|

দুষ্ট ডাইনির ছেলে – ইস্থার দৈমারী অনুবাদ : তপন মহন্ত

শেয়ার করুন

সেদিন সকালে রুদ্র লাগামহীন খুশিতে দুলছিল। শনিবার সবসময় ওর কাছে একটি ভালো দিন। সেদিন স্কুল দেরিতে শুরু হয় আর খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। স্কুল ছুটির পরের সময়টুকুর জন্য ওর অনেক পরিকল্পনা থাকে। প্রথমে সে আয়েশ করে লাঞ্চ সারবে। তারপর বন্ধুদের সাথে নদীতে সাঁতার কাটবে। পরে বাবলুর বাড়িতে যাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত টিভিতে কার্টুন শো দেখতে। এমনকি সন্ধ্যায় দেরি করার ব্যাপারে ওকে খুব বেশি চিন্তা করতে হবে না। কারণ পরের দিনটি রোববার! যখন সে অলসভাবে তার বিছানায় শুয়ে ভালো দিনটির কথা ভাবে, ওর মনে পড়ে ওর মা আর কাকিমাদের শনিবার সম্পর্কে কিছু অদ্ভুত মন্তব্যের কথা। তাঁদের কাছে শনিবার সপ্তাহের একটি অশুভ দিন। শয়তানের দিন! অথচ ওর কাছে শনিবার একটি স্বপ্নের দিন। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সে এই দিনটির স্বপ্নই দেখে।

তাড়াতাড়ি স্নান করে রুদ্র ইউনিফর্ম পরে আগের দিনের অবশিষ্ট কিছু শক্ত লাউডুমসি (চালের গুঁড়ো, নারকেল ও চিনি সহযোগে বানানো পিঠা) গপাগপ উদরস্থ করে স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় নেমে এক প্রকার ছুটতে থাকে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ ওকে ডাকে।

“রুদ্র, একটু দাঁড়াও!”

ওর কাকাতো ভাই ডেমফুর ডাক। রুদ্র থেমে যায়। যখন ডেমফু ওকে ধরে ফেলে, তখন রুদ্র মাথা নেড়ে দুঃখ প্রকাশ করার ভঙ্গিতে বলে, “তাহলে, তুমি কখনও তোমার মায়ের কথা শুনবে না, তাই না?”

ডেমফু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“হ্যাঁ”, ডেমফু ক্ষোভের সাথে বলে, “আমি কীভাবে তোমার সাথে বন্ধুত্ব ছেদ করতে পারি! আমার মা আমাকে নিষেধ করেছে বলে… আমরা সবসময় বন্ধু ছিলাম… ঠিক বন্ধু নয়, আমরা ভাই!”

“ঠিক আছে ঠিক আছে। তাহলে তুমি কি আজ বাবলুর বাড়িতে কার্টুন দেখতে যাচ্ছ?”

“অবশ্যই … ‘ছোটা ভীম’ মিস করা যাবে না।”

ওরা যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, একদল গ্রামবাসী অভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপে দ্রুত ওদের পাশ দিয়ে ছুটে যায়। একজন তো ডেমফুর ছোটো পা প্রায় মাড়িয়েই ফেলেছিল! কারণ দশ-এগারো জন মানুষের দঙ্গল অনুন্নত গ্রামের সরু রাস্তায় একে অপরের পাশাপাশি ছুটতে থাকলে অপ্রীতিকর কিছু ঘটতেই পারে। তাঁদের অধিকাংশের হাতেই বড়ো দা আর কুকরি ছিল। রুদ্র ও ডেমফু সবাইকে তাঁদের নিজেদের গ্রামের মানুষ বলেই চিনতে পারল। কিন্তু তাঁরা কেউ একটু থেমে ওদের সাথে কথা বলা এমনকি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করল না। বরং, তাঁদের একজন যাকে ওরা রাকাউ আয়োং বলে জানত, সে ওদের দিকে খুব কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল।

“ব্যাপার কী?”, বিস্মিত রুদ্র বলে, “এরা এত রেগে আছে কেন!”

“হয়তো ওদের জিনে পেয়েছে!”, উত্তেজিত ডেমফু উত্তর দিল।

“আর তুমি রাখাউ অয়োংকে দেখলে? তাঁর বসন্তের দাগ ভর্তি মুখটা ঠিক দানবের মতো দেখতে না?”

“জিন… একটি জিন দেখতে ঠিক কেমন হয়? তুমি অবশ্যই জানো। গোটা গাঁয়ের লোকেরা বলে, তোমরা নাকি তোমাদের বাড়িতে পোষা প্রাণী হিসেবে জিন রাখো?”, ডেমফু কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে।

“অপদার্থ!” রুদ্র পালটা জবাব দিল।

“আমাকে না বোলো না, যে তুমি জিন সম্পর্কে কিছুই জানো না যা তোমার মা পোষেন!”, ডেমফু অনুযোগ করে বলে।

রুদ্র ঘাড় নেড়ে বলে, “আমি আমার জীবনে কখনও জিন দেখিনি। আমার মা শুধু আমাকে বলেন যে জিনগুলো কুৎসিত এবং ভীতিকর চেহারার দৈত্য-দানব যারা এসে আমাকে খেয়ে ফেলবে যদি আমি বেশি দুষ্টুমি করি। আমি যদি পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করি তাবে মা পেছনের বাগান থেকে দৈত্যদের ডেকে আনবে।”

ডেমফু কিছুক্ষণ রুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে সে মিথ্যা বলছে কিনা পরখ করার চেষ্টা করে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“কিন্তু আমার মা ইতিমধ্যে তোমাদের বাড়ির জিনের ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। তিনি বলেন যে প্রেতাত্মা একটি উপদ্রব। তারা প্রতিরাতে অসময়ে গির্জার ঘণ্টা বাজায়। এক রাতে যখন আমরা ঘুমোচ্ছিলাম, তারা আমাদের পর্দায় আগুন লাগিয়েছিল কিন্তু যখন আমরা জেগে উঠে লাইট জ্বালালাম, তখন কোনো আগুন ছিল না, কেবল ছাই ছিল। সেদিন মাঝরাতে আমাদের বাড়িতে অনেক চেঁচামেচি হয়েছিল।”

“এটা বাড়াবাড়ি, ডেমফু। তুমি কীভাবে জানলে যে আমার মা সেই জিনগুলো পাঠিয়েছেন? আর তুমি কি তাদের আগুন জ্বালাতে দেখেছ?” রুদ্র রাগ করে জিজ্ঞেস করে।

ডেমফু চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে উত্তর দেয়, “আমি গভীর ঘুমে ছিলাম। মা চিৎকার করে আমাকে জাগিয়ে তোলার পর আমি কেবল ছাই দেখেছি। কিন্তু তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে। তোমার মায়ের জিন ছিল না, যে আমার বাচ্চা ভাইটিকেও খেয়ে ফেলেছিল?… আর এইজন্যই আমার মা আমাকে তোমার সাথে মিশতে দিতে চান না… সে বলে যে তোমার মা আমাদের ঠাকুর্দার সমস্ত জমিজমা জিনের হাতে তুলে দিয়েছে।”

“আমি তা মনে করি না, ডেমফু”, রুদ্র বলে, “মা আমাকে কখনও বলেনি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করব। সে আমাকে জিনের কথা তখনই বলে যখন আমি জোরে জোরে কাঁদি। যখন বাবা রাতে মদ খেয়ে মাকে পাগলের মতো মারে তখন মা আমাকে জিনের কথা বলে শুইয়ে দেয়। আর আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি কারণ আমি তাদের ভয় পাই!”

“হতে পারে জিনগুলো শুধু তোমার মায়ের কাছেই দেখা দেয় আর শুধু তাঁর কথাই শোনে। আর তিনি যা করতে বলেন তাই করে থাকে।”

অপমানিত রুদ্র কিছুক্ষণ চিন্তা করে। তারপর বলে, “কিন্তু তা যদি সত্যি হয়, তাহলে সে কেন তোমার বাচ্চা ভাইকে হত্যা করতে বা তোমাদের পর্দায় আগুন লাগাতে জিনদের ব্যবহার করতে যাবে? সে কি আমার জন্য শহর থেকে স্পাইডারম্যান কেক বা উজ্জ্বলের দোকান থেকে রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি আনতে জিনকে কাজে লাগাত না।”

“…অথবা একটি টিভি যাতে আমরা কার্টুন দেখতে পারি”, ডেমফু চাহিদার তালিকাটি সম্পূর্ণ করে!

