ভারতের দৃষ্টিকোণে বাংলায় SIR বাঙালির জন্য বিপর্যয় ডাকবে – সৌম্য মণ্ডল
SIR প্রশ্নে দেশের যাবতীয় বিরোধীদল মোটামুটি একটি ঐক্য মতে পৌঁছাতে পেরেছে ‘কোনও বৈধ ভোটার বাদ দেওয়া যাবে না’। তারা এটাকে নাগরিকের ভোটাধিকার সঙ্কোচনে প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন, যা সারা ভারতের ক্ষেত্রে ঠিক হলেও বাংলার ক্ষেত্রে ঠিক কি? এর উত্তর লুকিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসের বিশেষ ধরনে, ভারত রাষ্ট্রের জন্ম, জন্মের সময় দেশভাগ নামক রক্তাক্ত দুর্ঘটনা বা পরিকল্পিত অপরাধী তৎপরতার মধ্যে, যা SIR বা নাগরিকপঞ্জি ইস্যুতে বাংলাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে অন্যান্য রাজ্যের মানুষ সচেতন থাকবেন, সহানুভূতিশীল হবেন এমন আশা করাটা কতটা বাস্তবসম্মত হবে সেই নিয়েই প্রশ্ন থাকলেও বাংলার নেতারা না বুঝলে সেটা বাঙালির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলা এবং পাঞ্জাবের জমি এবং মানুষ কেটে ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরি হয়েছে, অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতাটা অন্যরকম। আবার ১৯৪৭ সালেই পাঞ্জাবে মোটামুটি উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধান হয়ে গেলেও বাংলায় সেটা হয়নি। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও ১৯৫০ সালের দাঙ্গা, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সহ তার পরবর্তীতে পূর্বপাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুরা আসতেই থেকেছেন। এই উদ্বাস্তুরা ভারতে প্রচলিত নাগরিক আইনের চোখে নাগরিক নয়, অবৈধ অভিবাসী।
কাজের সন্ধানে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে পরিযান ঘটালেও মুসলিমরা সাধারণত কয়েকমাস বা বছর কাটিয়ে আবার বাংলাদেশে নিজের আত্মীয় পরিজনদের কাছে ফিরে যান, অন্যদিকে মূলত হিন্দুরা স্থায়ী ভাবে রয়ে যান, মূলত পশ্চিমবঙ্গে। এরা পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা, শ্রমশক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। SIR আতঙ্কে যারা বাংলাদেশ ফিরে যেতে গিয়ে ধরা পড়ছেন তারা মূলত মুসলিম, অন্যদিকে ভোটার লিস্টে নাম না থাকার ভয়ে যারা কাঁদছেন, যারা আন্দোলন করছেন তারা মূলত হিন্দু।
পূর্বপাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আগত মানুষের নির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও ২০০৪ সালে একটি গবেষণা পত্র থেকে জানা যায় স্বাধীনতার পর থেকে ঐ সময়কাল পর্যন্ত আড়াই কোটি মানুষ ভারতে এসেছেন। বালা বাহুল্য তার পরেও এই অভিবাসন চলতে থেকেছে। তাদের সন্তান নাতি নাতনি হয়েছে। এদেশের ঘটিদের সাথে তাদের বিয়ে সন্তান হয়েছে।
১৯৫০সালের ২৬ শে জানুয়ারির পর যারা ভারতে ঢুকেছেন (নেপাল, ভুটান ছাড়া) বা আগামী দিনে ঢুকবেন তাদের পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে ভারতে প্রবেশ করবেন এবং ভিসার মেয়াদ শেষে নিজের দেশে ফিরে যাবেন, অন্যথায় তিনি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এটা যে কোনও দেশেরই স্বাভাবিক আইন। তাকে নাগরিকত্ব পেতে গেলে হয় ন্যাচেরালাইজেশন পিরিয়ড (ভারতে ১১ বছর) ভারতে থেকে বা রেজিস্ট্রেশন (বিবাহ সূত্রে) আবেদন করে ভারতে নাগরিকত্ব পেতে হবে। অন্যথায় তিনি অনাগরিক। কেউ যদি শরণার্থীর মর্যাদা পান, তবুও তিনি নাগরিক হলেন না, তিনি শরণ পেয়েছেন মাত্ৰ ৷
১৯৭১ সালে ইন্দিরা মুজিব চুক্তি পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা মানুষদের ভারত সরকার আবেদনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ দিলেও ২৫ মে ১৯৭১ এর পর গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে ভারত সরকার নাগরিকত্ব প্রদান একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং এর অর্থ হল- ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারী থেকে ১৯৭১ অব্দি যারা ভারতে এসেছেন তাদের অনেকে নাগরিক, অনেকে নাগরিক নয়। আর ১৯৭১ সালের পরে ভারতে আসা একজন বাংলাদেশীও ভারতের নাগরিক নয়। অথচ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তারা ভোটার কার্ড বানিয়ে নিয়েছে, সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন, এই রাজ্যের বা ভারতের মূলধারায় সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন।
যেহেতু নাগরিকারাই একমাত্র ভোট দিতে পারেন, বিদেশিরা নয়, তাই এই বড় অংশের মানুষ আসলে ভুয়ো ভোটার। বিহার বা গোটা ভারতের আশঙ্কা হল জন্মসূত্রে বৈধ নাগরিকদের কারচুপি করে “ভোট চোর” নির্বাচন কমিশন বাদ দেবে বা নথীর অভাবে ভারতের নাগরিক অর্থাৎ বৈধ ভোটাররা তাদের অধিকার হারাবেন।
বাংলার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। যদি আমরা ধরেনেই যে নির্বাচন কমিশন একটি নিরপেক্ষ সংস্থা, সমস্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে পর্যাপ্ত কাগজ আছে, প্রক্রিয়ায় কোনও এরর হবে না, তবুও কয়েক কোটি মানুষকে বৈধভাবেই ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। কারণ এরা বা এদের পূর্বপুরুষ জন্মসূত্রে নাগরিক নয় এবং আবেদন করেও নাগরিকত্ব তারা অর্জন করেনি। সুতরাং কোনও “বৈধ ভোটারকে বাদ দেওয়া যাবে না” এই কথার অর্থ হল এই মানুষদের বাদ দিয়েই ভোটার লিস্ট তৈরি করা। পশ্চিমবঙ্গের মূল সমস্যা বৈধ ভোটার বাদ যাওয়ায় শুধু নয়, আসল সমস্যা নাগরিক আইনে। এই মানুষদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করিয়ে এদের ভোটার লিস্টে রাখতে বলার অর্থ অনাগরিক বা বিদেশিদের ভোটাধিকার দাবি করা, যা অযৌক্তিক এবং উদ্ভট।
এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে ২০০২ সালের ভোটার লিস্টে কারও নাম থাকলে বা বাবা মায়ের নাম থাকলে তাকে কোনও কাগজ জমা দিতে হবে না এবং কারও যদি ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাইয়ের আগে জন্ম হয় তবে তাকে স্কুল সার্টিফিকেট বা এই ধরনের সরকারি সার্টিফিকেট দেখালেই হবে। বলাবাহুল্য যদি শেষ পর্যন্ত এটাই পদ্ধতি হয়, প্রচুর মানুষ ভোটার লিস্টে নাম তোলার সুযোগ পাবে, যারা ভারতের নাগরিক নয়। কিন্তু আমরা জানিনা যে এই তথ্য নির্বাচন কমিশন ২০১০ এবং ১৫ সালে হয়ে যাওয়া ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের তথ্যের সাথে মেলাবে কিনা? বা আগামী NPR বা NRCর সময় নাগরিক আইন অনুযায়ী কড়া ভাবে নথি চাওয়া হবে কিনা!? যদি এমনটা হয় তবে ২০০২ সালের ভোটার লিস্টে যাদের নাম আছে বা যারা ১৯৮৭ সালের ১জুলাইয়ের আগে সার্টিফিকেট দেখিয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন, তারাও বিপদে পড়বেন। ফলত সংখ্যাটা চারকোটির উপরে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সুতরাং বাঙালিকে জাতি হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই মানুষেরা আমাদের আপনজন কি না? এটা বোঝা জরুরি যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির স্বার্থেই এই মানুষদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করা জরুরী। এর মূলত তিনটে কারণ-
১) পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু বাঙালি ভোটার কমলে বাঙালি মুসলিম এবং হিন্দিভাষী ভোটারের অনুপাত বাড়বে। বর্তমানে অবাঙালি ভোটার ১৫% এবং বাঙালি মুসলিম ভোটার ৩০%। এর ফলে বিভিন্ন বিধানসভা,লোকসভা কেন্দ্রে বিহার উত্তর প্রদেশ মূলে ভোটারদের এবং বাঙালি মুসলিমদের প্রভাব এবং দাবি বাড়বে। এর ফলে বিজেপি মুসলিম বেড়ে গেছে দেখিয়ে একদিকে ইসলামোফোবিয়া ছড়াবে অন্যদিকে অবাঙালি মূলত হিন্দিভাষীদের উপর ভিত্তি করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আরও তীব্র করবে। বিজেপি রাজ্য সরকার জিততে না পারলেও বদলে যাওয়া সমীকরণ তাকে সাম্প্রদায়িকরনে সুবিধা দেবে। এছাড়াও বাঙালির খাদ্যাভ্যাস সংস্কৃতি আরও বেশি আক্রান্ত হবে।
২) বাঙালিদের জন্মহার কম হওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে যদি অবাঙালি ভোটার ৩০% এর বেশি হয়ে যায় তখন ভাষাভিত্তিক রাজ্যের মর্যাদা হারাবে পশ্চিমবঙ্গ।
৩) ২০২৮সালের ডিলিমিটেশনে ১১৫টা আসন বাড়তে চলছে গোবলয়ের এমনই অনুমান করছেন পর্যবেক্ষকরা। লোকসভার সিট বেড়ে হবে ৮০০ এর বেশি। এমনিতে অহিন্দি রাজ্যগুলোর অসম কম। এই সময় বাংলার ভোটার সংখ্যা যদি কমে যায়, তাহলে আনুপাতিক আসন আরও কমবে। ভারত রাষ্ট্রে বাংলা তার ভাগিদারী বা দরকষাকষির ক্ষমতা হারাবে।
সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের নিজের স্বার্থে, ধর্ম নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বৈধ নাগরিকদের স্বার্থেই ওপাড় বাংলার মানুষের নাগরিকত্বকে সুরক্ষিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সর্বভারতীয় দৃষ্টিতে, দিল্লির দৃষ্টিতে বা গোবলয়ের দৃষ্টিতে বাংলার SIR বাI NRCর ইস্যুকে দেখলে হবে না। বরং বাঙালির স্বার্থের লেন্স দিয়ে ভারত রাষ্ট্রকে দেখতে হবে।

