কফিহাউসে এলিয়েন – শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

টেবিলে ব্ল্যাক কফি। ভ্যাপসা হাওয়ায় ঠান্ডা হচ্ছে ঢিমেতালে। পাশে সম্পূরক তিরিশ টাকার ভেজ স্যান্ডউইচ। একটু আগেই ঠক করে রেখে গেছেন সাদা ইউনিফর্মে ঢাকা বয়স্ক ওয়েটার। নিখুঁতভাবে কাটা তিনকোণা সাদা পাউরুটির মধ্যে শসার সবুজ আর টমেটোর লাল কিছুটা হলেও দেখা যাচ্ছে। মেনুকার্ডের সাত নম্বর এই খাবারটি প্রকৃতির রঙের ছোঁয়ায় কতটাই না লোভনীয় হয়ে উঠতে পারে, এই নিয়েই ভাবছিল উদয়ন। ভাবতে ভাবতে অন্য কোনও একটি বিষয়ে এবং তারপর তার অন্তর্যাস চেটেপুটে নিয়ে সেখান থেকে অন্য আরেকটি বিষয়ের গভীরে ডুবে যেতে চাইছিল সে। এই মুহুর্তে এটাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য এবং কাজটি বিনা বাঁধায় চালিয়ে যাওয়ার মতো সময়ও তার হাতে অঢেল। সময়কে ঠিক এইভাবেই ব্যবহার করতে আজ সে কফিহাউসে এসেছে। কোনও রকম আরোপ ছাড়াই সহজভাবে যা এসে তার মনকে নাড়া দেবে তাই নিয়েই শুরু হবে ভাবনা। যেমন আপাতত এই রঙিন স্যান্ডউইচ।

ঠিক সামনের টেবিলেই যে মেয়েটি বসে, তার কাছাকাছি আর কেউ না থাকায় টেবিলটাকে ঘিরে বাকি তিনটে খালি চেয়ারের কোনও একটিকে দখল করার অনুরোধ আসছিল আশপাশ থেকে। সে ফিরিয়ে দিচ্ছিল সকলকেই। উদয়ন শুনতে পেল মেয়েটি বলছে, বন্ধুরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে তাই এই আগলে রাখা।

কফিহাউসে শনিবার বিকেলের ভিড় স্বাভাবিকের তিনগুণ। এমতাবস্থায় তিন তিনটে বেওয়ারিশ চেয়ার দেখতে বড়োই বেমানান। বিগত এক ঘন্টায় গোটা পঞ্চাশেক মানুষের বিনীত অনুরোধ ঘনীভূত হয়েছে এই একটি টেবিলে। এখন উদয়নের মন ঝুঁকেছে সেদিকেই। মেয়েটি যে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে হাবভাবে তা কিন্তু মোটেই ফুটে উঠছে না। অবশ্য তার মানে এই নয় যে অপেক্ষা মানেই ঘনঘন ঘড়ি দেখা বা ফোন করে জেনে নেওয়া বন্ধুরা কখন আসছে কারণ বসার সুযোগ না পেয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অনেকগুলি মানুষের চোখের সামনে চেয়ারগুলিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যক্তিগত মালিকানায় আটকে রাখা বড়োই অস্বস্তিকর। না, তেমন কোনও অস্বস্তি বা সামান্যতম উৎকন্ঠার ছাপ মেয়েটির চোখে-মুখে একেবারেই নেই। বরং কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে এমনই এক মুখভঙ্গির আভাস খুঁজে পেয়েছে উদয়ন। উদয়ন জানে, মানুষ যতই কোলাহল চাক, আড্ডাবাজ হোক সে একলা হতে চায়। সবাই চায়। কিন্তু এই মানুষটার একলা থাকার ধরনটাই যে একেবারেই অন্যরকম। কফিহাউসে অনেক প্রখ্যাত কবিদের ভিড়ের মধ্যে থেকেও একলা থাকার ধরনটার সঙ্গে উদয়ন ভালোরকম পরিচিত। কিংবা ঠিক তার মতোই একলা বসতেই আসা মানুষের মুখের ভাবও খুব চেনা। না, কোনটার সঙ্গেই খাপ খাচ্ছে না মেয়েটির ভাবভঙ্গি। সহজভাবে চিহ্নিত করলে বলা যেতে পারে একা থাকতে চাওয়া এবং একইসঙ্গে একা থাকতে না চাওয়ার এক মিলিত অবস্থান মেয়েটি সযত্নে পুষে রেখেছে। ইংরেজি শব্দটা মনে পড়ে গেল উদয়নের। জাক্সটাপজিসন।

উদয়ন ফিল্ম রিভিউ লেখাতে ইদানিং বেশ নাম কামিয়েছে। বিশেষ করে সাই-ফাই সিনেমাগুলোর রিভিউ পড়তে তার ব্লগে চোখে পড়ার মতো ভিড়। পদার্থ বিজ্ঞানের ভালো ছাত্র আবার একইসঙ্গে শিল্প সাহিত্যে নিবিড় আসক্তি, এমন সমলয়ন তো সচরাচর চোখে পড়ে না, হাতেগোনা মানুষদের মধ্যেই দেখা যায়। উদয়ন তাদেরই একজন। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির জটিল রহস্যকে গ্রাফিক্সের কারুকাজে ইংরেজি সিনেমায় যতই সহজ করে দেখানো হোক না কেন দর্শক মাথা চুলকোবেই। উদয়নের ব্লগই তখন একমাত্র ভরসা। অভিধান নিংড়ানো সুন্দরতম সব বাংলা শব্দের মনোরম ঝংকারে রিলেটিভিটি, ব্ল্যাক হোল, কোয়ান্টাম গ্র‍্যাভিটির মতো কাঠখোট্টা কঠিন ব্যাপার-স্যাপারগুলো প্রেমের মধুর অনুভূতিতে রূপান্তরিত হয়ে দর্শকদের মধ্যে সিনেমাটির প্রতি এক অদম্য আকর্ষণ তৈরি করে। দিন দুয়েক আগেই সে কল্পবিজ্ঞানের ওপর একটি সিনেমা দেখেছে। সিনেমার পর্দায় পৃথিবী ক্রমশই ভরে উঠছে বিষাক্ত বালুঝড়ে। এ এমন এক সময় যখন পৃথিবীতে মানুষের থাকার যোগ্য কোনও জায়গাই আর বাকি নেই। সংকট কাটাতে সিনেমার নায়ক আকাশযানে করে রওনা হয় এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সিতে নতুন কোনও জগতের খোঁজে যা পৃথিবীর মতোই সুন্দর। এই জগতই হবে মানুষের নতুন আবাসভূমি। বিপন্ন, বিপদগ্রস্ত সকলকেই সেখানে স্থানান্তরিত করা হবে। দীর্ঘ অন্বেষণের পর অবশেষে এমন এক স্থানের খোঁজ পাওয়া যায় যা পৃথিবীর আয়তনের প্রায় দশগুণ। আশ্চর্য সব রঙের খেলা সেখানে। যেন সর্বত্রই দৃশ্যমান অরোরা বোরিয়ালিস। কিন্তু মুশকিল দেখা দেয় মানুষের নতুন সম্ভাব্য আবাসভূমির স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে। তাদের অনুমতি ছাড়া তো অনাহুতর বিশাল মিছিল নিয়ে জবরদখল করা যায় না। সমস্যা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায় তাদের ভাষা বুঝে ওঠার সময়। তারা কেউ কথা বলে না বরং দুর্বোধ্য হুঙ্কারে মাথা নাড়ে। ভাব-ভঙ্গি দেখেও বোঝার উপায় নেই যে তারা হাত বাড়িয়ে দেওয়া সবচেয়ে কাছের বন্ধু না পেটে কুমতলব পুষে রাখা ঘোর শত্রু। যদিও হাত মুখ পেট বলে ওদের কিছুই নেই। সে এক আশ্চর্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সিনেমার নায়ক! যোগাযোগ স্থাপনের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষায় মাসখানেক অবিশ্রাম তুমুল চেষ্টার পরেও নতুন জগতের বাসিন্দাদের মন সম্পূর্ণ অধরা থেকে যায় নায়কের কাছে। এরা সকলেই অন্য এক নক্ষত্রের প্রাণী, এরাই তো এলিয়েন। এলিয়েনের দিকে অনেক সময় ধরে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে নায়ক। সে অনুভব করে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে আলাদা কিছুই নেই তাদের ধারণায়। সবকিছুই মিলেমিশে একাকার। বর্তমানে দাঁড়িয়ে একইসঙ্গে তারা অতীতচারী, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তাই এলিয়েনরা জানত পৃথিবীর মানুষ একদিন আসবে নিজেদের বিপন্ন অস্তিত্বের সমাধান খুঁজতে তাদের কাছে। নায়ক যেহেতু পৃথিবীর সকল অভ্যাসের দাস তাই সে এলিয়েনদের অতিকায় শরীরে চোখের খোঁজ করে। খুঁজতেই থাকে।

পরিচত যা কিছু পার্থিব তার থেকে কয়েকশ আলোকবর্ষ দূরে, এমন দুর্ধর্ষ রঙিন এক জগতের মধ্যে এলিয়েনের উপস্থিতিকে আমূল অনুভব করতে চায় উদয়ন নায়কের মতোই। কিন্তু কানের ভিতর হলুদ ট্যাক্সির হর্ন আর ফুটপাতের বাজার থেকে উঠে আসা কয়েকশ ভীষণই চেনা আওয়াজকে সঙ্গী করে এমন অনুভবের কাছাকাছি যাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। উদয়ন ঠিক তখনই থেমে গিয়েছিল রিভিউ লেখার সময়ে। বেরিয়ে এসেছিল বাড়ির বাইরে দমকা হাওয়ার মতো। তারপর সেই অনুভূতির খোঁজেই সে চষে বেরিয়েছে মাঠঘাট, অসম্ভব জেনেও এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ছুটে গিয়েছে এমন এক অঞ্চলের খোঁজে যা বহু আলোকবর্ষ দূরের আশ্চর্য সেই রঙিন জগতের মতোই অবিকল। চোখ বন্ধ করে, পুরোনো সমস্ত প্রেম আর এখনও ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা বিদ্রোহের আগুনকে যথাসম্ভব স্তিমিত করে এলিয়েনের মুখোমুখি হতে চেয়েছে উদয়ন। তার চোখেমুখ ভিজে গিয়েছে অজানা আশঙ্কার ঘামে, বুকের ধুকপুকানি স্বাভাবিকতা ছাড়িয়েছে কিন্তু তবুও আগামীর সম্ভাব্য যাবতীয় শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেবপত্র ভুলে এলিয়েনের মুখোমুখি হতেই সে চেয়েছে।

উদয়ন যখন কলেজে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের দুনিয়ায় বিভোর, সে আশপাশের সকল মানুষের মধ্যেই খুঁজে বেড়াত এমন এক বিশুদ্ধ ভাব যা ওই কোয়ান্টাম জগতের মতোই খাঁটি, যেখানে কোনও ভান নেই, ছলাকলার প্রশ্রয় নেই। সভ্য সকল আয়োজন, যে আয়োজনের সান্নিধ্যে মানুষ নিজেকে সম্ভ্রান্ত মনে করে, সেসবই এড়িয়ে চলত সে। একটি মেয়েকে উদয়ন ভালোবেসেছিল। সে চাইত, হঠাৎই কোনও শীতের দুপুরে খুব পুরোনো স্মৃতির মতো মেয়েটি তার কাছে এসে বসুক। তারপর কিছু কথা। কথার মধ্যে উদয়ন খুঁজে পাবে সিম্ফনির ছন্দ। তার এই অন্বেষণ, দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে যা ছিল আগাগোড়াই খ্যাপাটে অবাস্তব সব চিন্তার আনাগোনা, সে চাইত মেয়েটি বুঝুক। সে যোগাযোগ করতে চাইত ঠিক এই ভাষাতেই। মেয়েটি বোঝেনি।

কফিহাউসে অন্যান্য সমস্ত টেবিলে কফিতে চুমুক দিয়ে যে সকল মানুষ মুখোমুখি কথা বলছে তাদের সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও উদয়ন তাদের সকলকেই চেনে। মুখোমুখি না হয়েও সে নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারে তাদের কথাবার্তার বিষয়গুলোর ভূত ভবিষ্যত বর্তমান। তাদের সীমাহীন উদাসীনতা বা অতিসক্রিয় ব্যাপক আবেগের পরিণামগুলো। উদয়ন স্পষ্ট দেখতে পায় তাদের দেখেও না দেখা বা সবকিছু বদলে দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে তা আস্তে আস্তে থিতিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ জীবনচক্র। কেবল ব্যতিক্রম সেই মেয়েটি। উদয়ন এতক্ষণে বুঝে নিয়েছে মেয়েটির ভিতরে এখনও বিদ্রোহের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। হয়তো বা সে বিদ্রোহে খুব ক্লান্ত বলেই শ্রেষ্ঠ বন্ধুর সান্নিধ্যও পছন্দ করছে না, অথচ ভিতরের দারুণ তাড়নায় বিশেষ এক কথোপকথনে শরিক হওয়ার জন্যেই আকুল চোখে অপেক্ষা করছে। এমন এক জগতের সে বাসিন্দা হতে চায় যেখানে শুধুই কোয়ান্টাম বিশুদ্ধতা, সম্ভাব্যতার বিজ্ঞানকে নাকচ করে যেকোনও মুহূর্তে যেমন তেমন কিছু ঘটে যাওয়ার বিপুল অনিশ্চয়তা। উদয়নের ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হল কফিহাউসের প্রত্যেকটি চেয়ারে টইটম্বুর মানুষগুলোর টেবিল চাপড়ানো হুঙ্কার দুর্বোধ্য ঠেকছে তার কাছে। তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বিশুদ্ধতার ক্রমাবিলুপ্তির আভাস সে পায়। সে দেখে কফিহাউস ক্রমশ রঙিন হয়ে উঠছে। ঐতিহ্যের প্রাচীন দেওয়াল জুড়ে দৃশ্যমান অরোরা বোরিয়ালিস। দুর্ধর্ষ সমস্ত রঙে মাখামাখি হয়ে আশপাশের মানুষগুলোর চোখগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু সেই মেয়েটি। তার চোখের দিকে তাকায় উদয়ন। মেয়েটিও তাকায়। সংরক্ষিত চেয়ারটার দিকে এগিয়ে যায় উদয়ন। মেয়েটির মুখোমুখি হয় সে। শেষ হয় তার অন্বেষণ। সিম্ফনি বেজে ওঠে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *