বাংলা সাহিত্যে হোমসের প্রভাব – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের সূত্রপাত উনবিংশ শতক থেকে হলেও তার জনপ্রিয়তা শুরু হয় কমবেশি বিশ শতকের গোড়া থেকে। ওই সময় পাঁচকড়ি দে তার দেবেন্দ্রবিজয়-অরিন্দম বসুদের নিয়ে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশেষ করে “হত্যাকারী কে?” উপন্যাসটি সেই যুগে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। যদিও অনেকেই মনে করেন যে পুলিশি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরপর-ই গোয়েন্দা কাহিনির শুরু হয় ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে ফলে বাংলাতেও তাই-ই হয়েছিল (অন্তত আধুনিক সাহিত্যে)। কিন্তু সুকুমার সেন বৈদিক আমল থেকেই ক্রাইম কাহিনির কিছু কিছু উদাহরণ দেখিয়েছেন (“ক্রাইম কাহিনির কালক্রান্তি”-আবাপ)। 

প্রথম এ জাতীয় সাহিত্য শুরু হয় ১৮৫৫ সালের অব্যবহিত পরে “বাকাউল্লার দপ্তর” মারফত। এরপর “নবজীবন” পত্রিকা (অক্ষয়চন্দ্র সরকার সপমাঃ) ১৮৯৩-৯৪ সাল নাগাদ প্রকাশ করে “সেকালের দারোগার কাহিনি”। লেখক ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু। প্রায় সাথে সাথে আরও কিছু ইংরেজি বই “A Detctive Footstape” বা “Every Man His Own Detective” জাতীয় কিছু রচনাকে অনায়াসে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় দ্বারা রচিত সিরিজের অনুপ্রেরণা বলে ধরা চলে। তাঁর লেখা “দারোগার দপ্তর” প্রতি মাসে প্রকাশিত হত। ১৮৯৩ থেকে প্রায় ২০ বছর (কম-বেশি হতে পারে–পাঠক জানালে সমৃদ্ধ হব) বেরিয়েছিল। দারোগার দপ্তর-এর একটি চরিত্র নাম ও ধাম সহ পরবর্তীকালে ব্যবহৃত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজে। চরিত্রটি হল মণিপুরের টিকেন্দ্রজিত। এরপর ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এ জাতীয় কিছু রচনা প্রকাশ করেন। তাও জনপ্রিয় হয়েছিল। কিছু গল্প একেবারেই অনুবাদ ছিল। তবে এ সবই উদ্ভট-কেচ্ছা জাতীয় রচনা। ওই একই সময়ে ক্ষেত্রমোহন ঘোষ, শরচ্চন্দ্র (আজ্ঞে হ্যাঁ, এই বানান) দেব (সরকার), হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, হরিদাস মান্না, মহিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কুসুমেষু মিত্র, রমানাথ দাসেরা বটতলার বাজার গরম করে রেখেছিল।

বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মধ্যে অম্বিকাচরণ দে প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি রচনা শুরু করেন। তাঁর আগে কোনও বিখ্যাত সাহিত্যিক এই কাজে হাত দেননি। তাঁর পর পাঁচকড়ির আবির্ভাব। দেবেন্দ্রবিজয়, অরিন্দম, কীর্তিচন্দ্র, গোবিন্দরাম ইত্যাদি গোয়েন্দা তাঁরই সৃষ্টি। তাঁকে বাংলার গোয়েন্দা গল্পের এমিল গ্যাবরিয় বলা যেতে পারে। তাঁর রচিত ‘নীলবসনা সুন্দরী’, ‘হত্যাকারী কে?’, ‘গোবিন্দরাম’, ‘মৃত্যু বিভীষিকা’, ‘জীবন্মৃত রহস্য’ প্রভৃতি রচনা কিঞ্চিদধিক শতবর্ষ পূর্বে যতপরোনাস্তি ঝড় তুলেছিল। ইনিই প্রথম শার্লক হোমস-এর গল্প বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে জানাই, সুকুমার সেন থেকে প্রসাদরঞ্জন রায়, প্রত্যেকেই দাবি করেছেন যে পাঁচকড়ি দে রচিত ‘হরতনের নওলা’ আসলে ‘সাইন অফ ফোর’-এর বঙ্গানুবাদ। যদিও, যে কেউ উপন্যাসটি পড়ে দেখতে পারেন গল্প পুরো আলাদা এবং রহস্যটা বেশ প্যাঁচালো। আমি মনে করি, যাঁরা যাঁরা, ওই অদ্ভুত দাবিটি করেন, তাঁরা নাম দেখে আন্দাজ করেন, আদৌ মূল গল্প পড়ে দেখেননি (এককালে দুষ্প্রাপ্য, বর্তমানে উইকিমিডিয়ার কমন্সে পাওয়া যায়, তাছাড়া সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে)। 

লেখক যে যে গল্পগুলি অনুবাদ করেন:

১. গোবিন্দরাম (স্টাডি ইন স্কারলেটসাইন অফ ফোর এর একত্র অনুবাদ)।

২. মৃত্যু বিভীষিকা (হাউন্ড অফ দ্য বাস্কার্ভিল)।

৩. কৃপনের মন্ত্র (দ্য এডভেঞ্চার অফ দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল)।

এছাড়াও আরও কিছু গল্পে তিনি গোবিন্দরাম-কে এনেছেন।

*****

হোমসের কিছু গল্প কুলদারঞ্জন অনুবাদ করেন যার মধ্যে বিখ্যাত হল “বাস্কারভিলের কুকুর”(পরে প্রেমাঙ্কুর আতরথী “জলার পেত্নী” নামে আবার অনুবাদ করেন)। এরপর মাঠে নেমে পরেন হেমেন্দ্রকুমার। 

*****

হেমেন্দ্রকুমার রায় শুরু করেন ‘চতুর্ভুজের স্বাক্ষর’ (সাইন অফ ফোর), কুলদারঞ্জন রায় লেখেন ‘বাস্কার্ভিলের কুকুর’, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী লেখেন ‘জলার পেত্নী’ যা বাস্কার্ভিল থেকেই অনুপ্রাণিত। একই প্লটে নীহাররঞ্জন রায় লেখেন ‘পদ্মদহের পিশাচ’। 

এছাড়াও আছে বেশ কিছু গল্প যেখানে হোমসের প্রভাব পরিষ্কার পরিলক্ষিত হয়। যেমন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘গুপ্তধনের দুঃস্বপ্ন’ গল্পে ‘স্টাডি ইন স্কারলেট’-এর মোটিফ দেখা যায়। আবার একই লেখকের ‘ব্যাঘ্ররাজের বিভীষিকা’ গল্পে ‘ভ্যালি অফ ফিয়ার’, ‘ছয় নেতাজীর রহস্য’ গল্পে যে কেউ ‘সিক্স নেপোলিয়ন’-কে পাবেন। ‘শাহজাহানের ময়ূর’ নিঃসন্দেহে ‘আ কেস অফ আইডেন্টিটি’ থেকে প্রভাবিত।

এ তো গেল হেমেন্দ্রকুমার। বাকিরা? বাস্কার্ভিল থেকে নিয়ে সরাসরি লেখেন সুধীন্দ্রনাথ রাহা (অভিশপ্ত বংশ)। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ-এর ‘চোরাবালি’ আর সত্যজিতের ফেলু কাহিনি ‘টিনটোরেটর যীশু’ গল্পে রীতিমতো বাস্কার্ভিল-এর প্রভাব আছে। শরদিন্দুর ‘অদ্বিতীয়’ একদিকে ‘রেড সার্কেল’ আর অন্যদিকে ‘আ কেস অফ আইডেন্টিটি’ দ্বারা প্রভাবিত। সত্যজিতের ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’ গল্পে ‘আ কেস অফ আইডিনটিটি’-র প্রভাব আছে। শরদিন্দুর ‘রক্তমুখী নীলা’ গল্পে একসাথে তিনখানা হোমস কাহিনির (‘স্কারলেট’, ‘ব্ল্যাক পিটার’, ‘ব্লু কার্বানকল’) প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে। ‘ব্লু কার্বানকল’ থেকে স্বপ্নকুমারের দীপক চ্যাটার্জীর একটি এবং নীহাররঞ্জনের কিরীটি রায়ের গল্প তৈরি হয়েছিল। 

এঁদের বাদ দিলেও বুদ্ধদেব গুহর ‘আলবিনো রহস্য’ উপন্যাসে ‘দ্য স্পেকল্ড ব্যান্ড’ গল্পের মোটিফ দেখা যায়। ‘রেড হেডেড লীগ’ থেকে বাংলায় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় লেখেন ‘একচরণ সংঘ’ আর নারায়ণ সান্যাল তাঁর কাঁটা সিরিজে লেখেন ‘সর্ব শুভ্রসংঘের কাঁটা’। আবার সিক্স নেপোলিয়ন থেকে কাঁটা সিরিজের ‘ষড়ানন রবীন্দ্র মূর্তির কাঁটা’।

এছাড়া নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের গোয়েন্দা নালক হোম, নারায়ণ সান্যাল এর শার্লক হেবো, রাজশেখর বসুর সরলাক্ষ হোম ও বটুক সেন এমনকি অনেকের মতে শরদিন্দুর ‘ব্যোমকেশ’ হোমসের নামের প্রভাবে তৈরি।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *