|

ভারতীয় ক্রিকেটে ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’ – অম্লান চক্রবর্ত্তী

শেয়ার করুন

ঋষভ পন্থের ড্রাইভটা মিড্ অন দিয়ে সীমানার বাইরে যেতেই মাঠের মধ্যে দৌড়ে নেমে এলেন সহখেলোয়াড়েরা। শাপমুক্তি ঘটল একটি ক্রিকেট দলের বা একটি দেশের বেসরকারি জাতীয় খেলার। কে বলবে মাত্র তিনটি টেস্ট আগেই এই দলটা ৩৬ রানে অল আউট হয়ে লজ্জার ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। সেই লজ্জার আগুনে পোড়া একটা দলের ফিনিক্স পাখির মতো নবজন্ম ঘটল। সেই দলটাই রচনা করল নয়া ইতিহাস। ৩২ বছর পর গাব্বায় অস্ট্রেলিয়াকে হার মানতে বাধ্য করিয়ে।

শুরু থেকেই শুরু করা যাক। মোটামুটি ভাবে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে বরাবর উত্তেজনার পারদটা চড়ে থাকে। ১৯৮১ সালে গাভাস্কারের সেই ম্যাচ থেকে উঠে যাওয়া আজও প্রবীণদের মনে থাকার কথা। বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি চালু হবার পর থেকে তো আরও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ২০০১ সালে অধিনায়ক সৌরভ অজি অধিনায়ক স্টিভ ও’-কে টসের আগে মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখেন। উত্তেজনার মিটার আরও ঊর্ধ্বগামী হয়। সেই সিরিজেই অস্ট্রেলিয়ার অশ্বমেধের ঘোড়াকে ভূপতিত করা। ২০০৩-০৪ সালেও দুই দেশের সিরিজে প্রথমে ব্যাগিগেট, তারপর সেই “বিখ্যাত” মাঙ্কিগেট—সাইমন্ডস দাবি করেন, হরভজন সিং তাঁকে মাঙ্কি বলেছেন। পরে শচীন তেন্ডুলকর হরভজনের হয়ে সাক্ষ্য প্রদানের সময় বলেন, হরভজন মানকি বলেননি, বলেছিলেন “তেরি মা কি…” (বাকিটা না লিখলেও চলবে)। ২০০৭-০৮ সিরিজেও সিডনিতে ভারতকে একপ্রকার জোর করেই হারানো হয় জঘন্য আম্পায়ারিং করে। কমেন্ট্রি বক্সে গাভাস্কারের রাগত কমেন্ট্রি আজও কানে বাজে। পরবর্তীতে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে এত স্লেজ করা হয় যে তিনি বলে ফেলেন, “অস্ট্রেলিয়ার সাথে বন্ধুতা রাখা যায় না।”

এই ইতিহাস মনে রেখে করোনাকালের পর ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ। প্রথমত একবছর আগে নিউজিল্যান্ড সফরে বিধ্বস্ত হওয়া, দ্বিতীয়ত প্রায় একবছর দলটা ক্রিকেটের বাইরে, তারপর নিও নরম্যাল পরিস্থিতিতে কঠোর কোয়ারেন্টিন—মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেবার জন্য যথেষ্ট। ওয়ান ডে সিরিজে হার এবং টি-২০ সিরিজে জয় হলেও টেস্ট সিরিজে ভারত কিছু করে দেখতে পারবে তা বোধহয় চূড়ান্ত দেশভক্তও ভাবেননি। প্রথম টেস্টে ভারত গুঁড়িয়ে গেল মাত্র ৩৬ রানে অল আউট হয়ে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো দলের সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির পিতৃত্বকালীন অবসরে দেশে ফেরা। এবং পেসার মহম্মদ শামির চোট। সামনের পথ যে নিকষ অন্ধকার তা বুঝতে আর কারও বাকি ছিল না।

আর এখান থেকেই শুরু নতুন পথ চলার। ভাঙাচোরা দলের হাল ধরলেন অজিঙ্ক রাহানে। বক্সিং ডে টেস্টে অধিনায়োকোচিত সেঞ্চুরি এবং ৩৬ রানে আউট হওয়া দলটা ৩২৬ রান করল। শামির জায়গায় অভিষিক্ত মহম্মদ সিরাজ প্রথম ইনিংসে দুটি ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩টি উইকেট নিলেন। মনে রাখতে হবে, সিরাজের পিতৃবিয়োগ ঘটেছে এর মধ্যে। জানাজা নামাজ পড়ার জন্যও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। আট উইকেটে ভারত জিতলেও চোট পেলেন অপর পেসার উমেশ যাদব।

সিডনিতে তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামার আগে পর্যন্ত সকলেই ধরে নিয়েছিলেন, বাকি দুই টেস্টে নির্ঘাত হারছে ভারত। দলটির বোলিং শক্তি বলতে জসপ্রীত বুমরাহ, আর এক ম্যাচ খেলা সিরাজ এবং অভিষেক ঘটা নভদীপ সাইনি। স্পিন বোলিংটা অবশ্য শক্তিশালী ছিল। তথাপি প্রথম ইনিংসে ৯৪ রান পিছিয়ে থাকা দলটির উইকেটরক্ষক ঋষভ পন্থের এবং স্পিনার-অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজার চোট। চতুর্থ ইনিংসে ভারতের সামনে লক্ষ্যমাত্রা ৪০৭। এই টার্গেট যে ভারত তাড়া করে জিতবে তা কেউই ভাবেননি। শেষদিনের অস্ট্রেলিয়ার কামিন্স, হ্যাজলউড, স্টার্ক, লিয়ঁরা একপাল ক্ষুধার্থ বাঘ। সাথে বিখ্যাত অজি “মধুবাক্য”। এবং বর্ণবৈষম্যের বিতর্ক। কিন্তু এর মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ালেন চোট থেকে ফেরা ঋষভ পন্থ। ১০৭ বলে ৯৭ রানের ইনিংসটি ভারতীয় দলের লড়াইয়ের ইতিহাস। ঋষভ যখন আউট হলেন দিন শেষ হতে চল্লিশ ওভার বাকি। বাকি ১৩৫ রান। পাঁচ উইকেট।
মধ্যবিত্তের সংসারে অট্টালিকা অলীক স্বপ্ন। কিন্তু একটু একটু ঘাম ঝরিয়ে গড়া যায় মাথা গোঁজার আশ্রয়। যা একান্ত তার নিজস্ব তাজমহল। সেই ইমারত গড়ার কাজে মন দিলেন হনুমা-অশ্বিন। ধরে খেলো। টিকে থাকো। তোমাকে টিকে থাকতেই হবে। কুৎসিত লাগছে? লাগুক। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে বসন্তের আলোয় পলাশ বনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। বরং খাবলা মেরে মাটি পেলেও তাকে আঁকড়ে ধরতে হয়। বুক ঘষটে ঘষটে বরিস পলেভয়ের উপন্যাসে দু-পা কাটা যাওয়া আলেক্সেই মেরসিয়েভের মতো বরফের মাঠ পেরোতে হয়। লাল পতাকাটা যেন ভূলুণ্ঠিত না হয় খেয়াল রেখেই।

হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট উপেক্ষা করলেন হনুমা। পাঁজরে “অজি আদরের” লাল দাগ অগ্রাহ্য করলেন অশ্বিন। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। মান বাঁচানোর জন্য। ১৬১ বলে ২৩ এবং ১২৮ বলে ৩৯ ভারতীয় ক্রিকেটের দুটি সম্পদ। টি-২০ র দাপটে রক্তাক্ত ক্রিকেটের বলিউডি জগঝম্পের বাজারে কৌশিকী কানাড়ায় দীর্ঘ আলাপ ধরলেন দুই মায়েস্ত্রো। হাফভলি? ঠুকে দাও। শর্ট পিচড? সামলাও। আউট সাইড দ্য অফস্টাম্প? ছাড়ো। লিয়ঁর বল বেশি ঘুরছে? ব্লক করো। লাইনের বল প্যাডে লাগলেও যেন ব্যাটের আলতো চুমুতে নির্বিষ হয়ে যায়। ধ্বংসাত্বক প্রবাহিনী যেন হয়ে যায় নমিতা নদী। ফলাফল? দিনের শেষে মাথা উঁচু করে ফিরছে ভারতীয় দল। ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পার্টনারশিপ হয়ে থাকল। ম্যাচ ও মান বাঁচল বটে। কিন্তু চোট পেয়ে বেরিয়ে গেলেন দলের সেরা পেসার জসপ্রীত বুমরাহ, অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং ব্যাটসম্যান হনুমা বিহারী। অতঃকিম্?

“সম্মুখে ঘন আঁধার”—কী হবে শেষ টেস্টে? ব্রিসবেনের গাব্বায়?

বিশ্বক্রিকেটে মোটামুটি যে চারটি ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে ব্যাটসম্যানের চূড়ান্ত পরীক্ষাক্ষেত্র ধরা হয় তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় দুটি—ওয়াকা (পার্থ) এবং গাব্বা (ব্রিসবেন)। বলা হয় ওয়াকা ফুটন্ত কড়াই, আর গাব্বা জ্বলন্ত আভেন। প্রথম কারণ যদি পিচের গতি ও বাউন্স হয় তবে দ্বিতীয় কারণ বাইশ গজের অস্বাভাবিক আচরণ। চতুর্থ দিনের থেকেই পিচ ফাটতে শুরু করে এবং শেষ দিন ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমি হয়ে যায় গাব্বার পিচ।

এই পিচে ভারতীয় দলের সম্বল বলতে ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে লজ্জা নিবারণ। মাত্র দুই ম্যাচ আগে অভিষেক ঘটা মহম্মদ সিরাজ, এক ম্যাচ আগে জীবন শুরু করা নভদীপ সাইনি, দেড় বছর আগে একমাত্র টেস্ট খেলা শার্দুল ঠাকুর। সাথে টেস্ট ক্যাপ পেলেন টি নটরাজন এবং ওয়াশিংটন সুন্দর।

বারবার মনে হয় খেলা যতটা স্কিল-ধৈর্য্য-টেকনিকের, ততটাই মনস্তস্ত্ব এবং প্ল্যানিংয়ের। আর এই দুটি কাজ করেছিলেন অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে এবং কোচ রবি শাস্ত্রী। এমনিতেই “শাস্ত্রীয় বচন” ভয় পেয়ো না। তদুপরি ভারতীয় তরুণদের মধ্যে পালটা মার্ দেবার একটা প্রবণতা কয়েক বছর হল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ৩৬৯ রানের জবাবে যখন ভারত ৬ উইকেটে ১৮৬ রানে ধুঁকছে, তখনই পালটা মার দিলেন শার্দুল ঠাকুর এবং ওয়াশিংটন সুন্দর। সপ্তম উইকেটে ১২৩ রান যোগ হল। এবং ভারত শেষ করল ৩৩৬ রানে। দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিংয়ে জ্বলে উঠলেন মহম্মদ সিরাজ। বাবার কবরে মাটি দিতে পারেননি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আগুন জ্বালালেন পেস বোলিংয়ে। পাঁচটি উইকেটই তুলে নিলেন। চতুর্থ ইনিংসে ভারতে সামনে লক্ষ্যমাত্রা ৩২৮। সামনে ভয়ংকর অজি বোলিং লাইন-আপ এবং গাব্বার শেষ দিনের পিচ। ইতিহাস অনুসারে, এর আগে গাব্বায় সফল চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করার ঘটনা ১৩৫১ সালে – ২৩৬ রান।

নিখুঁত কৌশল ছিল ভারতের। প্রথম দু-ঘণ্টা যথাসাধ্য উইকেটে টিকে থাকা। পরের দুই ঘণ্টায় রানরেট সামান্য বাড়ানো এবং শেষ দিকে টি-২০ মোডে শিফট করা। প্রথম অর্ধে উঠল মাত্র ৭৮ রান, পরের অর্ধে ১০০ এবং শেষ অর্ধে ১৫০ রান। শুরুতেই বড়োলোকের বাউন্ডুলে ছেলের মতো উইকেট ছুঁড়লেন রোহিত শর্মা। এবং এখান থেকে খেলা ধরলেন চেতেশ্বর পূজারা এবং এই সিরিজে অভিষেক ঘটা শুভমন গিল। ভয়ংকর প্যাট কামিন্সকে সামলালেন পূজারা। নবীন গিলকে আগলালেন পূজারা। কামিন্স-স্টার্কের বল সারা শরীর দিয়ে সামলালেন তিনি। হয়তো কোহলি বা পান্ডিয়ার মতো উল্কি আঁকা পেশীবহুল শরীর তাঁর নয়। কিন্তু কাল যখন তিনি ড্রেসিংরুমে ফিরে জামা খুলেছিলেন, সেখানে আঁকা ছিল প্রতিরোধের কালশিটে। অন্যদিকে গিলের ইনিংস ছিল দু-চোখ ভরে দেখার মতো। মুহূর্তের মনোসংযোগের অভাবে সেঞ্চুরি হয়তো পেলেন না, কিন্তু তাঁর ৯১ রানের ইনিংসটা সারা জীবন মনে থাকবে। অজিঙ্ক রাহানের ২২ বলে ২৪ রানের ইনিংস প্রথমেই ভারতের গিয়ারটা বদলে দেয়। ছোট্ট কিন্তু অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।

এই টেস্টে নবীনদের যেভাবে আগলালেন প্রবীণরা তা যে-কোনো ম্যানেজমেন্ট স্কুলে “কেস স্টাডি” হিসাবে পড়ানো যেতে পারে। পূজারা যেমন প্রথমে গিলকে আগলালেন, পরে ঋষভ পন্থকে। ঋষভ মারতে শুরু করার পরেই জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করে ভারত। পরে পূজারা ও ময়ঙ্ক আউট হবার পর রান দাঁড়ায় ২৬৫। পন্থের সাথে ওয়াশিংটন সুন্দর জুটিটা বাঁধলেন এই সময়। টি-২০ খেলা এই তরুণদের মধ্যে ফিল্ডিংয়ে ফাঁক ফোঁকড় খুঁজে রান নেওয়া, বাউন্ডারি খুঁজে নেওয়ার প্রবণতা যেমন আছে, তেমনই আছে অকুতোভয়ে ব্যাট চালিয়ে বলকে গ্যালারি চেনানোর ক্ষমতা। ফলে এক ওভারে এল পনেরো রান। পরের কিছু ওভারে কিছু খুচরোও এল। আর যখন অজি অধিনায়ক পেইন এই বিষয়টি ধরতে পারলেন, ততক্ষণে ম্যাচ ভারতের পকেটে। শেষমেশ আরও দুটি উইকেট পড়লেও অবশেষে জয় ভারতেরই হল।

গ্ল্যামার সর্বস্ব দুনিয়া সকলের থাকে না। পুজারার জীবন একেবারেই নয়। নয় রাহানেরও। নেহাতই দৈববশে অধিনায়ক হয়েছিলেন রাহানে। পেয়েছিলেন একটা আনকোরা দল। কিন্তু রাহানের মন ছিল ইস্পাত কঠিন। যে ব্যর্থতা লজ্জার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল, সেইখান থেকে রাহানে দেখেছিলেন আলোর আশা। যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে, সেই আগুনকে মশাল বানানোর ক্ষমতা সকলের থাকে না। কারও কারও থাকে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *