ভ্রমণ: উপসালা – অম্লান চক্রবর্ত্তী
ট্রেন থেকে উপসালা শহরে নেমেই যা আমায় প্রথম মুগ্ধ করেছিল তা হল স্টেশনের উল্টোদিকে ফুটপাতে কিছু মানুষ বসে পড়াশোনা করছেন, কেউ বা গিটার হাতে গান গাইছেন। বুঝতে বিলম্ব হল না,একটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরে আমি এসে পড়েছি। পায়ে হেঁটে গোটা শহরটি ঘুরে দেখার সময় এই সংস্কৃতির ছোঁয়া দেখেছিলাম শহরটির অলি-গলি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, কেল্লার ম্যাথ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ক্যাফে সর্বত্র। নানা দেশের নানা সংস্কৃতির ছাত্র, তাঁদের জীবন যাপন, পড়াশোনা, প্রেম এই শহরটির পরতে পরতে মিশে আছে। সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটছে বন্ধুতা, প্রেমের মাধ্যমে। জন্ম নিচ্ছে এক উদার, শিক্ষিত সংস্কৃতি।
স্টেশন থেকে বের হয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে গুগল ম্যাপে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি চিহ্নিত করছিলাম। পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। দ্রষ্টব্য স্থানগুলিও খুব বেশি দূরে নয়। দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যেই প্রায় সবকটিই রয়েছে। কেবলমাত্র গামলা উপসালা বাদে। “ম্যাপ পয়েন্টিং খেলা” প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, হঠাৎ পাশ থেকে এক নারীকণ্ঠ, “চিয়েনা লেগিত”, আমিও প্রতি সম্ভাষণের পর তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলেন আমার কোনো সাহায্য করতে পারেন কি না। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “যদিও আমি ট্যুরিস্ট, কিন্তু অসুবিধা নেই কোনও, আমি পুরোটাই রুট জানি, তাও একবার ম্যাপটা দেখে দাও।” সব ঠিকই আছে, তবে গামলা উপসালার জন্য সাইকেলের বদলে বাস নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কথায় কথায় জানলাম, উনি স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। নাম মার্থা। রোম থেকে এসেছেন। ছুটির দিনে উপসালা স্টেশানে দাঁড়িয়ে এভাবেই টুরিস্টদের সাহায্য করেন। কোনও অর্থের বিনিময়ে নয়, উনি চেষ্টা করছেন নিজের “কমিউনিকেশন স্কিল” বাড়ানোর।
ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ম্যাপ অনুযায়ী চলা শুরু করলাম। আমার প্রথম গন্তব্য ছিল, উপসালার ক্যাথিড্রাল। চলতে চলতে আমি একটু উপসালার ইতিহাসটা বলে নিই। আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে উপসালা শহরটির পত্তন হয়। বর্তমান শহরটির প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে। ফাইরিস নদীর ধারে। তখনও খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার ঘটেনি সুইডেনে। এই ছিল একটি “পেগান শহর” ক্রমে ক্রমে শহরটি হয়ে ওঠে উত্তর ইউরোপের ধর্ম ও রাজনৈতিক চর্চার প্রধান পীঠস্থান। ১০৮৭ সালে শহরটি রহস্যময় কারণে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এরপর ধীরে ধীরে শহরটির খ্রীষ্টীয়করণ ঘটে। কোনও অজ্ঞাত কারণে এর কিছুদিন পর থেকেই ফাইরিস নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলত বন্ধ হয় বাণিজ্য।
শহরটি স্থানান্তরিত হয় ফাইরিস নদীপথ চলে কিছুটা দক্ষিণে। এটিই বর্তমান শহর। পুরোনো শহর অর্থাৎ গামলা উপসালা বর্তমানে টিলার নিচে চাপা পড়ে আছে। এর কথা পরে বলছি।
নতুন শহরটি মোটামুটি গড়ে উঠতে শুরু করে দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি থাকে। প্রথমে বন্দর ও লোকালয় এবং ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে উপসালা ক্যাথিড্রাল। ১৪৭৭ সালে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ১৫২৩ সালে সুইডেনের রূপকার রাজা গুস্তভ ভাসা গোটা সুইডেন নিজের দখলে আনতে সক্ষম হন কিন্তু উপসালার পরিবর্তে স্টকহোম হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ শহর তথা রাজধানী। তবে বর্তমান কেল্লাটি তাঁর তৈরী।
সুইডেনের কিংবদন্তি রাজা দ্বিতীয় গুস্তভ এডলফ রাজ সিংহাসনে আসীন হবার পর উপসালা পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় সাহিত্য, দর্শন, জীবনবিজ্ঞান, অনেক শাস্ত্রচর্চা। ক্রমে ক্রমে সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় এই প্রতিষ্ঠানের নামডাক। কিন্তু বিধাতা মনে হয় অলক্ষ্যে মুখ টিপে হেসেছিলেন। ১৭০২ সালে বিধ্বংসী আগুনে আবার গোটা শহরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার প্রায় ২০০ বছর পর বিংশ শতাব্দীতে কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় আবার গড়ে ওঠে শহরটি।
এত বিস্তারিত বলার কারণ পরবর্তীকালে বহু ক্ষেত্রেই রাজাদের নাম, নদীর কথা আসবে। ইতিমধ্যে আমি এসে পোঁছেছি ফাইরিস নদীর ধারে। তিরতিরে নদী। বয়ে চলা পরিষ্কার নীল জল। তাকে ছায়া দিচ্ছে গাছপালা। নদীও পরিবর্তে দিচ্ছে দুই পাড় সবুজ রাখার অঙ্গীকার। এরই মধ্যে কিছু পর্যটক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী কায়াক, ক্যানু চালাচ্ছে। ঘন্টায় ভাড়াও পাওয়া যায় নৌকাগুলি। আমার আফসোস হল নৌকো চালাতে না পারার জন্য। যাই হোক, মনের দুঃখ মনে রেখে আমি চললাম ক্যাথিড্রাল অভিমুখে।
অন্যান্য নর্ডিক দেশের শহরগুলির মতো উপসালার বাড়িগুলিতেও সঙ্গের সমাহার। এবং গোটা শহরটি জ্যামিতিক। রাস্তা-বাড়ি-অফিস-গীর্জা সবকিছুর মধ্যেই একটি জ্যামিতিক মিল আছে। যাকে প্যাটার্ন বলা যেতে পারে। রাস্তাঘাট ও সমকোণে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। জ্যামিতি ও রঙ যেন একে অপরের পরিপূরক। এরই মধ্যে ছাত্র ছাত্রীদের কাজ-প্রেম-ভালোবাসা-আদর চলছে। দেখি রাস্তায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। পরে আলাপ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্র। ছুটিতে বেড়াতে যাবার জন্য টাকা তুলছে গান গেয়ে।
ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ম্যাপ অনুযায়ী চলা শুরু করলাম। আমার প্রথম গন্তব্য ছিল, উপসালার ক্যাথিড্রাল। চলতে চলতে আমি একটু উপসালার ইতিহাসটা বলে নিই। আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে উপসালা শহরটির পত্তন হয়। বর্তমান শহরটির প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে। ফাইরিস নদীর ধারে। তখনও খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার ঘটেনি সুইডেনে। এই ছিল একটি “পেগান শহর” ক্রমে ক্রমে শহরটি হয়ে ওঠে উত্তর ইউরোপের ধর্ম ও রাজনৈতিক চর্চার প্রধান পীঠস্থান। ১০৮৭ সালে শহরটি রহস্যময় কারণে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এরপর ধীরে ধীরে শহরটির খ্রীষ্টীয়করণ ঘটে। কোনও অজ্ঞাত কারণে এর কিছুদিন পর থেকেই ফাইরিস নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলত বন্ধ হয় বাণিজ্য।
শহরটি স্থানান্তরিত হয় ফাইরিস নদীপথ চলে কিছুটা দক্ষিণে। এটিই বর্তমান শহর। পুরোনো শহর অর্থাৎ গামলা উপসালা বর্তমানে টিলার নিচে চাপা পড়ে আছে। এর কথা পরে বলছি।
নতুন শহরটি মোটামুটি গড়ে উঠতে শুরু করে দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি থাকে। প্রথমে বন্দর ও লোকালয় এবং ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে উপসালা ক্যাথিড্রাল। ১৪৭৭ সালে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ১৫২৩ সালে সুইডেনের রূপকার রাজা গুস্তভ ভাসা গোটা সুইডেন নিজের দখলে আনতে সক্ষম হন কিন্তু উপসালার পরিবর্তে স্টকহোম হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ শহর তথা রাজধানী। তবে বর্তমান কেল্লাটি তাঁর তৈরী।
সুইডেনের কিংবদন্তি রাজা দ্বিতীয় গুস্তভ এডলফ রাজ সিংহাসনে আসীন হবার পর উপসালা পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় সাহিত্য, দর্শন, জীবনবিজ্ঞান, অনেক শাস্ত্রচর্চা। ক্রমে ক্রমে সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় এই প্রতিষ্ঠানের নামডাক। কিন্তু বিধাতা মনে হয় অলক্ষ্যে মুখ টিপে হেসেছিলেন। ১৭০২ সালে বিধ্বংসী আগুনে আবার গোটা শহরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার প্রায় ২০০ বছর পর বিংশ শতাব্দীতে কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় আবার গড়ে ওঠে শহরটি।
এত বিস্তারিত বলার কারণ পরবর্তীকালে বহু ক্ষেত্রেই রাজাদের নাম, নদীর কথা আসবে। ইতিমধ্যে আমি এসে পোঁছেছি ফাইরিস নদীর ধারে। তিরতিরে নদী। বয়ে চলা পরিষ্কার নীল জল। তাকে ছায়া দিচ্ছে গাছপালা। নদীও পরিবর্তে দিচ্ছে দুই পাড় সবুজ রাখার অঙ্গীকার। এরই মধ্যে কিছু পর্যটক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী কায়াক, ক্যানু চালাচ্ছে। ঘন্টায় ভাড়াও পাওয়া যায় নৌকাগুলি। আমার আফসোস হল নৌকো চালাতে না পারার জন্য। যাই হোক, মনের দুঃখ মনে রেখে আমি চললাম ক্যাথিড্রাল অভিমুখে।
অন্যান্য নর্ডিক দেশের শহরগুলির মতো উপসালার বাড়িগুলিতেও সঙ্গের সমাহার। এবং গোটা শহরটি জ্যামিতিক। রাস্তা-বাড়ি-অফিস-গীর্জা সবকিছুর মধ্যেই একটি জ্যামিতিক মিল আছে। যাকে প্যাটার্ন বলা যেতে পারে। রাস্তাঘাট ও সমকোণে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। জ্যামিতি ও রঙ যেন একে অপরের পরিপূরক। এরই মধ্যে ছাত্র ছাত্রীদের কাজ-প্রেম-ভালোবাসা-আদর চলছে। দেখি রাস্তায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। পরে আলাপ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্র। ছুটিতে বেড়াতে যাবার জন্য টাকা তুলছে গান গেয়ে।
এরপর এগিয়ে একটি “আর্চ ওয়ে” পেরিয়েই পৌঁছে গেলাম উপসালা ক্যাথিড্রালের সামনে। ফ্রেঞ্চ-গথিক স্থাপত্য ঘরানার এই ক্যাথেড্রালটি নর্ডিক দেশগুলির মধ্যে উচ্চতম। পশ্চিম দিক থেকে দেখলে “টুইন টাওয়ার” মনে হয়। ভিতরে ঢুকতেই এক স্নিগ্ধ প্রশান্তি মনে ছেয়ে গেল। তার কারণ সুর। একটি মন ছোঁয়া সুর ভেসে আসছে। সুরের সন্ধানে চলে দেখলাম, এক প্রবীণ ভদ্রলোক দুই হাত, পা, মুখ্যভবর সব কিছুর প্রয়োগে একটি অদ্ভুত যন্ত্র বাজাচ্ছেন। এ যন্ত্র আগে কখনও দেখিনি। নামও জানি না। কিন্তু তার যা সুর তা সর্বনাশা!! একটি গান শেষ হতেই দেখলাম, একটি বছর কুড়ি-একুশের মেয়ে প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রবীণকে জড়িয়ে ধরল।
এর পর ভিতরে থাকা একটু অসমীচীন ভেবেই আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। ক্যাথিড্রালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুস্তাভিনাম। রাজা গুস্তভ আডলফের নামে। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। আমার দুইবার উপসালা ভ্রমণই রবিবার হওয়ায় কোনোবারই মিউজিয়ামে প্রবেশ করা হয়নি। দক্ষিণ দিকে কিছু দূর এগিয়েই সবুজে মোড়া এক রাস্তা দিয়ে কিছুটা চড়াই উঠে পৌঁছলাম উপসালা কাসল। টিলার উপর দুর্গটি শহরের স্থানও বটে। উপর থেকে দেখলে পূর্ব দিকে গোটা শহরটাকে অদ্ভুত সুন্দর সবুজ কার্পেট ,যার মাঝে বাড়িগুলি যেন কার্পেটের উপর বুটির কাজ। দুর্গের মধ্যে বর্তমানে কিছু রেস্তোরাঁ ও কিউরিও শপ। ছাত্রছাত্রীরাই চালাচ্ছেন। দুর্গের পশ্চিমে এসে দেখি উপসালার বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন।
জীবন বিজ্ঞানের পিতৃপুরুষ কার্ল লিনিয়াসের নাম পড়েছিলাম ক্লাস সেভেনে। যাঁর বিখ্যাত কাজ সমস্ত জীবজগতের প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদের দ্বিপদ নামকরণ। ইংরিজিতে যাকে বলে “বাইনোমিয়াল নোমেনক্লেচার”। লিনিয়াস ছিলেন উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। উপসালার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সবুজের সমারোহ। যার মূলে আছে কিছু বোটানিক্যাল গার্ডেন। সবচেয়ে বড় বোটানিক্যাল গার্ডেনটি দুর্গের পশ্চিমে। কিছুটা ঢালু পথে নেমে এসে। কার্ল লিনিয়াসের গবেষণার জন্য রাজা গুস্তভ এডলফ এই গার্ডেনের জন্য বিশাল জমি উপহার দেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। সেই সময় থেকে শুরু হয়ে আজও এই গার্ডেন চলে অধ্যাপক, গবেষক, ছাত্রদের নিরলস পরিশ্রমে। অধ্যবসায়। গবেষণায়।
মূল উদ্যানটির মধ্যে অনেকগুলি লাগোয়া “গ্রীন হাউস”। ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টে ঢুকে হঠাৎ বেশ গরম লাগতে শুরু করল। আসলে গ্রীন হাউসের শর্তই হল ভিতরে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের তাপমাত্রা তৈরী করে রাখা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বহু নাম না জানা গাছ, নাম না জানা ফুল দেখে নিজেকে যেন বিশ্বযাত্রী মনে হচ্ছিল। চমক ভাঙল খিদে পাওয়ায়।
বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বেরিয়েই ঠিক করলাম খেয়ে নেব। পরবর্তী গন্তব্যের দিকে যাওয়ার পথে উপসালা মেইন স্কোয়ারেই পড়বে বেশ কিছু নাম করা রেস্তোরাঁ। যেগুলিতে ওয়েটারের কাজ করে ছাত্র-ছাত্রীরা। কিছু উপার্জন ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। সেই দিকে যেতে যেতেই একটি ফুড ট্রাকে “ফালাফেল রাপ” দেখে মন ছুটে গেল সেখানেই। মোটামুটি তাৎক্ষণিক খাবারের পসরা নিয়ে যে ক্যারাভান বা ট্রাকগুলি রাস্তার ধারে বসে, তাকেই ফুড ট্রাক বলে। এই শহরে ট্রাকগুলিতেও যথারীতি ছাত্রছাত্রীরাই বসেছেন। আমি একটি চিকেন ফালাফেল রাপ ও এক কাপ কফি দিয়ে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারলাম।
পরবর্তী গন্তব্য লিনিয়াস গার্ডেন। এটি উপসালার ওপর এক বোটানিক্যাল গার্ডেন। আদতে এটি ছিল অধ্যাপকদের বাসগৃহ। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় এ ছিল চাঁদের হাট। এখানেই থাকতেন অধ্যাপক লিনিয়াস। বর্তমান বাড়িটি তার নামেই। বিখ্যাত পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী এন্ডার্স সেলসিয়াস থাকতেন এই বাড়িতে। যিনি আবিষ্কার করেন তাপমাত্রার সেলসিয়াস স্কেল।
যাবার পথে দেখি বিভিন্ন বয়সের বহু মানুষ রাস্তার শেয়ার গান গাইছেন গিটার-ইউকুলেলে -একর্ডিয়ান-বেহালা-হারমোনিকা আরও বহু যন্ত্র নিয়ে। বেশিরভাগই ছাত্র-ছাত্রী। সুইডিশরা গানপ্রিয় জাতি। একসময় দুনিয়া কাঁপিয়েছিল সুইডেনের “আবা ব্যান্ড”, এখনও তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্র ও এ্যালবাম নিয়ে বিখ্যাত আবা মিউজিয়াম আছে। পপ সংগীতের এই দলটিতে ছিলেন ৪জন – বিয়র্ন, বেনি, আজেন্টা ও আনি ফ্রিড। ১৯৭২-এ এঁদের যাত্রা শুরু হয়। ৩৮০ মিলিয়নেরও বেশী রেকর্ড বিক্রি হয় সারা পৃথিবী জুড়ে। অবশ্যই ঢুকে পড়েন পৃথিবীর “অল টাইম হিট” এর লিস্টে। দুইজন বয়স্ক ভদ্রলোক দেখি দুটি বেহালা নিয়ে রাস্তার ধারে গান গাইছেন। সুরটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। কিছুটা ভাটিয়ালি। আলাপ হল। দুজনেই সত্তরোর্ধ্ব। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। পড়াতেনও। এখন অবসর। ছুটির দিনে আসেন শুধুমাত্র গান শোনাতে। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও গান গেয়ে যা রোজগার হবে তা দিয়ে দুই বন্ধুতে বসে বিয়ার খাবেন। অবাক হয়ে গেলাম, উপমহাদেশীয় লোকগানে ওঁদের প্রজ্ঞা দেখে। ভাটিয়ালি সুরের ছোঁয়া ওঁদের গানে তা আগেই বলেছি। এর পরে কথায় কথায় বললেন, অন্যান্য লোকসঙ্গীত যেমন বিহু, বাউল, ভাওয়াইয়ার নাম। যখন চলে আসছি, আমার জন্য একটি সুর বেহালায় বাজালেন। কিছুটা ঝুমুরের মত।
লিনিয়াস গার্ডেন থেকে যখন বেরোচ্ছি, জানলাম, তখন সেখানে একটি পরিবেশ বিষয়ক নৃত্য আলেখ্য অনুষ্ঠিত হবে। দেখলাম একদল ছেলেমেয়ের একটি সুন্দর উপস্থাপনা। একটি গানের সুর তো আবার “আয় তবে সহচরী”র মতো লাগল।
পরবর্তী গন্তব্য গামলা উপসালা বা উপসালার পুরোনো শহর। এর ইতিহাস শুরুতেই বলেছি। বাস ধরে যেতে হবে। ভাবলাম, একটি স্থানীয় পাবে বসে বিয়ার খেয়ে তারপর যাব। রোদ্দুরটা যদি একটু পড়ে। পাবে বসে একটি বিয়ার নিয়ে ডায়েরী লিখছি, সামনের টেবিলে দেখি দুটি ছেলে পড়াশোনা করছে। দেখে মনে হল অঙ্ক কষছে। কারণ পাশে ক্যালকুলেটার। একটি করে অঙ্ক মিলে গেলেই ছেলে দুটি একে অপরকে আদর করছে। সমপ্রেম সুইডেন তথা গোটা ইউরোপেই আইনসিদ্ধ। বেশ লাগছিল ওদের দেখে। একসঙ্গে পড়াশোনা, তাও প্রেম, ভালোবাসা, আদর, আশ্লেষে পরিপূর্ণ।
গামলা উপসালায় পৌঁছেই চোখ জুড়িয়ে দেওয়া নরম গালিচার মতো ঘাসে ঢাকা কয়েকটি টিলা। যা প্রকৃতির কোলে এঁকেছে স্নিগ্ধ ল্যান্ডস্কেপ। টিলাগুলির নিচেই রয়েছে পুরনো ইতিহাস। কোনো শুরু হলেও পরে বন্ধ হয়ে যায়। এই টিলাগুলিকে বলা হয় “সুইডিশ রয়াল মাউন্ড”। স্থানীয় লোককথা অনুসারে প্রধান তিনটি টিলা থর, ওডিন, ফ্রেইর – উত্তর ইউরোপের তিন দেবতার নামে। এই অঞ্চলের অপর আকর্ষণ মধ্যযুগেরও অনেক আগে নির্মিত একটি ছোট্ট আর্চবিশপীয় গীর্জা। গীর্জাটিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন বুড়ি ঠাকুমা,যার ঝুলিতে আছে অনেক অনেক গল্প। চুপচাপ বসেছিলাম সেই চার্চের ছায়ায়।
হয়তো অনেক্ষন বসেছিলাম। হঠাৎ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যে সাতটা। নামেই সন্ধে। আকাশে তখনও ঝকঝকে সূর্য। মে মাসের মাঝামাঝি মধ্য সুইডেনে সূর্যাস্ত হয় দশটার পর। তবুও বাসায় ফিরতে হবে। ট্রেনে করে। তাড়াতাড়ি একটা বাস ধরে উপসালা স্টেশনে এলাম। পরবর্তী ট্রেন রাত সাড়ে আটটায়। স্টেশনে একটি ক্যান বিয়ার নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আলাপ হল রাস্তার ধারে গান গাইতে থাকা এক দম্পতির সাথে। ছেলেটির নাম পেদ্রো। বাড়ি স্পেনে। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গান গাইছিলেন গিটার নিয়ে। পাশে প্রেয়সী কামিলা। ম্যান্ডোলিন নিয়ে। পোল্যান্ড থেকে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রেম। এবারে দুজনে ঘুরতে যাবেন গ্রিনল্যান্ড। পয়সা নেই। সম্বল গান। অক্লান্ত এক সুরেলা কাপল গেয়ে যাচ্ছেন একের পর এক গান। লোকে দাঁড়িয়ে শুনছে। পয়সা দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেলেই আদরে ভিজিয়ে দিচ্ছেন পরস্পরের ঠোঁট। এভাবেই আর কয়েকদিনের মধ্যে বাকি টাকাটা উঠে আসবে। দুজনেই তখন যাবেন ঘুরতে। গ্রিনল্যান্ডের মোহময় পরিবেশে যাপন করবেন নিজেদের মধুঋতু। তাতে হয়তো রং ঢালবে শিমুলের মতো কোনো ফুল।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে ভাবছিলাম। একটি শহর কেমন যেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই গড়ে উঠেছে। একবারে যেন সভ্যতার জরায়ু। এখানে এসে মিশে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর সংস্কৃতি। মার্থা, পেদ্রো, কামিলা সকলেই যেন নিজেদের সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট বীজ এই জরায়ুতেই বপন করেছে। আবার এখান থেকেই জল, মাটি, বাতাস নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তারাও আবার পান করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তন্য, যাতে মিশে আছে সারা বিশ্বের সংস্কৃতির পুষ্টিগুণ। এরপর এরা ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর অন্য দেশে। অন্য শহরে। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের আম্বেলিকাল কর্ড এদের মাধ্যমেই সারা পৃথিবীকে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করবে।