ভোজ কয় যাহারে (দ্বাদশ পর্ব) : কুমড়ো – সত্যম ভট্টাচার্য
“ইচ্ছে করে শুনতে আমার নতুন কথা
—কবীর সুমন
অন্যরকম শব্দ এবং নীরবতা
অথবা খুব অন্যরকম দিনে রাতে
ইচ্ছে করে অন্যরকম গান শোনাতে…”
সুমন তো একথা গানের ক্ষেত্রে বলেছিলেন। কিন্তু আমরা যারা খাদ্যরসিক আছি আমার মনে হয় তাদের নতুন যেকোনো জিনিস দেখলেই খেতে বা নিদেনপক্ষে স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে। তবে সবসময় এই অভিজ্ঞতা যে বড়ো মধুর হয় তা বলা যায় না। কারণটা একটু বলি। আমার একটু গলা চুলকানোর দোষ আছে আর কেউ যদি তা বলে তাহলে তার যতখানি গলা চুলকোবে তার দশগুণ চুলকোবে আমার।
যাই হোক, বউ দেখলাম নতুন কী একটা জিনিস বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কী এটা জিজ্ঞেস করাতে বলতে পারল না। কথায় কথায় জানা গেল এক বয়স্ক মহিলা তাকে খুব ভালোবেসে রাস্তায় এগুলো দিয়েছে। পরদিন রান্নার মাসি এসে বললেন এগুলো কচুর ফুল এবং খেতে ভালোই লাগে। যা হোক, কাজ থেকে ফিরে দেখলাম যথারীতি বেশ তরিযুত করেই রান্না হয়েছে। বউ পাতে দেবার আগে বলল যারা আগে খেয়েছে তাদের নাকি অল্প গলা ধরেছিল। কিন্তু নতুন জিনিস খাবার তাগিদে লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
আর ব্লান্ডারটা এখানেই করে ফেললাম। কতরকমের যে টক দুপুরের পর থেকে রাত অব্দি খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। একসময় গলা চুলকানো থেকে মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল। মনে হতে লাগল গলার মধ্যে কী যেন একটা দলার মতো আটকে আছে। তাই সকলের এবং নিজের জন্যও পরামর্শ-বুঝে খেতে হবে।
তবে যে সবজিটির কথা বলার জন্য এত শিবের গীত গাইলাম তা কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই খাই। তাহলে নতুনটা কোথায়? সেই সেখানে যেভাবে খেয়েছিলাম। একবার লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজোর মধ্যে গিয়েছি পুরুলিয়া বাঁকুড়া বেড়াতে। আছি অযোধ্যা পাহাড়ে। তার আগের দিন অনেক ঘুরেছি। সেদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে চলে আসব পুরুলিয়ায়। যেখানে আছি সেটা খুব সম্ভবত বেসরকারি নয়। বেশ ভালো ব্যবস্থাপনা। ঘরদোর বড়ো, মেঝে লাল। সকালে খাচ্ছি লুচি বা পুরি-ওই জিনিসটাই। তবে সাথের তরকারিটি কীসের কিছুতেই ধরতে পারছি না। কখনও বেশ মাংসের মতো মনে হচ্ছে। আবার কখনও মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। কী এই জিনিস? জিজ্ঞেস করাতে কী বলছে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
খাচ্ছি, একটা বেশ বাগানের মধ্যে শেড দেওয়া জায়গায় বসে। পাশেই কিচেন, তার পাশে স্টোর। খাচ্ছি আর এদিক ওদিক দেখছি। হঠাৎ একটা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে নজর পড়াতে দেখি ঘর ভর্তি কুমড়ো। তারপর পরের লুচিটি নেবার সময় যে দিচ্ছিল তাকে বেশ নিশ্চিত ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম এটা কি কুমড়োর তরকারি? সম্মতি মিলল।
বিশ্বাস করুন আমাদের এই ডুয়ার্সে বড়ো হয়ে কোনোদিন ওভাবে কুমড়ো খাইনি। হতে পারে যে আমার বাড়িতে হয় না। তাহলে বাইরে খেতে পেতাম। তাও পাইনি। হতে পারে কোথাও হয়তো এদিকেও হয় কিন্তু আমি মিস করে গিয়েছি। কুমড়োর বড়া বা পাঁচমিশেলি তরকারিতে কুমড়ো খেতেই অভ্যস্ত ছিলাম। বা হয়তো উচ্ছে কুমড়ো দিয়ে ভাজা। যৌবনে বেশ কবার জয়দেবের মেলায় গিয়ে রুটি আর কুমড়োর ছক্কা খেয়েছি বটে তবে তার স্বাদ এর ধারেকাছেও নয়।
এবারে কথা হচ্ছে কোন কাজের জন্য কি রকমের কুমড়ো লাগবে। যদি ভাজা বা বড়া খেতে হয় তাহলে লাগবে একদম পাকা টুকটুকে লালচে কুমড়ো। আবার যদি ঘ্যাঁট বা লাবড়া মানে পাঁচমিশেলি তরকারিতে দেবার ব্যাপার থাকে সেক্ষেত্রে ভালো হয় একটু কাঁচা দেখে কুমড়ো নিতে পারলে।
এবারে কুমড়োরও অনেক প্রকারভেদ আছে। কোনো কুমড়ো চালে হয় আবার কোনো কুমড়ো মাটিতে হয়। কোনটির স্বাদ উত্তম বা কোনটি কীভাবে খেতে হয় বাবু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় বলতে পারতেন। এই অধমের মোটা জিভে অত সূক্ষ্ম তফাত ধরা পড়ে না।
কুমড়োর সাথে তার লকলকে ডগাটিও কিন্তু বড়ই উপাদেয়। মুগডালে অথবা আলু বেগুন বড়ি আর শীতকালে ফুলকপি দিয়ে তার চচ্চড়িটিও গরম ভাতে জমে বেশ ভালোই।