সুপ্রিয় সেনের ‘দুই শত্রুর গল্প’: খালি পা বনাম বুটের লড়াইয়ের এক মর্মস্পর্শী আখ্যান – পারমিতা রায়
না, এ আখ্যান ১৯১১-র সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের কাহিনিনির্ভর নয়, এমনকি শহর কলকাতার কোনো ময়দানি গল্পও নয়। এ আখ্যানের পটভূমি পূর্ব বাংলার কুমিল্লা শহর। বিশিষ্ট ক্রীড়াসাংবাদিক এবং ক্রীড়াসাহিত্যিক সুপ্রিয় সেন নিজে কুমিল্লা শহরের সন্তান ছিলেন। এখানেই তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩২ এ। ফলে তিরিশের শেষ থেকে গোটা চল্লিশের দশক পর্যন্ত কুমিল্লার মনোরম ছবি ফুটে ওঠে তাঁর লেখালেখির ভিতরে। কুমিল্লা শহরটি পরিচিত ছিল ‘ব্যাংকস, ট্যাংকস আর ট্রিজ’-এর শহর নামে। ব্যবসা বাণিজ্য, ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় যেমন এ শহর অগ্রণী ছিল, পাশাপাশি গাছপালা আর বড়ো বড়ো জলাশয়ে ঘেরা এই সবুজ শহরটিতে সাহিত্য, গান-বাজনা আর খেলাধুলারও দারুণ চর্চা ছিল। তিরিশের দশকের গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, শচীন দেব বর্মণ–সবাই এই শহরের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। অদ্বৈত মল্লবর্মণ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী এই শহরের সন্তান। ফুটবলে সূর্য চক্রবর্তী, প্রমোদ দাশগুপ্ত, পাখি সেন সবাই খেলা শিখেছিলেন এবং খেলেছিলেন এই কুমিল্লার মাঠেই। তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ লাগেনি এ শহরের গায়ে। এর মাঠেঘাটে স্কুলে কলেজে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি তখন রমরমিয়ে চলছে। খেলার মাঠে ঈশ্বর পাঠশালার সঙ্গে জেলা স্কুলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলত সেসব দিনে। ওদের মধ্যে খেলা পড়লে গোটা শহর দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে যেত। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি সব খেলারই লিগ হত কুমিল্লায়। আর বিশেষত ফুটবল খেলা ছিল যেন এই শহরের প্রাণের খেলা। ছোটো মাঠে ছোটো ছেলেরা খেলত সেভেন এ সাইড টুর্নামেন্ট। তারা খেলত হ্যাপি ক্লাব, বাদুড়তলা স্পোর্টিং, মোগলটুলি বয়েজ, বাগিচাগাঁও অ্যাথলেটিক্স, সেভেন জুয়েলস ক্লাবের হয়ে। একটু বড়ো হলে স্কুলের বড়ো মাঠে তারা পা পাকাতো আর লক্ষ রাখত শহরের বড়ো বড়ো ফুটবল ক্লাবের দিকে। সেইসব ক্লাব থেকে কবে ডাক আসবে সাগ্রহে অপেক্ষায় থাকত ছেলের দল। সেইসময় কুমিল্লার বড়ো ক্লাবগুলোর মধ্যে বিখ্যাত ছিল ইয়ংম্যানস ক্লাব, ইউনিয়ন ক্লাব, মহামেডান স্পোর্টিং, ইউনাইটেড ফ্রেন্ডস, ভিক্টোরিয়া কলেজ আর কান্দিরপাড় ইলেভেন। জমজমাট লিগের আসর বসত ধর্মনগরের মিলিটারি মাঠে। বিশেষ বিশেষ খেলায় শহর ভেঙে পড়ত মাঠে। তখন চারদিক টিন আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হত। খেলা দেখার দর্শনী ছিল এক আনা। সুপ্রিয় সেন পরম মমতায় ফুটবলকে ঘিরে কুমিল্লার মানুষের জীবনযাপনের যে ছবি এঁকেছেন সেই ছবিতেই ভিন্ন রং লাগে যখন মিলিটারি দলের সঙ্গে মাঠে লড়াই শুরু হয় ঘরোয়া দলগুলোর। ১৯১১-র আঁচ লাগে যেন পুব বাংলার এই ছোট্ট শহরে। বুটের সঙ্গে খালি পায়ের এই লড়াই কেমন করে দানা বাঁধল, কী-ই বা হল শেষে–এসব নিয়েই রচিত হয়েছে সুপ্রিয় সেনের মরমি উপাখ্যান ‘দুই শত্রুর গল্প’।
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবার আক্রমণ করল জাপান। এর পরই অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল আমেরিকা। এদিকে সিঙ্গাপুরের পতন হল। বার্মার অনেকটাই দখল করে নিল জাপান। যুদ্ধ চলে এল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান উপনিবেশ ভারতবর্ষের দোরগোড়ায়।দেশে দুর্ভিক্ষ এসেছে। যুদ্ধের ফলে বাজারে আগুন।কুমিল্লার দরিদ্র মানুষগুলি দু-বেলা জাউ খেয়ে কোনোমতে বেঁচে বর্তে আছে। আশপাশের গ্রাম থেকে কঙ্কালসার মানুষেরা শহরের পথে পথে ভিক্ষে করছে আর ভিক্ষা না পেয়ে মরছে। সমস্ত শহরটার দখল নিয়ে নিয়েছে মিলিটারি। সকলের চোখের সামনে রাতারাতি পাালটে যাচ্ছে শহরটা। আগে ছিল সুরকির রাস্তা। এখন ঝকঝকে তকতকে পাকা রাস্তা। বিরাট বিরাট মিলিটারি ট্রাক, জিপ, এমনকি ট্যাঙ্কও অনবরত চলাচল করছে রাস্তায়।লালমুখো ব্রিটিশ টমি, আমেরিকান নিগ্রো এবং ভারতীয় সৈন্যের ভিড় চারিদিকে। শহরের সব স্কুল, বড়ো বড়ো বাড়ি মিলিটারিরা নিয়ে নিয়েছে। মূল শহর থেকে ছ’মাইল পশ্চিমে ময়নামতীতে রাতারাতি তৈরি হয়েছে মিলিটারি বেস। শহরের প্রান্তে তৈরি হয়েছে এয়ারপোর্ট। অনবরত প্লেন নামছে আর উঠছে। নানান জায়গায় বসেছে অ্যান্টি এয়ারক্রাফটের ব্যাটারি। শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে লাগানো হয়েছে সাইরেন। রাস্তার ধারে কাটা হয়েছে ট্রেঞ্চ। এই যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের দিনে কোথায় ফুটবল! কোথায় খেলাধুলোর সেই চেনা ছন্দ!
দিন কেটে যায়, বছর ঘুরে যায়। রণাঙ্গনের অবস্থা ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে। রুদ্ধ হয়েছে জাপানিদের অগ্রগতি।শহরের রাস্তায় যেসব নিরস্ত্র কঙ্কালসার ভারতীয়দের মূর্তিগুলো দেখা যেত এখন আর তাদের চোখে পড়ে না। ইতিমধ্যে অবশ্য কলকাতায় বোমা পড়েছে, চট্টগ্রামের বন্দর পতেঙ্গাতেও। তবু মানুষের মন থেকে ভয় কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে চাইছে শহরবাসী। যদিও স্কুল কলেজ এখনও মিলিটারিতে ভর্তি।ঈশ্বর পাঠশালা চলে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কলেজ আর জেলা স্কুল স্থানান্তরিত হয়েছে শহর থেকে তিন মাইল দূরে কালিয়াজুরিতে। দেওয়ানি আদালত গেছে দৌলতগঞ্জে।বিনোদনমূলক সমস্ত কার্যাবলী এখনও বন্ধ রয়েছে। বন্ধ গ্রেট ভারনেল থিয়েটারের নাটক। চালু হল শুধু খেলা।সুপ্রিয় সেন লিখছেন “একটি মাত্র আনন্দের জানালা।” শুরু হল ফুটবল লিগ, শহর ভেঙে পড়ল মাঠে। এইবারের কুমিল্লা লিগ শুরু থেকেই দারুণ জমে গেল। কারণ এবারের লিগে যোগ দিল বেশ কয়েকটি মিলিটারি টিম।বিভিন্ন ব্যাটেলিয়ান থেকে দল গঠন করা হয়েছে।কনস্ক্রিপশন বা বাধ্যতামূলক ভাবে সৈন্যদলে নাম লিখিয়ে যারা যুদ্ধে নাম লিখিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই একসময় নিয়মিত ফুটবল খেলত। এমনকি অনেকে পেশাদারও ছিল। ফলে ময়নামতী বেস থেকে মোট চারটি দল তৈরি হয়ে গেল। ইনফ্যান্ট্রি ইলেভেন, এম ই চার্জারস, স্টাকাটো আউটকাস্ট এবং আর এ এফ উইংস। এতদিন ধরে চলা যুদ্ধ এই সৈন্যদের শরীরের থেকেও মনকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। উপরন্ত তারা কোনো জাপানি শত্রুকে আজ অবধি চোখে দেখেনি। ‘শত্রু’ বললে কোনো অবয়ব তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। যেন একটা বিমূর্ত ধারণার বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। তারা তো ইংল্যান্ডে নিয়মিত ফুটবলটাই খেলত। এখন এতদিন পরে ফুটবল মাঠের হাতছানি তাদের জীবনকে যেন নতুন করে সাজিয়ে তুলল, কারো কারো বুট ছিল, কারো ছিল না। পায়ের মাপ চলে গেল কলকাতায়। এক সপ্তাহের মধ্যে সবার বুট চলে এল। চুটিয়ে শুরু হল প্র্যাকটিস। তারা নিজেদের মধ্যে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলা শুরু করল। বোঝা গেল আর এফ এ উইংস আর স্টাকাটো দুর্ধর্ষ দল তৈরি করেছে।
চারিদিকে গুলিগোলা, সাইরেন আর ব্ল্যাক আউটের মধ্যে এই যে লিগ শুরু হল কুমিল্লায়, এই আয়োজন যেন প্রমাণ করে দিচ্ছে যুদ্ধ সর্বগ্রাসী নয়, যুদ্ধ সব কিছু কেড়ে নিতে পারে না। যুদ্ধের ফাঁকফোকর দিয়ে মানুষই তৈরি করে নিতে পারে বেঁচে থাকার ফন্দিফিকির। ফুটবল লিগ তো কুমিল্লা শহরের গৌরব ছিল। এইবার দেশি টিমের পাশাপাশি মিলিটারি দলগুলো যোগ দিতেই প্রতিযোগিতা একটা অন্য মাত্রা পেয়ে গেল। স্থানীয় দল ছটা আর চারটে মিলিটারি টিম নিয়ে শুরু হয়ে গেল লিগ। মিলিটারি টিমগুলো মাতিয়ে দিল তাদের ইওরোপীয় ফুটবলে। এ শহরের লোক এ ধরনের খেলা আগে দেখেনি। জ্যামিতির ছকে ডবলু এম সিস্টেমে এক ছন্দোবদ্ধ ফুটবল উপহার দিয়ে যাচ্ছে তারা। স্থানীয় দলগুলো ঠিক যেন এঁটে উঠতে পারছে না তাদের সঙ্গে। আলোচনা চলে চায়ের দোকানের আড্ডায়। তাহলে কি বুট-পরা মিলিটারি দলের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেবে খালি পায়ে খেলা স্থানীয় দল। নিজের অজান্তেই এই লিগ যেন একটু একটু করে কলকাতা ময়দানের সেইসব যুদ্ধের পূর্ববঙ্গীয় সংস্করণ হয়ে উঠছে। স্থানীয় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল। বুট সম্পর্কে ভয়। মিলিটারি দলগুলির সঙ্গে খেলতে গেলেই প্রথম দু-একটা চার্জের পর তারা কেমন গুটিয়ে যাচ্ছিল। খেলাটা ধরতেই পারছিল না। ফলে শোচনীয় ফলাফল হতে লাগল।ব্যতিক্রম শুধু ইয়ংম্যানস ক্লাব আর নতুন দল এ আর পি। এ আর পি-র অধিনায়ক ধীরেশ সেন ভয়ানক মারকুটে খেলোয়াড়। তার দলের খেলোয়াড়রাও খালি পায়েও অকুতোভয়, কাউকে রেয়াত করে না। এরা উলটে বুট-পরা সাহেবদের ঠেঙাতে লাগল। তবে শেষ পর্যন্ত এ আর পি পারল না। চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে থাকল ইয়ংম্যানস ক্লাব। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আর এ এফ উইংস। রবিবার এই দুই দল পরস্পরের মুখোমুখি হবে। সেটিই ঠিক করে দেবে কে হবে লিগের সেরা দল। এই ম্যাচের তিনদিন আগে থেকেই শহর গরম হয়ে উঠতে লাগল। কুমিল্লার সম্মান তথা দেশের সম্মান রক্ষার কাজ ইয়ংম্যানস এর উপরই বর্তাল। বিশেষ করে ইয়ংম্যানস এর সেরা অস্ত্র বলাই দাসকে নিয়ে কুমিল্লাবাসীর অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন। লিগের শুরু থেকেই টুর্নামেন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা সুরা দত্ত বলাইকে তাতায়। বলে ‘তোরা তো খেলবি খালি পায়ে। পারবি না।’ বলাই জবাব দেয়, ‘১৯১১ সালে সাহেবদের হারিয়েছে তো মোহনবাগান।’ সুরা দত্ত বলে ‘কোথায় মোহনবাগান আর কোথায় তোরা। কোথায় শিবদাস ভাদুড়ি, অভিলাষ–আর কোথায় বলাই দাস।’ বলাই আর একটা উদাহরণ দিয়েছিল–ঢাকাতে করিন্থিয়ানসকে হারিয়েছে। এই উদাহরণগুলো বলাইদের কাছে প্রেরণাস্বরূপ, সমর্থকদের কাছেও। রবিবারের নির্ণায়ক ম্যাচের আগে বলাই রাস্তায় বের হলেই সবাই ছেঁকে ধরে– ‘বলাইদা, সাহেবদের হারাতে হবে। ওদের সেন্টার হাফটা দারুণ খেলে।’ বলাই আর এফ এ উইংসের সেন্টার হাফের খেলা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। দুর্দান্ত খেলোয়াড়। নাম স্টিভ ম্যাককুইন। বলাইও অন্যদের মতো সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের প্রতিনিধি হিসেবেই স্টিভকে দেখতে চায়, তাকে শত্রু বানাতে চায়। কিন্তু তারও পরে বলাইয়ের এটা মনে হয় যে শত্রুতার জায়গা অন্যত্র, তাকে খেলার মাঠে টেনে আনাটা ঠিক নয়। এখানে যে শত্রুতা সেটা দুই বিপক্ষ খেলোয়াড়ের শত্রুতা। খেলার কৌশল প্রয়োগ করে একে অপরকে হার মানাবার শত্রুতা। খেলা শেষ হয়ে গেলে করমর্দনের মধ্য দিয়ে সে শত্রুতা মিটে যাবে। সুপ্রিয় সেন বলাইয়ের এই চিন্তাধারার ভিতর দিয়ে ক্রীড়াসাফল্য বনাম জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ এই দুটি ধারা নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তাকে খানিক উসকে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি তিনি স্টিভের দলের অধিনায়ক রবিনস এর মনোভাবটিও ব্যক্ত করেছেন। রবিনস যুদ্ধের আগে ইংল্যান্ডে পেশাদার দলে খেলত। তার কাছে খেলা মানেই একটা যুদ্ধ। তাই স্টাকোটার বিরুদ্ধে ইয়ংম্যানস এর সেন্টার ফরোয়ার্ড বলাই এর খেলা দেখে রবিনস খুবই চিন্তিত হয়ে উঠল। সে আশঙ্কা করল তাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে বলাই। স্টিভ কিন্তু বলাইয়ের খেলা উপভোগ করছিল রীতিমতো। মাঠে বলাইকে কালো পাথরে খোদা ডেভিডের মতো সুন্দর লাগছিল তার, বলাই যেন তার ব্ল্যাক ডেভিড। পুব বাংলার প্রত্যন্ত অখ্যাত অবজ্ঞাত একটি ছোট্ট শহরে বলাইয়ের এই ফুটবল সে বা তার সহখেলোয়াড়রা প্রত্যাশাই করেনি। রবিনসের যুদ্ধং দেহি মনোভাব স্টিভের মধ্যে সঞ্চারিত হয়নি, আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হতে পারে, কিন্তু ম্যাচের দিন বলাই যখন লাফিয়ে উঠে ভলি করে তার দ্বিতীয় গোলটা করল সেই মুহূর্তে কি স্টিভ তার উদার মনোভাব বজায় রাখতে পারল? গোল রোখার জন্য স্টিভ সবুট পা চালিয়েছিল বলাইয়ের তলপেটে আর সে কাটা পাঁঠার মতো মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারায়। হাসপাতাল থেকে খবর আসে, মুখে মুখে খবর ছড়ায় বলাই বুঝি আর বাঁচবে না। হাফটাইমে আত্মসমীক্ষায় বসে স্টিভ। তবে কি বলাইকে রুখতে পারছিল না বলে ইচ্ছে করেই মারল সে।নিজেকে প্রশ্ন করে সে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হলে বোঝা যায় ইয়ংম্যানস তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। পরপর দুটো গোল খেয়ে যায়। ম্যাচ অমীমাংসিত থাকে। দু-দলের সমান পয়েন্ট। ঠিক হল সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে। এরপরই কাহিনির মোড় ঘুরে যায়।
স্টিভ আর রবিনস এর ব্যবস্থাপনায় বলাইকে ময়নামতীর কমান্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওর ব্লাডারে ক্ষতি হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। আর্মির বড়ো সার্জন অপারেশন করেন, বলাই বেঁচে যায়। দুদিন পর বলাইয়ের জ্ঞান ফেরে, এই দুদিন স্টিভ হাসপাতাল থেকে নড়েনি। বলাইয়ের হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে স্টিভ ক্ষমা চায়। বলাই খুব তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে। আবার খেলায় ফেরে। স্টিভ ময়নামতীর মিলিটারি স্টোরে বলাইকে একটা চাকরিও জুটিয়ে দেয়। গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। সে সম্ভাবনা যথেষ্ট ছিল। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কুমিল্লার ফুটবল চর্চার এক বিশ্বস্ত ছবি উঠে আসত যা অখণ্ড বাংলার ফুটবল ইতিহাসকে বুঝে নিতে সহায়ক হত, শুধু সেইদিক থেকেই এই আখ্যানটি খুবই মূল্যবান হত। পাশাপাশি মিলিটারি দল আর স্থানীয় দলকে ঘিরে লিগের নতুন সমীকরণ একটা ছোট্ট শহরকে কীভাবে উদ্বেল করতে পারে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারত এই কাহিনি। পাশাপাশি বলাইয়ের জীবনরক্ষার ক্ষেত্রে স্টিভ এবং সার্বিকভাবে মিলিটারিদের ভূমিকার মানবিক কাহিনি হিসেবে এই আখ্যানটি বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এই সব কিছুকে ছাপিয়ে ‘দুই শত্রুর গল্প’ এক অভিনব সমাপনের দিকে এগিয়ে গেল।
সুপ্রিয় সেন এই আখ্যানের একেবারে শেষ পর্বে খালি পা আর বুটের মধ্যে যেভাবে মেলবন্ধন ঘটাতে চাইলেন তার রেশ সহজে মুছে যাবে না। এই মেলবন্ধন মূলত ঘটিয়েছে স্টিভ। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের মালীর ছেলে বলাই গোটা শহরের মানুষের কাছ থেকে খেলা দেখিয়ে সম্মান আদায় করে নিতে যে পেরেছিল এ তো মোটামুটি চেনা ছকের গল্প। কিন্তু স্টিভ, যে কিনা লন্ডনের বিশাল বড়ো ডাক্তারের ছেলে, একাধারে ফুটবলার এবং শিল্পী সে যখন বলাইদের অপরিসর বাড়িতে একটা ভাঙা টুলে বসে টিনের মগে চা খায় আর পকেট থেকে চকোলেট বের করে বলাইয়ের ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে খুনসুটি করে তখন যেন লন্ডন থেকে কুমিল্লা একই সরলরেখায় মিলেমিশে এক অপার্থিব ‘খেলা’ দেখায়। ১৯৪৫ এ জাপান যখন আত্মসমর্পণ করল তখন থেকেই ময়নামতীতে শিবির গোটানোর পালা শুরু হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরে স্টিভও ফিরে যাবে নিজের দেশে। সে আর খেলবে না, এবার সে ছবি আঁকা নিয়েই থাকবে। কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ বলাইয়ের পায়ে এখনও তো অনেকদিন খেলা আছে। বলাইকে নিয়ে লন্ডনে যেতে চায় স্টিভ। তাকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। অনেক রাতে তাদের বেড়ার ঘরের দাওয়ায় একটা মোড়া নিয়ে বসে বলাই। কামিনী ফুলের গন্ধে ম-ম করছে চারিদিক। কত কী ভেবে চলে বলাই। তার ভাইবোনেরা ক্লাস থ্রি-ফোর পর্যন্ত পড়েছে। পয়সার অভাবে আর পড়তে পারেনি। এখন বলাইয়ের রোজগারে তাদের দুবেলা খাবার জোটে। বৃদ্ধ বাবা, রোগাক্রান্ত মা, ছোটো ভাইবোনকে ফেলে কোন্ স্বপ্নের মরীচিকার পিছনে ছুটবে বলাই। অবশ্য খালি পায়ের এই লড়াই কতদিন চালাতে পারল সে, কে তার খবর রাখে! স্টিভের সঙ্গে সে দেশত্যাগ করেনি ঠিকই, কিন্তু তার দু-বছর পর, কিংবা তারও পরে সে কি তার ভিটে, তার স্বজনকে আঁকড়ে, দেশে থাকতে পেরেছিল? জানা যায় না তা, তবে জানার তৃষ্ণা থেকেই যায়।