বন্দিশালার আলোকরেখা: সাম্রাজ্যবাদের উত্তরকথন – রূপায়ণ ঘোষ
বিশ্বব্যাপী সাহিত্যের যেমন অজস্র ধারা-উপধারা রয়েছে তেমনই আছে তার নিজ নিজ ঘরানা। বন্দি সাহিত্য (Prison Literature) হল সেরকমই একটি সাহিত্যধারা। সুদূর অতীত থেকে বর্তমানেও এই ধারাটি বিশ্ব সাহিত্যে অতি দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে, জনপ্রিয়ও হয়েছে এমনকী কালোত্তীর্ণও।
কথাসাহিত্য, কবিতা, নাটক তথা প্রবন্ধ সাহিত্যের মধ্যেও একটি উদীয়মান উপধারা হিসাবে এটি বিদ্যমান। এই ঘরানার মূল চরিত্র হল মানুষের নিঃসঙ্গতার স্বর ও মেজাজকে উন্মোচিত করা। এর কিছু সৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এটি স্থানে স্থানে সাহিত্যের শৃঙ্খল হিসাবেও আবির্ভূত হয়েছে। লেখক যে-ই হোন না কেন- আফ্রিকান, আমেরিকান, ইউরোপীয় বা এশীয় এবং যে জেলেই তিনি বা তাঁরা আটক থাকুন না কেন; তাঁঁদের কারাগারের অভিজ্ঞতা একই প্রকৃতির- শাসকের চরিত্র সেখানে অমানবিক, নির্যাতনমূলক, ঘৃণ্য তথা স্বেচ্ছাচারী। তাই কারাবাসের অভিজ্ঞতা এবং তার সৃজনশীল অভিব্যক্তি একটি অনুমানযোগ্য শৈলী (Pattern) অনুসরণ করে যা সমালোচকদেরকে বন্দি সাহিত্যের তত্ত্বীয়করণে সহায়তা করেছে।
কারাগারের জগতে এক অপরিসীম শূন্যতার পাশাপাশি মানসিক চেতনার ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার এক রহস্যময় গতিশীলতাও নিহিত রয়েছে!
জেল অর্থে শুধু লোহার গরাদ ও ইঁটের দেওয়াল নয়; এই শৃঙ্খল আসলে একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাধীনতার উপর কষাঘাত; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন থেকে প্রায় সম্পূর্ণ স্থানচ্যুতি। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের নকশায় বন্দিদের ক্রমান্বয়ে বা বলা ভালো শৃঙ্খলা ও শাস্তিতে উল্লিখিত বিবিধ তত্ত্ব আদতে শাসনযন্ত্রের কৌশলগত ব্যবহার। সমাজবিদ মিশেল ফুকো বলেন, ”জেল হল পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আচরণ পরিবর্তন, ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ বা সংশোধন করার একটি যন্ত্র। ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং তাদের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা। বিভিন্ন শাস্তির চেষ্টা করা, বিভিন্ন কৌশল শেখানো, এসবই শাসকের পদ্ধতিগত ব্যবস্থা।”
Corinne Rostaing কারাগারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, বন্দি করে রাখার একটি নির্দিষ্ট স্থান ও একটি সাংগঠনিক শাস্তিতন্ত্রের কেন্দ্র রূপে।
পৃথিবীর সব দেশেই কয়েদিদের সঙ্গে জেলে যে আচরণ করা হয়েছে তা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। তিলক, গান্ধি, নেহরু এবং তাদের মতো অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দি যাদেরকে সময়ে সময়ে ভালোভাবে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। লেখা এবং মনসংযোগের জন্য দেওয়া হয়েছে সেলের নির্জনতা। অরবিন্দ আলিপুর জেলে ‘নারায়ণ দর্শন’ করেছিলেন, তিলক লিখেছিলেন গীতা রহস্য, গান্ধি লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী ‘My Experiment with Truth’ এবং ‘হিন্দ স্বরাজ’, নেহেরু রচনা করেন আত্মজীবনী তাছাড়া ‘Discovery of India’ ও ‘Glimpses of World History।’
তবে এগুলি কোনোটিই জেলের অভিজ্ঞতা বা কয়েদির দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা নয়। এই সৃষ্টিগুলিকে বরং জেলের নির্জনতার সর্বোত্তম ব্যবহার বলা যেতে পারে- যা যে কোনও স্থানেই রচনা অবশ্যম্ভাবী ছিল। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হল কারাগার যাপনের কোনো চিহ্ন-প্রকরণ নেই এমন লেখাকে বন্দি সাহিত্য বলা যায় কি না।
অসওয়াল্ড, এরওয়েন এলিজাবেথ যুক্তি দেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বন্দিদের দ্বারা যে সকল সাহিত্য রচিত হয়েছে বন্দি সাহিত্যের শ্রেণিভুক্ত হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য সেগুলিকে অবশ্যই লেখকের কারাগারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্পর্কীত হতে হবে। যদি এই ভাবনা দক্ষিণ আফ্রিকার বন্দি সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় তবে এটি আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া বা অন্য যে কোনও দেশের জেল সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। অথবা এটি জেল সাহিত্যের বিভিন্ন রূপের ক্ষেত্রেও হতে পারে। সাধারণ রাজনৈতিক বন্দি, অপরাধী, রাষ্ট্র-বহিষ্কৃত এবং অন্যান্য কয়েদি যাদের জন্য জেল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন ব্যতীত কিছুই নয়।
ঔপনিবেশিক আমলে সাধারণ শিল্পীরা রাষ্ট্রের জন্য অতিরিক্ত চুক্তিভিত্তিক শ্রম প্রদানের কাজ করত কারণ এই ধরনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানবদেহই একমাত্র সম্পত্তি যাকে শাসকশ্রেণি বাজেয়াপ্ত-যোগ্য বলে মনে করত। উত্তর-ঔপনিবেশিক (Post Colonial) সমালোচকরা এটিকে অর্থনীতি ও রাজনীতির জোট হিসেবে দেখেন যা সাম্রাজ্যকামী রাজনৈতিক অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে। যাইহোক, মুক্তবাজার অর্থনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী সময়ে শ্রমিকদের জোরপূর্বক আটক রাখা বা বলা ভালো ক্রীতদাস করে রাখবার প্রথা হ্রাস পায়।
তাই জবরদস্তিমূলক আটক আজ সংশোধনমূলক বা সংস্কারমূলক বন্দিদশায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রেও সর্বদাই বন্দিদের শরীর, মন- যা বশ্যতা এবং নমনীয়তার জন্য সংশোধনমূলক ব্যবস্থার অধীন- তাকে নানান অত্যাচারে প্রতিনিয়ত জর্জরিত করা হয়েছে। এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে আপাত পার্থক্য থাকলেও ব্যক্তির প্রতি সামাজিক বহিষ্কার, জেলে তাঁঁদের বন্দিত্ব এবং নির্জনতার অভিজ্ঞতা একইরকম। রাজনৈতিক মতান্তর থেকে শুরু করে ভিন্নমত দমনের জন্য আধুনিক সময়েও জেল ব্যবহার করা হয়েছে এবং করা হয়েছে যথেষ্ট সাংগঠনিক কৌশলে।
তবে অতীত সময় থেকেই দর্শনালোকিত ব্যক্তিরা সর্বদা চেষ্টা করেছেন, শারীরিক বন্দিত্ব যেন কোনোভাবেই মানসিক পরাধীনতা বা মানসিক দাসত্বের দিকে পরিচালিত না হয়। রিচার্ড লাভলেস যেমন লিখেছেন, “পাথরের দেওয়াল কারাগার তৈরি করে না, লোহার গরাদ খাঁচা তৈরি করে না; মননে নিজেকে নির্দোষ এবং শান্তভাবে গ্রহণ করতে না পারলে আপনা থেকেই ভিতরে ভিতরে কারাগার তৈরি হয়ে যায়।”
লাভলেস ১৬৪২ সালে বন্দি অবস্থায় ‘To Althea from Prison’ এই স্মরণীয় কবিতাটি লিখেছিলেন তাতে রাজা প্রথম চার্লসের প্রতি তাঁঁর আবেগপূর্ণ সমর্থন সম্পর্কিত অভিযোগে তাঁঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যাইহোক, পরবর্তীতে লাভলেস এবং চার্লসকে মুক্তি দেওয়া হয়।
কারাগার থেকে রচিত আখ্যানগুলির মূল উদ্দেশ্য হল এমন এক চেতনার বহিঃপ্রকাশ- যা দেহের মাধ্যমে মননে ছড়িয়ে পড়বে। যাবতীয় ঔপনিবেশিক দাসত্বকে, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সৃজনশীলতার আগুনে পুড়িয়ে রাষ্ট্রতান্ত্রিক একনায়কত্বের নকশাকে প্রতিহত
ও ধ্বংস করাই তার কর্তব্য। যদিও নানান লেখা বা উচ্চাঙ্গ সাহিত্য রচনা করলেও তাঁঁরা কারাগারের সেই নির্মম অভিজ্ঞতাগুলি নিজেদের কাছে রাখতে পারেননি অন্তত অতীত ইতিহাসে এমন উদাহরণ অগণন।
আসলে কারাগারের অমানবিক অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে একটিই উপায় ছিল, অবশিষ্ট সময়টাতে লেখা বা কথা বলবার মাধ্যমে হৃদয়ের ভারকে মুক্ত করা এবং আরেকটি উপায় ছিল সমস্ত মনোযোগ অন্য কিছুতে সরিয়ে দেওয়া। এই প্রাচীন প্রক্রিয়াটি প্রতিটি যুগে প্রতিটি দেশের সাহিত্য ধারায় অসাধারণ সব সাহিত্যকীর্তি তৈরি করেছে। কে. সচ্চিদানন্দন লিখেছেন, “এই সময়ের প্রত্যেকটি কারাগারের লেখার ধারা একটি আকর্ষণীয় সংগ্রহ তৈরি করেছে।” আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, চিঠি, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি। জেমস জয়েস একবার লেখকদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ”আমাদের চেপে ধরে, আমরা জল পাই। কারাবাস যদি একজন মানুষকে একজন লেখক বা শিল্পীতে পরিণত করে, তবে একটি মানুষকে নিঃসঙ্গ উন্মাদেও রূপান্তরিত করতে পারে।”
তিনি আরও একটি ঘটনা বিবরণ (Case Study) তৈরি করেন যেখানে তিনি দেখান যে, আমরা যে ধরনের আধুনিকতার মাপকাঠি তৈরি করেছি জেলের লেখা সর্বৈব তার বিরুদ্ধাচরণ করে। যেহেতু কয়েদিরা সমাজের তথাকথিত বাস্তবতাকে বিচার ব্যবস্থার শিকার হওয়া ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকেন- ফলে যা আধুনিক সমাজ তাঁঁদের দেয়নি সেই বঞ্চনার ইঙ্গিত তাঁঁদের রচনাতে থেকেই যায়। তবে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিগুলি ভুলে যাওয়া উচিত নয়, যেখানে দোষীরা সবসময় যে ব্যবস্থার (System) শিকার হয় তাও নয়। তাঁঁরা আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি তাঁঁদের ভিন্নমত পোষণের জন্য রাষ্ট্র বা সাধারণ প্রতিপক্ষের শিকার হতে পারে। যে কোনও ক্ষেত্রেই একটি কারাগার চারপাশের বিশ্বকে দেখার জন্য একটি সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে যেমনটি নেহরু তাঁঁর “কারাগারে প্রাণী” প্রবন্ধে স্পষ্ট রূপে পারিপার্শ্বিকতার আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেছেন। একজন বন্দি কারাগারের জগতে তাঁঁর সৃজনশীল প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে একজন বহিরাগতের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে থাকে। সেই দেখার মধ্যে তিনি নিজেকে ভিড় ও আবর্জনাময় এই জায়গার সঙ্গে এক শ্বাসরুদ্ধকর শারীরিক অবস্থানে যেমন অনুভব করেন তেমনই বন্দিদের মধ্যে স্তর-বিন্যাস, শোষণ এবং ঝগড়ার সঙ্গে সবসময় তাল মেলাতেও ব্যর্থ হন। ফলে মাঝে মাঝেই অন্যান্য প্রতিবাদীদের সঙ্গে নিজেকে দ্বন্দ্বরত অবস্থায় খুঁজে পান।
লক্ষ করলে দেখা যাবে জেলের মধ্যে নাবালক অপরাধীরা অদূরদর্শী দৃষ্টির (ফুকো যাকে বলেছেন, Myopic) বিকাশ করে, প্রাপ্তবয়স্করা তুচ্ছ- জীবিত এবং নির্জীব জিনিসগুলির সঙ্গে এক নৈসর্গিক সখ্যতা গড়ে তোলেন। একই সময়ে তাঁঁরা বহির্বিশ্বকে একজন বন্দির দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারেন। যেমন টম উইকার নামক একজন আমেরিকান লেখক বলেছেন, “জেল আদতে জীবনের ভিতরের ঘৃণ্য, পাশবিক বিবরণগুলিকে প্রকাশ করে। এক-একটি জীবন কীভাবে কর্তৃপক্ষের ইশারায় নিয়ন্ত্রিত হয় এবং যাদের তারা ভিতরে রাখে তাদের কীভাবে প্রভাবিত করে তা অনুধাবন করা যায়।” (Jail: The Captive picture of Human, Tom Wicker)
টম উইকার বন্দি সাহিত্যকে মানবতার এক চিত্তাকর্ষক ঝলক হিসাবে বর্ণনা করেছেন; যে কোনও পরিস্থিতিতেই ভাষার অপ্রতিরোধ্য শক্তি দিয়ে এটি একনায়কতন্ত্রের ধ্বংসের প্রচেষ্টা চালাতে বদ্ধপরিকর।
অবশ্য একথা সত্য যে, জেল সাহিত্যের ইতিহাস প্রাচীন বাইবেল থেকে শুরু হয়েছে।
“I was a stranger and you took me in. I was Naked and you clothed me. I was sick and you visited me. It was prison, and you came unto me.” (Bible: Matthew: 25-35-36)
কারাগার সাহিত্যের ঐতিহ্যকে তার বিভিন্নতার সঙ্গে যুগে যুগে স্থাপন করা এবং এই সাহিত্যের তাত্ত্বিক কাঠামোর বিকাশে সাহায্য করা একান্ত জরুরি।
ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক আলোচনায় ইতিপূর্বে এই বিষয় বারংবার উঠে এসেছে। বস্তুত বন্দি সাহিত্য পরবর্তী সময়ে জেলের কালজয়ী রচনাসমূহকে সামাজিক ঐতিহ্যের কোথাও একস্থানে স্থাপন করতে সাহায্য করবে। তাদের বাহ্যিক চেহারার সঙ্গেই অভ্যন্তরীণ অস্তিত্বে চিত্রিত থাকবে- প্রতিরোধ, সাহস, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশোধন এবং লড়াইয়ের নির্ভীক মানসিকতা।
আফ্রিকা ও ইউরোপের বন্দি সাহিত্য
বন্দি সাহিত্যে জেলের ভয়াবহ অবস্থার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বক্তব্য পাওয়া যায়- উপন্যাস, নাটক, কবিতা এবং প্রবন্ধে। আফ্রিকান লেখকদের লেখায় সেই আর্তি সর্বাধিক। সে কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া বা এই মহাদেশের যে কোনো স্থানই হোক না কেন। এটি এতই বিস্তৃত যে আফ্রিকান সাহিত্যের কোনও অধ্যয়নই বন্দি সাহিত্যকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ হতে পারে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই রচনাসমূহ তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ পাশাপাশি ঔপনিবেশিক জবরদখল থেকে আরম্ভ করে এই মহাদেশের যাবতীয় ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে তাদের বন্দি সাহিত্যের অসংখ্য মণিমুক্তো।
একই সঙ্গে এই ‘জেল সাহিত্য’ আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকেও নানাভাবে চিত্রিত করে যার মধ্যে কিছু মুক্তিযোদ্ধার জেলবন্দি হওয়া থেকে শাসক দ্বারা ভিন্নমতকে দমন করার জন্য একই পদ্ধতি ব্যবহার করার এক দীর্ঘ অশান্ত সময়কাল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই কালপর্বে রাষ্ট্র দ্বারা প্রচারিত সরকারি আখ্যানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য কারাগারে অজস্র কবি-শিল্পীদের নিক্ষেপ করা হয় বা আরও সঠিকভাবে বললে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এক সহিংস শিকারি প্রবৃত্তিতে তৎকালীন আফ্রিকার লেখক-শিল্পীদের বন্দি ও হত্যার মাধ্যমে দমিয়ে রাখার সবরকম প্রচেষ্টা হয়েছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী কেনিয়ার প্রথম রাজনৈতিক বন্দি এবং লেখক অধ্যাপক আবদিলাতিফ আবদুল্লাহ তাঁঁর ডায়েরিতে যা বর্ণনা করেছেন তা জেলের ভিতর আফ্রিকান লেখকদের সাধারণ অভিজ্ঞতার একটি নমুনা,
“আমার সেলে হঠাৎ একদিন, পুলিশের উন্মত্ত এবং অস্বাভাবিক সব অনুসন্ধান শুরু হয়। আমি জানতাম না তারা ঠিক কী খুঁজছিল। বহু সন্ধানের পর তারা টয়লেট পেপারের পাতা খুঁজে পেয়েছিল যাতে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। তারা আমার ‘কামলিওয়াজে’ (যাও এবং তাকে সান্ত্বনা দাও) কবিতার চোদ্দোটি পঙক্তি বাজেয়াপ্ত করে। দুঃখের বিষয় যে আমি এই কবিতাটি হারিয়েছি, বিশেষ করে আমি এর প্রথম চারটি স্তবকই মুখস্থ করেছিলাম। বাকিগুলো এখন হারিয়ে গেছে। ভাগ্যক্রমে তারা বাকি তিনটি কবিতা (নিশিয়েলো নি লীলো, তুজা মঁয়ো এবং জিপু) খুঁজে পায়নি, সেগুলি আমি প্লাস্টিকের কাগজে মুড়িয়ে ফেলেছিলাম। “নিরাপদ হেফাজতে” এবং আরও দুটি কবিতা (সিওয়াতি এবং মাম্বা), যেগুলি আমার সেলের জানালার বাইরে একটি কম্বলের সুতোয় ঝোলানো ছিল। যদিও আমার সন্দেহ রয়েছে যে তারা কবিতাগুলির মর্মার্থ বের করতে আদৌ সক্ষম হবে কিনা। এমনকী যদি তারা চায়, আমার কাছে তাদের প্রত্যেকের জন্য অন্তত একহাজার একটি বিকল্প ব্যাখ্যা প্রস্তুত রয়েছে।” (Flashback: May 22, 1970 Prison Literature in East Africa)
আফ্রিকান লেখকরা তাঁঁদের সবচেয়ে তিক্ত এবং বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বন্দি সাহিত্যের ধারায়। তাতে লিখিত হয়েছে কীভাবে তাঁঁরা প্রতিনিয়ত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন ও ন্যায়বিচারের সম্মুখে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন, আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখেছেন। আজ আফ্রিকার প্রায় সর্বত্র মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং তা নিশ্চিত করার জন্য এই ধারার সাহিত্য নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তাঁঁদের বেশিরভাগ লেখাকে প্রত্যক্ষ স্বীকারোক্তিমূলক বলা যেতে পারে। থিম বা বাস্তবসম্মত এবং তিক্ত সত্যের প্রত্যক্ষ প্রকাশ তাঁঁদের কাছে শৈল্পিকতার (Stylistic) চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। নাইজেরিয়ান লেখক কেন সারো-উইওয়া, কারাগারে থাকাকালীন তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তিনি সেখানে সরাসরি লিখেছিলেন একজন সাদাসিধে বন্দি যুবা সৈনিকের কথা। ইরানি লেখক মাহমুদ দৌলতাবাদি পাঁচশো পৃষ্ঠার ‘মিসিং সোলুচ’ (Missing Slouch) লিখেছিলেন যখন তিনি কলম বা কাগজ ছাড়াই সম্পূর্ণভাবে বন্দি হয়েছিলেন, ফলে জেলের দেওয়াল ও মেঝেতে নিজের অভিজ্ঞতা লিখে রাখেন। মুক্তির ৭০ দিনের মধ্যে তিনি এটি কপি করে নিয়ে গিয়েছিলেন (কারাগার সাহিত্য, মাহমুদ দৌলতাবাদি)।
