বাড়িতে ফিরেই একটা দ্বন্দ্ব যুদ্ধ বেঁধে গেল। পরমা এমনিতে খুব একটা কথা বলে না। শান্তিতে থাকতেই ভালোবাসে। কিন্তু, অহেতুক অশান্তি একদম ভালো লাগে না।
রান্নার লোককে ঝাল ছাড়া তরকারীটা করতে বলা হয়েছিল। ছেলেটা খেতেই পারছে না। আর শাশুড়ি মা, যত বয়স হচ্ছে কথাবার্তা খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে যাচ্ছে। সারাজীবন ঝাল ঝোল খেয়ে এখন উনি নিজে ঝাল খেতে পারেন না। আর চার বছরের ছেলেটা খেতে পারছে না বলে পরমা রান্নার লোককে বলেছে দুটো কথা, তাই তিনি মুখ ভার করে আছেন। শাশুড়ি মা’র ভয় হয়ে গেছে। কাজ ছেড়ে চলে গেলে কি হবে।
এই ঘটনাটা গতকাল রাতের।
দ্বন্দ্ব টা হল অখিলের সাথে একচোট। আজ সকালে যখন রান্না করতে এসেছে কুসুম, সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে কে কেমন ঝাল খাবে, তাতে পরমা উত্তর দিয়েছে,
“আমাদের তো ঝাল খেতে কোন সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় আমার ছেলে আর আমার শাশুড়ি মায়ের। ওদের জন্য ঝাল ছাড়া করে দিও।”
পেছন ঘুরতেই স্পষ্ট কানে এল শাশুড়ি মা বিড়বিড় করে বেশ রাগত স্বরে বললেন,
“ঝাল খেতে পারে, কি গর্বের কথা”….
মুখ লাগানো অভ্যেস নেই পরমার। রুচিতে বাঁধে। কিন্তু, তীরের মতন বিঁধল বুকে। অবাক লাগল। এটা কি একটা গর্ব করার মতন বিষয় হল??
অদ্ভুত সব।
অখিলের সাথে শুধু ঝগড়াটুকুই হল। মীমাংসা হল না। ও মীমাংসা করার মতন ছেলেও নয়।
পরের দিনও এর রেষ থেকে গেল পরমার মধ্যে।
অটোতে বসে বসে ভাবছে, এই যুগেও এসব হয়?
অথচ, কত শিক্ষিত, পড়াশুনা জানা সব। তাদের এরকম আচরণ? আসলে এরা শিক্ষাটাকে বিলোতে জানে না। দিতে জানে না। মানসিকতাটা তাই বড় জায়গা পায়নি।
হঠাৎ অটোটা তীব্র শব্দে সজোরে একটা ব্রেক কষল। মুখের সামনের রডটা আরেকটু হলেই থুতনিতে লাগত। তাও মাথায় একটা জোর আঘাত লাগল অটোর ছাদটা। পাশে একটা বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের কোলে ছিল। ভয়ে কেঁদে উঠল। কি ভাগ্যিস ওর মায়ের হাতটা রডে ছিল।
কি ঘটল, দেখার জন্য অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল সবাই..
অটোওয়ালা বলল,
– সামনে দেখুন, কানে ফোন দিয়ে সাইড দিচ্ছে না। হর্ন দিলাম কতবার। আমি কি করব?
পরমা নামল, বাকিরাও নামল।
একটা কমবয়সী ছেলে, কানে হেডফোন গুঁজে মনের সুখে প্রায় মাঝরাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ভিড় হয়ে গেছে রাস্তাটা। কিছু লোক ছেলেটাকে পাকড়াও করল। একজন কান থেকে টেনে খুলে দিল হেডফোনটা। তর্ক বিতর্ক চলছে। ছেলেটা অনর্গল ইংরেজি তে কথা বলে যাচ্ছে। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ ইংরেজিতে বলছে, কেউ বাংলাতেই কাঁচা খিস্তি দিচ্ছে। যাচ্ছেতাই অবস্থা।
পরমা একটু এগিয়ে গেল।
সবাইকে একটু থামতে বলল।
বলল, ” ভাই, তুমি তো লেখাপড়া শিখেছো। এভাবে যে তুমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছো, তোমার নিজেরই কিন্তু সবচেয়ে বড় বিপদ ঘটবে। বাড়িতে তোমা্রও তো মা বাবা রয়েছেন। তারা তোমায় নিয়ে সবসময় চিন্তা করেন। দেখো তো, আজ আমাদের কত বড় বিপদ হতে পারত। বাচ্চাটাকে দেখো, ভয় পেয়ে গেছে…..
– দিস ইজ নট মাই ফল্ট, হি ডিডন্ট সি মি..
তাও তর্ক করে যাচ্ছে ইংরেজিতেই। অটোওয়ালার দোষ দিচ্ছে। অটোওয়ালা মারতে উদ্যত হল। পরমা থামাল, কিন্তু নিজে একটা কাজ করে বসল। ছেলেটার হাত মচকে ঘুরিয়ে পেছনে নিয়ে এল।
এবার ছেলেটা বলে উঠল,
– উফ্। মা গো, কি করছেন টা কি? লাগছে দিদিভাই, ছাড়ুন।
– কেন? এতক্ষণ তো ইংরাজিতেই বলছিলি, এবার মা বলছিস কেন? বিপদে পড়লে মায়ের কথা মনে পড়ে তাই না? তার আগে নয় কেন?
– আআআআ। ভুল হয়ে গেছে দিদিভাই। লাগছে খুব ছাড়ুন।
– দু’কলম ইংরেজি আওড়ালেই বিশাল বড় কেউকেটা হওয়া যায় না। আর সবসময় নিজের কথা চিন্তা না করে একটু অন্যের কথাও ভাবা উচিৎ। তুই তো আচ্ছা পাগল, নিজের প্রাণের কথাও চিন্তা করছিস না।
বলে হাতটা ছেড়ে দিল।
ছেলেটা হাতটা ধরে বসে পড়ল যন্ত্রণায়।
অফিসের গেটে আসতেই সিকিউরিটি গার্ড বলে উঠল,
“গুড… না মানে, সুপ্রভাত ম্যাডাম”..
“পরের বার যেন ম্যাডামটুকুও সংশোধন হয়”..
পরমার কান্ড দেখে কলিগরা হাসে।
লিফ্টের সামনেই একচোট হয়ে গেল রুবির সাথে।
– তুই পারিস বটে।
– তোরাও পেরে দেখা। তোরা পারছিস না কেন?
– কারণ, আমরা তোর মতন চেষ্টা করছি না।
– সেটাই তো প্রশ্ন, কেন করছিস না?
হঠাৎ লিফ্টম্যান একটা সেলাম ঠুকে বলল,
– নমস্কার দিদিমণি..
বেশ অবাক করা কান্ড। দীর্ঘ পনেরো বছর পর কেউ সেলাম মেমসাহেব এর বদলে এই ভাষা বলে উঠল।
– সিংজী…
– হা দিদিমণি, আপনি বলেছিলেন, কি এক্কুস্সে ফরবরী বাংলা চাই। তো লিয়ে লিন, হামিভি বাংলা বলছি।
– বাহ্ সিংজী। খুব সুন্দর, অসাধারণ। আপনি পেরেছেন। আরও পারবেন।
সবাই একটা মজা পেয়েছে ধরে নিয়ে হেসে ফেলেছে।
রোহিত বলে উঠল।
“লিফ্টম্যানকে দিয়ে বাংলা বলিয়েছিস, জিও বস।”
সিংজী মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল।
পরমা রোহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কলিগ না হয়ে যদি ভাই হতিস, এই মুহুর্তে ঠাসঠাসিয়ে দুটো চড় মারতাম দু’গালে।
– কেন?
বাকিরাও চেঁচিয়ে উঠল।
– বিহেভ ইওর সেল্ফ। হি ইজ ইওর কলিগ।
পরমা দমল না।
– বিহেভ?? ওরে ওটা ব্যবহার বল। বিহেভিয়ার কে তোরা জাস্ট ব্যবহার করিস। কারণ ওটুকুই পারিস। লিফ্টম্যানকে লিফ্টম্যান বলিস। ওনার নাম নেই, তাই সম্মানও নেই।
এবার সবাই চুপ করে গেল।
সিংজী মুখ খুলল,
– দিদিমণি খুব জেদী। আদায় করে ছাড়ে। হামাকে বলত, তোমাদের দেশে বাঙ্গালিরা গেলে তোমাদের জন্য হিন্দী শিখতে হয়। আবার সেই তোমরাই যখন বাঙ্গলায় আসো, সেই বাঙ্গালীকেই হিন্দী বলতে হবে, এটা কেন? আমাদের জন্য তোমরা কেন বাঙ্গলা শিখবে না? আমরা তোমাদের সুবিধা দেখব, তোমরা আমাদের সুবিধা দেখবে না??”..
কিছুক্ষণ স্তব্ধ সবকিছু।
রোহিত আর রুবি দুজনে হঠাৎ হাততালি দিয়ে উঠল।
রোহিত বলল, নে মার। দিদি হলে মারতিস। নে মার।
পরমা হেসে আস্তে করে একটা হাত গালে বুলিয়ে দিল রোহিতের।
সারা অফিসে রটে গেল এ ঘটনা।
আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে যেন পরমার জন্যই বাঙলা খানিকটা জিতে গেল।
সিংজীকে রোজ মনে করাত লিফ্টে উঠেই,
“কতটা বাঙলা শিখেছো, দেখব ২১ তারিখ”..
রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে শাশুড়ি মা বললেন,
“বাবু তো কত কি জানে, কি সুন্দর অ আ লিখল। দাদু দিদা বানান লিখলো, বর্ণপরিচয়টা নিজেই চিনে নিয়ে এল। ও তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, ওদের স্কুলে শেখায়?”
– না মা, ওকে বাঙলা আমি শেখাই।
– খুব ভালো করো। টুম্পার ছেলেটা এক কলম বাঙলা পারে না। ওর ও তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।
– বাঙালী হয়ে বাঙলা পারে না, এটা কিন্তু খুব একটা গর্বের কথা নয়। আসলে কি জানেন তো। গর্বটা বিষয় হলেই করা উচিত। বিষয়হীন ঘটনাগুলোকে নিয়ে আমরা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তাই গর্বিত হওয়ার বিষয়গুলো ঢাকা পড়ে যায়।
পরমা চলে আসছিল। শাশুড়ি মা কি বুঝলেন জানা নেই। তাও বললেন..
” তুমি খাবে না”??
– না মা, আমি আজ যা পেয়েছি, এটা নিয়ে অনেকদিন পেট ভরে থাকবে আমার।
মস্তিষ্ক, হৃদয় সায় দিয়ে বলল,
হ্যাঁ। আমি গর্বিত, আমি বাঙালি।।