দেবীপক্ষেও আশাকর্মীদের দুয়ারে নিরাশা – দীপক সাহা

শেয়ার করুন

সকাল ৭ টায় দিন শুরু। সরকারি নির্দেশ মেনে গ্রীষ্মের রোদ বা বর্ষার জল পেরিয়ে বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্যসমীক্ষা– সন্ধ্যা ৫টা-৬টা পর্যন্ত, এভাবেই দিনটা কেটে যায় তাঁদের। গ্রামবাংলার তৃণমূল স্তরের জনস্বাস্থ্যের ভার তাঁদের কাঁধে। কার জ্বর হয়েছে, কোন্ মায়ের কী অবস্থা, কে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত, শিশুদের আয়রন খাওয়ানো, টিকার ব্যবস্থা করা, গর্ভবতী মাকে দিনে রাতে যখনই হোক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, করোনা রোগীর বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, প্রতিদিন অক্সিজেন টেস্ট করা, সুগার, প্রেশার, হার্টের রোগী শনাক্ত করা, টিবি রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি নানা কাজে ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন দেশের ১০ লক্ষ অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট (ASHA)কর্মীরা।

NRHM (national rural health mission) এর অন্তর্গত আশা প্রকল্প চালু হয় ২০০৫ সালে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে। প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যুতে ভারত তখন বিশ্বে প্রথম সারিতে। গ্রামীণ ভারতের বেশিরভাগ মা তখনও বাড়িতেই শিশুর জন্ম দিতেন। মা ও শিশুকে হাসপাতালমুখী করা, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ২০০৫ সাল থেকে ধাপে ধাপে ২০১১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব্লকে আশাকর্মী নিয়োগ করা হয়। রাজ্যে এখন প্রতি ১২০০ জনে একজন, সবমিলিয়ে ৫৪,৮৪৮ জন আশাকর্মী কাজ করেন। এঁরা সকলেই গ্রামাঞ্চলের অভাবী সংসারের মেয়ে বউ, অনেকেই বিধবা। অনেকের পরিবারের আর কোনো রোজগেরে সদস্য নেই, আশাকর্মীর উপার্জনেই সংসার চলে।

পোলিও মোকাবিলায় তাঁদের অবদানকে কুর্নিশ জানিয়েছে বিশ্ব। তাঁদের প্রচেষ্টা, প্রচার ও আন্তরিকতা বদলে দিয়েছে গোটা একটি প্রজন্মের ভবিষ্যত। করোনা পরিস্থিতিতেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের দুঃখ-কষ্টের রোজনামচায় দেবীপক্ষেও কোনো আশার আলো নেই।

পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া জেলা পুরুলিয়ার বরাবাজার ব্লকের বান্দোয়ান সেন্টারের আশাকর্মী দ্রৌপদী মাহাতো। নিজে সুগারের রোগী, এইসব কাজ করতে করতেই একদিন জ্বরে পড়লেন। শয্যাশায়ী অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার চার দিনের মাথায় শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয় তাঁর। বাড়িতে দুই নাবালক সন্তান। কর্মরত অবস্থায় আশাকর্মীর মৃত্যু হলেও সরকারের তরফে তাঁর পরিবারের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।

আশাকর্মীর কাজ করতেন হাওড়া জেলার রেহানা কাজি। ব্রেন স্ট্রোক হয় তাঁর। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও চিকিৎসা চলাকালীন অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারেননি বলে তাঁর সাম্মানিক ভাতাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর বলা হয় চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা।

গত বছর পশ্চিম মেদিনীপুরের এক আশাকর্মী কাজ করতে করতে করোনায় আক্রান্ত হন। তাঁরও হৃদরোগ ছিল, বাইপাস সার্জারি করতে হয়। ডাক্তার তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলেন। তাঁর বিশ্রামের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় সাম্মানিক ভাতাও।

এমন চিত্র অসংখ্য।

অভিযোগ, আশাকর্মীদের কাঁধে সব কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনও ছুটি নেই। করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন। অথচ ন্যূনতম বেতনও পান না। পুজোকালের দিনে ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কিনে দিতে পারেননি। জিনিসপত্রের এত দাম, সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। এই অতিমারিতে তাঁরা মরে বেঁচে আছেন।

২০১১ সালে আশাকর্মীদের জন্য চালু হয় ফরম্যাট সিস্টেম। এই ফরম্যাটে ৪২ ধরনের পরিষেবার কাজ করতে বলা হয়। এর মধ্যে আছে মা ও শিশুর পরিষেবা সংক্রান্ত ২৬ রকমের কাজ; যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, প্রেশার, সুগার, হার্টের রোগ ইত্যাদি ১৬ রকমের কাজ। এ ছাড়াও পালস পোলিও, ফাইলেরিয়া, ব্লক হাসপাতালে ডিউটি, ভোটের ডিউটি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ডিউটি, ব্লকের যে কোনো সরকারি মেলায়, দুয়ারে সরকারে, কোভিড ভ্যাকসিন ডিউটি, কোয়ারেন্টাইন জোনে ডিউটি, পরিযায়ী শ্রমিকদের দেহের তাপমাত্রা মাপার ডিউটি রয়েছে। এছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ ব্লক মেডিকাল অফিসার অফ হেলথ (বি এম ও এইচ) যখন যেখানে দরকার আশাকর্মীদের পাঠিয়ে দেন, বিডিও অফিস থেকে তাঁদের বিভিন্ন কাজ করার জন্য বলা হয়। না করলেই জবাবদিহি করতে হয়। এই সমস্ত কাজের জন্য নিজস্ব ফরম্যাটের কাজ করতে না পারলে ফরম্যাটের টাকা কাটা যায়। চব্বিশ ঘণ্টা স্বাস্থ্য পরিষেবার এত ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আশাকর্মীদের পারিশ্রমিক খুবই কম—মাসে ছয়-সাত হাজার টাকার বেশি হয় না।

বেশিরভাগ আশাকর্মীর বয়স এখন পঞ্চাশের কিছু কম বা বেশি। অনেকেই প্রেশার, সুগার, হার্ট, কিডনি, থাইরয়েড ইত্যাদি নানা রোগে আক্রান্ত। আর আশাদের কাজটাও সবসময় রোগ ও রোগী নিয়ে। তার উপর এত ধরনের কাজের চাপে তাঁরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। গ্রামাঞ্চলে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এই লকডাউনে অনেককেই অসুস্থতা নিয়েও ২০-২২ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে ব্লক হাসপাতালে দিশা ডিউটি করতে যেতে হচ্ছে। রাতে প্রসূতির সঙ্গে ব্লক হাসপাতালে এসে তাঁকে ভর্তি করে সারারাত হাসপাতালে বসে থাকতে হয়, ফিরে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। পরের দিন সকালে কোনোরকমে বাড়ি ফেরা। তারপর রান্নাবান্না করে কোনোরকমে দুটি খেয়ে আবার কাজে বেরিয়ে পড়া।

বাড়তি কাজের চাপে আশাদের এমনিতেই হিমশিম অবস্থা, তার উপর গত বছর থেকে করোনা অতিমারীর বিপুল কাজের ভার আশাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় কোনোরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই। আশাকর্মীদের বিক্ষোভের আগুন আবার জ্বলে ওঠে। শুরু হয় ধর্মঘট, কর্মবিরতি, জেলায় জেলায় বিক্ষোভ প্রদর্শন। ২০১৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রায় ৪০,০০০ আশাকর্মী কলকাতার ধর্মতলার রানী রাসমণি রোডে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ধর্মতলার পুরো চত্বরটা সেদিন বেগুনি আগুনের শিখায় জ্বলতে থাকে। বিক্ষোভ চরমে ওঠে। রাজ্য সরকার এই বিক্ষোভ শান্ত করার জন্য আশাকর্মীদের কিছু কিছু দাবি মেনে নেয়। দীর্ঘদিনের দাবি মেনে বোনাস ২০০০ টাকা, অবসর ভাতা তিন লক্ষ টাকা, এবং সাম্মানিক ভাতা ১০০০ টাকা বাড়ানো হয়।

নিয়োগের সময় থেকেই আশাদের স্বেচ্ছাসেবিকা আখ্যা দিয়ে শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে কেন্দ্রের সরকার। আশাকর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন, মেডিকেল ভাতা, ছুটি, মেডিকেল ছুটি, ইএসআই—কোনোকিছুই নেই। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’। কর্মরত অবস্থায় আশাকর্মীর মৃত্যু হলে তার পরিবারের জন্য সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রীয় সরকার উদাসীন। রাজ্য সরকারও নীরব। দুর্গতিনাশিনী আশাকর্মীরা আশায় দিন গোনেন কবে সরকারের ঘুম ভাঙবে, তাঁদের দুর্গতির নাশ হবে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *