্রেইতাসের আগমনকে বছরের অন্যতম বড়ো খবর হিসাবে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছে।
তবে এই সাফল্য যে অপটু, অনভিজ্ঞের সাফল্য ছিল, এমনটা নয়। আমাদের মধ্যে তিনজন ফুটবল নিয়ে আলোচনা করতেন বিভিন্ন পত্রিকায়, যাঁর মধ্যে অবশ্য উল্লেখ্য হেরমান বার্গাসের নাম। আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োর ফুটবলের অন্ধভক্ত আর আলবারো সেপেদা মিসৌরির সেন্ট লুইসে ‘স্পোর্টিং নিউজ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন তিন বছর যাবৎ। তবুও যে পাঠককুল আমাদের এমন সাদরে গ্রহণ করেছিলেন পরের সংখ্যাগুলির ক্ষেত্রে তাঁরা আর তেমন হাত বাড়িয়ে দিলেন না। আর স্টেডিয়ামের যে অসংখ্য ভক্তদের দেখা গিয়েছিল তাঁরাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন কোনো বেদনাবোধ ছাড়াই।
এই দুরাবস্থা ঠেকাতে সম্পাদকীয় মণ্ডলীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে দেপোর্তিভো জুনিয়রের অন্যতম তারকা উরুগুয়াইয়ার সেবাস্তিয়ান বেরাসকোচেয়াকে নিয়ে আমি প্রধান আর্টিকল লিখব। আশা ছিল সেই লেখায় আমি ফুটবলের সঙ্গে সাহিত্যের মিশেল ঘটাতে পারব, ঠিক যেমনটি আমি বহুবার করেছি আমার প্রতিদিনের কলামে অন্য অনেক গুপ্তবিদ্যার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে। যাই হোক সেই কাতাকায় থাকতেই লুইস কার্মেলো ফুটবলের প্রতি আমার যে তীব্র আসক্তির সঞ্চার ঘটিয়েছিল, তার রেশ তখন প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। বরং আমি ছিলাম ক্যারিবীয়ার বেসবলের প্রথম দিককার ভক্ত। আঞ্চলিক ভাষায় এ খেলাকে বলতাম ‘el juego de pelota’ অর্থাৎ বলখেলা। যাই হোক, আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।
আমার লেখার আদর্শ ছিল অবশ্যই হেরমান বার্গাসের লেখনী। তবে তার সঙ্গে অন্যান্য ক্রীড়াসাংবাদিকদের লেখাও পড়লাম এবং বেরাসকোচেয়ার মতো বুদ্ধিমান ও সহৃদয় মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ কথাবার্তার পর অনেকটা চিন্তামুক্ত হলাম। বেরাসকোচেয়ার অন্যতম একটি গুণ হল নিজেকে কীভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে চাইছেন সে সম্বন্ধে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল। কিন্তু যে বিষয়টা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিল তা হল তাঁর পদবী। শুধুমাত্র ওই পদবীর জন্য আমি তাঁকে একজন আদর্শ বাস্কোর[৩] মানুষ হিসাবে বর্ণনা করলাম, যেখানে আসলে তিনি ছিলেন শুদ্ধ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত এক কালো মানুষ। এটা ছিল আমার জীবনের সাংঘাতিক এক ভুল আর সেটা করলাম পত্রিকার সেই সংকট মুহূর্তে। এমনকি একজন পাঠক চিঠিতে লিখলেন পর্যন্ত যে আমি হচ্ছি সেই ক্রীড়াসাংবাদিক যে একটা ফুটবল আর একটা ট্রামের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। সর্বান্তকরণে তাঁর কথার সঙ্গে আমি সহমত ছিলাম। বহু বছর পরে হেরমান বার্গাসের মতো দক্ষ সমালোচকও একটি স্মৃতিচারণমূলক বইতে স্বীকার করেছিলেন যে আমার আজীবনের সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্টতম লেখাটি হল বেরাসকোচেয়াকে নিয়ে লেখা আমার সেই রিপোর্ট। বোধকরি তিনি একটু বাড়িয়েই বলেছিলেন, তবে খুব বেশিও নয় আবার। এ ব্যাপারে তাঁর মতো দক্ষ আর কেউ ছিলেন না। রিপোর্ট আর প্রবন্ধ যাই লিখুন না কেন তার ভাষা এতই ঝরঝরে ছিল যে মনে হত যেন লিনোটাইপিস্টকে[৪] সেটা মুখে মুখে বলে রচনা করেছেন।
আমরা ফুটবল বা বেসবল কোনোটাকেই বাদ দিলাম না। কেন-না ক্যারিবীয়ার উপকূলে উভয়ই খুব জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা ও আধুনিক সাহিত্যের উপর আরও বেশি লেখা সংযোজন করতে লাগলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবই বিফলে গেল। ‘ক্রোনিকা’ একটি খেলার পত্রিকা বলে যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছিল তা কিছুতেই ভাঙা গেল না। অথচ স্টেডিয়ামের সেইসব অন্ধ ভক্তের দল তাদের ধারণা থেকে বেরিয়ে আমাদেরকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। তবুও আমরা যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম সেভাবেই পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকলাম। তা সত্ত্বেও তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকে সে স্বর্গ-মর্ত্যের মধ্যপথে ঝুলে রইল।
আমি অবশ্য হতাশ হয়ে পড়িনি। কারণ সেই সময়টায় মায়ের সঙ্গে কাতাকা যাওয়া, দোন রামোন বিনিয়েসের সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক কথোপকথন এবং ‘বাররানকিয়া দল’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমাকে এক গভীর প্রেরণায় মাতিয়ে তুলেছিল। এমনকি সারা জীবন তার রেশ রয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে লেখা ছাড়া আর কোনোভাবে আমি একটা পয়সাও রোজগার করিনি। এই ব্যাপারটাকে লোকে যেভাবেই দেখুক না কেন আমার কাছে তার মূল্য অনেক বেশি। কারণ নিজের গল্প ও উপন্যাস থেকে প্রাপ্ত শুধু রয়্যালটির টাকা দিয়ে সংসার চালানোর অবস্থায় যখন আমি পৌঁছলাম তখন আমার বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে এবং চারখানা বইও বেরিয়ে গেছে। অবশ্য সেগুলো থেকে যৎসামান্য টাকা পেয়েছিলাম। এর আগে আমার জীবন সব সময় চালাকি, ভনিতা আর বিভ্রান্তির উত্তেজনায় ভরে থাকত যা দিয়ে আসলে আমি সেইসব অসংখ্য প্রলোভনের হাতছানি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছি, যারা সারাক্ষণ চেষ্টা করত অন্য যে কোনো পথে আমাকে নিয়ে যাওয়ার, শুধু লেখক হওয়ার পথটা বাদ দিয়ে।
টীকাঃ
১। ফ্রাঙ্কো – ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কো স্পেনের একজন মিলিটারি জেনারেল ছিলেন যাঁর পরিচালনায় ‘জাতীয়তাবাদী’ দল স্পেনের গৃহযুদ্ধের (১৯৩৬-৩৯) পর দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে এবং ফ্রাঙ্কো ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত একনায়ক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
২। কাতালিনা দে সিয়েনা – ইটালির সন্ন্যাসিনী (২৫ মার্চ, ১৩৪৭ – ২৯ এপ্রিল, ১৩৮০), রোমান ক্যাথলিক চার্চের সদস্যা, অতীন্দ্রিয়বাদী ও সেবাব্রতী। তাঁর রচনার মধ্যে অন্যতম তাঁর পত্রগুচ্ছ, যার অধিকাংশই তিনি মুখে মুখে বলে লিখিয়েছেন বলে মনে করা হয়, যদিও ততদিনে তিনি লিখতে শিখে গিয়েছিলেন। ৩৮২টি পত্র এখনো অবধি সংরক্ষিত আছে। তিনি একুশ বছর বয়সে যীশুখ্রীস্টের সঙ্গে এক আধ্যাত্মিক বিবাহ-বন্ধন উপলব্ধি করেছিলেন যার অভিজ্ঞতা চিঠিতে লিখেছেন এবং পরবর্তীকালে এই ঐশ্বরিক বিবাহ বহু শিল্প-সৃষ্টির প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল।
৩। বাস্কো – উত্তর স্পেনের একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল।
৪। লিনোটাইপ – টাইপরাইটারের মতো কি-বোর্ডযুক্ত ছাপার হরফ সাজাবার যন্ত্র। এই পদ্ধতিতে বইয়ের প্রতিটি লাইন এক একটি স্বতন্ত্র ধাতব ছাঁচে পরিণত করে তার ব্লক তৈরি করে ছাপা হত।