ভাষা, রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদ – সাম্যজিৎ গাঙ্গুলী

শেয়ার করুন

বন্ধুমহলে আমার ‘গন্ডারের চামড়া’ বলে দুর্নাম আছে। না, ভীষণ কষ্টসহিষ্ণু বা দু’কান-কাটা নির্লজ্জ, কোনোটাই নই। গন্ডার যেমন কাতুকুতু দিলে দু’মাস পরে হাসে, তেমনই আমারও সাড়া জাগে একটু দেরিতে। আর সত্যি বলতে, কিছু ঘটনার বেআব্রু হিংস্রতা আরও ভোঁতা করে দেয় মাথা, কলম দুটোকেই। তাই, প্রায় দুমাস পুরোনো, আপনাদের বিচারে একটা পুরোনো কাসুন্দি-ই টেনে আনলাম। বিরক্ত হলে মার্জনা করবেন। নিজেকে শুধরাবো। কুপিত হলেও জানাবেন, নিজেকে অভিনন্দন জানাব।

রাজ্যের নাম আসাম। গ্রামের নাম সিপাঝাড়। প্রকৃতিতে, কাঠামোয়, চেহারায় সেই গড়পড়তা ভারতীয় গ্রাম। কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। ঘটনাটাও নেহাতই সাধারণ। বাড়াবাড়িরকমের বাড়াবাড়ি নয় কিছুতেই। সরকারি জমি জবরদখল করে ছিল কজন। ‘ভিখারির বাচ্চা সরকারটা কী তোর বাপের?’, হুঙ্কার ছাড়ে রাষ্ট্রের পেয়াদারা। হইহই রবে ঘিরে ফেলে চারদিকে। আর তারপর, উচ্ছেদ কর্মসূচি। একটুও অন্যায় নয়। জমির মালিকানা জনতার সরকারের। তাই জনতাকে সেখানে থাকতে দেওয়া হবে কেন? এবার কথা হল, গেঁয়ো গরিবরা মাঝেমাঝেই গোঁয়ার হয়। ভীষণ রকমের গোঁয়ার। তাই কয়েকজন এগিয়ে গেল সামনে। তাদের মধ্যে একজন পাগলা জগাইয়ের মতো লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে চলেছে, খালি গায়েই প্রবল বিক্রমে। পুলিশের বীরপুঙ্গবদের হাতে রাইফেল, গায়ে বর্ম। বেচারাকে ঘিরে ফেলতে লাগল কয়েক মুহূর্ত মতে। আর তারপর গুলির শব্দ। এবং, লাল হয়ে গেল সবুজ মাঠ। পুলিশের চক্রব্যূহ একটু হালকা হল। এবং মৃতদেহের উপর সরকার-নিযুক্ত ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার বিজয় বানিয়ার উদ্দাম নৃত্যের জন্য ময়দান খালি। নাঃ, এসবে আশ্চর্য হবার কোনো জায়গা নেই। এরকম লাশের উপরে নৃত্য অনেককাল চলেছে, ভবিষ্যতেও বহু বহু বছর ধরে চলবে। মৃত ‘জবরদখলকারী’-র নাম মইনুল হক। সরকারি খাতায় বিদেশি অনুপ্রবেশকারী, ‘illegal encroacher’। এদের অস্তিত্বই বেআইনি। তাই, এদের নিয়ে বন্দুকের টিপ প্র্যাকটিস করা হোক বা লাশের উপর ‘নাঙ্গা নাচ’, সবই জায়েজ। তাই, লেখার বিষয় মোটেই এই ঠান্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডটি নয় (এসব নিয়ে স্রেফ লেখালেখি কতদূর লাভজনক, তাই নিয়ে আমি বহু যুগ যাবৎ সন্দিহান)। বরঞ্চ, এই মানুষের অস্তিত্বটাই বেআইনি হয়ে যাওয়ার পিছনের পিচ্ছিল পথটা, সেই ভাষার রাজনীতিকে দেখার জন্যই এই লেখার অবতারণা।

জার্মান ভাষাবিদ ম্যাক্স ওয়াইনরিখ ঠাট্টা করে ভাষার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, “ভাষা হল এমন একটা উপভাষা যার সেনা ও নৌবহর আছে।” আসল তামাশাটা হল এই যে ওয়াইনরিখের ঠাট্টাটা আদপেই মিথ্যে নয়, ভাষা পুরোদস্তুর একটি রাজনৈতিক বিষয়বস্তু। তাই, রাজনৈতিক গোলমাল যে ভাষার কারণে লাগবেই, এতে আশ্চর্য কী? গত শতাব্দীর মাঝামাঝি শুরু হওয়া ‘আসাম সমস্যা’-য় এখন হিন্দুত্বের মোটা সুর মিশলেও আন্দোলনের শুরুটা কিন্তু ভাষা নিয়েই। অসমিয়া জাত্যাভিমান এবং জাতিবিদ্বেষ, না স্বাধিকারের লড়াই, তাই নিয়ে তর্ক চললেও ‘বঙ্গাল খেদা’ যে ভাষার সংগ্রাম, সে প্রশ্নে কোনো সংশয় নেই। তলিয়ে দেখলে এই লড়াইয়ে বঞ্চিত ‘অসমিয়া ভূমিসন্তান’ বনাম ‘ইংরেজিনবিশ বাঙালি এলিট’-এর angle টা খুঁজে পাওয়াও মুশকিল না। সমস্যা হল, লড়াইটা স্রেফ অসমিয়াদের অধিকারের লড়াইয়ের বদলে বাঙালি-বিরোধী জাতি-হিংসায় পরিণত হওয়া। এবং দরিদ্র বাঙালি উদ্বাস্তুদের এই হিংসার প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠা। ১৯৮০-র নেলি গণহত্যা রোয়ান্ডাকে লজ্জা দিতে পারে। হত্যার নেপথ্যে তখন আসাম-কাঁপানো ছাত্র আন্দোলনের সমর্থন স্রেফ কল্পনা নয়। এবং নিহতদের পরিচয়? দরিদ্র, বাংলাভাষী কৃষক। হিংসার কারণ, ‘বাঙালি আধিপত্য উচ্ছেদ করা’। তারা কোথায়, কাদের অধিপতি হচ্ছিল সেটা এই মোটা মাথায় ঢোকেনি আজও। উল্লেখ্য, আক্রমণ স্রেফ আলফা-আসু বা অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীরা নামিয়ে আনেনি। আক্রমণ এসেছে একেবারে সরকারিভাবে। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে বিমলাপ্রসাদ চালিহার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার চেষ্টা করে গোটা রাজ্যের উপরে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার। ১৯শে মে কাছাড়ের শিলচর রেল স্টেশনের সামনের মাটি লাল হয়ে গেল এগারো জন বাঙালির রক্তে। রক্তের দামে ভাষার অধিকার আপাতত সুরক্ষিত হল বটে, কিন্তু স্রেফ বরাক উপত্যকায়ই। হ্যাঁ, আপাততই, স্থায়ীভাবে নয়। এবং হ্যাঁ, এখনও বাকি আসামে, বহু অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও, ভাষার স্বীকৃতি নেই। বরঞ্চ, হিন্দুত্বের জোয়ারে, রোজ হুমকি আছে।
এই বঞ্চনার রাজনীতিতে এখন মিশেছে ধর্মের স্রোত। উচ্চবর্ণের হিন্দু অসমিয়ারা এখন সর্বার্থেই ‘এলিট’। এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অসমিয়া জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে দেশব্যাপী ধর্মীয় ফ্যাসিজমের ছায়া অত্যন্ত স্পষ্ট। ‘মিঞা’ বা ‘ন অসমিয়া’–অর্থাৎ বাঙালি বংশোদ্ভূত কিন্তু অসমিয়া-ভাষী মুসলিমরাও আর আসামের ভূমিপুত্র নন এদের হিসেবে। একইরকম বেআইনি তাদের অস্তিত্ব। যে NRC-র দাবিতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা সোচ্চার, যে দাবিকে মান্যতা দেয়া আছে ‘আসাম চুক্তি’-তে, সেই NRC-তেও মুসলমান হবার অপরাধে ন অসমিয়াদের স্থান হয় না। দলিত, আদিবাসী বা জনজাতিদের পরিস্থিতিও ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ভাষার রাজনীতি অবলুপ্ত। ‘অসমিয়া হিন্দুত্ব’-র মধ্যে হিন্দুত্বের সাথেই যেমন অসমিয়া ভাষারও গুরুত্ব আছে, তেমনই ধর্ম-বিমুখ প্রগতিশীল রাজনীতিতেও ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রভাব তীব্র। মনে রাখা ভালো, গোটা দেশের মতো আসামে কিন্তু CAA-বিরোধী বিক্ষোভ নাগরিকত্বের মধ্যে ধর্ম ঢোকানোর প্রসঙ্গে হয়নি। আন্দোলনের অভিমুখ ছিল উদ্বাস্তুদের (তাদের ভাষায়, ‘অনুপ্রবেশকারী’দের) নাগরিকত্ব দেয়ার বিরুদ্ধে। যুক্তি, সেই ‘বঙ্গাল খেদা’-র সময়কার মতোই, আসামের ‘জাতিগত ভারসাম্য’ বজায় রাখা, ভূমিপুত্রদের অধিকার সুরক্ষিত করা।

জীবনে একটা জিনিস ভারী মজার। তুলনামূলক ছোটো জিনিস চোখে পড়ে বেশি, বড়ো ক্ষতর চেয়ে। আসামের এই জাতি সমস্যা ও ভাষা-ভিত্তিক রাজনীতিও তেমনই একটা ব্যাপার। হয়তো ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম হিংস্র রূপ আসামে দেখছি আমরা। তবুও, তার একটা ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা আছে। বরঞ্চ চোখে পড়ে না অনেক বেশি বিস্তৃত, শক্তিশালী, সরকার-স্বীকৃত এবং গড়পড়তা মানুষের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ হয়ে যাওয়া হিন্দি ভাষা সাম্রাজ্যবাদ। অবশ্য যে দেশে স্কুল-কলেজে জোর দিয়ে শেখানো হয়, ‘হিন্দি আমাদের রাষ্ট্র ভাষা’, সে দেশে এটাই তো স্বাভাবিক।

উইকিপিডিয়া (বর্তমানের চটজলদি জ্ঞানের সস্তা আধার) ভাষা সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দেয় ‘অপরের উপরে ক্ষমতাশালী ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া’। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ‘খাড়িবোলি’-নির্ভর হিন্দির রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এই সংজ্ঞার একেবারে টেক্সটবুক উদাহরণ। আজকের ‘হিন্দিভাষী বলয়’ বলতে যা বুঝি, সেই সমগ্র অঞ্চলের বহু স্থানীয় ভাষাকে খাতায়-কলমে বেপাত্তা করে দিয়ে ‘মান্য’ ভাষায় মিশিয়ে দেবারই ফলাফল এই বৃহত্তর হিন্দি বলয়। আধুনিক হিন্দির মূল ভিত্তি হল দিল্লি ও সংলগ্ন অঞ্চলের ‘খাড়িবোলি’ ভাষা, অনেকটা মান্য চলিত বাংলার যেমন শান্তিপুর-নবদ্বীপ-কলকাতার কথ্য ভাষা, তেমনই। উত্তর ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাথে এর মিলের পরিমাণ কোথাও কম, কোথাও আকাশ-পাতাল। কিন্তু রাজনৈতিক গুঁতোয় মথুরার ব্রজভাষা, রাজস্থানের মারওয়াড়ি আর বিহারের অঙ্গীকা-মাগধী-ভোজপুরি সবই ঢুকে গেল এক খাতায়, দিল্লির ক্ষমতাবান ‘স্ট্যান্ডার্ড’ খাড়িবোলির ‘কথ্য’ রূপ হিসেবে। স্রেফ লিপি ভিন্ন বলে, নয়তো একই ভবিতব্য নাচছিল পাঞ্জাবি, মৈথিলিদের কপালেও।

কিন্তু ব্যাপারটা স্রেফ অন্য ভাষাদের স্বীকৃতি বা পরিচিতি লোপ করে দেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় কোনোমতেই। ভাষা সাম্রাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্য হল ব্যবহারিক জীবনেও ক্ষমতাবান ভাষা, ক্ষমতাবানের পছন্দের ভাষা ও তার সাথে সম্পৃক্ত সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়া। এবং সেই লক্ষ্যে ব্যর্থ হলে, এই চাপিয়ে দেওয়া ভাষা ও সংস্কৃতি মেনে নিতে না চাওয়া জনগোষ্ঠীকে ‘otherize’ করা, ‘জাতিশত্রু’ হিসেবে ব্যবহার করা। হিন্দি ভাষা সাম্রাজ্যবাদও সময়ের সাথে, ক্ষমতাবানদের ব্যক্তিগত পছন্দের হেরফেরের সাথে তাল রেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কাজটাই করে চলেছে, যথেষ্ট সাফল্যের সাথেই। ভারতের রাজনীতির একটা অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে জোরদার শত্রুতা হয় অহিন্দিভাষী রাজ্যের আঞ্চলিক দলের সাথে, উত্তপ্ত লড়াই বহু ক্ষেত্রেই ছাপিয়ে যায় প্রধান বিরোধী দলের সাথে লড়াইয়ের তীব্রতাকে। কেন্দ্রের কাছে হিন্দি ভাষা রাজনীতির অস্ত্রও হয়ে ওঠে এই ক্ষেত্রে—রাষ্ট্রের একতার প্রতীক হিন্দি, ভারতীয়ত্বের প্রতীক হিন্দি। হিন্দি আধিপত্য অস্বীকার করতে চাইলে সে দেশদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী। (এখানে উল্লেখ্য যে পালটা হিন্দি-বিরোধী ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরও জন্ম হয় ঠিক এখানেই। এবং সেই আন্দোলন যে সবসময়ই হিতকর, তেমনও নয়। এই হিন্দি আগ্রাসন তীব্র হওয়ায় যেমন হিন্দি ভাষা সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রতিরোধ বেড়েছে, বেড়েছে প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদও। একে অপরের পরিপূরক হয়ে।)

বিজেপির ২০১৪-পরবর্তী উত্থান অন্য সময়ের থেকে একটু আলাদা—অটল বিহারী বাজপেয়ীর বিজেপির হিন্দুত্ব ও ফ্রি মার্কেট ইকোনোমিক্সের তত্ত্ব যেমন জোরদার করা হয়েছে মোদি আমলে, তেমনই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরাসরি প্রভাব বৃদ্ধি হয়েছে। RSS কে স্রেফ হিন্দুত্ববাদী হিসেবে categorize করলে একটা মোক্ষম জায়গায় ভুল হবে—মহারাষ্ট্রে জন্ম হলেও আদর্শগতভাবে সংগঠনটি উত্তর ভারতীয় উচ্চবর্ণের হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপরে দাঁড়িয়ে। তাই স্লোগান ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’। লক্ষ্য উত্তর ভারতে হিন্দু ভূস্বামী ও অন্যান্য উচ্চবর্ণের নেতৃত্বাধীন মনুবাদী সংস্কৃতিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। ‘এক দেশ’-কে ঐক্যবদ্ধ করে কঠোর শাসনে বাঁধতে গেলে ‘এক ভাষা’ ও ‘এক ধর্ম’ জরুরি এবং সেই কাজের দায়িত্ব হিন্দি ও হিন্দুত্বের। কোথাও কোথাও ক্ষুদ্র রাজনীতির কারণে অন্য ভাষার জাতীয়তাবাদকে স্থান দেওয়া হয়েছে বটে, তবে ‘আদর্শ সমাজ’-এর ‘আদর্শ ভাষা’ হিন্দিই।

হিন্দি আগ্রাসনের অতিরিক্ত উগ্রতার দায় হয়তো ২০১৪-পরবর্তী বিজেপির উপর চাপানো যায় খালি। কিন্তু সামগ্রিক হিন্দি অধিপত্যবাদের দায় বাকিদের উপর কম বর্তায় না। আগেই বলেছি, কেন্দ্রের কাছে হিন্দি ভাষা হিসেবে উপযুক্ত অস্ত্র, জাতীয় একতার অজুহাত হিসাবেই। এক্ষেত্রে স্রেফ সরকারকেই উত্তর ভারতীয় chauvinism আর authoritarianism-এর প্রবক্তা বলে ছেড়ে দিলে আসল উৎসকে চেনা যায় না। ‘হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয়’ বলে যে সংবিধানকে খাড়া করি নিজেদের প্রধান সাক্ষী হিসেবে, সেই সংবিধানেই সরকারের দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এটাই। আর্টিকেল ৩৫১-র নির্দেশ ঠিক এরকম:

“It shall be the duty of the Union to promote the spread of the Hindi language, to develop it so that it may serve as a medium of expression for all the elements of the composite culture of India and to secure its enrichment by assimilating without interfering with its genius, the forms, style and expressions used in Hindustani and in the other languages of India specified in the Eighth Schedule, and by drawing, wherever necessary or desirable, for its vocabulary, primarily on Sanskrit and secondarily on other languages.”

অর্থাৎ, কেন্দ্রের দায়িত্ব দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষের সংযোগের ভাষা হিসেবে হিন্দিকে গড়ে তোলা, দেশের ঐক্যের জন্য হিন্দি ভাষার প্রসার ঘটানো। এবং যেখানে দরকার, সেখানে আগে সংস্কৃত তৎসম শব্দ ব্যবহার করা। সেভাবে ভাবলে, RSS এর অখণ্ড ভারতের সাথে খুব কী ফারাক হয়?

সংবিধান রচয়িতারা অনেকেই রক্ষণশীল হলেও, কেউ RSS বা হিন্দু মহাসভা করতেন বলে শুনিনি। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তখনও ভারতে পলিটিকাল ফ্রিঞ্জেই। তবুও, সংবিধান এমনই হয়েছে, এবং রাজনৈতিক কারণেই হয়েছে। কিন্তু কেন? সেই রাজনীতির ঐতিহ্যকে খুঁজে পেতে গেলে পৌঁছতে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে। যখন আদি কংগ্রেসের নরমপন্থী, তুলনামূলক রক্ষণশীল নেতৃত্বের উলটোদিকে উঠে আসছেন তিলক, লাজপত রায়, বিপিন চন্দ্র পালের মতো আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব। নরমপন্থী নেতৃত্বের ব্রিটিশ-সহযোগ যেমন এনাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনই গ্রহণযোগ্য নয় সাধারণ ভারতীয়র marginalization, ভারতের জনতার নিজের ঐতিহ্য ভুলে তাদের উপরে ব্রিটিশ সভ্যতাকে চাপিয়ে দেয়া। তাই, শতধা-বিভক্ত ভারতবাসীকে একত্রিত করতে চাই unifying factor। সেই ঐক্যস্থাপনকারী শক্তি, এদের অনেকের মতেই হল দেশের গৌরবজনক অতীত, এবং সেই অতীতকে ধারণ ও বহন করে নিয়ে চলা, বিদেশি নাস্তালিকের বদলে দেশি দেবনাগরীতে লেখা হিন্দি। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর পর থেকেই ভারতের ‘হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার’-এর স্লোগানে হিন্দু ধর্মের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবন চলছিল, হিন্দু বৈদিক সভ্যতার গৌরব প্রসারিত (বলা ভালো প্রচারিত) হচ্ছিল। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তৎকালীন মুখেরাও তাই নিজেদের আর্য হিন্দু ঐতিহ্যকে গৌরবের বলে স্বীকার করতে এবং তাকেই নিজেদের শুধু না, সমগ্র দেশের ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পিছপা হলেন না। এবং তাই, জাতীয়তাবাদে লাগল ধর্মের এবং জাতির রং। ভারতমাতা মায়ের বদলে উত্তর ভারতের হিন্দু দেবী হয়ে গেলেন, মুসলমান ও দক্ষিণ ভারতীয়রা হয়ে গেলেন সপত্নীসন্তান। পরে গান্ধী হোক বা জওহরলাল নেহরু—কেউই এই ‘হিন্দি ও হিন্দু’ ট্র্যাডিশনটা ভাঙতে পারেননি আর; বরঞ্চ গেঁথে গেছে আরও ভালো করেই—কখনও কখনও বা এনাদেরই প্রচ্ছন্ন মদতে। স্বাধীনতার পরে, হয়তো খানিকটা দেশভাগের রক্তেই জাতীয়তাবাদের ধর্ম ধুয়ে গেছে, কিন্তু তাও, বহু দেশপ্রেমিক নেতার ভাষ্যে হিন্দি সুপ্রিমেসির মৃত্যু হয়নি—বিদেশি ও এলিটদের ইংরেজির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের হিন্দি চলুক—দাবি তুলেছিলেন লোহিয়া, জেপি, কৃপালনীর মতো আদি কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীরা। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ, দাবিতে সে অর্থে সত্যিই ভুল নেই। স্রেফ ভুল হল, নিজের মাতৃভাষাকে, তুলনামূলক সংখ্যাগুরুর ভাষাকে সবার মাতৃভাষা ভাবা। ফলত, এসবের ছাপ শুধু সংবিধানেই না, গোটা ভারতের ঐক্যের উপরেই পড়ল। আর এইভাবেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধর্ম ও ভাষার অজুহাতে বেলাইন হবার ক্ষেত্রে সবথেকে দুঃখজনক ঘটনাটা হল, এই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদীরা সর্বার্থেই কিন্তু প্রগতিশীল ছিলেন। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে, চিন্তায়-ভাবনায় বহু যোজন এগিয়ে ছিলেন সেই সময়ের থেকে। তবুও, তাঁরা পড়ে গেছিলেন এমন একটা rhetoric-এর ফাঁদে যা পরে তাঁদেরই বড়ো শত্রু ও সমালোচক হিন্দু মহাসভা, সংঘ পরিবার এবং তাদের সঙ্গী-সাথীরা co-opt করবে। (এখানেই সম্ভবত হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি এবং ভগৎ সিংয়ের কৃতিত্ব। ভারতীয় স্বাধীনতা এবং ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ, বিশেষত ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণকে decouple করা, জাতীয়তাবাদকে ছোটো গণ্ডিতে না বাঁধা, এসব প্রথম সফলভাবে করা কিন্তু এই দলটারই। সে ইতিহাস ভুললে জাতীয় লজ্জা, যতই সংঘ ভোলাতে চাক না কেন।)

এত ভাষা জাতীয়তাবাদের চর্চা হল, বিশেষত এমন সব জাতীয়তাবাদ যা বাংলা ও বাঙালিকে বিপন্ন করে। তাই ‘বাংলা খতরে মে হ্যায়’ ভাবনাটা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। আর ঠিক তাই-ই, শেষপাতে বাংলা ভাষার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে চর্চা করাটা একটু প্রয়োজন। মণিপুরের রাজা গরিবনাওয়াজ, বা তার গুরু শান্তিদাস অধিকারীকে আমরা চিনি না তেমন, চেনার কথাও না। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কীভাবে হঠাৎ সিনো-টিবেটান ভাষা ব্যবহারকারী, মৈতৈ ধর্মাবলম্বী মণিপুর হিন্দু রাজ্য হয়ে গেল, রাজভাষা হয়ে গেল বাংলা, সে ইতিহাস কেউ জানিই না। হয়তো দেশের অবহেলিত অংশ বলে। তাও, তথ্যের খাতিরে একবার জানিয়ে রাখি, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের নির্দেশে, নিজের গদি শক্ত করতেই রাজ্যের ধর্ম শুধু পালটাননি রাজা পেমহেইবা (গরিবনাওয়াজের আদি নাম), সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষাকে বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন, মুছে দিতে চেয়েছিলেন সমগ্র মৈতৈ লিপিকে। হঠাৎ করেই বাংলা এবং স্রেফ বাংলাই হয়ে গেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতির ‘সরকারি ভাষা’। আরও শ’দেড়েক বছর এগোনো যাক। জায়গাটার নাম সাঁওতাল পরগনা। হুল শুরু হল। সাঁওতাল জাতির নবজাগরণ। অত্যাচারের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে। সেই লড়াই যতটা ব্রিটিশ-বিরোধী, ঠিক ততটাই বিরোধিতা করে তাদের দেশীয় স্যাঙাত বাঙালি জমিদারদের। আদিবাসী জনতার উপরে মূল অত্যাচারের উৎস হয়ে ওঠা বাঙালি সামন্তপ্রভুদের নিপীড়নে স্রেফ অর্থনৈতিক শোষণ ছিল না, ছিল সামাজিক বঞ্চনাও। আরও উল্লেখযোগ্য সম্ভবত প্রায় তিন দশক পরে ওড়িশার পরিস্থিতিটা। যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রিয়তম বাঙালি কেরানি-শ্রেণীর খোঁচায় সমগ্র ওড়িয়া ভাষাটাই বাংলার ‘উপভাষা’ হয়ে গেল (ভাষা সাম্রাজ্যবাদের এর থেকে নগ্ন উদাহরণ আর হয় কী?) আর এতশত অতীত ছেড়ে যদি একদম বর্তমানে আসি, তবেও বেশিদূর যেতে হবে না। উত্তরবঙ্গ (পশ্চিম ও পূর্ব দু’দিকেই) হাজং উপজাতির সিনো-টিবেটান মাতৃভাষার ধাঁচই বদলে গিয়ে হয়ে গেছে বাংলা-অনুপ্রাণিত ইন্দো-আর্য ভাষা। আর লক্ষাধিক চাকমা ভাষাভাষীর কোনো স্বীকৃতি নেই কোথাওই—রাষ্ট্রভাষা বাংলাই বরাদ্দ বাংলাদেশি চাকমাদের জন্য। না, বাংলার হাতও নেহাত নির্মল না! (জার্মানিতে হলোকাস্ট স্মরণ করানো স্কুল শিক্ষকদের দায়িত্ব। ধরে নিন, তেমনই কিছু করলাম।)

বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সক্রিয় বহুকাল, যদিও জাতিরাষ্ট্রে তার প্রভাব চোখে পড়া কঠিন, হয়তো সরকারি স্বীকৃতি আছে বলেই কঠিন। এপারেও এখন নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউ উঠেছে, খানিকটা ‘হিন্দি-হিন্দু’ জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এই নব্য জাতীয়তাবাদীরা যদিও বহুলাংশেই ইন্টারনেট ক্লাউন, তবুও এদের কিছু প্রভাব কিন্তু ধীরে ধীরে মাটিতেও পড়ছে মাঝে-মাঝে। আর আবারও, দুর্ভাগ্যজনকভাবেই, এরা প্রগতিশীল সমাজের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ হয়ে উঠছে। হয়তো dominant, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়ায় উঠে আসা জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীলদের দ্বারা স্বীকৃত হওয়াই স্বাভাবিক এখন। বাকি অনেকের কাছে দুই জাতীয়তাবাদের মাঝে শত্রু না বাছতে পেরে নীরবতাই শ্রেয়। আর এসব মিলিয়ে, রাজ্যে এবং সারা দেশে যখন ভাষা ও ধর্মের জাতীয়তাবাদের ঢেউ দেখি, তখন ভয় হয়, বাড়াবাড়ি রকমের ভয় হয়। আর আরও বেশি ভয় হয়, যখন দেখি কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেন এক উগ্র জাতীয়তাবাদকে দিয়ে আরেক উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রতিরোধ করবেন। বাঘের পিঠে চড়ে কুমির শিকার কিন্তু দারুণ ধুরন্ধর হবার পরিচয় নয়!

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *