কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ৯)
নবম পর্ব
তীরে পৌঁছতেই তলিয়ে গেল কাঠগোদাম এক্সপ্রেস
সেই কোন আদিকাল থেকেই হিমালয় মানুষকে এক চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে। যুগে যুগে মানুষ কখনো দল বেঁধে , কখনো একলা পাড়ি দিয়েছে এক রহস্যলোকের খোঁজে। কখনো হাতে অস্ত্র নিয়ে, কখনো হৃদয়ে রোমাঞ্চ নিয়ে। রোমাঞ্চিত আমরা, অবাক আমরা আবার ফিরে যাই নিজ নিজ ঘরে। সবারই একটা নিজস্ব ঘর থাকে। তবে কেউ কেউ রহস্যলোকের পথকেই নিজের ঘর বানিয়ে নেয়। সমগ্র বিশ্ব-সৃষ্টির সাপেক্ষে একটা মানুষের জীবনকাল আর কতটুকু, একটা সভ্যতার, একটা সবুজ গ্রহেরই বা কতটুকু আয়ু! এসব প্রশ্ন যখন আমাদের ব্যাকুল করে তোলে তখন এমন পথে নামলে হয়তো উত্তর পাওয়া যায়, হয়তো যায় না। তবে ভাসমান এই গ্রহে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে শ্বেতশুভ্র হিমালয় শৃঙ্গগুলির এক মায়ারঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ছোটবড় পাথরের বাঁধা পেরিয়ে একটা ঝরনার নদী হয়ে ওঠা, আলোর দর্শন পেতে ছটফট করা সরলবর্গীয় গাছেদের শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা, আপন সুরের কাছে মাথা নত পাখির গান আর প্রতিটা হেয়ারপিন বাঁকে জীবনের অনিশ্চয়তা দেখে আমরা হিমালয়ের মতোই ধীর,স্থির,শান্ত হতে চাই। হয়তো পারি সাময়িক মেয়াদে হলেও। এসব ভাবনার মধ্যেই একটা বাঁকে এসে আমাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল, সামনে আরও গাড়ির লম্বা লাইন। পাহাড়েও ট্র্যাফিক জ্যাম হয়। বিশেষ করে উইকএন্ডে কিংবা ছুটির দিনগুলিতে সবাই যখন দুদিনের আমোদপ্রমোদের উচ্ছিষ্ট পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে সমতলে নিজেদের নিশ্চিত আশ্রয়ে ফিরবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। শামুক গতিতে গাড়ি চলছে, কখনো থেমে আছে তো আছেই। একটা বাঁকে এসে দেখা গেল একটি মালবোঝাই ট্রাক উল্টে আছে রাস্তার উপর। খুব সম্ভবত ওভারলোডিঙের কারণে চড়াই উঠতে না পেরে উল্টে গেছে। তবে গতি কম থাকার কারণে খাদে পড়েনি। শুনলাম ড্রাইভার ও খালাসি আহত হলেও বেঁচে গেছে!
যতবারই পাহাড়ে আসি প্রত্যেকবারেই এই পথের পাকদণ্ডী মনের মধ্যে গুলিয়ে ওঠে, প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের মধ্যেই ছায়ার মতোই সাথে চলা একটা খাদ ভীতির সঞ্চার করে। একদিকে বিস্ময় অন্যদিকে ভীতি চলে পাশাপাশি। এভাবেই একটা দুলকি ছন্দে হৃৎপিণ্ড চালু থাকে। মনের মধ্যে তার ছাপ পড়ে। মনও তাকে চেতনা দিয়ে জারিত করে একটা সাম্যভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে। তবে ট্র্যাফিক জ্যামে সেই খাদে পড়ার ভয় নেই কিন্তু বিরক্তি আছে। আর সেই বিরক্তি চরমে পৌঁছয় যখন ঘরে ফেরার ট্রেন ধরার থাকে। কাঁসারদেবীর চুম্বকার্ষণে পড়ে একে তো আমরা সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম তার উপর এই না ফুরানো এক পাইথনের গতির মতো গাড়ির লম্বা লাইন। জ্যামে আটকে থাকার মুহূর্তটুকু সময়বোধকে প্রলম্বিত করে; পাহাড়ি বাতাসেও যেন দম বন্ধ হয়ে আসে! তীরে এসে তরী ডুবে যাবে? এক বিরক্তি ও অবসাদ ঘিরে ধরে। অনিমেষ, পূর্ণিমা, শিখা চুপচাপ। বাচ্চারা বাচ্চাদের মতোই আছে। জাগতিক নিশ্চয়তা- অনিশ্চয়তা ওদের মনে কোনও দাগ কাটতে পারে না। শুধু আমিই যেন একবুক উৎকণ্ঠা নিয়ে আটকে আছি যান্ত্রিক যন্ত্রণার মধ্যে! পেছনে একটা অ্যাম্বুলেন্সের অবিরাম চিৎকার; আহত সেই ট্রাকড্রাইভার ও খালাসিকে দ্রুত পৌঁছে নিয়ে যেতে হবে হলদোয়ানির হাসপাতালে। কিন্তু যাবে কী করে? বিশ ফুটের রাস্তাতেও তিন তিনটি লাইন। সমতলের বাবু-বিবিরা সপরিবারে, বন্ধু-বান্ধবীকে দামি দামি গাড়ির পাশের সিটে বসিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে আসে সে ঠিক আছে, তবে পথের স্বাভাবিক নিয়মগুলো তো মানবে, একটা সাধারণ সিভিক বোধ থাকবে না? একটুও ধৈর্য নেই, যে যার মতো একটু ফাঁক পেলেই মোটা মাথাটি অন্যের পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অথচ লাইনের পেশাদার ট্যাক্সি চালকেরা ঠিক নিজেদের লাইন মেনে ধীর শান্ত ভাবে চলছে। মানুষের এই অধৈর্য দেখে, গোঁয়ার্তুমি দেখে রাগে আমার মুখ দিয়ে খিস্তি বের হয়। পরক্ষণেই আবার ভাবি মানুষের এই আচরণও যেন উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তায় ভরা এক পরিস্থিতির বাই প্রোডাক্ট! যেন নিজেরই লোভ ও লালসায় আচ্ছন্ন একটা সিংহ জালে আটকে পড়েছে। আর সেই জাল থেকে বেরতে গিয়ে সে আরও বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছে জালের জটিল প্যাঁচে। গাড়ির চাকা একটু গড়ালে যেন শ্বাস ফিরে আসে, জেগে ওঠে আশ। ঘড়ি দেখি মাত্র আধঘণ্টা বাকি কাঠগোদাম এক্সপ্রেসের সবুজ বাতি দেখার। মাত্রতো পাঁচ কিলোমিটার, ঠিক পৌঁছে যাবো।
না, সময়ে আমরা কাঠগোদাম ষ্টেশনে পৌঁছাতে পারিনি সেদিন। স্বরূপদাদের ট্যাক্সিটি আমাদের পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছিলো ষ্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে ঢুকতেই চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল আমাদের নিশ্চিত ঠিকানার ট্রেনটি এক অনিশ্চিত মুহূর্তে ফেলে দিয়ে আমাদের। অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে থাকা স্বরূপদার চোখের সামনে তখন একটা লাল রেখার ইল্যুজ্ন্! আমাদের আর ট্যাক্সি থেকে নামতে হয়নি। ড্রাইভারের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমতো সবাইকে নিয়ে ট্যাক্সি আবার ছুটল মাত্র সাত কিমি দূরেই হলদোয়ানির দিকে, যদি সেই স্টপেজে গিয়ে একটু বিলম্ব করে ট্রেনটি- ক্ষীণ একটা শেষ সুযোগ! না সেই সুযোগটিও আমাদের হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে। মৌমাছির যেমন আছে মৌচাক তেমনই কোনও নগরের নাগরিক, ভবঘুরে, নানা কিসিমের ব্যাপারী ও খেটে খাওয়া যত মানুষের আছে ষ্টেশন ও তার আশেপাশে গড়ে ওঠা শহরের মধ্যে আরেকটা শহর। সেই ভিড়, সেই কোলাহল ডিঙিয়ে যেতে পারিনি আমরা! শেষে উপায় না দেখে বাসে যাওয়াই স্থির হল। কিন্তু বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি সেখানেও মানুষের মেলা। অটো, রিক্সা, ট্র্যাফিক পুলিশ, বাসের লাইন, যাত্রীদের জটলা কাটিয়ে ব্যাগপত্র সমেত একটি গুমটি দোকানের সামনে, পান মশালার পিক সামলে, অপরিসর ড্রেন থেকে রাস্তায় তুলে রাখা ময়লা বাঁচিয়ে দলের সবাই আগে একটি জায়গায় জড় হলাম। দুপুরের পর আর কিছু টিফিন হয়নি। সবার মুখেচোখেই ক্ষুধা ও বিরক্তির এক মিশ্রিত ছাপ পড়েছে। হলুদ নিয়ন আলোয় সেই ছবি আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। সৃজা, অদ্রিজার হাত চলে যাচ্ছে দোকানের ডালা থেকে ঝুলে থাকা চিপসের প্যাকেটের দিকে। শিখা ট্রলিব্যাগের হাতলের সাথে সাথে ওদের হাত দুটিকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রিয়াংশু ফ্রুটি খাবার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে। এমনিতেই ছেলেটার ঠাণ্ডার দোষ, ঠাণ্ডা খেলেই গলা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে; তাই পূর্ণিমা তার ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে ছেলেকে ধমকাচ্ছে। বেচারির মুখটাও শুকিয়ে আছে; বিনসারে গিয়ে দুদিন জ্বরে ভুগেছিল। বিনসারের মেঘকুয়াশার কুহক সেও বুঝতে পারেনি ঠিকমতো। ফটোশ্যুটের উৎসাহে সোয়েটার ও চাদরকে সে অবহেলা করেছিল। তারই ফল ভুগতে হয়েছে। দেবশ্রী বৌদি ও দেবরূপা কোনও শিল্পীর ভাস্কর্যের মতো শান্ত স্থির হয়ে আছে। মৌসুমি মাসিমার হাঁটুর ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে কিন্তু বুঝতে দিচ্ছে না। গত চারদিন ধরে পাহাড়, গাছাপালা, পাখি, বনজঙ্গলের সবুজ প্রকৃতি দেখে দেখে অভ্যস্ত চোখের সামনে এই ইট-কাঠ-লোহা ও মানুষের জঙ্গল তার চেয়ে বেশি বিরক্তিকর লাগছে। যদিও সে এই শহুরে যাপনেই অভ্যস্ত। ষাটোর্ধ মাসিমা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মহিলা, শিশু ও সমাজ কল্যাণ দপ্তরের চাকুরী থেকে অবসরের পর খড়দহের ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। আমাদের ঘুরতে যাবার প্ল্যান শুনে তিনি চলে এসেছেন ফ্লাইটে করে। আর্থারাইটিসের সমস্যাটা তাকে মাঝে মাঝেই ভোগায়। সেই হাঁটুর ব্যথা নিয়েই আমাদের সাথে সমান তালে পাহাড় চষে বেড়ালেন, ছোটোখাটো একটা ট্রেকিং ও করলেন। কষ্ট হয়েছে ঠিকই তবুও আমাদের সঙ্গ, একসাথে আড্ডা-গান, তাকে সেই ব্যথা ভুলিয়ে রেখেছে। এই ক’দিনের পাহাড় ভ্রমণ তাকে একটা সুন্দর স্মৃতি দিয়ে যাবে। যদিও হরিদ্বারে গিয়ে মেয়ের কাছে কিছুদিন থাকার পরই তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠবে ইট-কাঠ-লোহার জঙ্গলের মাঝে শূন্য ফেলে রেখে আসা তার দু’কামরার বাসাটির জন্য, তার একফালি ঝুলন্ত বারান্দায় গড়ে তোলা সাধের বনসাইয়ের জন্য। যদিও পাশের ফ্ল্যাটে থাকা ছোটো বোনটিকে বলে এসেছে গাছগুলিকে প্রতিদিন জল দেবার জন্য, তবুও কতদিন হয়ে গেল নিজহাতে একটু ওদের দেখভাল করতে পারছে না। বিছানার পাশের টেবিলে তোয়ালে দিয়ে সযত্নে ঢেকে রাখা তার নিঃসঙ্গ অবসর যাপনের একমাত্র সহায় হারমোনিয়ামের রিডগুলি তাকে ডাকছে কাতর স্বরে। কবে গিয়ে তার গা থেকে ধুলো ঝেড়ে আবার বসবে গানের রেওয়াজ করতে। মাসিমাদের একটি ছোটো গানের দল আছে। মাঝে মাঝে এর ওর সোসাইটিতে গিয়ে ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে তারা। রোজ ফোন করে করে তারা মাসিমাকে আরও উতলা করে দেবে ঘরে ফিরবার জন্য।