চামড়ায় জড়ানো খাতা ( পর্ব ৪ )- বল্লরী সেন

শেয়ার করুন

॥ নবম অধ্যায় ॥

(জিয়াভরলি নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছে বকের ডানায় আমার মা-হারা রোদের রাংতায় মোড়া একাক্ষর তারামণ্ডলটি। একে জন্মান্তর বলব, না ভাসান কোজাগরি? সত্যি কথা বলতে, হাঁসেদের পাখনায় আমার ডাইনি মায়ের চেরা জিভ লুকোনো; আমি তাঁর অজান্তেই পা টিপে নেমেছিলাম, এখনও সেরকমই আসা-যাওয়া চলছে। বলা কি যায়, হয়তো ওই ডায়ারিটাও ফেলে চলে গেছেন ইয়ুং নিজেই। আর আমার মতো একজন তুলে নিয়ে সযত্নে তাকে তুলে রেখেছে, সে লেখা কিছু আছে কিছু উবে গেছে কালির দাগ আর কিছু জলের লেখা মিশে গিয়েছে এর সঙ্গে।)

দিন দুই পার হল, কিন্তু কার্ল তখনও সাবিনার সামনে নিজেকে দাঁড় করাতে পারেননি, এত বিস্রস্ত হয়েছেন। স্ত্রীর সামনেও কিছু বলতে পারেননি, নিজের গবেষণাগারে দীর্ঘ সময় কাটানোর অছিলায় কয়েক রাত তিনি বাড়ি ফেরেননি। অনেকবার মনে হয়েছে, ওর কাছে যাওয়া দরকার, কথা বলা দরকার, আরও সংকটের ভাগফল নিশ্চয় কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে।

কেন অবিরত তাঁর নিজের মায়ের সেই কান্নার বুভুক্ষার দৃশ্যটা ঘুরে আসে মাথাভর্তি রাগ নিয়ে। নিকোলাইয়ের রংচটা মুখের ওপর কাল ঘুমের মধ্যে কেন যে চেপে বসছিল মায়ের সেই হারামজাদামুখ — সেই জট ক্রমশ কাজ থেকে সরিয়ে নিচ্ছে কার্লকে। আজ ব্লেউলরের মিটিংয়ে তো যেতেই হবে, কোনও উপায় নেই পালানোর। তথাপি লিবের্ নোভস্ এ লিখে চলা কয়েকটি পরিচ্ছেদ মনঃসংযোগে রীতিমতো বাধা দিচ্ছে ক্রমাগত। ঘুম এল না। গীর্জার ঘণ্টায় তখন রাত একটা, আচমকা কান জুড়ে ভেসে এল মা এমিলির নৈশ আর্তনাদ। নিজের ঘর থেকে এক ছুট্টে কার্ল চলে আসতেন বাবা মায়ের দরজায়, কিন্তু বহু ডাকা সত্ত্বেও কেউ সাড়া দিত না। ভীত ছেলেটি কাঁদতে শুরু করলে অন্য ঘর থেকে বাবা এসে সান্ত্বনা দিতেন। সান্ত্বনা বললে ভুল হবে। বাবার রুক্ষ গলার স্বরে মায়ের প্রতি তাঁর ক্ষোভ ও বিরক্তি গল্‌গল্ করে নেমে আসত, আর বালক কার্লের পিঠে কখনও সেই খেসারতের দাগ তৈরি করত উলটো এক না-বোঝা ক্ষত। ক্রুদ্ধ কুকুরের মতো গর্‌গর্ করতে করতে বাবা একটা শব্দ শুধু বলতেন ‘হিস্টেরী’, ‘হিস্টেরী’। ডার্করুমে তখন সেই ডাইনি আবার চিৎকার করছে আর ভয়ে কুঁকড়ে কার্ল অসুস্থ হয়ে পড়ত। এর ফলে এমিলিকে বালকপুত্রের থেকে পুরোপুরি পৃথক করা হল। মানসিক রোগীদের সঙ্গে রাখা হল এ্যাসাইলামে। আর ভীষণরকম একাকিত্বে বড়ো হতে লাগলেন ইয়ুং, বাড়ির চতুর্থ সন্তান, পরিবারের একমাত্র জীবিত বংশধর। ন’বছর বয়সে বোনের জন্ম কার্লের কাছে একটা অভিনব ঘটনা। পর পর দুই মৃত সন্তানের পর তৃতীয়টিকেও হারানোর পর কার্লের জন্মের স্মৃতি, এমিলির কাছে এক দুর্বিনীত আশঙ্কার ঢাকনা খুলে দিয়েছিল। প্রতি মুহূর্ত তাঁর কাছে হত্যাদৃশ্যের পরিকল্পনায় বাঁধা, যেন এই ডুবল, এই ডুবল। খিটখিটে মায়ের উন্মাদ-দশা বালকপুত্রের কোনও সহমর্মিতা পায়নি। যেন দেনা হয়ে আছে অনেক। যেন জন্ম দেওয়া, আসলে মায়ের সেই অভিশাপ — যার কোনও মীমাংসা নেই, সমঝোতা নেই। বেঁচে থাকার শর্তাবলি ভেঙে মায়ের প্রতি ইয়ুং-এর জেগে উঠেছিল ধুন্ধুমার বিদ্বেষ ও বিরাগ। বাবার সেই ঘাতক স্বরের ‘হিস্টেরী’ কোনোদিন মিটমাট হবে না, ঝাঁক-বাঁধা কালো গহ্বরের হাঁ কার্লকে বাধ্য করে লাল নোটবুকের পাতায় বৃত্তের ভেতর বৃত্তের চলমান শামিয়ানার গোলকধাঁধায় এক কণা বুদ্‌বুদের‌ মরে যাওয়া লিখতে। গোঙানির শব্দ ঘিরে বাবার রাগ, ধারালো চিবুকের স্বর মাথার মধ্যে একই শব্দ ভাঙে আর গড়ে। আর সে হল এক অজানা ডাইনির নাম, যাকে বাবা বলেন — ‘হিস্টেরী’। এভাবেই মাকে না পাওয়া হতে হতে মা-বিরূপতায় তৈরি হচ্ছিল ওই লালখাতা, ছবি আর ডায়ারি। একদিকে বাবা তাঁর পাদরিজীবনের সম্মোহন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন আর আমি আমার মা-হারা শৈশবের দিনগুলো সরিয়ে তার ভেতরকার গলিঘুঁজি সমস্ত তন্ন তন্ন করে দেখছি; দেখছি কতদূর যন্ত্রণার ঘা ছুঁতে পারছি আর সেখানেই সেদিন সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেলাম মিস্ স্পিয়েলরিনের কনফেশনের মধ্যে। মনে করে দেখুন, তার টানা কথার মধ্যে চুপ করে ছিলাম, যেন হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। রিক্ত নগ্ন চতুর এক মোসাহেবের মতো হেরে হেরে ক্ষয়িত এক কঙ্কাল, জন্মজারজ। ভিখারি, যে নিজের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ হেরেছে, সেই পাপের এক কাল্পনিক খরচের বোধ আমাকে নিঃশেষে মারত। ব্যাজেল জিমনেসিয়ামে ভর্তি হয়ে তাই আমার একটা নতুন দুয়ার কে যেন খুলে দিল। বন্ধুদের ‘ফাদার অ্যাব্রাহাম’ বলে খ্যাপানোও বেশ লাগত। বেশির ভাগ ছেলেরাই অবস্থাপন্ন। আমি এ সময় থেকে আমার গরিব বাবাকে একটু করে দয়া করতে লাগলাম। যেমন প্রাণে বাঁচার জন্য কুকুর-মা তার ছানাদের ঘেন্টি ধরে টেনে আনে, আমিও আমার বেচারা মায়ের হিস্টিরিয়াকে লালন করতে লাগলাম মনের ভেতর, তাঁর চিৎকারের ভয়টয় চুকিয়ে। সন্দেহ হল, বাবা হয়তো জোর করে বোনকে এনেছে, মা হয়তো চায়নি আমি বাদে আরও কেউ আসুক। কচি সন্তানের আতুপুতু আদরে আমি মাকে, আমার এমি-কে একদিন রাতের স্বপ্নে যেন হাঁটুসমান ক্লোকের মধ্যে নিয়ে দুলিয়ে ঘুম আনছি, আর তার মুখ ঠিক জেট্রুডের ডৌল বসানো। মানে বোনের। হস্টেলের ঘরে বাকি রাত আর ঘুম এল না। পরদিন ক্লাসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি দেখে বন্ধুরা সন্দেহ করল হয়তো বিয়ার পানের ফল। তাদের ধারণা তাই আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। শেষে হেলি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করেছিল। সূর্য ডুবলে আমার ওপর যে অন্য কেউ ভর করত, হেলি সহজভাবে তা বোঝার চেষ্টা করেছিল। নভেম্বরের সন্ধ্যায় তখন বেলা ছোটো, মেঘলা, প্রায়ান্ধকার চারদিক। হেলিকে বললাম, প্ল্যানচেট করব। আমাকে ঠাট্টা করে যেমন ওরা বলত, হেলিও হেসে বলল, কাকে? ফাদার অ্যাব্রাহাম? রুগ্ন মায়ের কোলের কাছে বোন খেলে বেড়ায় আর আমি কিছুতে আমার লাল নোটবইয়ে আঁকা ছবি ভুলতে পারছি না।

—ডাক্তার! পরিচিত স্বর, চিনতে পারলাম না তবু।

ওদিকে তখন সাবিনার আকুতি ভেসে উঠল, ‘–ডাক্তার!’

হাসপাতাল চত্বরে সাদা তুষারদানা কেভিয়ারের মতো বিস্তীর্ণ থালায় কে যেন ঢেলে রেখেছে। দরজা খোলামাত্র এক পশলা তুষারবাতাস হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এল; আর যে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, অবিকল এমিলির মতো ফ্রিল দেওয়া লেসের কারুকাজের সাটিনের গাউন-পরা সেই মেয়ে। এক্ষুনি তার আবদার মেটানোর কাজে লেগে গেলেন কার্ল, হসপিটালে
তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রথম মনোরোগী, হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত সাবিনা স্পিয়েলরিন। কয়েক মুহূর্ত নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন ইয়ুং।

(ক্রমশ)

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *