শিক্ষক চেয়ে বুলেট! – রিমি মুৎসুদ্দি
ছাত্রদের দাবী অনায্য নয় মেনে নিয়েও যদি বলি ছাত্ররা চরম বিশৃঙ্খলা করেছিল। তাহলেও কোনও বিশৃঙ্খলতাই ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোকে যাস্টিফাই করেনা। এই নৃশংসতার সাক্ষী আমাদের রাজ্যই। শুধু আজকে নয়। অতীত ফিরে ফিরে আসে। কংগ্রেস-নকশাল আমল ছেড়েই দিলাম। বাম আমলেও ঘটেছে এ ঘটনা। আজও ঘটল।
রাজনীতির রঙ ঘটনার ওপর চড়তে শুরু করেছে। এই প্রসঙ্গে নিজের লেখা একটা গল্পই মনে পড়ল। বর্তমান সংবাদপত্রের রোববারের পাতায় প্রকাশিত, ‘একটা মৃত্যু ও কয়েকটা পতাকা।’ মেদিনীপুরের সবং-এ একটি কলেজে ছাত্র হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকরণ। পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটাও এখন একইরকম। সবই রাজনৈতিক দল বনধ ডাকছে। একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে। স্লোগান, মিছিল, মিটিং-এ উত্তপ্ত বাংলার আকাশ। রাজনৈতিক নেতারা ও মিডিয়া একটা লাশ পেয়ে গেছেন। তপ্ত টাটকা একাদশ শ্রেণীর একটা কিশোরের লাশ। রাজনীতির রঙ পড়বে তার ওপর। ধর্মের চিহ্নও ব্যবহার হবে। কারণ ঘটনাস্থলের নাম ইসলামপুর আর মৃত ছেলেটিও হিন্দু। কিন্তু আমি একজন মা। তাই মায়ের কথাটাই মনে হচ্ছে শুধু। মা তো তার সন্তান হারাল। বোন হারাল দাদা। বন্ধুরা, সহপাঠীরা সবাই হারাল তাদের প্রিয়জনকে। কোন রাজনীতি, কোন ধর্মীয় ভাবনা এই শোকের সান্ত্বনা হবে? ভাগ নেবে এই যন্ত্রণার? প্রশ্ন থেকে যায়। প্রবলভাবেই।
‘Ask no questions of our patriotic police and you will be told no lies.’-Fascism Shall Not Pass, Ashok Mitra, Calcutta Diaries
প্রশ্ন করা চলবে না। কখনওই। ৭২-এর পশ্চিমবঙ্গের এই চিত্রটা এখনও বদলায়নি। আরও ভয়ংকরভাবে ফিরে আসছে এই সময়ে। তাই যে রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ হতে চায় সেই রাজ্যেই বাংলা শিক্ষকের দাবীতে ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। প্রশ্নটা শুধু ছাত্রদের দাবীদাওয়া নিয়ে নয়। প্রশ্নটা কোথাও একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কাছে জোর করে করা নতিস্বীকারও। যেখানে বিরোধিতার কোনও পরিসর থাকবেই না। কী রাজ্যে, কী কেন্দ্রে? সমগ্র দেশেই।
ছাত্ররা কেন রাজনীতি করবে- এই প্রশ্ন আমাদের ছাত্রজীবন থেকে ও তারও আগে থেকে চলে আসছে। ভি এস নইপল তার India a Million Mutinies Now-তে লিখেছেন, তিনি তাঁর বন্ধু প্রেসিডেন্সি কলেজের একসময়ের মেধাবী ছাত্রের হঠাৎ নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে সর্বস্ব হারানো দেখে অত্যন্ত অবাক হয়েছিলেন। প্রশ্নও করেছিলেন তাঁর বন্ধুকে। বন্ধুর উত্তরে জানতে পারেন, প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রায় সমস্ত ছাত্রমনেই তখন নকশালবাড়ি খুব দাগ কেটেছিল। আর ওনারা, যাঁরা দিনের পর দিন ক্লাশরুম ছেড়ে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে গরিব চাষীদের নায্য অধিকার আদায় আন্দোলনের জন্য লড়াই করেছিলেন, অবশ্য লড়াই বলতে চাষী মজুরদের নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা। শিক্ষিত করে তোলা। তাঁরা প্রত্যেকেই নকশালবাড়ি আন্দোলনে অনুপ্রাণিত। যে মার্কসিজম বইয়ের পাতায় পড়েছেন, নকশালবাড়িতে কার্লমাক্সের নামও না জানা কিছু অশিক্ষিত ক্ষেতমজুর সেই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। নিজেদের অধিকারের জন্য অস্ত্র ধরেছেন জমির মালিক ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এই ঘটনা তাঁদের তরুণ মনে এমন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল যে তাঁরা সবকিছু ছাড়তে দুবার ভাবেননি।
পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন ব্যর্থ বা সফল সে আলোচনা এখন নিষ্প্রয়োজন। যে ভূমিসংস্কার একসময়ে গরীবচাষীদের জমির মালিকানা দিয়েছিল, টুকরো হয়ে যাওয়া সেই জমির মালিকানাই আজ পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ ইণ্ডাস্ট্রিহাব গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। ধনতান্ত্রিক ধারণায় পরিপুষ্ট জনকল্যাণনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব।
প্রশ্ন সেসব ছাপিয়েও এই সময়ে ঘটে যাওয়া ফ্যাসিজমের ওপর। চরম নৈরাজ্যের ওপর। একটা প্রশ্ন আরও যুক্ত করতে ইচ্ছে হল। একটা ছাত্রের ওপর গুলি চললে প্রশাসনের ওপর দায়ভার এসে পড়বে এবং জনরোষের প্রভাব অবশ্যই নির্বাচনী ফলাফলের ওপর এসে পড়বে- এই সহজ অঙ্কটুকুর জন্যই প্রশাসনের পক্ষ থেকে গুলি চালানোর নির্দেশ একেবারেই সম্ভব নয়। তবুও গুলি চলল। যদিও স্বীকার করা হয়নি তা। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রের মৃত্যু ঘটেছে। তাই খুব বড় প্রশ্ন দায় কার? কে আসল অপরাধী? এই ঘটনা কেন্দ্র করে আরও যত অপরাধ ঘটে যাবে বাংলার বুকে তার দায়ভারও বা কার? শুধুই প্রশাসনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যেকোনও বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরই অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ হবে।