ঘানার প্রথম রাষ্ট্রপতি, প্রয়াত কোয়ামে এনক্রুমাহ তাঁর আত্মজীবনী লেখেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা ঘানার জেমস ফোর্ট কারাগারে বন্দি থাকাকালীন অবস্থায়। জে.এম কারিউকি প্রথম কেনিয়ান যিনি ১৯৬৩ সালে তাঁঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ‘অ্যাকাউন্ট মাউ মাউ ইন ডিটেনশন’ গ্রন্থে কারাবাসের ভয়াবহ দৃশ্যপটগুলি রচনা করেন। গাকারা ওয়া ওয়ানজাউ, একজন বহুল প্রশংসিত লেখক। তাঁর বই ‘দ্য ব্রিটিশ করিডোর অফ সাইলেন্স’-এ নিজ অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করেছেন। এই লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন এনগুগি ওয়া থিওং’ও, যাকে তাঁঁর কমিউনিটি থিয়েটার সম্পর্কিত কার্যক্রমের জন্য ১৯৭৭ সালে উগান্ডার জেলে আটক করে রাখা হয়েছিল। তিনি কারাগারের নির্মম জীবনযাপনে পদে পদে হোঁচট খেয়েছিলেন। তাঁর লেখা ‘প্রিজন ডায়েরি’- যাতে তিনি কারাগারের মানসিক অধীনতাকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন সর্বতোভাবে। পরবর্তীতে তিনি গিকুয়ুতে আশ্রয় পেয়েছিলেন যেখানে তিনি ‘কাইতানি মুথারাবাইন’ (ক্রুশের উপর শয়তান) -এর মতো কালজয়ী লেখা লেখেন। অন্যান্য কেনিয়ার লেখক যাঁঁরা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁঁদের মধ্যে রয়েছে মাইনা ওয়া কিনিয়াত্তি- তাঁঁর কবিতার বই ‘A Season of Blood: Poetry from Kenian Prison’ (১৯৯৫), ‘Day in- Day out relection Kenia- A Prison Notebook’ (১৯৯৬) এবং তৃতীয়টি বইটি যা- ‘মাদার আফ্রিকা’ নামে রচিত, প্রধানত কিনিয়াত্তির গ্রেফতারি, নির্যাতন এবং কারাবাসের নৃশংস ঘটনাগুলির বিবরণ দেয়।
ওয়ানইরি কিহোরো তাঁঁর গদ্যসংকলন ‘Never say Die’ -তে একই বর্ণনা দিয়েছেন। এছাড়া বিংশ শতাব্দর অন্তিম পর্বে পশ্চিম আফ্রিকার জন কিরিয়ামিতির ‘My life in a Crime’, কিগিয়া কিমানির ‘Jail is not a Holiday camp’ বা চার্লসের মতো অসংখ্য কয়েদিদের দ্বারা আত্ম-অনুসন্ধিৎসা মূলক সাহিত্য রচিত হয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার জেলে বিভিন্ন সময়ে গিথায়ের অঞ্চলের বেশকিছু বামপন্থী বন্দি ছিলেন। তাঁঁদের মধ্যে কারুগা ওয়ান্ডাইয়ের মেয়র ও বেঞ্জামিন গার্থ বুন্দেহ -এর ‘Bards of Committee’ উল্লেখযোগ্য, যেখানে তাঁঁরা
কারাগারকে বন্দিদের ভাগ্যে জীবনের এক করুণ বাঁকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নির্জনতার অসীম যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টিতে একটি সম্পূর্ণ নতুন অথচ ক্লান্ত পৃথিবীর বর্ণনা পাওয়া যায়। এমন এক জগতের কথা এখানে ফুটে উঠেছে যেখানে মানুষের অন্তরাত্মা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে, অধঃপতিত হয় অথবা দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে একসময় সত্যিকারের সাহসের জন্ম হয়। বুন্দেহ লিখছেন,
“যখন তুমি এই স্থানে প্রবেশ করবে, বাইরের বিশ্বের সবকিছু তোমায় ভুলে যেতে হবে। যেন এক সুবিশাল অন্ধকূপ তোমার ঘরে পরিণত হয়েছে। জীবনের ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যাবে, বাঁচার কোনও অবলম্বন থাকবে না তবুও তোমাকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। নিঃসঙ্গতা ও অত্যাচারের প্রাচীন অন্ধকারে প্রস্তর যুগের মানুষের মতো আমরা এই গুহাগুলিতে অশ্রু ও বিষাদের আগুন সৃষ্টি করি, সেই উত্তাপেই ভালো থাকতে চাই। এই বন্দিশালা এমন এক স্থান যেখানে বেঁচে থাকার মৌলিক প্রবৃত্তিগুলি জীবনের প্রাথমিক অধিকারের জন্য লড়াই করতে থাকে। প্রতিনিয়ত লড়ে আর পরাজিত হয়।”
তিনি এমন কিছু কঠিন প্রশ্ন তুলেছেন যা বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার কর্মীরা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের আবেদনে ক্রমাগত উত্থাপন করে চলেছে-
“I wonder, should any man be allowed to condemn the death penalty of another man? Should one type of murder be legal and another illegal? Should the law be allowed to take it away? Is there a connection between the death penalty for treason, murder or violent robbery and the number of crimes committed? Kenya’s hanging, guillotine, electric chairs and firing squads elsewhere are the only deterrents to these crimes? (Flashback: May 22, 1970 prison-literature-in-east- africa)
দক্ষিণ আফ্রিকার জেল সাহিত্যের বিকাশ হারমান চার্লস বোসম্যানের ‘কোল্ড স্টোন জগ’ (১৯৪৯) থেকে ১৯৮৩ সালে DM Zwelonke -এর ‘Robben Island’ পর্যন্ত ধরা যেতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী সরকার বেশ কয়েকজন লেখককে বন্দি করেছিল, কারাগারের ভিতর নিষ্ঠুরতম অত্যাচারে তাঁঁদের প্রাণ হারাতে হয়। ডেনিস ব্রুটাসের মতো লেখক যিনি প্রিয় পত্নী মার্থাকে হৃদয়বিদারক চিঠি লিখেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যিনি তাঁর জীবনের ২৭ বছর জেলে কাটিয়েছিলেন, তাঁর আত্মজীবনী ‘Conversation with MySelf’ এই সময়েই লেখেন। অ্যালেক্স লা-গুমা এবং আরও কয়েকজন কবি-শিল্পীকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক অ্যালেক্স লা-গুমা জেলের ভিতরে এবং বাইরে শাসকদের একইরকম নির্যাতন দেখেছেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত গৃহবন্দি অবস্থায় তিনি ‘দ্য স্টোন কান্ট্রি অ্যান্ড এ থ্রিফোল্ড কর্ড’ লিখেছেন। একইভাবে মালাউই থেকে জ্যাক মাপাঞ্জে, ঘানার কফি আউনোর, শেরিফ হাতাতা, মিশর থেকে নাওয়াল এল সাদাউই এবং আফ্রিকান সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কারের প্রাপক, প্রফেসর ওলে সোয়িংকা সকলেই কোনও না কোনও সময়ে বন্দি হয়েছেন। ওলে সোয়িংকা, একজন নাইজেরিয়ান কবি এবং নাট্যকার জেল জীবনের একটি করুণ বর্ণনা চিত্রিত করেছেন ‘The man died in Jail’ গ্রন্থে।
ঔপনিবেশিক এবং জাতিগত অভিজ্ঞতায় প্রায় সমগ্র আফ্রিকান সাহিত্যকে এক অর্থে বন্দি সাহিত্য বলা যেতে পারে, কারণ রাষ্ট্রীয় একনায়কত্বের যূপকাষ্ঠে সমগ্র দেশটিই প্রায় বৃহত্তর কারাগারে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই মহাদেশের প্রত্যেক স্বাধীনচেতা মানুষকে তাঁঁদের নিজের দেশেই মুক্তি ও মননশীলতার জন্য প্রাণান্তকর লড়াই লড়তে হয়েছে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় সাহিত্যে প্রারম্ভিক লেখনীর মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে, সেন্ট পল দ্য এপস্টেলের কথা যিনি জেরুজা়লেমে বন্দি থাকার সময় ৬২ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্মের প্রতি তাঁর আবেগপূর্ণ ধর্মোপদেশের জন্য, জেলে বসে চিঠি লিখেছিলেন- যা স্থানীয় ইহুদি কর্তৃপক্ষকে তাঁঁর বিরোধী করে তুলেছিল। এই সময়কালে সেন্ট পলকে নিকটবর্তী শহর সিজারিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে দুই বছরের জন্য বন্দি করে রাখা হয়। ঠিক এ সময় তিনি চারটি গ্রন্থ লেখেন।
বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে প্রদর্শিত বিখ্যাত পত্রগুলির মধ্যে ইফিসিয়ান, ফিলিপিয়ান, কলসিয়ান এবং ফিলেমন উল্লেখযোগ্য। জেলে রচিত বোয়েথিয়াসের ‘Consolation of Philosophy’ -কে এখনও পর্যন্ত বিশ্ব বন্দি সাহিত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদাহরণ রূপে দেখা হয়। ৫২০ খ্রিস্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক চার্চের পূর্বের প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করার জন্য তাঁঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল।
পঞ্চদশ শতকের স্যার টমাস ম্যালোরি (১৪০৫-১৪৭১) তাঁঁর ‘লে মর্তে ডি’আর্থার’ -গ্রন্থের জন্য সুপরিচিত। একজন আধা-পৌরাণিক রাজা আর্থার সম্পর্কে একটি গদ্যকেন্দ্রিক রোম্যান্স। কারাগারে একজন বন্দির সৃজনশীল লেখক হিসাবে উত্তরণের একটি আকর্ষণীয় ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। ম্যালোরি একজন যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত হন। তিনি Wars Of Roses -এর কয়েদি রূপে লন্ডনের মার্শালসি কারাগারে বসে ‘লে মর্তে ডি’আর্থার’ গ্রন্থটি লেখেন। তাঁঁকে কখনই বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়নি। পরিবর্তে, ১৪৬১ সালে চতুর্থ এডওয়ার্ড সিংহাসনারোহণের সময় তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। মার্কোপোলো ছিলেন ভেনিসের বণিক, চীন থেকে রাস্টিচেলো দা পিসা পর্যন্ত তাঁঁর ভ্রমণের নির্দেশ গ্রন্থাকারেন রচনা করেন যখন তিনি ভেনিসের প্রতিদ্বন্দ্বী জেনোভা প্রজাতন্ত্রের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ‘The Travels of Marcopolo’ -তে তাঁঁর কল্পিত পথরেখানুসারে রেশম পথ (Slik Route) বরাবর এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার বর্ণনা পাওয়া যায়।
মিগুয়েল ডি সার্ভান্তেসকে ৫৭৫-৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ‘গ্যালি স্লেভ’ হিসাবে বন্দি করে রাখা হয়েছিল কারণ তিনি জনৈক পুঁজিপতির ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। এই বন্দি অবস্থায় তিনি তাঁঁর উপন্যাস ‘ডন কুইক্সোট’ (১৬০৫) লেখার অনুপ্রেরণা পান। ঋণখেলাপির জন্য কারা-নির্বাসনে রচিত উপন্যাসটি এত বড় সাফল্য লাভ করে যে অনেক সমালোচক এটিকে প্রথম আধুনিক ইউরোপীয় উপন্যাসের পাশাপাশি সর্বকালের সেরা উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম মনে করেন এবং এটিই তাঁঁকে যাবতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হয় না।
স্যার ওয়াল্টার রেলেই ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের একজন বিখ্যাত দরবারী ছিলেন সেইসঙ্গে একজন বণিক, অভিযাত্রী, লেখক ও কবি হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি রাজকুমার জেমসের অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং সিংহাসন আরোহণের পরপরই রাজকুমার জেমস তাঁঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে জেলে পাঠান। স্যার ওয়াল্টার তাঁঁর ‘হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ভলিউম’ গ্রন্থটি সুদীর্ঘ ১৩ বছর ধরে লিখেছিলেন, এই সময় তিনি লন্ডনের টাওয়ারে বন্দি ছিলেন এবং পরে তাঁঁকে ১৬১৮ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পাশ্চাত্য দেশগুলির ইতিহাসে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে কারা-নির্বাসন থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ডের অলিখিত পরম্পরা রয়েছে। তা সে যীশুখ্রিস্ট থেকে শুরু করে জন বুনিয়ান, মার্টিন লুথার হোক কিংবা অন্য কেউ। সকলেই ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শিকার হয়েছিলেন। জন বুনিয়ান ছিলেন একজন পিউরিটান, চার্চের বিপক্ষে ভিন্নমত পোষণকারী- যে কারণে তাঁকে আটক করে জেলে তাঁঁর উপর নৃশংস নির্যাতন করা হয়।
১৬৬০ সালে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরে এক দশক ধরে বুনিয়ান বারংবার আটক হয়েছেন ও তাঁঁর বেশিরভাগ সময় জেলেই কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি ‘The Pilgrim’s Progress’ -এর প্রধান অংশের খসড়া তৈরি করেন ও তাকে গ্রন্থের রূপ দেন। এটি একটি রূপকধর্মী পরিকল্পিত আখ্যান- যা সাধারণ মানুষের উপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবিচার এবং ক্লেশকে চিত্রিত করেছে। বুনিয়ান বলেন,
“ধর্মের নামে একটি ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীতে তথাকথিত ধার্মিক জীবনযাপন করার চেষ্টা চলছে। যেখানে ন্যায় নেই, সেই পৃথিবীতে ঈশ্বর নেই। ধর্মের ভেরী সেখানে কেবল এক ঢক্কানিনাদ।”
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ‘দক্ষিণী খ্রিস্টান নেতৃত্ব সম্মেলন’ -এর সভাপতি ছিলেন। এটি ছিল একটি নাগরিক অধিকার সংস্থা- যা বার্মিংহামে জাতিগত বিচ্ছিন্নতা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় কাজ করছিল। ১২ এপ্রিল, ১৯৬৩ -তে, তাঁঁকে জনগণের বিক্ষোভকে সমর্থন ও রাজ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য গ্রেফতার করা হয় ও বার্মিংহাম কারাগারে রাখা হয়। আলাবামার আটজন শ্বেতাঙ্গ পাদ্রীর দ্বারা জারি করা একটি গণবিবৃতি পড়ে জনসমক্ষে তাঁঁর আইন অমান্য পদ্ধতির নিন্দা করা হয়েছিল। এর জবাবে তিনি “Letters from Birmingham Jail” লিখেছিলেন যা ছিল শাসকের বিরুদ্ধে নাগরিক অবাধ্যতার একটি উৎসাহী প্রতিরক্ষা কবচ। এই চিঠিগুলিতে বিবিধ যুক্তি সাজিয়ে তিনি লেখেন, “রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত অন্যায় আইন ভাঙার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে জনসাধারণের।”
ইউরোপীয় ইতিহাসের দুই সুপরিচিত স্বৈরশাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং অ্যাডলফ হিটলার জেলে বসেই তাঁঁদের আত্মজীবনী লিখেছিলেন। নেপোলিয়ন তাঁঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে সেন্ট হেলেনার একটি ছোট দ্বীপে নির্বাসিত হওয়ার সময় স্মৃতিকথা রচনা করেছিলেন।
১৯২৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার এবং দুইহাজার নাৎসি কর্মী মিউনিখের রাস্তায় একটি বিয়ার হলে অনুষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক বৈঠকের ব্যাঘাত ঘটান। এই ভ্রান্ত বিদ্রোহে তাঁঁর ভূমিকার জন্য হিটলারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং তাঁঁকে বাভারিয়ার ল্যান্ডসবার্গ কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি জেলের এই নির্জনতাকে ব্যবহার করেছিলেন “মেইন ক্যাম্ফ” নামক আত্মজীবনী লেখার জন্য। আইরিশ নাট্যকার তথা কবি অস্কার ওয়াইল্ড ১৮৯৫ সালে লর্ড আলফ্রেড ডগলাস নামক একজন ইংরেজ অভিজাত পুত্রের সঙ্গে সমকামী সম্পর্কের জন্য শাসনতন্ত্রের নজরে দোষী সাব্যস্ত হন এবং ‘রিডিং গাওলে’ নামক জেলে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। অস্কার ওয়াইল্ডের মৃত্যুর দশ বছর পর ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘The Profundis’ গ্রন্থটি ছিল লর্ড আলফ্রেডের কাছে তাঁর সঙ্গীর এক জায়মান আর্তনাদের চিঠি- যা তিনি কারাগারের অতল অন্ধকারে নিজের অস্তিত্বটুকু হারাতে হারাতে লিখেছিলেন।
“ট্র্যাকট্যাটাস লজিকো-ফিলোজফিকাস” বইটি অস্ট্রিয়ান দার্শনিক লুডভিগ উইটগেনস্টাইনের ভাষা, বিজ্ঞান এবং সমাজ বাস্তবতার মধ্যে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে রচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বন্দিদের যুদ্ধ শিবিরে বসে এটি লেখা হয়। ১৯৪৫ সালে আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন নামক একজন রেড আর্মি সৈনিককে এক বন্ধুর কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে তৎকালীন রাশিয়ার সর্বেসর্বা জোসেফ স্তালিনের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক মত প্রকাশের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। সলঝেনিৎসিনকে সাইবেরিয়ার একটি শিবিরে (গুলাগ) দীর্ঘ আট বছরের সশ্রম শাস্তি দেওয়া হয়। তিনি যে কাগজের টুকরো খুঁজে পেতেন তাতে তিনি জেল ক্যাম্পের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন। ১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর ঠিক পরে পরেই তিনি মুক্তি পান এবং নয় বছর পরে নিকিতা ক্রুশ্চেভের শাসনকালে এই নোটগুলি ‘ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একদিন’ নামে একটি উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে সলঝেনিৎসিন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রাশিয়ার আরেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও লেখক হলেন নিকোলাই বুখারিন (১৮৮৮-১৯৩৮)। তাঁঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে, উগ্রবাদী কার্যকলাপের (শাসকের মতে) জন্য তিনি স্তালিন কর্তৃক বন্দি হন এবং মার্চ ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে, বুখারিন চারটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। তাঁঁর জেল সংক্রান্ত কবিতাগুলি এই সমস্ত পাণ্ডুলিপির শেষ সংযোজন। এই সময়ের কবিতায়, বুখারিন রাশিয়ার সময়, রাজনীতি, মানুষ এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁঁর ধারণার পাশাপাশি আন্না লারিনার প্রতি তার গভীর ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। তাঁঁর যুবতী স্ত্রী, যাঁঁকে তার কারাবাসের কারণে বিচ্ছেদ ও অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল।
স্তালিন জমানায় অত্যাচারিত আর এক কবি হলেন ওসিপ ম্যান্ডেলস্তম। সেই সময় তিনি রাশিয়ার কাউন্টার রেভিলিউশনারি অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং অতি শীঘ্রই এই পরিচয়ের জন্যেই তাঁকে অপরাধীর তকমাতে দাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৩৩ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘স্তালিন এপিগ্রাম’ প্রকাশিত হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রের চোখে তিনি অপরাধী শিল্পী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৮ -এ ম্যান্ডেলস্তম কারাবন্দি হন। জেলখানার প্রবল শীতে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। স্ত্রীকে পোশাক চেয়ে যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন সেটি পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিকথা ‘Abandoned’ -এ অন্তর্ভুক্ত হয়। জেলে বসে ম্যান্ডেলস্তম লিখছেন,
“Only in Russia is poetry respected. It gets people killed. Is there anywhere else where poetry is so common a motive for murder.”
ম্যালোরির মতোই ফরাসি লেখক জাঁ জেনে ছিলেন একজন ক্ষুদ্র অপরাধী; যিনি চুরি, জাল কাগজপত্রের ব্যবহার, নানা অশ্লীল কাজ ও এরকমই আরও ছোটখাটো অপরাধের অভিযোগে ক্রমাগত জেলের ভিতরে-বাইরে জীবনযাপন করতেন।
বিশ্ববন্দিত লেখক ফিওদর দস্তইয়েভস্কিও রাশিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন, কারণ তিনি তাঁঁর লেখায় রাশিয়ার রাজনীতি এবং ধর্মের সমালোচনা করেছিলেন। তাঁঁকেও সাইবেরিয়ার কাতোর্গা বন্দি শিবিরে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে চার বছরের নির্বাসন ভোগ করতে হয়েছিল। রাশিয়ার বন্দি শিবির সম্পর্কে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘The House of Dead’ এবং ‘Notes from the Underground’ -এ দস্তইয়েভস্কি তাঁর কারাবাসের দুঃসহ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন। জাঁ জেনে কারাগারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তাঁঁর প্রথম উপন্যাস ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য ফ্লাওয়ারস’-এ। এই সময় তিনি চুরির অপরাধে শাস্তি ভোগ করছিলেন।
ভারতের বন্দি সাহিত্য
ভারতের বন্দি সাহিত্যে প্রধানত কল্পকাহিনী, গদ্যচিঠি, ডায়েরি, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা এবং কবিতা সমন্বিত একটি বিশাল সংখ্যক লেখনীর সম্ভার রয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা এবং তৎপরবর্তী সময়ের বিস্তৃত ইতিহাস এই সমস্ত সাহিত্যে ধরা আছে। যদিও এখানে ভারতীয় লেখকদের কথা প্রাধান্য পেয়েছে তবে বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার) থেকে অং সান সুচির চিঠি, ‘Freedom From Fear’ ও ‘The Voice of Hope’ -এর উল্লেখ এই প্রসঙ্গে অযাচিত হবে না। কারণ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তমনা লেখাগুলিই গণতন্ত্র তথা স্বাধীনতার জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রামের প্রধান কণ্ঠস্বর। গান্ধি, নেহেরু এবং তিলক ছাড়াও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, শহীদ ভগৎ সিং কারাকক্ষে লেখাপড়ার স্বাধীনতার জন্য জেল-বিরোধি আন্দোলন (Movement Against Jail Discrimination) করেন। বন্দি অবস্থায় তিনি প্রচুর পড়তেন ও লিখতেন। এগুলি পরবর্তীতে ‘জাতীয় স্বাধীনতার’ -এর অংশ হয়ে ওঠে, সেগুলি ফুলস্ক্যাপ কাগজে লেখা হয়েছিল। পরে ‘The Jail Notebook’ নামে প্রায় চারশো পৃষ্ঠার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই নোটবুকটি ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সালে লাহোর জেলকর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয়, এই সময় সেখানে ‘HSRA’ (Hindustan Socialist Republic Association) সদস্যরা বিশেষ অনশনে রত ছিলেন।
১৯২০ সালে ‘জেল জীবন’ শিরোনামে আর একটি উল্লেখযোগ্য জেল ডায়েরি প্রকাশিত হয়, এটি ছিল মহাত্মা গান্ধির ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাজাজির। তিনি ভেলোর জেলে দেওয়ালের পিছনে বার্তা লিখতেন। এগুলি মূলত বর্ণবাদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন বিষয়ে তাঁঁর সুচিন্তিত প্রবন্ধ। ১৯২০ সালে প্রকাশিত রাজাজির ‘জেল জীবন’ ভেলোর জেলের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবিকতার উপর লেখা। গান্ধিজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তাঁঁকে গ্রেফতার করা হয়।
ভারতে আন্দামান ও নিকোবরের সেলুলার জেল ব্রিটিশদের বর্বরতা এবং কয়েদিদের দাসত্বের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কালাপানির মতো এতখানি নিদারুণ সাজা ছিল দেশপ্রেমিকদের জন্য যা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। তাঁরা ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা সন্ত্রাসবাদী হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।
এমনই একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আলিপুর বিস্ফোরণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁঁকে সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। প্রায় ১২ বছর সেই কারাগারে তিনি নরকযন্ত্রণা সহ্য করেন। মুক্তির পর নিজ স্মৃতিকথাকে ‘কারা-প্রবাসের আত্মজীবনী’ নাম দেন।
জরুরি অবস্থার সময় তৎকালীন ভারত সরকার দ্বারা বেশির ভাগ বিরোধী নেতাকে বিভিন্ন কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল এবং তাঁঁদের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাইয়ের মতো ব্যক্তিত্বরা ডায়েরি ও অন্যান্য গদ্য রচনা করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ ২১ জুলাই থেকে ৪ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত চণ্ডীগড় জেলে বন্দি থাকার সময় লেখেন ‘Prison Diary’। তিনি এই লেখায় জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে প্রতিদিন একটি করে চিন্তাভাবনা লেখার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেগুলিকে একত্রিত করে গণ-আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করেন। মজার ব্যাপার হল ৯ ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ -এ তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘আমার জীবন’ (My Life)
”জীবন ব্যর্থতায় পূর্ণ,
যখনই সাফল্য কাছে এসেছিল
আমি তাদের আমার পথ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি!
সেকি তবে মূর্খতা ছিল?
শোনো চরাচর,
আমার সফলতা এবং ব্যর্থতার সংজ্ঞা আজও আলাদা।”
অন্যত্র তিনি লিখছেন, “ইতিহাসকে জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে, বছর খানেক আগেও আমি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। কিন্তু আমি নিজের কাছে শেষপর্যন্ত একজন বিপ্লবী, আরও কিছু পথ যেখানে গ্রহণযোগ্যতার দাবি রাখে, ত্যাগের পথ যেখানে দৃশ্যমান, সংগ্রামের নির্মাণ যেখানে অবশ্যম্ভাবী, সার্বিক বিপ্লবের জন্য সেখানে ব্যক্তি সাফল্যের কথা ভেবে পশ্চাদপসরণ কোনও পথ হতে পারে না।” (Prison Diary)
জরুরি অবস্থা পরবর্তী সময়েও সরকার কর্তৃক গ্রেফতার, আটক এবং দোষী সাব্যস্ত করার অনুশীলন অব্যাহত থেকেছে। রাষ্ট্রদ্রোহ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অযৌক্তিক অভিযোগ গঠন করা বা সাধারণ আইনের অধীনে সন্ত্রাসী যোগসূত্রের সন্দেহে বা POTA (Prevention Of Terrorism Act, 2002) -এর মতো কঠোর আইন তখনও অব্যাহত ছিল, আজও রয়েছে।
এই সময়কালে বন্দি সাহিত্যের একটি বড় অংশ তৈরি হয়েছে- যা বর্তমানেও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচারে একচেটিয়া অধ্যয়নের দাবি রাখে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, কে. ভি রমনা রেড্ডির ‘ডিটেনু ডায়েরি’, ভারভারা রাওয়ের ‘সাহাচারুলু’, ‘Captive Imagination: Letters from Prison’ (২০১০) ‘খাঁচার রং’ (কবিতার বই) -এর মতো প্রভৃতি গ্রন্থের কথা।
মেরি টাইলারের ‘My Years in Prison’ (১৯৭৭), ইফতিখার গিলানি ‘My Days in Prison’ (২০০৫), অঞ্জুম জমারুদ হাবিবের ‘Prisoner No.100: The Story of My Ordeal in Indian Prison’ (২০১১), চেতন মহাজনের ‘The Bad Boys of Bokaro’ (২০১৪) ভারতীয় বন্দি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
ভারতীয় জেলের গঠনপদ্ধতি বোঝার জন্য চেতন মহাজনের লেখনী অত্যন্ত সহায়ক। তিনি লিখেছেন, “দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে; যদি আপনার কাছে টাকা থাকে তবে আপনি যা কিছু পান না কেন, কারারক্ষী ও পুলিশ সেই ভাগাভাগি খেলার অংশ। জেলের কর্মকর্তারা অর্থ উপার্জনের জন্য তাদের উপর অর্পিত ক্ষমতার যারপরনাই অপব্যবহার করে। যাঁঁরা অর্থ দিতে পারে না তাঁঁরা ভোগান্তির শিকার হয়। কিছু বন্দি এতটাই দরিদ্র যে তাঁঁরা তাঁঁদের জামিনের টাকাও দিতে পারে না- তাই তাদের অকারণে জেলে পচতে হয়।”
তিনি আরও লিখেছেন, “জেলের ডাক্তার একজন প্রতারক। তিনি কখনও রোগীকে স্পর্শ করেন না। কখনও তাঁঁর স্টেথোস্কোপ তোলেন না বা কারও চোখ, কান বা গলার দিকে তাকানও না, পরীক্ষাও করেন না। তিনি ত্রিশ মিনিটে প্রায় ত্রিশটি রোগী দেখেন।” চেতন মহাজন তাঁর লেখায় এও বলেছেন, “আমার জন্য উপলব্ধি হল যে, আমরা সকলেই কোনো না কোনো স্তরে একটি কারাগারে বাস করি। এটি আসলে আমাদের নিজেদেরই চারপাশে থাকা সীমাবদ্ধতার শীর্ণ কারাগার। আমরা যদি পারি তবে আমাদের সকলের সেই বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজন কেবল ভিন্ন ভাবনা ও চেতনার।” (Six Prison-books from India, Edit by Arun Ferera)
আজ চেতন মহাজন একজন মুক্ত মানুষ। তিনি এইচসিএল [HCL] সিইও। ২০১৩ -এর মার্চ মাসে তাঁঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়াগুলি বাতিল করা হয় কিন্তু তিনি যে যন্ত্রণার আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন তা সবসময়ের জন্য তাঁঁর স্মৃতিকথাতে বর্তমান।
প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী পল গ্রেডি বলেন, “বন্দি সাহিত্যে ‘ত্যাগ’ শব্দটি এমন একটি অস্ত্র যা আমাদের ব্যথা দেয় ও আত্মশক্তিকে সুরক্ষিত করে। বন্দিদের নিরলসভাবে লেখার ক্ষমতা, সরকারি ক্ষমতার সম্মুখে বারংবার প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বন্দির আত্ম ও বিশ্বের অনুভূতি তীব্রতা পায়, ব্যথা দৃশ্যমান হয়। লিখিতভাবে আপত্তিকর এবং রাষ্ট্রীক্ষমতার বিরোধী সাহিত্যগুলি শাসক কর্তৃক সম্পাদিত করে পুনরায় লেখা হলে তা শাসকের মোসাহেবিপনায় রূপান্তরিত হয়। বন্দিরা নিজের ও বিশ্বের অনুভূতি পুনরুদ্ধার করতে, বর্ণবাদী মিথ্যাচারের প্রকৃত রূপটি প্রতিষ্ঠা করতে, সরকারি পাঠ্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর লিখে যান। (কারাবাস, পল গ্রেডি)।
সাহিত্যের এই নতুন শ্রেণিতে আধিপত্যবাদ, পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিকতা এবং উত্তর-ঔপনিবেশিকতার তত্ত্বের সঙ্গে এর সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন কারণে বিশ্বজুড়ে শোষিত সাহিত্যিকরা একই চিন্তনে এই ধারাকে পরিচালিত করে এসেছেন। নানান যন্ত্রণা ও অত্যাচারে শব্দগুলি হয়ে ওঠে আত্মরেচক (Self Cathartic) যা একজন বন্দির আত্মদহনকে (Self Assertion) ধরে রাখার সবচেয়ে বড়ো মনস্তাত্ত্বিক হাতিয়ার। কখনও শব্দগুলি আফ্রিকান কারাগারের লেখকদের মতো তীব্র নৃশংসতার নিদর্শন বহন করে তো কখনও তা হয়ে ওঠে বন্দির উদাসীন আত্মকথন। জেল সাহিত্যের মূল লক্ষ্য হল, কারাগারের কয়েদিদের যে নৈতিক, মানবিক, বুদ্ধিবৃত্তিক তথা সাহিত্যিক গুণাবলি থেকে বঞ্চিত করে নিম্নমানের মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তাঁঁদের সম্পর্কে সেই তথাকথিত ধারণাকে বিপর্যস্ত করা।
বস্তুত উভয়ের জন্যে শব্দই শক্তি (শব্দই ব্রহ্ম)- যারা বন্দিদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এক শ্রেণির অপরাধ হিসাবে শর্তযুক্ত করেছে এবং বন্দিদের হয়ে যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের জবাব দেওয়ার জন্য একই হাতিয়ার গ্রহণ করেছিল। এর ফলে পৃথিবীর যেখানে যেখানে সামাজিক অবরুদ্ধতা দেখা দিয়েছে সেখানেই তাঁরা নতুন নতুন অন্তর্দৃষ্টির স্বাক্ষর রেখেছেন। এই ধারার সাহিত্য সমাজের, মানুষের অন্ধকার জীবন ও তাঁঁদের মনস্তাত্ত্বিক তথা সমাজতাত্ত্বিক অবস্থানসমূহকে মানবিকভাবে বুঝতে সাহায্য করে। আসলে সময়ে সময়ে সাহিত্যের এই ধারাটি প্রমাণ করেছে যে, দেশদ্রোহিতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহের আইনগুলি সমাজে ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরকে দমন করতে তথা ক্ষমতাতান্ত্রিক আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, বা বলা ভালো যে অপব্যবহৃত হয়েছে। ফলস্বরূপ দেশে-দেশে সংশোধনাগারগুলি তার মৌলিক ধারণাগত উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থ তো হয়েইছে এবং বর্তমানেও তা কেবলমাত্র ক্ষমতার পৈশাচিক ক্রীড়াক্ষেত্র হিসেবেই প্রতিভাত হয়ে রয়েছে।
******
তথ্যসূত্র:
১. Michel Foucault, Discipline and Punish, Penguin, 1979
২. Tom Wicker, Jail: The Captive picture of Human, Chicago, 1983
৩. Edward Memling, The outway of Prison Literature, Germany, 1994
৪. Natalia colingwood, Prison Mind: A discussion of Human Solitary, London, 2003
৫. T.K Shantakumaran, Indian Prison literature: A Dark light of Nominal Society, Kerala, 1999 ।