ফাইভ হান্ড্রেড ইয়ারস অফ ইন্ডিপেন্ডেনস্… – মঞ্জীরা সাহা
গতকাল থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। থম মেরে আছে আকাশটা। গুমোট গরম। পুরোনো বৃষ্টির কাদায় এখনও প্যাচপ্যাচ করছে চারপাশ। মাটি জমছে গলার ঘামে। মেয়েগুলো হাঁটছে পুকুরের দিকে। বিলের ধারের ঘন সবুজ রঙের ভেতর ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে শাড়ির রঙ উঁকি মারছে। কাদার উপর পা ডুবিয়ে উপুড় হয়ে তিন মহিলা। কলমি শাক তুলছে ওরা। পানি কচুর জঙ্গল আর আগাছা বাড়তে বাড়তে বিলের রাস্তাটা ছোটো হয়ে গেছে। ওই বিলের রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে ডানে মোড় নিলেই পিচের রাস্তা। পাকা রাস্তাটা সোজা চলে গেলেও যে জায়গাটায় যাচ্ছে সেখানে অতটা সোজাসুজি পৌঁছানো যায় না। সোজা গিয়ে ধাক্কা খেতে হবে বন্ধ গেটে। ওটা দেশের গেট। ওপারে জংলা ছাপার ইউনিফর্ম পরে বসে আছে বন্দুকধারী। গেটের ডানে বাঁয়ে যতদূর তাকানো যায় কালো কালো ঘোরানো প্যাঁচানো তারকাঁটা। ওখানে এই বিল, কলমি শাক, পাঁক জল, কচু বন এসব ম্যাপের সীমারেখায় ঠিক ভারতেও না বাংলাদেশও না।
ওই কচু বন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হঠাৎ মাটির দিকে তাকালে অন্য কিছু চোখে পড়ে। কাদামাটি গাছপালা লতাপাতা পোকামাকড়ের মাঝে সেই তিয়াত্তর বছর আগে সেগুলো কারা বসিয়ে দিয়ে গেছিল। হাঁটু সমান লোহার পিলার। তাতে ঢালাই লোহায় একদিকে লেখা ইন্ড তারপর ছোটো একখানা দাগ আরেক দিকে লেখা পাক। নিচে কতকগুলো সংখ্যা। ওগুলো জিরো পয়েন্টের ভাগ। কোন্ জমিটা, কোন্ গাছটা, কোন্ পুকুর ইন্ডিয়ার কোন্টা পাকিস্তানের বোঝানোর জন্য। ওই পিলারে পাকিস্তানই রয়ে গেছে সেই থেকে। পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে গেছে আরও অনেক পরে। পিলারের লেখাগুলোর বদল হয়নি।
ওই জিরো পয়েন্টের পাড়াটা থেকে হাত ধরাধরি করে মেয়েরা হাঁটছে পুকুর ঘাটের দিকে। ওরা ওই কুলোপাড়ায় থাকে। কুলোপাড়া তারকাঁটার ওপারের ইন্ডিয়ার পাড়া। কুলোপাড়ার পাশাপাশি আরও দুটো পাড়া ছিল। দাসপাড়া আর কাহারপাড়া। নদীয়ার এ এলাকায় দেশভাগের পর তারকাঁটা বসে গিয়ে ওই পাড়াগুলো চেনাতে নতুন শব্দ যোগ হয়ে গেছে সাথে। ‘ওপারের পাড়া’। দাস পাড়ার সবাই উঠে চলে এসেছে এপারে। আর কাহার পাড়ার মানুষেরা কবে কোথায় চলে গেছে জানা নেই। ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর উপর দিয়ে জংলা গাছ গজাতে গজাতে জঙ্গল হয়ে গেছে জায়গাটা। কুলোপাড়ার মানুষগুলো থেকে গেছে ওভাবেই ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশের মাঝখানে সেই তিয়াত্তর বছর ধরে।
ক-দিনের বৃষ্টিতে ঢালাই লোহার পিলার গুলোতে কাদামাটি লেগে আছে। নম্বরগুলো কাদায় মাখামাখি।
ওই মেয়ে তিনজন ক্লাস ফাইভে পড়ে। বিলের ডান দিকে মোড় ঘুরে পাকা রাস্তায় পড়ল ওরা এইমাত্র। ওদের ইউনিফর্মের ঘামের হলুদ ছোপওয়ালা সাদা-শার্ট অবধি হাওয়াই চটির কাদা ছিটোচ্ছে। কাদার ছিটেগুলো দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। এখন সকাল সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। পিঠে ব্যাগ নেই। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান আজ ইস্কুলে। দুজনের হাতে স্টিলের ক্যান দুলছে। ইস্কুলটা ওইপারে। জিরো পয়েন্টে কোনও ইস্কুল নেই। কোনও বাজার নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। ক্লাব নেই। মেলা নেই। ফাংশান নেই। পাহারাদার আছে। বিএসএফ আর বিজিবি-র আনাগোনা আছে। আর আছে কাঁটাতারে চামড়া মাংস কেটে যাওয়া গরুর চিৎকার। সাইকেল পার্টসের ঝনঝন আওয়াজ। গরুর ছোটাছুটি। বারো-পনেরো-সতেরোর ছেলেগুলির ছোটাছুটি। উর্দিপরা, উর্দি ছাড়া আরও অন্য সব মানুষের ছোটাছুটি। আছে গুলির আওয়াজ। আছে বড়ো বড়ো সার্চ লাইটের আলো। ঘোর অমাবস্যায় ঝকঝকে আলো।
গেট দিনে তিনবার খোলে। ঝামেলা বাঁধলে টাইম বদলে যায়। বা বন্ধ থাকে। ওদের গেটের এপারে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আসতে, প্রসব যন্ত্রণায় হাসপাতালে আসতে, ইস্কুলে পড়তে আসতে, শ্বাসটান উঠলে, বডি আনতে সব কিছুর নির্ঘন্ট ঠিক হয় গেট খোলা-বন্ধের টাইমের সাথে আর পাহারাদারের মর্জির সাথে সাথে। আজ ভোরের গেট খুলেছে ৬টায়। মেয়ে দুটো এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে। গেট থেকে এপারে আসছে কাস্তে কোদাল ঝুড়ি নিয়ে তিনজন। ওদের বডি সার্চ হয়েছে গেটের ওপারে এইমাত্র। ওরা মাঠে যাচ্ছে। জিরো পয়েন্টের মাঠে লেবারের কাজ করে। মেয়েগুলো একে একে অল্প ফাঁক করা গেট দিয়ে বেরোচ্ছে। ছাপা ছাপা উর্দিপরা পাহারাদার ওদের ফাঁকা ক্যানদুটো খুলে উঁকি মেরে দেখল। হিন্দিতে কীসব বলল। এবার ওরা এগিয়ে যাচ্ছে বর্ডার রোড ক্রস করে গিয়ে ধঞ্চের মাঠের পাশ দিয়ে। গেটের ওপার-এপার দেখতে কোনও ফারাক নেই। সবুজের কোনও ফারাক নেই। সব এক। ইস্কুলের গেট দিয়ে ঢুকছে ওরা। দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝখানের কোনও একটা লাইনের একেবারে শেষে। অনেকক্ষণ আগে শুরু হয়ে গেছে অনুষ্ঠান। পতাকা তোলা হয়ে গেছে। ঝকঝকে সাদা শাড়ি পরে নাচছে ক্লাস এইটের ফার্স্ট গার্ল। বক্তৃতা দিচ্ছেন হেডস্যার। জয় হিন্দ জয় হিন্দ্ জয় হিন্দ্ …। ওরাও চ্যাঁচাচ্ছে সবার সাথে। থু থু ছিটছে ওদের ঘা-ওয়ালা ঠোঁট দিয়ে। অনুষ্ঠান শেষ। পতাকা নেমে গেছে। কাদার উপর হলুদ হলুদ গাঁদা ফুলের পাপড়িগুলো ডেবে যাচ্ছে ছেলেদের পায়ের পাড়ায়। জিলিপি হাতে নিয়ে খাচ্ছে ওরা বকুল গাছের তলায়। হাত ভর্তি চ্যাটচ্যাট করছে আঠা। একুশ পাইপের কল চেপে হাত ধুচ্ছে। মিড-ডে মিলের ঘর থেকে খিচুড়ি ভরে নিয়ে এবার পাঁইপাঁই করে হাঁটা লাগিয়েছে ইস্কুল