পরি ও পতঙ্গ – প্রতিভা সরকার

শেয়ার করুন

উইপোকাকে চিনু ছোটোবেলা থেকেই উলিপোকা ডেকে এসেছে। তাদের টাউনের দস্তুর। উলিপোকা মানে উলিপোকা, বৃষ্টি নামলে যাদের পাখনা গজায়, যেমন তেলতেলে মুখে এবড়ো-খেবড়ো ব্রণ গজায় খারাপ কথা চিন্তা করলে। এই কথাটি তার মায়ের, সত্যমিথ্যা চিনু জানে না। কিন্তু তার নিজের গালে সত্যিই বর্ষাকালে ব্রণ গজাত, সবে তখন সে ঘুমের মধ্যে ঠাকুরদেবতার আদেশ পাবার মতো শ্রীদেবীকে স্বপ্নে পেতে শুরু করেছে। এখন সেটা বর্ষাকালীন পেটের গোলমাল না বৃষ্টির জলে ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা কলাগাছের মতো থাইয়ের কারণে কে জানে! কিন্তু সত্যি বর্ষাকালে টানা বৃষ্টি থামলে পুকুরপারের কচু গাছের জঙ্গলের ওপর দিয়ে লক্ষ লক্ষ ডানাওয়ালা পোকা তীরের মতো আছড়ে পড়ত ঘর, বারান্দা, রান্নাঘরে, এমনকি মায়ের পোষা মিনির চোখেমুখেও। পরের দিন মা ঝাড় দিত, ঝাঁটার আগায় স্তূপ হয়ে যেত ফিনফিনে ডানা আর মরা পোকার, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তখনও কিলবিলোচ্ছে। সম্বচ্ছর উলিপোকার পাখনা গজাত, যেন সংখ্যাও বাড়ত, আর চিনু নিজের শরীরের ক্রমাগত পরিবর্তন নিয়ে হতভম্ব হয়ে থাকত। তার মনে হত দুটোর মধ্যে অনিবার্য কোনো সম্পর্ক আছেই আছে। কাউকে বলতে পারত না সেসব, কারণ চিনু বোকা, চিনু ক্যালানে, চিনু কথা কয় খুব কম। বৌ রেগে গিয়ে বলত, ‘মুখে কি বড়া ঢুকায়া রাখসো নাকি!’

মেয়েমানুষকে ভাতার ছেড়ে পালালে অত নিন্দামন্দ হয় না, যতটা হয় ব্যাটাছেলের মাগ ভেগে গেলে। ভয়ানক লজ্জায় পড়ে যায় পুরুষটি। সমাজে সেই ব্যাটাছেলে যেন আর ব্যাটাছেলে বলে সম্মান পায় না। বৌকে ধরে রাখতে পারেনি, ও শালা নিকম্মা মেনিমুখো একটা। বৌ ভাগল চিনুর নিজের ছোটোবেলার বন্ধু শম্ভুর সঙ্গে, তাও ক’দিন চোর চোর মুখ করে ঘুরে বেড়ালে লোকজন ভুলে যেত, পেছনে ছেড়ে গেল দুধের বাচ্চাটাকে। চিনুকে আতান্তরে পড়তে দেখে পড়শিরা এগিয়ে এল। জীবনের বৌটা নিজের বাচ্চার সঙ্গে দুধ খাওয়াল, আগলে রাখল। চিনু না ফেরা অব্দি ওদের ঘরেরই সামনে ধুলো মেখে মেয়েটা খেলত, মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়ত। পরের দিকে যে যা পারত খাবার দিত, খেত কি খেত না তা দেখারও লোক ছিল না। রোজ সন্ধেয় ঘুমন্ত মেয়ের ল্যাগব্যাগে শরীর দু’হাতে শুইয়ে নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে চিনু ভাবত এমন অযত্নে একটা জিগা গাছও বাঁচে না, মেয়েটা বেঁচে আছে কী করে!

উলিপোকা যে আসলে উইপোকা সেটা ক্লাস এইটে জীবনবিজ্ঞানের বই থেকে জেনেছিল চিনু। পড়া ছেড়ে দিতে খুব কষ্ট হয়েছিল তার, কিন্তু শত চেষ্টাতেও তারপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। তবু এখনও স্পষ্ট মনে থেকে গেছে যে ওই উড়ান আসলে ওদের শেষ মিলন, ভেজা বাতাসে, কালো মেঘের তলায়, চারদিক স্যাঁতসেঁতে আর গুমোটে ভারী হয়ে গেলে অজস্র মেয়ে-পুরুষ পোকা পরস্পরের দিকে চুম্বকের মতো ছুটে যায়, যেন দু-হাত দুদিকে ছড়ানো জিতেন্দ্র আর পায়ে সলমা চুমকি বসানো কাপড় ধুতির মতো করে পেঁচিয়ে পরা শ্রীদেবী। দৌড়ে আসছে পরস্পরের দিকে। মিলন শেষে পুরুষের মৃত্যু অনিবার্য। স্ত্রী পতঙ্গরাও ডানা খসিয়ে বেশিরভাগই মরে, তবে যে ক’খান টিকে যায়, তারা নতুন কলোনির পত্তন করবে বলে পেটভরা ডিম নিয়ে অন্ধকারে কোনো কোনায় অপেক্ষা করে। এত কথা তো আর বইয়ে লেখা থাকে না, আসলে তাদের ইস্কুলের জীবনবিজ্ঞান মাস্টার ধামাকাদার পড়াত। যেন চোখের সামনে দেখা যেত পঙ্গপালের মতো চারদিক কালো করে উলিপোকার শেষ যাত্রা, একই সঙ্গে মিলন ও মৃত্যু। এখনও দু-তিন দিন নাগাড়ে বৃষ্টি হলে এইসব মনে পড়ে যায় চিনুর। বাইরের পৃথিবী, ঋতুর রকমফের, বিজ্ঞানের টুকরো-টাকরা, দেশবিদেশের খবর, পোকামাকড়ের হালচাল তাকে ছোটোবেলা থেকেই খুব টানে। কিন্তু পড়াটাই যা হল না আর।

শ্রীদেবীর অত্যাচার শুরু হবার আগে পর্যন্ত এই বর্ষাকালটাকেই খুব মজার মনে হত। সকালে পান্তা ভাতের থালা সামনে, আমের রস কনুই বেয়ে গড়িয়ে গেলে জিভও পেছন পেছন সে অব্দি চাটতে যেত। তাতে শুকনো খড়খড়ে কনুই থেকে নোনতা স্বাদ উঠে আসত, কিন্তু তার পরোয়া তখন কে করে! বুকসমান পেঁপে গাছের বড়ো বড়ো ভেজা পাতার উলটো পিঠে আটকে থাকত ছোটো কালো রোঁয়াহীন ছ্যাঙ্গা। হ্যাঁ, শুঁয়াপোকাকে এই নামেই ডাকা হত তাদের কলোনিতে, আর জাম্বুরা গাছের কালচে সবুজ পাতা থেকে জল ঝরত টুপটাপ। বৃষ্টি থেমে যাবার পরও বহুক্ষণ। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি মাঝে মাঝে থেমে গেলে আরও গুমোট হয়ে উঠত চারধার, কালো মেঘ যেন মাথার ওপর সামিয়ানার মতো ঝুলে রয়েছে, চিনু ঠিক বুঝত মাটির গর্ভ ভেদ করে কিলবিল করে বেরিয়ে আসছে অজস্র কীটপতঙ্গ, তারা কেউ ভেজা পাতায় উঠে গেল, কেউ সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের গুটির ভেতর রেখে দিল সন্তর্পণে, কেউ মারা পড়বে জেনেও আবার মহানন্দে প্রেমের খেলায় মেতে উঠল। পুকুরে জলের ভেতর হলুদ ছোটো ব্যাঙ দেখা যেত এইসময়। একই ক্লাসের শিবু মুখখিস্তি করে সেগুলোকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘এই মাদিগুলো কাজ সারা হলেই মদ্দাগুলোকে খেতে শুরু করে।’ ভবিষ্যৎ তো কেউ দেখতে পায় না অত ছোটো বয়সে, নাহলে এক বর্ষাকালে বাড়তি কম্বলের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরে বৌকে দেখতে না পেয়ে তার কেন সেই হলুদ ব্যাঙের কথা মনে পড়ে যাবে!

মেয়েকে সাবধানে কাঁথার ওপর শুইয়ে দেয় চিনু। ঘুম ভেঙে গেলে এখুনি খেতে চাইবে। এইরকম আতান্তরের সময় কমই এসেছে জীবনে। আগে কম্বল চাদর ফিরির সঙ্গে সঙ্গে ছোটোখাটো কাজ করে দুবেলার যোগাড় করতে পেরেছে চিনু। কিন্তু লকডাউনের সময়ে প্রায়ই চেয়েচিন্তে চালাতে হচ্ছে তাকে। দুবেলা খাবারের যোগাড় করা এখন খুব কষ্ট। মহকুমা শহরের উপান্তে উঁচু-নীচু জমিতে এই কলোনি। এখানে সবাই ছোটোখাটো কাজ করে। কেউ তার মতো মাথায় চাদর কম্বল টিভি কভার নিয়ে ফেরি করতে বেরোয়, কেউ বাদাম বিক্রির কাজে আছে, আবার মোতির মতো চুড়ি চাই বলে হাঁক দেবার লোকও আছে এখানে। সোনপাপড়ি, ফুচকাও বিক্রি হয়। তার বাপই পায়ে হেঁটে শিল কাটাই চিৎকারে দুপুরবেলাগুলো মাত করে রাখত। ছোটোখাটো লোক সব, অল্প পড়াশুনো, নিরক্ষরও ঢের, কিন্তু এলাকায় মোটামুটি শান্তি বজায় থাকে, সারাদিন গরু-গাধার মতো খেটে সন্ধে থেকে লোকে পড়ে ঘুমোতে চায় এখানে। তবু ইলেকশনের সময় কখনও কখনও শোরগোল হয়, এবার যেমন হয়েছিল, তারা এদেশের না বাংলাদেশের এই নিয়ে। বক্তৃতায় সব পক্ষই বলে গেল তাদের হাল ফেরাবে, কিন্তু বার বার লকডাউনে যখন তাদের হাল অতিসারের রোগীর মতো, কারো দেখা নেই। নিজেদের ভাগ্য নিয়ে ঘরে ঘরে এলাকার সবাই ধুঁকছে যেন।

উপায়ান্তর না দেখে আজ কলোনির হোমিওপ্যাথি ডাক্তারবাবুর কাছে সে টাকা ধার চাইতে গেছিল, লোকটা ভালো, প্রাণে মায়াদয়া আছে, নির্বিরোধী চিনুকে পছন্দও করে। চিনুও গাছের ডাল কেটে দেয়, বাগানের মাটি কুপিয়ে দেয়, ডাক্তারবাবু ভিজিট তো নেয়ই না, বরং মেয়ের সর্দি-জ্বর বা পেট খারাপ হলে মিষ্টি পুরিয়া বা গোল গোল চিনির দানার মতো ওষুধ ফ্রিতে দেয়। মেয়েও একবার খেয়ে আবার কখন খাবে সেজন্য হাঁ করে থাকে। জ্বরে পোড়া জিভ শুকনো টাগরায় শব্দ ক’রে ছোঁয়ায়, লোভী চোখে তাকিয়ে দেখে বাপ তার হাতের নাগালের বাইরে শিকেয় ঝোলানো হাঁড়ির ঢাকনার ওপর ওষুধের পুরিয়া তুলে রাখে।

লজ্জার মাথা খেয়ে আবোদা চিনু, মুখ ফুটে কথা না বলতে পারা চিনু মরিয়া হয়ে ধার হয়তো আজ চেয়েই বসত, কিন্তু চেম্বারে নিজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে ডাক্তারের কথাবার্তা কানে যেতেই স্বভাব মতোই সব ভুলে সে কান খাড়া করে কথা শুনতে বসে গেল। ওরা বলাবলি করছিল, এই যে দেশে একটা পায়ে হাঁটা সমান্তরাল অর্থনীতি ছিল, যেটা গড়ে উঠেছিল পায়ে হেঁটে যারা রোজগার করে সেই গরিবগুর্বোদের নিয়ে, সেটা যে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল, এ কথাটা তো কেউ বলছে না। পরিযায়ী শ্রমিকের কথা বলছে, কম্পিউটার বাবুদের কথা বলছে, সাংবাদিকদের কথা বলছে, এদের কাজ চলে গেলে তবু তো হায় হায় হচ্ছে, কিন্তু পায়ে হাঁটা অজস্র ফিরিওয়ালা? সকাল থেকে রাত অব্দি যারা রাস্তায় থাকে রোজগারের ধান্দায়, তাদের কথা কেউ ভাবছে না। যারা রোগে মরে হেজে গেল তারা তো একরকম বাঁচল, যে পায়ে হাঁটা রোজগারীরা বেঁচে রইল, তাদের বাঁচার রাস্তা কিন্তু একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। সত্যি কথা, চিনু ভাবে, আরে, সাত দিন না খেলে জ্যান্ত মানুষ ধড়ফড়িয়ে মরে যায়, আর টানা দুমাস লকডাউন! এখন সবাই সকালের দু-তিন ঘণ্টা ফলসবজি বিক্রি করে। বাদবাকি সময় স্রেফ বসে থাকো, চাদর মাদর ফিরি করতে বেরোলে রোগের ভয়ে কেউ দরজা খুলবে না, পুলিশও ডান্ডা নিয়ে রেডি।

এদের কথাবার্তায় চিনু এতোই ডুবে গেল, তাদের মতো মানুষের কথা এই ভদ্দরলোকেরাও এত ভাবে দেখে চিনু এতোই কৃতজ্ঞ বোধ করতে লাগল যে শেষ অব্দি ধার না চেয়েই উঠে পড়ল। কারো অসুখবিসুখ কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে ফ্যাকাশে হেসে জানাল, এই পথ দিয়েই যাচ্ছিল, তাই একবার ডাক্তারবাবুকে দেখে গেল, জিজ্ঞাসা করে গেল কোনো কাজকাম আছে কিনা। যদিও চিনু বসেছিল একেবারে দরজার গোড়ায়, কিন্তু তার মাস্কের অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবুর অস্বস্তি হচ্ছিল, সে উঠলে তিনি খুশিই হলেন।

টাকা পায়নি, তবে জ্বালানির কষ্টের কথা শুনে ডাক্তার এমনিই ওকে বেশ কয়েক কিলো পুরনো খবরের কাগজ দান করেছে, ‘যাঃ নিয়ে যা, এই বৃষ্টি আর রোগের মরসুমে তোরাই বা কী করবি।’ তখন খুব রাগ হয়েছিল, এই কাগজ কি গুঁজে বসে থাকব, কিন্তু এখন সেগুলোই মোটা করে পাকিয়ে বিনেপয়সার রেশনের চাল বসিয়ে দেয় চিনু। ঘরে জমা পাতা কাঠকুটোও ঢোকে তার সঙ্গে। কমলা আলোর আভায় বাদ বাকি কাগজের হেড লাইন পড়তে থাকে সে। বড়ো বড়ো নেতারা দলবদল করছে হাসিমুখে, কত গাছ কাটা পড়ছে, রেশনের চাল গরিব মানুষ পাচ্ছে কিনা, কত খবর! এই ঝোঁক চিনুর সারা জীবন থেকে গেল। নতুন নতুন খবর তাকে টানে, বাইরের পৃথিবীটা তখন যেন আয় আয় বলে ডাকতে থাকে তাকে।

সেই ঝোঁকে মেয়ের ফুঁপিয়ে কান্না প্রথমে শুনতে পায়নি চিনু। পাঁচ বছর পুড়ে গেল, চিনু খুব আশায় ছিল, স্কুলে ভর্তি হলে মিড ডে মিল পাবে, দুপুরে পেট পুরে খেয়ে মেয়ের হাল ফিরবে। সেসব গুড়ে বালি পড়ার পর রাতের ভাতে সে একবাটি জল দিয়ে রাখে। ভোর চারটেয় সাইকেল নিয়ে চিনু ফলের আড়তের দিকে দৌড়োয়, মেয়ে উঠে একাই খায়, ফেলে না, ছড়ায় না, ধুলো থেকে প্রত্যেকটা ভাত খুঁটে নেয়, জানে পাড়াপড়শি না দিলে রাতে বাপ না ফেরা অব্দি কিছু জুটবে না। গত দুদিন যাবৎ কিছু জোটাতে পারেনি চিনু। জামাইষষ্ঠীর জন্য ফলের দাম এত বেড়েছে, তার হাতে যেন ছ্যাঁকা লাগে। তারপর টই টই করে ঘুরে বেড়িয়েও কিছু জোটাতে না পেরে চিনু ঠিক করে রেশনের চালে যতদিন হয় শুধু ভাতে ভাত খাবে। এখন মেয়ের কান্না শুনে সে চৌকিতে ঝুঁকে পড়ে,

—কী হইল মা, কান্দিস ক্যান! খুধা পাইসে?

প্রথমে মেয়ে কথার উত্তর করে না, গুনগুন খুনখুন করে কেঁদেই চলে, যেন ঘরের পেছনের বেলগাছের নীচের কাদা জমিতে বসত করা কোনো পতঙ্গ। হাত মোচড়ায়, পা ছোঁড়ে, পিটপিট করে বাপকে দ্যাখে। এর ফাঁকে ভাতের জল মরে যায়, চিটপিট শব্দ ওঠে। চিনু তাড়াতাড়ি ঘটি থেকে ঠান্ডা জল ঢেলে দেয়। শব্দ আর ধোঁয়া দেখে মেয়ে চিটচিটে কাঁথার ওপর সোজা হয়ে বসে উনুনের দিকে চেয়ে থাকে। বায়নার কথা সে বুঝি ভুলেই গেল।

অ্যালুমিনিয়ামের সানকিতে করে বাপবেটি গরম ভাত নুন দিয়ে মেখে খায়। দু’তিন গরাস খাবার পর আবার তেড়ে বৃষ্টি আসে। তার আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সারা রাত এই-ই চলবে। মেয়ে আঙুল চাটে, ভাত শেষ করে বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারায় অনুমতি চায়, দরজা একটু ফাঁক করে ছ্যাঞ্চার গড়িয়ে পড়া জলে সে হাত ধোবে। ভালোই হয়েছে, মনে মনে ভাবে চিনু, ঘটিতে খাবার জল তলানিতে। টিউকল থেকে আনতে হলে স্নান করে উঠতে হবে। হাতমুখ ধুয়ে মেয়ে চৌকিতে বসে একমনে ব্যাঙের ডাক শোনে, তারপর বাবা উঠে আসতে বলে,

—বাবা, পরি দ্যাখাও ।
—পরি ? কই পামু তারে ?

চিনুর মুখ হাসি হাসি হয়, কিন্তু একটা বিড়ি খাবার জন্য তার তখন বুক ফেটে যাচ্ছে। চালের বাতায় গোঁজা আধখাওয়া বিড়ি মুখে নিয়ে সে উবু হয়ে কুপির কাঁপা কাঁপা আগুনের নাগাল পেতে চায়। পরি সে কোথায় পাবে! যত্ত পোলাপাইন্যা কথা! কিন্তু মেয়েটাও ওর মায়ের মতো জিদ্দি। একই কথা ঘ্যানঘ্যান করে চলে। মণ্ডলপাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে সে চলে গেছিল আজ, কার জানালায় দুপুরে উঁকি মেরে কোন্ সিরিয়াল দেখেছে, ডানা মেলা, মাথায় মুকুট পরা, হাতে তারা-আটকানো দণ্ড নেওয়া খুদে পরি ছিল তাতে। এখন তার মাথাভর্তি সেই গল্প। বাবা পরি দ্যাখাও, বাবা পরির গল্প বলো। আলো ফোটার আগে ওঠা শরীর দেয় না, তবু চিনু স্তোক দেয় মেয়েকে,

—দেখামুঅনে। বৃষ্টিটা একটু কইমা যাক।

বৃষ্টি কমার সঙ্গে পরির কী সম্পর্ক থাকতে পারে, ছোটো মাথা তা বুঝতে পারে না। কিন্তু তার ঘ্যানঘ্যানানির ভেতরই সত্যি বৃষ্টি একটু ধরে আসে। মেয়ে লাফায়, বাবা বৃষ্টি নাই নাই।

দূরে কোথাও বাজ পড়ে, মেয়েকে বাগ মানাতে না পেরে ঘরের একমাত্র জানালা খুলে দেয় চিনু—‘খুইলা রাখলাম। তর ভাগ্য ভালো হইলে পরি আয়া পরবে।’ জোলো হাওয়া ঘরে ঢুকে টিনের দরজায় ঠকঠক করে, যেন সেও কাউকে খুঁজছে। চিনু উঁকি মেরে আবছা মতো আকাশ দেখে, সেই ছোটোবেলার মতো মেঘ ফেঁপে ঝুলে রয়েছে। দুই পশলার মাঝে এমন গুমোট, শরীরে যেন বিনবিন করে ঘাম ছুটে বেরোবে। এমন দিনেই মাটির অনেক ভেতরের চাক ভেঙে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসত পালে পালে উলিপোকা! ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে চিনুর।

চিনুর মনে মনে ভাবা শেষ হয়েছে কী হয়নি, তাকে বেদম আশ্চর্য করে দিয়ে খোলা জানালা পথে ঢুকে পড়ে লক্ষ লক্ষ পাখা। কোনো শব্দ নেই, ঝাপট নেই, পাতলা ফিনফিনে পাখার পর পাখা, দুই পাখার জোড়ে ছোট্ট বাঁকানো শরীরের পর শরীর। চকচকে, চাক-ভাঙা, মসৃণ। তারা উনুন, ভাতের হাঁড়ি, ঝোলানো শিকে, জলের ঘটি, টিনের তোরঙ, তারপর মেয়ের ধুলোমাখা চুল ঢেকে ফেলে। জলন্ত বিড়ির ছ্যাঁকায় জ্বলে যায় বেশ কয়েকটা। মেয়ে ছোটো দুইহাতে হাততালি দিয়ে ওঠে, ‘বাবা এত্তগুলা পরি!’ চিনু তাকে তাড়াতাড়ি নিজের কাছে টেনে নিয়ে নাক কান থেকে পাখা ঝাড়তে ঝাড়তে তেলচিটে কাঁথা দিয়ে নিজেদের আপাদমস্তক মুড়ে নেয়। কোনরকমে মুখ বার করে ফুঁ দিয়ে কুপি নেভায়, মেয়েকে ফিসফিস করে বলে, ‘ঘুম যা। না হইলে উড়ায়া নিয়া যাইবো গা।’

মেয়ে তবু বলে, ‘বাবা এইগুলা এত ছুট্ট ক্যান? মুকুট নাই, তারা নাই, এইরকম হইছে ক্যান?’

—এইগুলা লকডাউনের পরি, মা। তর লাহান না খাইতে পায়া শুকাইয়া ওইরকম হইছে।

ভয়েই মেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিনের ধুলিশয্যার পর বাপের কোল তার বড়ো আদরের। এখান থেকে সে কিছুতেই কোথাও যাবে না, পরি এসে হাত ধরে টানাটানি করলেও না।

শুধু চিনু নিঃসাড়ে জেগে থাকে, নিজেকে মনে হয় তার অর্ধমৃত পতঙ্গ, ডানা খসার মুহূর্তেও যে বাঁচার জন্য আঁকপাঁক করে। তবু ঘুমন্ত মেয়ের রুখা চুলে হাত বোলায় সে, ‘আমি আছি তো মা। কিছু না কিছু বেবস্থা হইবেই।’

শেয়ার করুন

Similar Posts

7 Comments

  1. প্রতিভা সরকারের “পরি ও পতঙ্গ” মুগ্ধ করল।

  2. ‘লকডাউনের পরি’ অপূর্ব লাগল। চলমান সময়ের একটি স্থিরচিত্রকে তুলে এনে তাতে ফের প্রাণ দিয়ে একদম চোখের সামনে তুলে ধরা — এ আপনার এক বিরাট দক্ষতা।
    অম্লমধুর ন্যারেটিভ, উপভাষার নিখুঁত প্রয়োগ এবং এক মায়াবী জাদু-জাদু গদ্যের মিশেল। আর উইপোকার কথাগুলো শুরুতেই অমিত শা, এনার্সি, বাংলাদেশী, মুসলমান…এসবের কথা মনে পড়িয়ে দিল।

  3. চিত্রকল্পের আশ্চর্য ব্যবহার এই গল্পটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে।মনে থেকে যাবে চিনু চরিত্রটি।

  4. প্রতিভা দির যেকোনো লেখা একবার পড়তে শুরু করলে কেমন একটা মায়া যেন নিজের ভিতরে টেনে জড়িয়ে নেয়। শেষ হয়েও যেন শেষ নেই।রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। কখনো একবার পড়ে ফেললে আবারও পড়ার মনে চায়। এবারেও ব্যাতিক্রম নাই। কাল রাতে পড়ে আর কিছু বলতেই যেন ইচ্ছা হচ্ছিল না! আজ সকাল থেকে এই পিটিসপিটিস ঝরে চলা অবিশ্রান্ত বৃষ্টি আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল এখানে, আবার পড়ে ফেললাম।

    প্রতিভা দি – এভাবেই মায়ায় জড়িয়ে রেখো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *