পুজোর একাল সেকাল – অন্তরা ঘোষ
ছোটবেলা থেকেই দিল্লিতে বড়ো হওয়া সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া মৌপিয়া আজ খুব খুশি। প্রায় দশ বছর পর গ্রামের বাড়িতে পুজো দেখতে এসেছে। বাবা যেহেতু এয়ারফোর্সে চাকরি করে তাই ছুটি পাওয়ার বিশাল সমস্যা। সেজন্য এতবছর ইচ্ছে থাকলেও গ্রামে আসতে পারেনি মৌপিয়ারা। বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে ওদের আদি বাড়ি। বিশাল বনেদি বাড়ি।
মৌপিয়ার দাদুরা পাঁচ ভাই ছিলেন। মৌপিয়ার ঠাকুরদার বাবা এককালে এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। যদিও জমিদারি চলে গেছে কিন্তু জমিদারির ঠাটবাট এখনো আছে। প্রায় দুশো বছরের পুরানো দুর্গাপুজো হয় গ্রামে। জমিদাররাই এই দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন।পাঁচ ভাইয়ের বংশধররা এখন এখানে বসবাস করে ও পুজো চালায়। পুরনো জমিদার বাড়ি ভেঙেচুরে নতুন করে বিশাল বনেদি বাড়ি করা হয়েছে। অনেক আত্মীয়স্বজন এই বাড়িতে থাকেন। মৌপিয়া ওর বাবা-মায়ের সাথে আজ সকাল ১১ টায় এসে পৌঁছেছে। মৌপিয়ার সবকিছু খুব অভিনব ও সুন্দর লাগছে। সেই কোন্ ছোটবেলায় একবার এসেছিল। খুব আবছা স্মৃতি ছিল মনের মধ্যে। দিল্লির তিন কামরার ফ্ল্যাটে থাকা অভ্যাস মৌপিয়ার। এত বড় বনেদি বাড়ি যে ওর দাদুর বাড়ি দেখে বেশ মনে মনে গর্ব হচ্ছে মৌপিয়ার।
বিশাল তিনতলা বাড়ি এক এক তলায় কুড়িটা করে ঘর। অনেক ঘর তালাবন্ধ পরে আছে। এখনো জমিদারের বেশ কিছু অ্যান্টিক জিনিস মৌপিয়ার চোখে পড়ল। যেমন হুঁকো, গড়গড়া, শোকেসে সাজানো বড়ো বন্দুক, গ্রামোফোন রেকর্ড, দেয়ালে টাঙানো কাঠের ফ্রেমে হরিণের মাথা, বিরাট বিরাট অয়েল পেইন্টিং যেখানে পূর্বপুরুষদের ছবি ইত্যাদি। বিশাল লন পেরিয়ে বাড়ি ঢুকতেই মৌপিয়া দেখল খুব ফর্সা গায়ের রঙ গোলগাল চেহারার সাদা শাড়ি পরা একজন ভদ্রমহিলা মিষ্টি হেসে মৌপিয়ার বাবাকে বলছে “আয় বাবা আয়… এত দেরি হল আসতে… কখন থেকে পথ দেখছি তোদের।”
কি সুন্দর স্নেহের সুর। বাবা বললেন “ইনি ফুল পিসি। প্রণাম করো”।
মৌপিয়া প্রণাম করতে যেতেই উনি দুই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন চিবুক ছুঁয়ে চুমু দিলেন। সব আত্মীয়স্বজন একে একে মৌপিয়াদের ঘিরে ধরল। পাঁচ জ্যাঠা-জেঠি তাদের ছেলে-মেয়ে। সবকিছু খুব ভালো লাগছিল মৌপিয়ার। সবার সাথে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাব হয়ে গেল। এরপর দুর্গা মন্দিরে গিয়ে মা দুর্গাকে প্রণাম করে এল মৌপিয়ারা।
বেশ কিছু আত্মীয়স্বজনের সাথে খুব ভাব হয়ে গেল মৌপিয়ার। রাঙা জেঠু, সেজ জেঠু, গৌরী পিসি, মানিক কাকু। রাঙা জেঠু খুব ফর্সা বলে নাকি সবাই রাঙা জেঠু বলে ডাকে। রাঙা জেঠুর ছোটবেলা কলকাতায় কেটেছে উনার বাবা কলকাতায় চাকরি করতেন বলে। এক মামা এসেছেন কলকাতা থেকে। গগন মামা ..মেজ জেঠির ভাই উনি । বয়স ষাট-বাষট্টি হবে কিন্তু দেখে বোঝা যায় না । খুব আমুদে। হাসি-গল্পে-ঠাট্টায় পুজো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছেন। এছাড়া আছে মালতী মাসি। আজ তিরিশ বছর ধরে এই বাড়িতেই আশ্রিতা। বাল্যবিধবা উনি। মৌপিয়ার দাদু উনাকে কোনো গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন । সেই থেকে ওদের বাড়িতেই রয়ে গেছেন।
সকালবেলা উঠে দোলা আনতে যাওয়া থেকে পুজো, আরতি, সন্ধিপুজো, পুষ্পাঞ্জলি, বলি, বিসর্জন ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে চারটে দিন খুব আনন্দ করে কাটল মৌপিয়ার। সঙ্গে সাবেকি দিনের বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া রান্না মৌপিয়া ক’দিন ধরে খেল। কাল চলে যাবে মৌপিয়ারা। খুব মন খারাপ সবার। সন্ধেবেলা গল্পের আসর বসল। গগন মামা বললেন “দিদিভাই তোমাদের দিল্লির পুজো কেমন হয় একটু বল শুনি।”
মৌপিয়া জবাব দিল, “মামা আমাদের ওখানে মোটা টাকা চাঁদা নিয়ে ক্যাম্পাসে পুজো হয়। চারদিন ধরে ওখানেই খাওয়া-দাওয়া। খাওয়া-দাওয়া বলতে চিকেন, মাটন, মাছ, ফ্রাই, রাইস, মিষ্টির আইটেম এগুলোই থাকে। সন্ধেবেলাগুলো ফাংশন হয়। বাইরে থেকে অর্কেস্ট্রা আনানো হয়। হিন্দি গান, নাচ হয়। একদিন ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদের নিয়েও নাচ-গান-আবৃত্তি-নাটক ইত্যাদি প্রোগ্রাম হয়। আমরা সেজেগুজে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই। আর সেলফি তুলতে থাকি। মা দুর্গার সাথে সেলফি নিই। বন্ধুদের মধ্যে কম্পিটিশন হয় যে কে কত তাড়াতাড়ি দুর্গাপুজো সেলফি এফবিতে আপলোড করবে। এই কদিন বাড়িতে মা বেশ ভালো ভালো কিছু আইটেম রান্না করে। বাবা বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে আসে। আমরা প্রচুর সাজগোজ করে প্যান্ডেলে যাই। তবে কি জানো তো মামা.. দিল্লির পুজোতে কৃত্রিমতা অনেক বেশি থাকে। প্রাণের টান থাকে না। যেটা আমি এখানে এসে আরো বেশি করে বুঝেছি যে দিল্লির পূজোর সাথে এখানকার পুজোর কত তফাৎ! মামা তুমি তো শিবপুরে মানুষ। তোমাদের পুজোর গল্প শোনাও একটু। কেমন ছিল তোমার ছোটবেলায় দুর্গাপুুজো।
খুব গল্প করতে ভালোবাসেন গগন মামা। তাই মৌপিয়ার প্রশ্নে খুশি হয়ে গগন মামা বললেন , ” আমাদের বাড়িটা ছিল হাওড়ার শিবপুরে। ছোটবেলায় আমি দাদু-ঠাকুমার কাছে মানুষ। বাবা মিলিটারিতে ছিলেন । মাকেও বাবার সাথে সাথে বাইরে থাকতে হত। আমাদের ছোটবেলায় পুজোর একটা অন্যরকম মজা ছিল। তখন আমরা ক্লাস টু কি থ্রি তে পড়ি, আমাদের বাড়ির পাশেই এক জায়গায় ঠাকুর তৈরি হত। মোটামুটি রথের পর থেকেই আকাশে-বাতাসে পুজো-পুজো গন্ধ শুরু হয়ে যেত। বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে গেলে একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করতাম বিশ্বকর্মার হাতিটা বের করা হয়েছে ও ওখানে ময়ূর হয়ে গিয়ে বিশ্বকর্মা কেমন কার্তিক হয়ে গেছে। তারপর খড় মাটি দিয়ে দেবী প্রতিমা বানানো চলত। দেখতে খুব ভালো লাগত। যখন দেখতাম মহিষাসুরের বুকের গুলি ফুলছে তখন আমাদের শিশু মন ভাবত যে আমরাও কসরত করে ব্যায়াম করে ওরকম বুকের গুলি বানাবো ।
মৌপিয়া বলল “বাহ বেশ মজার ব্যাপার তো। আচ্ছা মামা আমরা তো পুজোর সময় পকেট মানি পাই বাবার কাছ থেকে আর পুজোর চার দিন বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ, ডিনার ,সিনেমা দেখা, মলে গিয়ে শপিং করা এসব করে কাটাই.. তোমরা কি পকেটমানি পেতে?
গগন মামা সহাস্যে বলে, “সেও এক মজার ব্যাপার। খুব ছোটবেলায় এই ধর যখন থ্রি কি ফোরে পড়ি তখন বাড়ির বড়োদের পুজো উপলক্ষ্যে ছোটদের পয়সা দেবার একটা চল ছিল। কেউ পাঁচ পয়সা কেউ দশ পয়সা কেউ চার আনা এইভাবে সব গুরুজনদের কাছ থেকে কালেক্ট করে খুব কষ্ট করে এক টাকা বা এক টাকা দশ পয়সা এইরকম জমা হত। এই পয়সাটা আমরা খুব মজা করে খরচ করতাম। তখন দশ পয়সায় দানাদার পাওয়া যেত। পাঁচ পয়সায় দু প্যাকেট ক্যাপ পাওয়া যেত যেগুলো আমরা প্রথমে বন্দুক ও আরেকটু বড়ো হয়ে দেয়ালে ঘষে ঘষে ফাটাতাম। এইটা একটা মজা ছিল।
আচ্ছা দিদিভাই তোরা পুজোর সময় জামাকাপড় কিনিস তো ..পুজোর জামা পেতে কেমন লাগে?
মৌপিয়া বলে, “পুজোর জামা বলে স্পেশাল কিছু মনে হয় না মামা কেননা সারা বছরই তো আমরা শপিং মল থেকে ড্রেস কিনতে থাকি। পুজোর সময় হয়তো একটা দুটো বেশি হয় এইটুকুই যা।”
গগন মামা বলে, “বুঝতে পারছি তোদের জেনারেশনের পুজো বলে আলাদা কোনো উন্মাদনা তেমন নেই। আমাদের ছোটবেলায় বাবা-কাকা-মাসি-পিসি করে অনেকগুলো জামাকাপড় হতো। জামাগুলোর রং কেমন বা দেখতে কেমন সেটা বড় কথা ছিল না.. পুজোর জামার গন্ধটাই দারুণ লাগত। নতুন জামা-প্যান্ট, জুতো সব রাত্রে মাথার কাছে নিয়ে শুতাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি ছিল।”
মৌপিয়া বলল, “ইস দারুণ লাগছে শুনতে মনে হচ্ছে আমরা কেন পুজোটাকে এইভাবে দেখিনি বা ভাবিনি। আচ্ছা পুজোর খাওয়ার ব্যাপারটা একটু বলো। ভোগ খেতে?
খাদ্যরসিক গগন মামা খাবার প্রসঙ্গে নড়েচড়ে বসলেন। দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে লাগলেন, “আমার ঠাকুমা খুব ভালো রান্না করতেন। মনে আছে, দুর্গাপুজোর সময় আমার ঠাকুমাকে কোনো কোনো বনেদি বাড়িতে ভোগ রান্নার তদারকি করার জন্য নিয়ে আসা হত। সেইসব বাড়িতে ঠাকুমার সাথে সাথে আমারও যাওয়ার পাসপোর্ট হয়ে যেত। কেননা ঠাকুমা তো চেখে দেখবেন না। অথচ রান্নাগুলো টেস্ট করারও একটা ব্যাপার ছিল। সেই ইন্টারেস্টে আমি ঠাকুমার সাথে যেতাম। আর ইচ্ছে করে একবারে টেস্ট করে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। তিন-চারবার আমাকে টেস্ট করার জন্য ভোগের রান্না নিতে হত। তো, সেটা একটা বেশ মজার ব্যাপার ছিল আমার কাছে।”
মৌপিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী কী ভোগ রান্না হত তখন মামা? আমাদের প্যান্ডেলে যেমন হয় খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর মিক্স ভেজ ..সেটাই হত তো? “
গগন মামা বললেন ,” না রে দিদিভাই.. খিচুড়ি তো ছিলোই.. আরো অনেক কিছু হতো। যেমন দুই-তিন রকমের পায়েস হত, বাসন্তী পোলাও হত, নবরত্ন তরকারি হত।
মৌপিয়া বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবা! এত কিছু হত! দু-তিন রকমের কী কী পাায়েস হত মামা ? আর বাসন্তী পোলাওটাই বা কী? নবরত্ন কারিটাও একটু বোঝাও। আর তোমাদের বাড়িতে এই কদিন কি কি রান্না হত?”
গগন মামা হেসে বললেন ,”উফ এতগুলো প্রশ্নের জবাব দিতে হবে !আচ্ছা দাঁড়া, দিচ্ছি এক এক করে। পায়েস এর মধ্যে গোবিন্দভোগ চালের পায়েস তো হতোই… তাছাড়া হত সন্ধেবেলার জন্য সিমুই-এর পায়েস। আর একটা লাউয়ের পায়েস হত তারও অপূর্ব টেস্ট ছিল।
বাসন্তী পোলাও কামিনী ভোগ চাল দিয়ে আমার ঠাকুমা রান্না করতেন। রংটা হলুদ হতো। খেতে অপূর্ব টেস্ট হত। এখনকার প্যান্ডেলে ক্যাটারার রা বাসন্তী পোলাও কখনো-কখনো দেয় বটে কিন্তু সেই টেস্ট আমি পাইনা।
আর নবরত্ন কারি ন’রকমের সবজি দিয়ে একটা তরকারি হতো। সবজিগুলোকে তেলে ছেঁকে তোলা হত। তারপর চার মগজ বাটা, কাজু বাটা, পোস্ত বাটা দিয়ে নবরত্ন কারি হত। অপূর্ব টেস্ট হতো তার।
ছোটবেলায় বাড়িতে খুব একটা রান্না হত না । কারণ ভোগের রান্না তিন চার দিন ধরে খাওয়া হত। যখন একটু বড় হলাম তখন দেখলাম ভোগের রান্না বাড়িতে আসা কমে গেল। আরো একটু বড়ো যখন হলাম… মানে ধর, যখন আমি এগারো কি বারো ক্লাসে পড়ি তখন ভোগ পয়সা দিয়ে কিনতে হত। কাজেই তখন বাড়িতেও রান্না শুরু হল পুজোর সময়। বিভিন্ন পদের মাছ, মাটন, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, এইসব বাড়িতে হত। এছাড়া বেশ কিছু মিষ্টি ও নোনতা জিনিস তৈরি হত বাড়িতে। যেমন নিমকি, ঘুগনি, নারকেল ছাপা, মিহিদানা, বোঁদে ইত্যাদি।”
মৌপিয়া বলল, নারকেল ছাপাটা কী মামা? ইজ ইট নারকেল নাড়ু?
গগন মামা উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগলেন, “নারকেল ছাপা হল চন্দ্রপুলি টাইপের এক ধরনের মিষ্টি। নারকেল কুড়ে সেটাকে শিলে বেটে তারপর সেটা পাক দেওয়া হত অল্প অল্প করে চিনি দিয়ে । পাক দেওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হত যাতে নারকেলটা যেন সাদা থাকে , লালচে না হয়ে যায়। তারপর সেটাকে নামিয়ে তার মধ্যে কর্পূর আর এলাচ গুঁড়ো দিয়ে সেটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটা ছাঁচে দিয়ে মিষ্টি বানানো হত। খেতে দারুণ টেস্ট ছিল।”
মৌপিয়া বলে উঠল, “ওয়াও, লাভলি! আমার তো শুনেই খেতে ইচ্ছে করছে..”
গগন মামা আরো উৎসাহিত হয়ে বললেন “শুধু খাওয়া-দাওয়া না দিদিভাই আরো আছে তখনকার পুজোর গল্প.. যখন আমি খুব ছোট, এই ধর টু কি থ্রি তে পড়ি, তখন ঠাকুমার সাথে পুজোর দিন সকালে রিক্সা করে গঙ্গা নাইতে যেতাম। মাঝে মাঝে রিক্সার সাইডের হুড ধরে ঝুলতাম নিজেকে রবিনহুড ভেবে। যখন আরেকটু বড়ো হলাম তখন সাইকেলে করে ঠাকুমার রিক্সার পাশ দিয়ে যেতাম গঙ্গা নাইতে। আরেকটু বড়ো হলে স্নান করব বলে যেতাম না। এমনি ঠাকুমার সাথে যেতাম গঙ্গায়।
পুজো এলে আরো একটা ব্যাপারের জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে থাকতাম মোটামুটি ক্লাস ফাইভ থেকে। সেটা হল শারদীয়া পূজাসংখ্যা পড়া। কিশোরভারতী, শুকতারা, আনন্দমেলা, সন্দেশ… তারপর একটু বড়ো হলে দেশ, নবকল্লোল– এগুলো প্রকাশিত হলেই কিনে গোগ্রাসে পড়তাম।
আরেকটা কথা যেটা না বললেই নয় সেটা হল পুষ্পাঞ্জলি। ছোটবেলায় ঠাকুমা-দাদুর হাত ধরে পুষ্পাঞ্জলি দিতে যেতাম তারপর একটু বড়ো হলে বন্ধুদের সাথে দিতাম। এখনো পুষ্পাঞ্জলি দিই। সেই ছোটবেলা থেকে পুষ্পাঞ্জলি মানে ফুল-চন্দন, ধূপ-ধুনোর গন্ধ আর তার সাথে মিশে থাকত পুজো মন্ডপে আসা সকলের গায়ের একটা পাউডার বা সেন্টের গন্ধ… সেটা একটা ভীষণ ভালো লাগা.. সেই গন্ধ আজও পাই।
পুজোর বলি দেখার ব্যাপারটাও বলি। ছোটবেলায় বলি দেখতে ভীষণ ভয় পেতাম। একটু বড়ো হলে বন্ধুদের কাছে বীরত্ব দেখাবার জন্য বলির ছাগল নিজেই ধরতাম। আমাদের পাশের পাড়ায় এক জায়গায় মোষবলি হত। যিনি মোষ বলি করতেন সেই কাকাকে আমার শিশুমনে হিরু ডাকাত বলে মনে হত। পরে অবশ্য মোষবলি উঠে যায়।
মৌপিয়া বলল, “আচ্ছা মামা, আমরা যেমন পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে যাই তোমরা সেরকম ঠাকুর দেখতে যেতে না?”
গগন মামা বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যেতাম দিদিভাই… এই ঠাকুর দেখার মধ্যে দিয়েই তো আমার কলকাতাকে চেনা। ছোটবেলায় দাদু-ঠাকুমার সাথে নতুন জুতো পায়ে দিয়ে, নতুন জামা গায়ে ঠাকুর দেখতে যেতাম। পায়ে ফোস্কা পড়ে যেত তবু হাঁটতাম ঠাকুর দেখার উন্মাদনাতে। যখন মাধ্যমিক দিই তখন থেকে বন্ধুদের সাথে যেতাম ঠাকুর দেখতে । তারপর আরেকটু বড়ো হলে ট্রামে, বাসে কলকাতায় ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখতাম। এভাবেই আমার কলকাতাকে চেনা দুর্গা পুজোর মাধ্যমে। যখন আরো বড় হই তখন ট্রামে, বাসে চড়ে ঠাকুর দেখতে যেতাম, হয়তো কখনো বিশেষ কারোর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে।”
মৌপিয়া নড়েচড়ে বসে বলল, “এবার একটা বিশেষ জিনিস জানতে ইচ্ছে করছে মামা তোমার কাছে। তোমার শেষের লাইনটা ধরেই আমার পরবর্তী প্রশ্ন… সেই সময়কার পুজোর প্রেম নিয়ে একটু বলো।”
গগন মামা মৌপিয়ার কথায় হা হা করে হেসে উঠলেন।
তারপর বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করলেন, “ছোটবেলায় তো এত প্রেম ব্যাপারটা বুঝতাম না.. যখন বুঝতে শুরু করলাম তখন সরস্বতী পুজো থেকেই কোন বন্ধুর যদি কোন মেয়েকে ভালো লাগত তাহলে সবাই মিলে পরিকল্পনা করা হত যে দুর্গাপূজা অব্দি এই মেয়েটাকে তুলতে হবে মানে এই মেয়েটার সাথে সেই বন্ধুর প্রেম করিয়ে দিতে হবে। আর তার জন্য শুরু হয়ে যেত যথেষ্ট প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা। আবার কখনো কখনো দাদাদের জন্য চিঠি পৌঁছে দিতাম প্যান্ডেলের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো দিদিকে। যখন একটু বড় হলাম মনে হতো চিঠিটার বিশেষ কিছু গুরুত্ব আছে। যখন বুঝতে শিখলাম তখন সেন্সর বোর্ডের মতো চিঠিটা পড়ে তারপরে গিয়ে দিয়ে আসতাম সেই বিশেষ মেয়েটিকে। তাছাড়া ছিল বিশেষ কারোর জন্য কোন মণ্ডপে পূজা দেখতে যাওয়া , বিশেষ কারো দিকে তাকানো, বিশেষ কোন একজনের জন্য প্যান্ডেলে অপেক্ষা করে থাকা। যখন পূজার দায়িত্ব আমরাই সামলাতাম তখন পুজো প্যান্ডেলে বিশেষ কারো জন্য গান গাইতাম। এইগুলোই ছিল পুজোর প্রেম।
মৌপিয়া বলল, “আচ্ছা বিজয়াদশমী কীভাবে কাটাতে একটু বলো।”
গগন মামা বললেন,”একদম ছোটবেলায় বিজয়া দশমীতে সকলকে প্রণাম করতাম। পাড়ার মাসি, পিসি, কাকু , জেঠুদের নিজের আত্মীয় বলেই মনে করে প্রণাম করতাম। যখন মাধ্যমিক দিলাম সেই সময়টা প্রণামের রীতিতে একটু পরিবর্তন এল। একটু বেছে বেছে প্রণাম করতাম ।কাকে প্রণাম করব কাকে করব না ঠিক করে নিতাম। পরে যখন আরো বড়ো হলাম তখন বাবার বয়সী গুরুজন ছাড়া সেভাবে প্রণাম করা হয়ে উঠত না। আরো পরে প্রণাম একটা স্টাইলে এসে দাঁড়াল এবং প্রায় উঠেই গেল বলা যায়। এইভাবে বিজয়া দশমীর প্রণাম এর ক্ষেত্রেও বেশ কয়েক বছরে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আমাদের ছোটবেলায় বিজয়া দশমীতে যারা দূরে থাকে তাদেরকে প্রণাম জানিয়ে চিঠি দেওয়া হত। কাকা ,জ্যাঠারা একগাদা পোস্টকার্ড নিয়ে চিঠি লিখতে বসতেন। এখন তো চিঠি লেখার চল উঠেই গেছে। লোকে হোয়াটসঅ্যাপেই বিজয়াদশমী সারে।”
মৌপিয়া বলল, “বাহ কী সুন্দর ছিল তোমাদের পুজোর দিনগুলো… রাঙা কাকু, তুমিও তো কলকাতা নিউ আলিপুরে থাকতে। তুমি বলো তোমাদের সময় কেমন ছিল পুজো।”
এখনো প্রায় একই রকম সুদর্শন রাঙা কাকু সহাস্যে বললেন, “আমার ছোটবেলার দুর্গাপূজার দিনগুলো খানিকটা গগনের মতোই কেটেছে রে… সময়টা তো মোটামুটি একই… । ছোট বেলায় মা আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে এক একদিন নিয়ে যেতেন জামা কাপড় কিনে দিতে। যেদিন যাকে নিয়ে যেতেন সেদিন তার চার সেট জামা, জুতো, মোজা, গেঞ্জি, প্যান্ট সব কিছু কেনা হত। সেদিন থেকে পুজো আসা অব্দি জামাকাপড়গুলো রোজ মাথার কাছে নিয়ে শুতাম। নতুন জামার গন্ধ দারুন লাগতো।”
“পাড়ার পুজোর ভোগ তো আসতোই, বাড়িতেও পুজোর চার দিন মা রকমারি পদ রান্না করতেন। মনে আছে ঝন্টু কাকা ( বাড়ির সর্বক্ষণের হেলপার) দেশী মুরগি কাটিয়ে পরিষ্কার করে পাটা বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আসতেন । থলিতে আনতেন না। আর সেই দেশী মুরগীর রান্নার গন্ধে গোটা ঘর ম ম করত। কি অপূর্ব টেস্ট ছিল। তাছাড়া চিংড়ি মাছ, মটন তো হতোই। লুচি, আলুর দম, কচুরি, নিমকি, নারকেল নাড়ু, এসবও পুজোর সময় হত। ছোট থেকেই আমার খুব ইন্টারেস্ট ছিল পটকা ফাটানোতে। বাবা প্রচুর পটকা আর তুবড়ির মশলা কিনে দিতেন। আমাদের বাড়ির ছাদে সেই মশলা দিয়ে আমরা তুবড়ি বানাতাম।”
মৌপিয়া অবাক হয়ে বলল “বাড়িতেই বানাতে? কী করে বানাতে একটু বলো শুনি।”
রাঙা জেঠু নড়েচড়ে বললেন, “আরে খুব সোজা ব্যাপার। তুবড়ির জন্য ঝন্টু কাকা মশলা এনে দিত। সোরা (সোডিয়াম), গন্ধক, কাঠ-কয়লা, অ্যালুমিনিয়াম চুর, লোহাচুর , পটাশিয়াম এইগুলো ১৬,১,৪,৩,২,১ এই পরিমাপের লাাগত।
এগুলো দোকান থেকে ওজন করে দিত। সবগুলো হামানদিস্তায় ভালো করে গুঁড়ো করে খবরের কাগজে শুকোতে দেওয়া হত যাতে কোনো রকম ময়েশ্চার না থাকে।তারপর মাটির তুবড়ির খোল কিনে এনে সেগুলো জলে ভিজিয়ে কড়া রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়া হত। তারপর আঙুল দিয়ে ঠেসে ঠেসে তুবড়ির মধ্যে মশলা ভরা হত। তুবড়ির উপরে যে ছোট ফুটো থাকে ছোট্ট কাগজে আঠা দিয়ে সেখানে লাগিয়ে দেওয়া হত। এক দিনে প্রায় একশো পঁচিশ থেকে দেড়শটা তুবড়ি বানানো হত। পাড়ার সব বাচ্চাদের দিতাম। পুজোর দিনগুলোয় ছাদে প্রচুর তুবড়ি ফাটানো হত। অন্যান্য বাড়িগুলো আমাদের বাড়িতে আলোর ফুলকি হাঁ করে দেখত। এছাড়া কালিপটকা, দোদোমা , ইলেকট্রিক তার, হাউই , চরকি এই সবই আমরা ফাটাতাম। আমার আরেকটা খুব নেশা ছিল উড়ন তুবড়ি ফাটানো। উড়ন তুবড়ি হাতে করে ছাড়তে পারতাম আমি।দুটো আঙুলের ফাঁকে নিয়ে হাতটা লাড্ডুর মত ঘুরিয়ে জোরে ছাড়লে ওটা আকাশে সার্কেল হয়ে ঘুরে ঘুরে আলোর ফুলকির মালা হত। হাত দিয়ে ছাড়াটা কায়দার ছিল। উড়ন তুবড়ি ও আমরা তৈরি করতাম। এখন তো পাওয়াই যায় না।
যখন কলেজে পড়তাম তখন নিজেরাই পাড়ায় চাঁদা কলেকশন করে পুজোর আয়োজন করতাম। প্রতিমা আনা থেকে পুজোর আয়োজন থেকে ভোগ, বিসর্জন অব্দি সমস্ত কিছু আমরাই করতাম। পুজো প্যান্ডেলে সেই সময় মানবেন্দ্র, কিশোর, হেমন্তর ভালো ভালো গান বাাজত। ধুনুচি নাচ নাচতে পারতাম আমি খুব ভালো। কম্পিটিশন করে ধুনুচি নাচ নাচা হত।
মৌপিয়া বলল, “সত্যি কত এনজয় করতে তোমরা পুজোতে। আগেকার পুজোর দিনগুলো কত ভালো ছিল। আমাদের পুজো অর্কেস্ট্রা, ডিজে, শপিংমল, রেস্টুরেন্টে ডিনার, সেলফি তোলা, এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আচ্ছা ফুল পিসি, মালতী মাসি, তোমরাও একটু গ্রামের পুজোর কথা বল। সেই সময় কেমন ছিল গ্রামের পুজো।
ফুল পিসি সস্নেহে মৌপিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সেই সময় তো গ্রামে বেশিরভাগ বাড়ি মাটির ছিল। তাই শরতে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, কাশফুলের বন, আগমনি গান যখন দুর্গা পুজোর গন্ধ নিয়ে আসত বাতাসে… তখন গ্রামের বাড়িগুলো গোবর মাটি দিয়ে সুন্দর করে নিকিয়ে পরিষ্কার করা হত। তারপর বাড়িতে বাড়িতে শুরু হত নানা রকমারি মিষ্টি করার আয়োজন। সিঁড়ির নাড়ু, নারকেল নাড়ু, গুড়ের নাড়ু, মুড়ির নাড়ু, খইয়ের নাড়ু বানানো হত। বড় বড় লোহার কড়াইয়ে গুড় জ্বাল দেওয়া হত। সিঁড়ি ভেজে উঠিয়ে একটু ভেঙ্গে গুড়ের কড়াতে দিয়ে পাক দেওয়া হত। নাড়ুর গন্ধে গোটাপাড়া ম ম করত। তাছাড়াও চালভাজা , চিঁড়েভাজা, নিমকি, বোঁদে এইগুলো পুজোর খাবার হিসেবে বানানো হত। আর ছিল পুকুরের টাটকা মাছ। গরম গরম ভাজা মাছ সকলে খেত। বিসর্জনের দিন প্রণাম করার পর বাড়ি বাড়ি নাড়ু পাবার একটা আলাদা মজা ছিল । কে কতগুলো নাড়ু শেষ পর্যন্ত পেল গুনে দেখা হত। সকলে একসাথে রান্না, পরিবেশন, খাওয়া, এর আনন্দই ছিল আলাদা। এখন তো সব ভাগ ভাগ হয়ে গেছে ।সবাই নিজের নিজের। সেই আনন্দটা আর নেই।”
মৌপিয়া বলল, “ফুল পিসি, আমি কিন্তু প্রতিবার এবার থেকে পুজোয় এখানে চলে আসব। তোমাদের সাথে পুজোর কটা দিন যে আনন্দ আর মজা করে কাটালাম সেটা আমি দিল্লিতে পাই না। আর রাঙা জেঠু , গগন মামা, আর সব জেঠুরা, ভাইবোনেরা সবাইকে আসতে হবে কিন্তু।”
গগন মামা বললেন, “দিদিভাই তোর আসার খবর টা দিয়ে দিস তারপর সবাইকে আনার দায়িত্ব আমার।”
রাঙা জেঠু বললেন, “পরের বছর তুবড়ি বানানোটা শিখিয়ে দেব আমরা বাড়িতেই তুবড়ি ফাটাবো… ঠিক আছে।”
মৌপিয়া খুশি হয়ে বলল, “ডান। আমি কনফার্ম আসছি পরেরবার”। সঙ্গে এক-দুজন বন্ধুকে নিয়ে আসতে পারি।”
গগন মামা বলে উঠলেন “দিদিভাই বয়ফ্রেন্ডকে আনার প্ল্যান করছো নাকি”।
মৌপিয়া হো হো করে হেসে উঠল।
হাসি-গল্পে অনেক রাত হয়ে গেছে । পরদিন ভোরে উঠতে হবে। যেতে হবে । মৌপিয়ার মা মৌপিয়াকে শুয়ে পড়তে বললেন। সকলকে গুড নাইট জানিয়ে মৌপিয়া শুতে গেল। মন খারাপ। কাল চলে যেতে হবে। আবার এই ভেবে মন ভালো হয়ে গেল যে অনেক কিছু নিয়ে যাচ্ছে সাথে করে।
অন্তরার লেখা টা পড়লাম । অসাধারণ। আমার পুরনো দিনগুলো খুঁজে পেলাম । অন্তরার আর লেখার আশায রইলাম ।
এই ভাবে ছোটবেলা টাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য আপনাকে কুর্নিশ জানাই আপনাকে।
আপনার লেখা বলে দিচ্ছে আপনার অন্তহীন এই লেখার ক্ষমতা আপনাকে অনেক অনেক মানুষের অন্তরে জায়গা দেবে। ভালো থাকুন আর আরো আরো এমন আন্তরিক ভালোলাগার গল্প আমাদের উপহার দিন।
Satti Asadharon Sundor Lekhata Antara Mann chuye gelo erokom Sundor lekha Satti anek Mann kharaap anek Koshto dur Kore dei sejonnyo aami Antara tomaar Sundor lekha er Gunograahi Bhokto Sundor lekhaar Jonnyo Anek Subhechha Abhinandan tomaay Antara Evabe egiye cholo tumi