টেবিল নং পি১৪-৩ – আর্যনীল মুখোপাধ্যায়
বারীন ঘোষালের সাথে আলাপ আঠাশ বছর আগে। ১৯৮৯য়ের জুন মাস। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে জামশেদপুরে টেলকো (বর্তমানে টাটা মোটোর্স) তে চাকরি করছি। বছরখানেক কেটেছে। লিটিল ম্যাগের সাথে কোনোকালেই যোগাযোগ নেই। বাড়িতে, বৃহত্তর পরিবারে অনেক লেখক/কবি। তাঁরা সব হয় আকাদেমিক কাগজে লেখেন নয় বানিজ্যিক পত্রপত্রিকায়। কেউ কেউ কিংবদন্তী, যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু এক নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে আমার হাতে কৌরব পত্রিকা পড়েছে ইতিমধ্যেই। অনেক আগেই।
১৯৮১ সালে, ১৭ বছর বয়সে। মদে চুর ও সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন, প্রস্রাবে সোফা ভিজিয়ে দুর্গন্ধ ক’রে ফেলা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সামনে এক দুপুরে ব’সে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ লক্ষ্য করি ভদ্রলোকের হাত থেকে কী একটা বই, কালো রঙের, মাটিতে কার্পেটের ওপর। হয়তো হাত থেকে পড়ে গেছে। বইটা তুলে দেখি পত্রিকা, নাম ‘কৌরব’। খুলে পদে পদে বিস্ময়! চাঁদিপুর ক্যাম্প সংখ্যা। সাহিত্য এইরকম হয় নাকি! কোনো ধারণাই ছিলো না। দেখি কবিদের নাম অচেনা – স্বদেশ সেন, কমল চক্রবর্তী, শংকর লাহিড়ী, বারীন ঘোষাল, দেবজ্যোতি দত্ত, যাদব দত্ত প্রমুখ। পত্রিকার নামাঙ্কন করেছেন কমল স্যার (কমলকুমার মজুমদার), আমাদের স্কুলের শিল্পশিক্ষক। পরপর আরো কয়েকটা সংখ্যা পড়ে ফেললাম। এইভাবেই, আমার জীবনের প্রথম ক্ষুদ্রপত্রিকা ‘কৌরব’। তার সাহিত্যের আলোয় এতটা ঝলসে, সেঁকে উঠেছিলাম সম্পূর্ণ একা একাই, সেই বয়সে, যে আর কোনো বাংলা পত্রিকাকেই পরবর্তীকালে, সৃষ্টিশীল বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর ওপরে রাখতে পারিনি।
ক’বছর পর কৌরব পত্রিকার জন্মক্ষেত্র জামশেদপুরে গেলাম চাকরিসূত্রে। বন্ধু অনিরুদ্ধ দত্ত কাজ করতো ফাউন্ড্রি ডিভিশনে। সেখানেই ড্রাফটস্ম্যান ছিলেন কমল চক্রবর্তী। অনি জানতো আমি কৌরব পত্রিকা পড়েছি, নিজেও লেখালিখি করি যদিও কোথাও পাঠাই না। ২৩-২৪ বছরের তরুণ তখন। সে সাধাসাধি করতে থাকে কমলদার সাথে আলাপ করার জন্য। শুনি কমলদাও দেখা করতে ইচ্ছুক। ৫-৬ বার বলার পর একদিন যাই। আলাপ হয় কমলদার সাথে। বারীন ঘোষালের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে আগামী শনিবার আসতে বলেন।
