শঙ্খবাবু, সুনীলদা ও স্বপনদা – অংশুমান কর
স্বপন চক্রবর্তী ছিলেন সেই বিরল প্রজাতির ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক যিনি সম-উৎসাহে পাঠ করতেন বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য। অবশ্য এখন এই ধারাটিকে বিরল বলতে হচ্ছে বটে, কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত এই ধারাটি বিরল ছিল না; বরং ইংরেজির মাস্টারমশাইদের এটা ছিল অতি স্বাভাবিক এক প্রবণতা। বেশি দূরে যেতে হবে না। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বা শিশিরকুমার দাশই উদাহরণ হিসেবে যথেষ্ট। কেবল স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে লিখিত বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও স্বপনদা খুব উঁচু ধারণা পোষণ করতেন। শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ তো ছিলই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও মনে করতেন এক মহান সাহিত্যিক ও কবি। স্বপনদা কীভাবে দেখতেন এই দু’জনকে তা আমার কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছিল।
“মিউজ ইন্ডিয়া” অনলাইন জার্নালটি থেকে শঙ্খবাবু জ্ঞানপীঠ পাওয়ার পরে আমার কাছে একটি প্রস্তাব আসে যে, ইংরেজি ভাষার এই পত্রিকাটি তাঁদের একটি সংখ্যায় শঙ্খ ঘোষের ওপরে একটি বিশেষ অংশ রাখতে চান। সেই অংশটির সম্পাদনার দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে। আমি নিজে এই কাজটির জন্য যোগ্য কি না তা নিয়ে আমার সংশয় ছিল। তবে সেই সংশয়কে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে দ্বিধাও ছিল। তাই এই সংশয়ের কথা গোপন রেখেই রাজি হই “মিউজ ইন্ডিয়ার”-র প্রস্তাবে। লেখক তালিকা নির্মাণ করি। অবধারিত ভাবে সেই তালিকায় থাকেন স্বপনদা। ফোন করি ওঁকে, লেখার অনুরোধ জানিয়ে। সব শুনে বললেন যে, উনি অবশ্যই লিখবেন যদি শঙ্খবাবু ওঁর লেখার বিষয়ে অনুমতি দেন। আমি তো অবাক! বললাম যে, লিখবেন তো আপনি, স্যার নন, তাহলে অনুমতির কী প্রয়োজন? উনি নাছোড়। বললেন, নাহ তুমি ওঁকে জিজ্ঞেস করো যে, আমি লিখলে ওঁর আপত্তি আছে কি না। আমি তো পড়লাম মহা বিপদে। সংখ্যাটি নিয়ে তখনও পর্যন্ত আমার বন্ধু সন্দীপনের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছে, কিন্তু স্যারের সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি। কিন্তু স্বপনদার অনড় অবস্থান দেখে আমি শেষমেশ ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম স্যারকে। সব শুনে উনি যেমন বলতেন, তেমনই বললেন। বললেন যে, এইরকম একটি সংখ্যা যে করা হচ্ছে সেই বিষয়ে ওঁর কিছুই বলার নেই, তবে স্বপন চক্রবর্তী এই সংখ্যায় লিখবেন জেনে উনি খুশি। ফোন করলাম স্বপনদাকে। শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হলেন। বললনে যে, এইবার লেখা পাবে, শঙ্খদা আমার যোগ্যতাকে সন্দেহ করেন না, তাই লেখা দেব। আসলে কী জানো, ওঁর ওপরে লেখা কি চাট্টিখানি কথা? আমি কি সত্যিই তেমন যোগ্য? তাই আগেভাগেই জানিয়ে রাখলাম। ভুলত্রুটি হলে এরপরে আর চিন্তা থাকবে না। শুনে আমি তো হতভম্ব। স্বপন চক্রবর্তী তাঁর লেখায় ভুল থাকবে কি না তা নিয়ে ভাবছেন আর আমি এক নাবালক এইরকম একটি কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি শঙ্খ ঘোষকে না-জানিয়েই। বুঝলাম যে, আমাদের ঔদ্ধত্য কী শিশুসুলভ প্রকৃত জ্ঞানীদের বিনয় ও আত্মজিজ্ঞাসার সামনে।
স্বপনদা তখন ন্যাশনাল লাইব্রেরির ডিরেক্টর। ভীষণ চাপের কাজ। সদা ব্যস্ত থাকেন। পুজোর মধ্যে প্রয়াত হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমি ছিলাম গ্রামের বাড়িতে। পুজোর ছুটিতে। ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছোলাম কলকাতা। তখন আমি সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলের সচিবের দায়িত্বে। অফিসে পৌঁছোনোর পরে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হওয়ার পরে ঠিক হল যে, পরের দিন সুনীলদার মরদেহ শায়িত থাকবে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে, সেখান থেকে আসবে সাহিত্য অকাদেমির অফিসে, আমাদের অফিস থেকে সুনীলদার মরদেহ চলে যাবে শ্মশানে। সন্ধেবেলা এল স্বপনদার ফোন। জিজ্ঞেস করলেন যে, আমাদের অফিসে ঠিক কখন পৌঁছোবে সুনীলদার মরদেহ? জানালাম। উনি বললেন যে, উনি আমাদের অফিসেই আসবেন সুনীলদাকে শ্রদ্ধা জানাতে, ভিড় এড়াতে। আমি বললাম, চলে আসুন। পরেরদিন ঠিক দশটায় স্বপনদা হাজির। অফিসে তখন মান্যবর ব্যক্তি কেউ নেই। শুরু করলেন কথা। সুনীলদার ওপরে। সহজ করে বলে যেতে লাগলেন কেন সুনীলদা কবি এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারী ভারী কথা। কিন্তু বলছেন নেহাত হালকা চালে। ওঁর লেখার ভাষা আর মুখের ভাষা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। লেখার ভাষা রসময়, সংবেদনশীল পণ্ডিতের; কিন্তু মুখের ভাষা যেন পাড়ার বড়োদাদার, যিনি কাঁধে হাত দিয়ে বুঝিয়ে দেন জীবনের জটিল রহস্য।
প্রথম ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল স্বপনদাকে। এই আমন্ত্রণ পেয়েও খুব খুশি হয়েছিলেন। লিখেছিলেন:
সেদিনের সেই বক্তৃতা যাঁরা শুনেছিলেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, কী অসাধারণ একটি বক্তৃতা করেছিলেন স্বপনদা!
বক্তৃতার পরে কী হয়েছিল সেটিও একটু বলতে ইচ্ছে করছে। সেই বক্তৃতায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। রাতে আমি স্বপনদাকে ফোন করে ধন্যবাদ দেওয়ার আগেই এল স্বপনদার ফোন। বললেন, শঙ্খদা কিছু বলেছেন বক্তৃতা শুনে? আমি জানালাম যে, তখনও জিজ্ঞেস করতে পারিনি। বললেন যে, যেন জিজ্ঞেস করে জানাই বক্তৃতাটি নিয়ে শঙ্খবাবুর মত। পরেরদিন সকালে স্যারকে ফোন করলাম। উনি জানালেন যে, স্বপনদার বক্তৃতা ওঁকে খুবই মুগ্ধ করেছে। ফোনে ধরলাম স্বপনদাকে। জানালাম কী বলেছেন স্যার। বললেন, যাক, বাঁচা গেল, দুটো ভুল করেছিলাম, ধরতে পারেননি!
ভুলে গেলে চলবে না যে, শঙ্খ ঘোষ কিন্তু সেই অর্থে স্বপন চক্রবর্তীর মাস্টারমশাই ছিলেন না। ছিলেন সহকর্মী। একজন সহকর্মীর প্রতি আর একজন সহকর্মীর এই গভীর শ্রদ্ধাবোধ — পশ্চিমবঙ্গে, আজ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কতটুকু অবশিষ্ট আছে? ভাবছিলাম এই কথাও। স্বপনদার প্রয়াণের পরে।
অসামান্য লাগল। দেরিতে পড়লাম বলে লজ্জা হচ্ছে।