থেকে বেরিয়ে। ধঞ্চের পুকুর পার হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে চলেছে। ছুটতে শুরু করল। দশটা বাজলে গেট বন্ধ হয়ে যাবে। খুলবে আবার বেলা একটায়। ওরা ছুটছে। ক্যানের মুখ বেয়ে ঝোলা খিচুড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। নীল স্কার্টে খিচুড়ি লেগে হলুদ হলুদ দাগ লেগে যাচ্ছে ইস্কুলের ইউনিফর্মে। আর একটু দূর। সামান্য দূর। ছুটছে…। না গেট খোলা আছে এখনও। দাঁড়িয়ে পড়েছে পাহারাদার। ওরা চ্যাঁচাচ্ছে কি যেন একটা বলে। ওরা পৌঁছেছে গেটের একেবারে মুখে। দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ওদের। খিচুড়ির ক্যান খুলে নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখছে ওই ছাপা ড্রেসের পাহারাদার। চাল-ডাল-নুন-হলুদের ভেতর আর কী আছে?
গেট ফাঁকা করে দিল অল্প। ঢুকে পড়ল ওরা গেট দিয়ে। গেট আটকে গেল। সাদা রঙ করা গেটে এনামেল কালারে আঁকা লেখাগুলোর উপর দিয়ে জঙ পড়েছে। জঙের উপর থেকে লেখাটা পড়া যাচ্ছে। বাঁ গেট থেকে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘সেলিব্রেশন অফ ফিফটি ইয়ারস অফ ইন্ডিপেনডেন্স’। শিকল জড়িয়ে তালা পড়ল গেটে।
এটা গত বছরের কথা। এ বছর তো লকডাউন। চুয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে ওরা স্কুলে যায়নি। পঁচাত্তরতম, ছিয়াত্তরতম, সাতাত্তরতম-তে আবার যাবে নিশ্চয়ই।
গতবছর ওদের একজন ক্লাসে বসে বসে ছবি এঁকেছিল। বর্ডারের ছবি। অংকের খাতার শেষ পাতায়। এঁকেছিল ওই গেট। পাহারাদারের থেকে নলওয়ালা বন্দুকের সাইজটা বড়ো। গেটের উপর লেখাটা আঁকতে ওদের একটুখানি ভুল হয়ে গেছিল। গেটের ছবির উপর লিখেছিল সেলিব্রেশন অফ ফাইভ হান্ড্রেড ইয়ারস অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স। লিখেছিল সংখ্যায়। ছোট্ট একটা ভুল। একটা শূন্য কেবল ডানপাশে বেশি।
গল্পটা সত্যি বেশ ভালো লাগলো। গল্পের শেষ টা অসীমের সীমায় এনে দাঁড় করালো আমায়।
তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলির মধ্যে – ভারত ও বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রান্তিক জীবনের উন্নয়ন হীন আর্থসামাজিক পরিকাঠামো, অনুন্নত জীবনের মান, স্বাধীনতার এত বসন্ত পার হবার পরেও ; স্বাধীনতা পূর্ব কালো সাদা জীবনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – দারিদ্র্যতা – অশিক্ষার দৃশ্যপট গুলি যেন চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে ছোট ছোট বাক্য যুক্ত বর্ণনার মাধ্যমে ।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই নির্মম অবস্থা প্রমাণ করে উন্নতির গ্রাফচিত্র কত কত ধীর; ফলতঃ আগামীতেও এইরূপ বর্ণনাযুক্ত নিদারুণ বৈষম্যের নানান দৃশ্যপট বহুল রূপে নানান লেখনীতে উঠে আসবে তা বলাই বাহুল্য ।
সুন্দর ।
🙏🙏🙏
অনেক ধন্যবাদ