টেলকো কলোনীর যে প্রান্তে আমার কোয়ার্টার, বারীন ঘোষালের ঠিকানা দেখি তার বেশ কাছাকাছি। আমার ফোন ছিলো না, তাই কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। এক বিকেল শেষে হাজির হলাম। একতলার ফ্ল্যাট, ঠিকানা পি১৪-৩। ছায়াচ্ছন্ন একটা নির্জন রাস্তার ওপর। বেল বাজাতেই একজন ভদ্রলোক খুলে দেন, নাম বলি (পরে আলাপ হলে জানতে পারি ইনিই শংকর লাহিড়ী), ভদ্রলোক ভেতরে গিয়ে ফ্ল্যাটের মালিককে ডাকেন। গম্ভীর প্রকৃতির এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন, আমার চেয়ে অনুচ্চ, শক্ত চেহারা, গোঁফ-দাড়ি নেই, শার্ট ও পাজামা পরা। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন – ‘আপনি অমুক? আমি বারীন, বারীন ঘোষাল। আসুন’।
বারীন ঘোষালের চৌকাঠ পেরিয়ে সেই আমার প্রথম প্রবেশ, কৌরবে। প্রথম সন্ধের কবিতা, যা পড়লাম, বাকি সবাই অনুপ্রেরণা দিলেও বারীন চুপচাপ রইলেন। একবার শুধু বললেন – ‘কাউকে উদ্দেশ্য করে কবিতায় কথা বলতে ভালোলাগে আপনার?’। সচেতন হয়ে গেলাম এ সম্বন্ধে। ফিরে গিয়ে একটা গদ্য লিখি। যাকে পরে বারীনদাই ‘মুক্তগদ্য’ বলেন। Free, creative prose। সেটা পরের শনিবার পড়ি। সকলেই সহর্ষ অভিবাদন জানায়। বারীনদা উঠে এসে হাতটা টেনে ধরেন। সেদিন থেকেই বুঝতে পারি আমি এই গোষ্ঠীতে দীক্ষা পেলাম। আঠাশ বছর পর আজো সেখানেই রয়ে গেছি।
আজো মনে হয় ১৯৮৮-১৯৯২ বারীনদার সাহিত্য ও সমাজ জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়,যে সময়টায় বারীন ঘোষাল নিজেকে গদ্যে, প্রবন্ধে, কবিতায়, আন্দোলনে, যোগাযোগে, বন্ধুত্বে এক নতুন, অনাস্বাদিত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, এবং প্রয়াতা স্ত্রী ও শিশুপুত্রের (যে মামাবাড়িতে দিল্লীতে বড় হচ্ছিলো) অভাবের আবেগকে তাড়িয়ে নিয়ত সৃষ্টিশীলতায় ভরিয়ে দিচ্ছিলেন সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা। ঠিক সেই সময়েই বারীনদাকে খুব কাছ থেকে বহু সন্ধ্যায় দেখতে পাওয়া (জামশেদপুর, কলকাতা, খড়গপুরে), ওঁর সাথে সাক্ষাত আলোচনা, আমার নিজের কবিতাভাবনা ও বিশেষ করে কবিতাদীক্ষার জায়গাটা গড়ে দিতে পেরেছিলো।
১৯৯০য়ের গোড়াতে কিছু খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে বারীনদার জীবনে। এবং এর একটা ঘটনায় অনুঘটকের ভূমিকা পালন ক’রে আমার খুব ভালোলেগেছিলো। বারীনদার ঘনিষ্ঠ সঙ্ঘ ছড়াতে ও পালটাতে শুরু করে। এর পূর্বে বারীনদা মূলত কৌরব গোষ্ঠী, জামশেদপুর এবং তার বাইরে কয়েকজন ছাড়া আর খুব একটা যোগাযোগ রাখতেন না। কলকাতার সাহিত্যবৃত্তের সাথে ওঁর যোগাযোগ কোনোকালেই তেমন গাঢ় ছিলোনা। অন্যান্য জেলার সাথেও তেমন না। এগুলো বাড়তে থাকে ১৯৯০ সালের পর থেকে। এবং এমন একটা জায়গায় পৌঁছয় যে আজ বাংলা কবিতা লিখে বারীন ঘোষালকে না চেনা অশিক্ষার পরিচায়ক।
১৯৯০ সালের কলকাতা বইমেলায় ‘আলাপ’ পত্রিকার সম্পাদক ধীমান চক্রবর্তীর সাথে আমার পরিচয় হয়। ধীমানদা বলেন – ‘আমাদের টেবল-স্পেস থাকে মেলার সময়, তুমি কিছু লেখা দিতে পার’। আমি ধীমানদাদের পরের যুগের লোক। প্রায় বছর দশেকের ছোট। কবিতা দিই। চিঠিপত্র জারি থাকে। তারপর একদিন ধীমানদাকে জামশেদপুরে আমন্ত্রণ জানাই। আসার সময় ধীমানদা জানতে পারেন ষাট দশকের কবি অভী সেনগুপ্ত ও অশোক চট্টোপাধ্যায়ও জামশেদপুরে যাচ্ছেন। ওখানে কবিতা ক্যাম্প হবার কথা। জয়দা বলে একটা জায়গায়। ধীমানদা ওদের সাথে জামশেদপুরে আসেন। আমার বাড়িতে প্রথম রাত। সন্ধ্যায় বারীনদার পি১৪-৩ য়ে আড্ডা, কবিতাপাঠ। পরের দিন জয়দায় কৌরব ক্যাম্প। স্বদেশ সেন ছিলেন, শংকর লাহিড়ী। কমলদা কোথা থেকে একটা সাইকেল নিয়ে এসে সেটা চড়ে ঘুরতে থাকেন বাংলোর চারপাশে শিশুর আনন্দে। আমার সাথে টানাটানি হয় সাইকেল নিয়ে। সে রাতে বড়রা প্রচুর মধ্যপান করেন, কবিতাপাঠ হয় যদিও, আলোচনা হয়, কমলদা আমায় দেখিয়ে দেন কীভাবে টেপ করতে হবে, কীভাবে এডিট। আলোচনায় উত্তেজনার ঢেউ লাগে। স্বদেশদা অসামান্য কবিতা পড়েন। আমি টের পাই আমার কবিতাধারণা আস্তে আস্তে এক আশ্চর্য আকৃতি নিচ্ছে।
এরপর থেকেই ধীমানদার সাথে যোগাযোগ বেড়ে যায় বারীনদার। আলাপ গাঢ় হ’তে থাকে ক্রমে ক্রমে ওঁর বন্ধুবৃত্তের সাথে – শুভঙ্কর দাশ, প্রণব পাল, রঞ্জন মৈত্র (যিনি পূর্বেই সত্তর দশকে লিখেছেন কৌরবে), অলোক বিশ্বাস, রামপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, স্বপন রায়, প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায়, নৃসিংহমুরারী দে প্রমুখ। ৮৮র পূর্বে বারীনদার দুটি মাত্র ক্ষীণকটি কবিতার বই। ৮৮ সালে বেরয় ‘মাটাম’ – বাংলা সাহিত্যের এক অতুলনীয় ‘নারীবাদী’ উপন্যাস। ৯০ সাল থেকেই ‘অতিচেতনা’র ধারণা দানা বাঁধতে থাকে বারীনদার মাথায়। এলাহাবাদ ঘুরে আসেন কমলদার সাথে। ত্রিবেণী সঙ্গমে এক করুণ, নিষ্ঠুর দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে দীর্ঘকবিতা ‘সৎকার’ এর জন্ম হয়। সেই কবিতা প্রথম পড়া হয় পি১৪-৩ য়ের টেবিলেই। সেদিন আমিও ছিলাম। আমরা হতবাক হয়ে যাই। কবিতার এক কণাও বুঝিনা। পরের সপ্তাহে আমায় বারীনদা অভিজ্ঞতার কথাটা বলেন, কবিতার কিছু শব্দ বুঝিয়ে দেন। জিজ্ঞেস করেন
-‘ত্রম্বক’ মানে জানিস?
-না বারীনদা
-‘ত্রম্বক’ হলো শিবের একটা নাম
-কিন্তু ‘ত্রম্বক’ কেন এলো এখানে?
বারীনদা বোঝাতে থাকেন। ৯০ বা ৯১ সালে ‘সৎকার’ বইটা বেরয় বইমেলায়। তখনো কৌরব স্টল দিতো না মেলায়। সেই শুরু। দু বছর পর বেরয় বারীনদার চতুর্থ কবিতার বই ‘হাশিস তরণী’। অতিচেতনার কবিতার উজ্জ্বল উদাহরণ বহন করে সে সব লেখা। ক্রমে ক্রমে আমরা এক প্রলিফিক, বিধর্মী, সৃষ্টিশীল সাহিত্যিককে পাই যিনি সারাজীবন ছোটো পত্রিকায় লিখে গেলেন এবং কখন যেন পৌঁছে গেলেন এক উত্তুঙ্গ বেদীতে, যেখান থেকে তাঁকে টেনে নামানোর মত শক্তি কোনো ভারতীয় সাহিত্যিকের নেই।
সর্বদা মিথবিরোধী বারীনের জীবনে কেবল একটা ট্রাজেডি রয়ে গেল। তিরোধান তাঁকে সেই মিথের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।