চতুর্থ ঢেউ—অতিমারির যুগে আশঙ্কা ও আশা – সাম্যজিৎ গাঙ্গুলী

শেয়ার করুন

গা হালকা ছ্যাঁক-ছ্যাঁক করছে, সর্দি-সর্দি ভাব। এক-দুদিন গড়ালে নাক একেবারে বন্ধ। কাশি হচ্ছে মাঝেমধ্যে। কিন্তু খুব একটা বেশি না। হচ্ছে, নিজে থেকে কমেও যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে সর্দি-জ্বরের ভাবটাও, ওই চার-পাঁচ দিনেই। দুর্বলতা থাকছে এক সপ্তাহ, কিন্তু তারপর ফুল চাঙ্গা। এই শেষ এক মাসে এরকম হাল প্রায় ঘরে ঘরে। হ্যাঁ, এটাই করোনার চতুর্থ ঢেউ। কোভিড-১৯-এর নতুন অবতার। আমাকে ছুঁয়েছে অলরেডি, ভগবান চান বা না চান, আপনাকেও ছোঁবে সম্ভবত।

বর্তমানে দৈনিক কোভিড কেসের সংখ্যা রোজই থাকছে হাজার পনেরো থেকে কুড়ির মধ্যে। Active case এর সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের মতো দিনে চার লক্ষ কেস না হোক, সংখ্যাটা মোটেই কম না। এবং আরেকখানা বিষয় মনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- এই সংখ্যাটা আদতে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। বেশিরভাগ আক্রান্তই হয় উপসর্গহীন, অনেকেরই পরীক্ষা করানো হয়নি উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও। এবং তাই, আসল আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়া অসম্ভব নয়। হ্যাঁ, তথ্যগুলো ভয় পাবার মতোই, যতই উপসর্গ মামুলি হোক না কেন। তবুও, ভয় আগের মতো নয়। কেন নয়, আসছি সেই কথাতেই।

কোভিড এখন অনেকটা ষান্মাসিক অনুষ্ঠানের মতো। বছরে দুবার করে দুটো ঢেউ। জনতা উত্তর খোঁজে, মুক্তি কবে। এবং কয়েক পাতা বইপত্র ঘাঁটলে উত্তর আসে, ‘মুক্তি নেই’। ১৯১৯-২০-র ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারির একশোরও বেশি বছর পরও ইনফ্লুয়েঞ্জা যখন এখনও চোখ রাঙায়, কোভিডই বা ময়দান ছাড়বে কেন! কিন্তু তা বলে পরিস্থিতি ২০২০-র মতোই হয়ে থাকবে না চিরকাল। বিবর্তনের ফলে নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাসের জন্ম হচ্ছে প্রত্যেক দিন। নতুন প্রজাতি, বা স্ট্রেন, নিয়ে আসছে নতুন কোভিডের ঢেউ। কারণ আমাদের দেহের ইমিউন সিস্টেমের কাছে তারা অচেনা। কিন্তু আবার বিবর্তনের সাথেই দুর্বলতরও হচ্ছে করোনা। কারণ লুকিয়ে সেই ডারউইনের ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’-এ। করোনা ভাইরাস আর পাঁচটা ভাইরাসের মতোই পরজীবী। আমাদের দেহে তারা আশ্রয়প্রার্থী। জীবদেহ বাদে করোনা ভাইরাসের পক্ষে বংশবৃদ্ধি সম্ভব না। যে স্ট্রেনের করোনা ভাইরাস যত দ্রুত তার আশ্রয়দাতার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সে ততই বাধা সৃষ্টি করে নিজের বংশবৃদ্ধিতে। ‘সারভাইভাল’-এর জন্য তাই বেশি বিপজ্জনক স্ট্রেইন রীতিমতো ‘আনফিট’। এবং সময়ের সাথে সাথে বিপদের ভয় তাই রোজ কমছে। তৃতীয় ঢেউয়ের কথা মনে পড়ে? আক্রান্তের সংখ্যায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের থেকে খুব একটা কম নয়, তবুও মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু নিয়ন্ত্রণেই। চতুর্থ ঢেউ সেই একই পথের পথিক হতে চলেছে সম্ভবত।

আশাটা স্রেফ অতীতের ট্রেন্ডের উপরে ভিত্তি করে বা থিওরির ভরসায় নয়। দুটি জিনিস এই ফোর্থ ওয়েভেও ভরসা যোগাচ্ছে আমাদের। এক, আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির হার অত্যন্ত কম। দুই, যাদের ভর্তি হতে হচ্ছে তাদেরও খুব কমেরই প্রয়োজন হচ্ছে অক্সিজেনের। অর্থাৎ কেস সংখ্যা বাড়লেও কেস severity কমছে। এবং মনে রাখার কথা, এর আগে কোভিডে মৃত্যুর মূল কারণ ছিল উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব। যদি হাসপাতালে আক্রান্ত রোগীর চাপ সত্যিই কম থাকে, তবে অক্সিজেন বা পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে রোগীমৃত্যু এড়ানো সম্ভব হবে। আর সঙ্গে আরও একটা সুবিধা এতদিনে আমাদের সাথে—এখন আর কোভিড আগের মতো নতুন, অজ্ঞাত বস্তু নয়। দুবছরে চিকিৎসকসমাজ কোভিডরহস্য উদ্ধার করে ফেলেছে অনেকটাই। ভ্যাকসিন পেয়ে গেছে দেশের অধিকাংশ মানুষ। এবার বাজি ধরতে হলে ভাইরাস নয়, মানুষের উপরে ধরাই বুদ্ধিমানের।

তা বলে এটাও কী ধরে নেওয়া চলে যে আমরা একেবারেই অতিমারী-মুক্ত? কোনো বিপদই আর ছুঁতে পারবে না আমাদের? না, অতটাও নিশ্চিন্ত হবার জায়গা নেই। প্রথমত, এখন কোভিডের সবথেকে dominant বা সংখ্যাগুরু স্ট্রেইনটি নেহাতই কম বিপজ্জনক হলেও ডেল্টা বা তারও আগের তুলনামূলক বেশি ক্ষতিকর স্ট্রেইনগুলো লোপ পেয়ে যায়নি। সংখ্যায় কম হলেও যথেষ্টই অস্তিত্ব রাখে এখনও। দ্বিতীয় ভয় হল, বিবর্তনের ফলে নতুন কোনো এমন স্ট্রেইনের সৃষ্টি যার সঙ্গে আমাদের দেহ একেবারেই অপরিচিত। একটা কোভিড-১৯ অতিমারি আরেকটা কোভিড-২২ অতিমারির জন্ম দেবে না, এটা হলফ করে বলা যায় না। হ্যাঁ, সুদূরপরাহত বটে, কিন্তু অসম্ভব না। তিন নম্বর ভয়ের কারণটি কিন্তু একেবারেই বাস্তব। সেটা হল, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং তার ফলে ঘটা দুর্যোগ। এমনিতেই আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর চেহারা কঙ্কালসার। এখন চাপ কম, দিব্যি ঘাড় শক্ত করে রেখেছি আমরা। কিন্তু চাপ বাড়লে কী হবে? ‘আরেকবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো পরিস্থিতি সামলানো যাবে তো?’—এ প্রশ্নটা ভাবায় প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীকেই। আর তাই, আশঙ্কা কম মানেই ঘোড়া বেচে ঘুম দেবার মতো নিশ্চিন্ততার কথা বলা যাচ্ছে না।

২০১৯-এর একেবারে শেষে করোনা যখন প্রথম মাথা তোলে, তখন একরকম আতঙ্ক ছিল। টিভি মিডিয়ায়, ইন্টারনেটে প্রথমে অজানা জ্বর নিয়ে বিস্ময়, সংশয় এবং মৃত্যুভয়। তারপর অজানা জ্বর জানা হল, মৃত্যুভয় কমল না। দেশে-বিদেশে ভীতি ছড়াল রোগের চেয়েও দ্রুত। ছড়াবে না কেন? অপ্রতিরোধ্য মৃত্যু যদি চোখের সামনে থাকে, তবে ভয়ই তো স্বাভাবিক। ভারতবাসীও মৃত্যু দেখল এবং দেখল লকডাউন। আর তাই, প্রথম ঢেউয়ের তীব্র আঘাত এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যু মিছিলের পরেও এখন বোধ করি আতঙ্কের তালিকায় অসুখের থেকে লকডাউনের ভয় আগে। এবং তাই, যখনই করোনার প্রসঙ্গ ওঠে, ওঠে লকডাউনের কথাও। আগের লকডাউনে শেষ হয়ে গেছে ছোটো ও মাঝারি ব্যবসা। চাকুরিজীবীরা কর্মহীন, স্বাধীন পেশাজীবীদের হালও ভালো না। শিক্ষাব্যবস্থার কোমর ভেঙে গেছে কার্যত বারংবার স্কুল বন্ধ রেখে। আবার কী ফিরতে পারে সেই লকডাউন? সে প্রশ্নের উত্তর, সত্যি বলতে, আমাদের কাছে নেই। কারণ লকডাউন এবং বাকি সব বিধিনিষেধ, সবই সরকারের হাতে। এবং এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নয়, শেষ কথা বলে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। কিন্তু আমরা এটুকু খতিয়ে দেখতে পারি, লকডাউন আদৌ প্রয়োজন কিনা। বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধির বালাই কোথাওই নেই। তবুও পরিস্থিতি মোটামুটি নাগালের মধ্যেই। তাহলে এটুকু অন্তত আন্দাজ করা যায়, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মানলে অবস্থার আরও বেশ খানিকটা উন্নতি হবে। যদি ধরে নিই দ্রুত অবনতি হল, তাহলেও কী লকডাউন যুক্তিযুক্ত? মনে হয় না। এক, এই অর্থনীতির পক্ষে আর লকডাউনের ধাক্কা সামলানো সম্ভব না। একেই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে রোজ। এরপর লকডাউন হলে ‘অসুখে মৃত্যু বনাম না খেতে পেয়ে মৃত্যু’-তে দাঁড়াবে ব্যাপারটা। আর দুই, লকডাউন করব ঠিক কেন? লকডাউনের মূল লক্ষ্য হল, সংক্রমণের গতিকে শ্লথ করা, peak কে delay করা। যাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপরে চাপ পড়ার আগেই গুছিয়ে নেওয়া যায়। এর আগে তিনটি ঢেউয়ে তিনবার লকডাউন হয়েছে, মানুষ মারি এবং মন্দা দুইয়ের সাথেই যুঝেছে, কিন্তু হাসপাতালের উন্নতি হয়নি। এবারে লকডাউন করে হঠাৎ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর হাল ফিরে যাবে, এমনটা বিশ্বাস কেন করব? আর বিশ্বাসযোগ্য না হলে, লকডাউনকেই বা যুক্তিযুক্ত বলি কোন্ বুদ্ধিতে?

ডাক্তাররা যতই আশ্বাসবাণী শোনান না কেন, ঘোলা জলে মাছ ধরার লোকের অভাব নেই। চতুর্থ ঢেউয়ের খবর sensationalize করাটা মিডিয়ার প্রবণতা হয়েই দাঁড়িয়েছে। অস্বাভাবিক কী, TRP-র দায় বড়ো দায়। কিন্তু তা বাদেও যে জনতার মধ্যে আতঙ্ক সত্যিই রয়েছে, সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এবং আছে তীব্র lockdown fatigue। ‘মাঝে মাঝে এরকম ঢেউ আসবেই, বিধিনিষেধ শিথিল হলে ঢেউ আসবে, থিতিয়েও যাবে। এটাই স্বাভাবিক’—এই ব্যাপারটা মানুষকে বোঝানো এখন ভীষণ জরুরি। কিন্তু সাথে এটাও দেখা জরুরি যে কথাটা যেন কখনোই ‘করোনা নেই’ মার্কা জিনিস হয়ে না দাঁড়ায়। অযথা আতঙ্কের মতোই অসচেতন শৈথিল্য কোনোমতেই কাম্য নয়। তাই সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিরও প্রয়োজন। এবং প্রয়োজন, একটু মানবিক প্রশাসনের। প্রথম দুটি তো নাহয় স্রেফ সাধারণ মানুষকে দিয়েই সম্ভব। শেষটা নিয়েই, সত্যি বলতে, সবচেয়ে বেশি চিন্তা।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *