অতনু চট্টোপাধ্যায়ের পাঁচটি কবিতা
অবলোকন
বিজ্ঞানমেলায় প্লাস্টিকের ছাউনিতে বসে পূর্ণাঙ্গ আকাশ, তারকাখচিত মণ্ডল, টরাস, ক্যাসিওপিয়া… সমুদ্র প্রাচীন এক ভয়ে খুব সন্তর্পনে হাঁটু অব্দি সবেমাত্র নেমেছি, কে যেন বলে উঠলো – “দেখো, দেখছে তোমাকে।” অস্পষ্ট সঞ্চালিকার গলা -কিশোরীর, অন্ধকারে একটা শিশু কেঁদে উঠলো , ‘ বিলয় ‘ শব্দটা তখনই হটাৎ মাথায় আসে। যে অশ্রুপুঞ্জ মেঘ হয়ে এতদিন থমথমে করে রেখেছিল আবহাওয়া, মুহূর্তেই তা তরল হয়ে গড়িয়ে গেল অতলে।
বৈশাখে হাওয়ার হল্কা টেনে ধরেছে পরিধান, অথচ সে হন্তদন্ত এগিয়ে চলেছে হেদুয়া ছাড়িয়ে, পাশের আবর্জনার স্তুপ থেকে যে প্রাজ্ঞ খগ তাকে সঙ্গ দিল, ঘটনাচক্রে তারও দিগন্তবিস্তৃত কপাল। উভয়ই প্রায় সমউচ্চতাসম্পন্ন। পরস্পরের মুখের দিকে তারা চেয়ে রইল কয়েক পলক। এমনই উদ্ভট চিত্র প্রস্তুত হয়েছিল সেই সান্ধ্য মদের আড্ডায়। কলকাতা করপোরেশনের লোগোয় একদা শোভা পেত জোড়া হাড়গিলে। হায় শুভদা তথা ঈশ্বর চন্দ্র অথবা সেই বিচিত্র বিহঙ্গ এই ক্ষয়িষ্ণু শহরের নালা, খাল বাহিত হয়ে শেষমেষ মিশেছে গঙ্গায়, তাও বহুকাল হল।
অসংখ্য লিটিল ম্যাগের ভিড়ে, উপকথার রাখালের ভঙ্গিতে লাল পল্কা চেয়ারে অধিষ্ঠিত দেবদাস আচার্য। তাকে ঘিরে বলয় রচনা করেছে অগণিত শূন্য উপাসক, মৃত কবিদের আত্মা। কিছুটা দূরত্বে একা দাঁড়িয়ে আমি লক্ষ্য করি এই অতিপ্রাকৃতিক প্রবণতা আর কালচক্রের চাকায় ধ্রুব থেকে চতুষ্পদে, বেবি টাক্সি থেকে সাম্যে উড়ে বসছে পাখিরা অবিরাম।
রসাতল
রাস্তায় যেভাবে মুখোমুখি হলো তা ছিল প্রত্যাশিত। তারকার শামিয়ানা, দু’ চারটে খুচরো সাইকেল , নিঝুম কুয়াশা, দূরে মনিহারি হলুদ আলোররেখা। বস্তগত এই পথে, ইত্যাবসরে খানিক পৃথুলা অথচ বৈষয়িক ভাবে অনাবৃত কিছু বিনিময়ে জানা গেল – ভবানীপুরে তার ছেলের দু ‘ কামরার ফ্ল্যাট, নাতনির কনভেন্ট, মধুমেহ, অস্থির হাঁটুর কারসাজি, ক্রমশ বেদনাজাত সবই। যৌবনে অপরূপা, ইতস্তত পাড়া বেড়ানোর সখে, কোলে পিঠে বিদেশী গন্ধের সাথে চিনেছি তাকেও। তার বরিশালী ছাড়া, নানাবিধ শাক, মাছ, ছোঁয়াছুঁয়ি – খঞ্জ বাতাসার ঢঙে মিশেছে ধুলায়। আমার মায়ের নাম, মায়ের বোনের নাম, – মৃত, জীবিতের ভিড় – কিছু তাকে ফেরাতে পারে নি। শুধু ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি আর অসংলগ্ন নাপথালিন গুলির মতো ছোট থেকে ছোটতর হয়ে উবে যাবে, এই স্বাধীনতা বোধ – দেশ থেকে, কাল থেকে, স্মৃতি থেকে ক্রমাগত তাকে আড়াল করেছে। পিতৃপুরুষ ও উত্তরকালের মধ্যবর্তী একটি দ্বিধাচিহ্ন হয়ে সে রয়ে গেছে অথচ নেই কোনখানে।
মহাভারতীয় কোন গৃধ নয়, ফেরবার পথে রুগ্ন পাতাখোর সকাতরে টেনে নিল বুকে, যেন কতকাল আমাদের মধ্যেকার কতো কথা বাকি রয়ে গেছে।
গবেষণা
আমার মাইনে বেড়ে ভদ্রস্থ হয়ে গেল। এখন আমার কাশির শব্দে ঘড়ঘড় আওয়াজ শোনা যায় না আগের মতো। বরং বিচক্ষণ নৈশব্দে আমি মনস্থির করি যথাসম্ভব। আমার সন্তানের একটা, সুশ্রী বীণাপাণির থেকেও সুরেলা হয়েছে, অন্যটা দিগম্বর। কাজের ফাঁকে নিয়ন্ত্রণকে ভুল করে নিমন্ত্রণ পড়ে ফেলি আজকাল। অথচ মাছের কাঁটার মতো বেড়ালের অপেক্ষায় শুয়ে থাকি রাতভোর, আমার ঘুম আসে না। আমার ঘুম আসে না কারণ আমার স্ত্রীর দৃষ্টির অসূয়া আমাকে বিদ্ধ করে না, করে না সুররহিত। ফলত সর্বগ্রাসী বিয়ে বাড়ির জেনারেটার থেকে কখন যে আমি হয়ে উঠেছি বুড়ো কাঁকড়া তা আমি টের পাইনি। আমার নাকের ভিতর থেকে খুব সন্তর্পনে হাওয়ার বুদবুদ উঠে আসে জলের উপরিতলে। আমি অস্তিত্ব নিয়ে ভাবি, ভাবি বিস্তার নিয়েও। আমার গবেষণার বিষয় ক্যান্সার সেল। জীবন মৃত্যুর মধ্যবর্তী একটা নোম্যান্স ল্যান্ড আমি আবিষ্কার করেছি – যেখানে ঝিম আলোর আভা লেগে থাকে ঝিম অন্ধকারের গায়ে। ইমারজেন্সির রোদে সেই নৈশব্দকে দুই পায়ে মাড়িয়ে মৃদুল দাশগুপ্তের সাথে শম্ভূ রক্ষিত হেঁটে গেলেন। খোলা রাজপথে এটাই ছিল শম্ভু রক্ষিতের ক্যামোফ্লেজ।
দংশন
মশারি সরিয়ে ভেতরে না এলে কথা বলা যায় না, মুখের সম্মুখে ইতর রহস্যজাল যেন স্তনে ঢাকা বুকের আগল, না সরালে কথা বলা যায় না। সন্তানের ক্রোধ তবু মলম লাগায়, কন্যা আবদার-স্নেহে বশ করে। শিশুর চাহুনি নিচু, মোলায়েম, বিপথগামীতা ভরা। এতসব আবরণ, অনুসঙ্গ ঝেড়ে ফেলে মুখোমুখি না বসলে কথা বলা যায় না।
দুস্থ জঙ্ঘা, বাহু নিয়ন্ত্রণে রাখ , অঙ্গে তুলে নাইবা ধরলে প্রাণ । বহু শতাব্দী প্রাচীন একটি ভেলা আমাদের ধারন করেছে। আমরা চলেছি অচৈতন্য সাগরের টানে। এই যে বুভুক্ষু সর্প, বিষ, দংশন, নদীর কিনারে ঝুঁকে পড়া হিজল শাখাটি, প্রবাদপ্রতিম এই ছলনার হাসি, এর থেকে দূরে থাক।
মনে আছে বোধ হয়, অন্তেষ্ঠির সকল সরঞ্জাম তুমি ঘৃণা ভরে ছুঁড়ে ফেলেছ নদীপারে। এখন অবিশ্বাসীর মতো চেয়ে থাকা পাপ। মড়াটির পাশে বস, শান্ত হও। ওর মুখে তুলে দাও পঞ্চব্যঞ্জন।
রাম মন্দির উদ্বোধনের দিনে
প্রত্যাখ্যান — ফোন না তুললে, প্রেমিকার প্রত্যাখ্যান। বন্ধুর সাথে নিত্যদিনের মনান্তর, যা হওয়ারই ছিল, কারণ প্রতিটা মানুষ নিজের দিকে হেঁটে যায়, ফলে অপরের সাথে দূরত্ব বাড়ে। সম্পাদক ফোন কেটে দিলে অবিমিশ্র মনে হয়। কোনো গাছে দু’টো শাখা, ডান ও বাম। বামে ফুল ধরবে আর ডানে ধরবে না, এ অসম্ভব। পাখিদের থেকে মানুষেরা প্রত্যাখ্যাত হয় না। কোনো টিয়া, বুলবুলি কিম্বা ছাতারে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করে না। আপনার সাথে প্রকৃত কোনো সম্পর্কই পাখিদের হয় না, পোষা পাখিদের ক্ষেত্রটা অবশ্য এর বাইরে৷ পাখিদের লকডাউন নেই, পাখিরা… নিরন্তর খোঁজে, কিছুই খোঁজে না। আকাশে যে ধাতুরঙ… নিজেকে পুনরাবৃত্তি করার মধ্যে প্রত্যাখ্যান নেই, পুনর্দখল আছে, প্রতিশোধ আছে, প্রতিরোধ আছে, প্রাকৃতিক প্রবণতা আছে। আকাশের সাথে মানুষের বনিবনা হয়, কারণ ধাতুরঙ আসলে ধোঁয়া বা তাও না, আসলে দর্পণমাত্র, আকাশ ধাতুহীন, কল্পনা প্রসূত।
প্রগতিশীল সমাবেশে, জনজাগরণে, প্রত্যাখ্যান থাকে না, কারণ আকাশের মতো তার মুখ আমি দেখি নাই, রূপ দেখিয়াছি, প্রচণ্ড।