“তার মানে, আমার মা যদি সত্যিই তাঁর কাজ করার জন্য জিন পোষেন, তাহলে এটা কি খুব খারাপ জিনিস হবে, তাই না ডেমফু?” রুদ্র আনন্দে বলল। আনন্দে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

“অবশ্যই!”, ডেমফুও উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল।

এসব কথা বলতে বলতে যখন ওরা স্কুল চত্বরে পৌঁছোয়, তখন ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওরা পাঁচ মিনিট দেরি করে ফেলেছে। ওরা দ্রুত স্যার মতিলালের ক্লাসে ছুটে গেল। দেরিতে আসা ছাত্রদের দেখে রাগে ফেটে পড়েন স্যার। তিনি চিৎকার করে ওদের অনুশাসনহীন বোকা বললেও শেষ পর্যন্ত ওদের ক্লাসে ঢুকতে দেন।

স্যার মতিলালের গণিতের ক্লাস চলাকালীন রুদ্রের নয় বছরের পুরোনো মাথাটি ওর সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলির তালিকায় আরও কী আকর্ষণীয় জিনিস যোগ করতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকে যা আনার জন্য জিনকে ব্যবহার করা যাবে। সে মনে মনে ভাবে যে সে তার মায়ের থেকে সেদিন জিন সম্পর্কে খোলাখুলি জানতে চাইবে এবং ওকে জিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বলবে যাতে সে জিনকে আদেশ করে ওদের জন্য কাজে লাগাতে পারে। সে ভেবেছিল যে জিনটি কার্টুন ফিল্মের আলাদিনের মতো ওর পোষা দৈত্য হবে আর সে হবে ছোটো মাস্টার। রুদ্র ওর কল্পনায় এতটাই মগ্ন ছিল যে ও বুঝতেই পারেনি কখন স্যার মতিলাল ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাছ থেকে খাতা চাইছেন। মাথায় শিক্ষকের গাট্টা খেয়ে রুদ্র সচকিত হয়। শিক্ষক অবশ্যই ক্লাসে ওর অমনোযোগীতার বিষয়টা ধরতে পেরে শক্ত করে ওর কানটা মলে দেন।

স্কুলের ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে, ডেমফু রুদ্রকে অনুসরণ করে। রুদ্র ওর যন্ত্রণাদায়ক কানে হাত বুলোতে বুলোতে একটু এগিয়ে গিয়েছিল। ডেমফু ওর দিকে তাকিয়ে হাসে।

“এতে হাসির কি আছে?”, রুদ্র চিৎকার করে উঠে।

“তোমাকে বেশ মজার দেখাচ্ছে। স্যার কি তোমাকে খুব ব্যথা দিয়েছে?”

ডেমফু ওর কানে হাত বুলিয়ে ব্যথা সারিয়ে দিতে চায়।

“আসলে তা না!”, রুদ্র জবাব দেয়, “কিন্তু আমি তাঁর কাছে ফিরে যাব… আমি আমার জিনকে পাঠাব স্যারের পচা সাইকেল ভাঙতে।”

ডেমফু বিভ্রান্ত হয়ে বলে, “কিন্তু তুমি কীভাবে জিন পাঠাতে পারবে? তুমি কি মনে করো আন্টি জিনকে বশীভূত করার কায়দা তোমাকে শেখাবে?… নাকি আমাদের অন্য ওঝা খুঁজতে হবে?”

“কোন্ ওঝা?”

“ওঝা যিনি তোমার মাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে জিনকে অনুচর হিসেবে রাখা যায়… যে ওঝাকে তোমার মা প্রায়ই দেখতে যেতেন।”

“উহু! তুমি বিরুপাড়ার ওঝাকে ভেবেছ, যাকে আগে গ্রাম থেকে তাড়ানো হয়েছিল? কিন্তু আমি মনে করি না সে মাকে কিছু শিখিয়েছেন। কারণ প্রতিবার মা আর আমি সেখানে গেলে, তিনি মাকে শুধু কিছু ওষুধ দিতেন যা দেখতে ছাগলের নাদার মতো। আর মাকে বলেতেন যে এটি ওর বাবার মদ খাওয়া ছাড়াতে কাজে লাগবে। তিনি মাকে প্রতিদিন সকালে বাবার চায়ের মধ্যে ওষুধটা মিশিয়ে দিতে বলেছিলেন। মাকে তিনি শুধু এটাই বলেছিলেন। এরচেয়ে কিছু বেশিও না কমও না!”

“হুম… তাহলে কি তোমার মা সত্যি জানেন কীভাবে জিনকে তাবে রাখতে হয়… অথবা তার কি আদৌ কোনো জিন আছে, নাকি সবটুকুই মিথ্যা?”, ডেমফু ধীরে ধীরে প্রশ্ন করে।

ডেমফুর প্রশ্নটি রুদ্রের পক্ষে বেশ অস্বস্তিকর ঠেকে। সে দেখতে পায় যে তার সুন্দর এবং আড়ম্বরপূর্ণ জিনিসগুলোর স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে!

“আসলে!”, রুদ্র বিড়বিড় করে বলে, “আমি অবশ্যই আজ মাকে জিজ্ঞেস করব যে জিন জিনিসটা পুরোপুর সত্যি না মিথ্যা। এখন কথা বলা বন্ধ করে বাড়ির দিকে পা চালানো যাক।”

ওরা বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করে এবং শীঘ্রই গ্রামের খেলার মাঠের কাছে পৌঁছে যায়। খেলার মাঠের ঠিক পাশেই রুদ্রের বাড়ি। দূর থেকে ওরা দেখতে পায় যে খেলার মাঠে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। যখন ওরা আরও কাছাকাছি পৌঁছোয় তখন রুদ্রদের বাড়িতেও জনসমাবেশ দেখা যায়।

“ব্যাপারটা কী হতে পারে?” দুজনেই একই সাথে বলে ওঠে।

ওরা খেলার মাঠের কাছাকাছি পৌঁছোতেই লোকেরা শোরগোল শুরু করে, কেউ কেউ অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে, কাউকে দুঃখিত, কাউকে বিভ্রান্ত দেখায়, কেউ কেউ আবার অপ্রীতিকর মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় ওদের দিকে। ওদের কৌতূহল চরমে পৌঁছেছে। এমনকি ওরা পথের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও জবাব পায়নি। অবশেষে ওরা উঠোনে পৌঁছে থমকে যায়। রুদ্র ওর মাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে। মায়ের বিচ্ছিন্ন মাথাটি তাঁর দেহ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে পড়ে আছে! তাঁর কাপড় ছিঁড়ে গেছে এবং শরীরে বিশ্রী আঘাতের চিহ্ন।

রুদ্র এবং ডেমফু দুজনেরই শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। ডেমফু ভিড়ের মধ্যে তার বাবা-মাকে দেখতে পায়। ভিড়ের অন্য সকলের মতো, তাঁদের মুখেও একটি অদ্ভুত অভিব্যক্তি ছিল যা দেখে মনে হয় যে তাঁরাও তেমন দুঃখিত নয়। ওরা বুঝতে পারে না কেন এমনটা হল।

পর মূহুর্তে রুদ্র ওর মায়ের নিথর দেহের পাশে মাটিতে গড়িয়ে হতাশায় হাহাকার করে কাঁদতে থাকে। ওর চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ পুরো জায়গাটায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে সে অনুভব করে যে ওর বাবা হয়তো কোথাও মাটিতে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে একরাশ বমির মাঝখানে। আর রাখাও আয়োং বিজয়ীর মতো একটি বড়ো পাথরে বসে আছে হাতে নিয়ে রক্তাক্ত কুকরি। সে আরও বুঝতে পারে যে চারপাশে মানুষের মাঝে থেকে মৃদু গুঞ্জন উঠছে, “দুষ্ট ডাইনির ছেলে!”

[ড. ইস্থার দৈমারী তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।]

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *