একটি অ-ধর্মীয় আলোচনা – প্রিয়াংকা মিত্র
‘এই, সর সর। আ মরণ, ছুঁয়ে দিবি নাকি রে?’ গিন্নিমার চিৎকারে ছোট্ট কালো মেয়েটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সরে দাঁড়াল। লজ্জায় মাথা নীচু করে বলল, ‘মু তুকে দেখতে পাই লাইরে’। প্রশ্ন ছুটে আসে, ‘চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি? ছুঁয়ে দিলে এক্ষুনি আবার স্নান করতে হত’। মেয়েটি জবাব দেয়, ‘কেনে রে? মুর তো কুনো ছোঁয়াচে রোগ হয় লাই। কাল মুর হাত কেটে গিছিল। মু দেখলাম, মুর রক্তের রং লালই রে, তুদিগের মুতো। বিশ্বাস যা কেনে?’
হ্যাঁ, সত্যিই মেয়েটির কোনো ছোঁয়াচে রোগ ছিল না। মেয়েটির শুধু দোষ ছিল, সে আদিবাসী ‘নীচু জাতের’ মেয়ে। এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়, আমাদের রোজকার জীবনের খুব চেনা একটা দৃশ্য। আমরা, যারা তথাকথিত ‘শিক্ষিত’, ‘ভদ্র’, ‘রুচিসম্পন্ন’, ‘আধুনিকমনস্ক’, ‘শহুরে’ তকমা আঁটা মানুষ, তাদেরই জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত উপরের ঘটনাটির মতো কিছু তুচ্ছ ঘটনা। ঘটনাগুলি এতই গা-সওয়া যে আলাদা করে হয়তো আমাদের চোখেও পড়ে না। আমরা যারা দু’বেলা চায়ের টেবিলে, গোল-বৈঠকে মানুষের Fundamental rights, Equality of status and of opportunity, Sovereign, Secularism, Democracy—এইসব ভারী ভারী কথা বলে টেবিলের রং চটাই, তারাও ওই চা-টুকু শেষ হওয়ার পর জীবনের ফার্স্ট ট্র্যাকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য বাথরুমে ছুটি, স্নান সারি, কেউ কেউ প্রতিটি এক্সামে আরও আরও বেশি নম্বরের আশায় বইয়ে, নয়তো গুগল ইঞ্জিনে চেপে নিজের নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দি’, আর কেউ কেউ টার্গেট অ্যাচিভের চিন্তায় মশগুল হয়ে অথবা প্রমোশনের চিন্তা করতে করতে অফিসের এ.সি রুমে কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রাখি। সত্যি তো, নিজের জীবনটা সুরক্ষিত করা, নিজের ঘরের আর গাড়ির আবহাওয়াকে হাতের মুঠোয়, নিয়ন্ত্রণে রাখা, ডিজাইনার স্যুট, গুচ্চির ব্যাগ, এসব নাহ’লে জীবন চলে? এসব না হলে মিঃ চৌহান কিংবা মিসেস পলের ককটেল পার্টিতে অন্যদের ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিকে কি উপভোগ করা যায়? ওইসব ভারী ভারী কথাও তো বলতে হবে, নইলে কিন্তু গুচ্চির ব্যাগের সঙ্গে শো-অফের অর্ধেকটাই মাটি।
পাঠক, একটু থামুন, একটু ভাবুন। কথাগুলো কি খুব ভুল? অধ্যাপক বার্চের মতে[১], জাতপ্রথায় জন্মগত আভিজাত্য স্বীকৃত, গুণগত স্বীকৃতি এতে নেই। জাতপ্রথার ফলে ব্যক্তির মেধা ও যোগ্যতা স্বচ্ছন্দে ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে পারে না। জাতীয়তাবোধের বিস্তার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠন প্রচেষ্টাও জাতপ্রথার দ্বারা ব্যাহত হয়। শুধুমাত্র সামাজিকভাবেই নয়, রাজনৈতিক দিকেও এর প্রাধান্য দেখা যায়—নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন, দলীয় প্রচারকার্য পরিচালনা, মন্ত্রীসভার সদস্য বাছাই, সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিগত বিচার-বিবেচনার প্রাধান্য দেখা যায়।
ব্রিটিশরা ভারত আক্রমণ করে এদেশের মাটিতে ক্ষমতাবিস্তার করে এদেশের ধনসম্পদ শুষে নিয়েছিল, আবার এদেশের মানুষের কালো চামড়া দেখে ‘নেটিভ’ বলে উপহাস করতেও দ্বিধা করেনি। তারা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে আজ প্রায় ৭৪ বছর হতে চলল, আজ আমরা স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি বলে মনে করি, কিন্তু আমাদের পোস্ট কোলোনিয়াল হ্যাংওভার আজও কাটেনি। আমরা আজও চামড়ার রং সাদা থেকে সাদাতর করে তোলার জন্য হাজারো ক্রিম মাখি, কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপনে প্রায় সকলেরই ‘ফর্সা’, ‘সুন্দরী’ পাত্রী চাই। কালো রঙের মেয়েটির বিয়ে তার মা-বাবা দিতে পারবেন কিনা সেই চিন্তায় পাশের বাড়ির কাকিমার প্রায়ই ঘুম আসে না। কালোর ঘনত্ব বোঝাতে ‘পুরো আদিবাসী’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করি। আন্দামানে বেড়াতে গিয়ে জারোয়া জনজাতির মানুষদের দেখতে যাই গাড়ি ভর্তি করে, যেমন করে বিভিন্ন অরণ্যে সাফারি করে বন্যপ্রাণী দেখতে যাওয়ার ধুম পড়ে। আবার কালো চামড়ার মানুষদের ঘৃণা করলেও আজও কৃষ্ণের লীলা শুনতে ভালোবাসি, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গান গাইতে গাইতে ক্লান্ত হই না।
শিক্ষিত পাঠকবর্গ হয়তো বলবেন, ‘আহা! তুমি ভুল বুঝেছ, কালো চামড়ার আদিবাসীদের তো ঘৃণা করা হয়নি। তাদের অবস্থান সমাজের নীচু স্তরে, কারণ তাদের নানারকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও তারা পড়াশোনা করে শিক্ষিত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখায় না। তারা চিরকাল বুটের তলায় থাকতেই পছন্দ করে।
সেইসব পাঠকবর্গকে মনে করিয়ে দিতে চাই, তথাকথিত শিক্ষার অহংকারে আমরা, যতই গর্ব করি না কেন, যে শিক্ষায় শিক্ষিত ওই ছোটো মেয়েটি বলেছিল ‘মুর রক্তের রং লালই রে’, সে শিক্ষা হয়তো আমরা পাইনি। “নিজের রক্তের রঙ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল বিরসা… সকলের রক্তের রঙই যে লাল হয়, কথাটা ওর কাছে খুব দরকারী এবং জরুরী বলে মনে হল”[২]। কই? এই কথাটা আমাদের তো ‘দরকারী এবং জরুরী’ বলে মনে হয় না।
মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে মুণ্ডারী জগতের উদ্ভবের যে কাহিনি বর্ণিত তা অনেকটা এইরকম—“সেই আদিযুগে সেঙ্গেল-দার আগুনে পৃথিবী জ্বলে ছাই হয়েছিল।… তাতে সকল মানুষ জ্বলে মরে যায়। এক কাঁকড়ার গর্তে ছিল ঠাণ্ডা জল।… একটি ছেলে একটি মেয়ে- মুণ্ডারী তারা,…আগুন দেখে থমকে দাঁড়াল। সিং-বোঙ্গা আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে বললেন- ‘আরে তোরা পালা। তোদের হাতে জনম মরণের ভার। তোরা হতে আবার জগৎ সির্জাব যে’।
তারা বলল, ‘কোথা পালাব?’
–‘ও—ই দেখ!’
আগুনরঙ্গা সাপ, তিনি নাগদেবতা নাগীরা, তিনি ফণায় ঢেকে ছেলেটিকে আর মেয়েটিকে নিয়ে গেলেন সেই কাঁকড়ার গর্তে। শীতল জলে তারা ডুবে থাকল। কতদিন নিদ্রায় গেল তারা জানে না। তারপর তারা সিং-বোঙ্গার ডাকে উঠে পড়ল।
বাইরে এসে দেখে কবে থেকে বৃষ্টি নেমেছে কে জানে। সিংবোঙ্গা যেমন আগুন ঢেলেছিলেন, তেমনি বৃষ্টি নামিয়ে বিশ্বভুবন ঠাণ্ডা করেছেন। কতদিন ধরে কে জানে, অরণ্য, নদী, পাহাড়, পশু, পাখী, ফুল, ফল, কীটপতঙ্গ সব- সৃষ্টি করেছেন।
সিং-বোঙ্গা মেঘ থেকে মাথা নামিয়ে হেঁকে বললেন, ‘যা! জগতে সব আছে, মানুষ নাই। তোরা সির্জা। শুন, মানুষে মানুষে – মুণ্ডারী মানুষে ভুবন ভরে দে”।[৩]
এই কিংবদন্তী বিশ্বাসের সঙ্গে কীভাবে যেন মিলে যায় খ্রিস্টধর্মমতের ‘আদম-ইভের’ গল্প। আবার যে আগুনরঙ্গা সাপটি তার ফণায় ঢেকে ছেলেমেয়েটিকে নিয়ে যায় সেকি আমাদের পুরাণের বাসুকি নাগ? যে বৃষ্টির রাতে শিশু কৃষ্ণকে একইভাবে ফণায় ঢেকে সুরক্ষিত রাখে?
“যখন সেই ছেলেটা আর মেয়েটা কাঁকড়ার গর্তে ঘুমোচ্ছে, তখনি হরম আসুল জল ঢেলে পৃথিবীর আগুন নেভালেন।
আগে সৃষ্টি করলেন জলের জীব। মাছেদের ডেকে বললেন- সাগরের নিচ থেকে মাটি আন। ডাঙার জীব সির্জাব”।[৪]
গরুড় পুরাণে বিষ্ণুর দশাবতারের প্রথম অবতার মৎস্য, তারপর কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি। মুণ্ডারীদের দেবতাও প্রথমে সৃষ্টি করলেন জলের জীব। এখানেও কি অদ্ভুত মিল। প্রতিটি সভ্যতার মূল যে একইস্থানে প্রোথিত, তা উপলব্ধি করা যায় গ্রীক পুরাণের “Hieros gamos” বা “sacred marriage” বিশ্বাসের সঙ্গে বাংলার প্রাচীন সাহিত্যসম্পদ চর্যাপদের গূঢ় সাধনপ্রণালীর আশ্চর্য মিলে। “The castration of the Attispriests was not depending on frenzy sent by the divine out of the blue, but on a human conception to establish a position at the limit of the divine and the mortal above the conditions of mankind. The way to salvation for those was the utter abhorrence of love.”[৫] আবার এর সঙ্গে মিলে যায় খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের “Holy Grail” বিশ্বাস, “This phenomenon finds expression in myths such as that of the goddess Cybele and the Galli.”[৬] এই বিষয়ে ইংরেজ ঔপন্যাসিক Dan Brown এর একটি জনপ্রিয় রোমাঞ্চকর থ্রিলার রয়েছে— “The Da Vinci Code”। চর্যাপদেও আপাত কাহিনির অন্তরালে বলা হয়েছে, প্রেম বা বিবাহ-সম্পর্ক বহির্ভূত কোনও নারীর সঙ্গে মিলনই মুক্তির পথ। বজ্রযানে নরনারীর দেহমিলনের কথা বলা হয়েছে, আবার ইন্দ্রিয়শক্তিকে দমনের কথাও বলা হয়েছে। ইন্দ্রিয়কে দমন করতে গেলে আগে তাকে জাগ্রত করতে হবে, মৈথুন সেই জাগরণের উপায়। মৈথুনজাত আনন্দ বা সাধকের বোধিচিত্তকে স্থায়ী করা যাবে মন্ত্রশক্তির সাহায্যে আর সেই মন্ত্রশক্তিতে মৈথুনজাত আনন্দ থেকে জন্ম নেবেন বিভিন্ন দেবদেবী এবং সাধকের ধ্যানচক্ষুর সামনে একেকটি মণ্ডলে অধিষ্ঠিত হবেন। সাধক যদি এই মণ্ডলগুলির সম্যক ধ্যান করতে থাকেন, তবেই তাঁর বোধিচিত্ত স্থায়ী স্থির এবং কঠিন হয়ে আস্তে আস্তে বোধিজ্ঞানে বিলীন হয়ে যায়।[৭]
এ থেকে বেশ উপলব্ধি করা যায়, মানুষের মধ্যে এই হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ প্রভৃতি ধর্মীয় বিভেদ কিন্তু মনুষ্যকৃত বিভেদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাহলে কবে, আর কতদিন পর আমরা মানসিকভাবে স্বাধীন হয়ে শুধু বলার জন্য নয়, আমাদের কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গরে তুলব? আমাদের পূর্বসূরিরা যে একরাশ স্বপ্ন দেখেছিলেন এক ও অভিন্ন ভারতবর্ষ গড়ে তোলার, তাকে বাস্তবে রূপদান করে কবে আমরা উদ্যত কণ্ঠে বলতে পারব, “আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্ররূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হলাম”।
গ্রন্থপঞ্জী :
১. Birch, A.H (1964). Representative and Responsible Government. London: Allen and Unwin
২. মহাশ্বেতা দেবী (১৪১৮)। অরণ্যের অধিকার। করুণা প্রকাশনী
৩. তদেব
৪. তদেব
৫. Sodergard, J. Peter(2017) The Ritualized Bodies of Cybele’s Galli and the Methodological Problem of the Plurality of Explanations. 179-180.
৬. Genter, Penny (2016). Hieros Gamos: Sacred Union of the Divine Feminine and Divine Masculine. Createspace Independent Pub
৭. মজুমদার, অতীন্দ্র ( ব.১৩৬৭) চর্যাপদ। নয়া প্রকাশ