টিনবাজার – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
লোকটা একটা ভেড়ার মালিক।
ভেড়ার গায়ে পাকানো সাদা লোম। চোখের পাতাও সাদা।
ভেড়ার দড়ি ধরে লোকটা টিনবাজারের খোলা নর্দমার ধারে উবু হয়ে বসে পেচ্ছাপ করে। সে উঁচু করে চেক লুঙ্গি পড়ে। গায়ে মলিন ফতুয়া। গালের সাদা দাড়ি ধীরে ধীরে পাকিয়ে উঠছে। টিনবাজার দিয়ে যাতায়াত করলেই এমন একটি লোককে সকলেরই চোখে পড়বে।
কত বয়স হবে লোকটার?
পঞ্চাশ। বা তার বেশি।
ষাটও হতে পারে।
সেক্ষেত্রে আসবে ভেড়াটার বয়সের কথাও।
কত বয়স হবে ভেড়াটার? লোকটার মত সেও কি বুড়ো হয়ে গেল?
যেহেতু এখানে বদলি হয়ে আসার আগে আমি কোনদিন কোন ভেড়াকে বেড়ে উঠতে দেখিনি বা এটা জানা নেই একটি ভেড়ার গড় আয়ু কত হতে পারে, তাই ভেড়ার বয়স অনুমান করা আমার পক্ষে শক্ত।
তবে এইটুকু বলা যায়, ভেড়াটা বুড়ো হয়ে গেছে—পাশাপাশি অন্য বাড়িতে ভেড়ার দিনগুলির তুলনায়।
সুতরাং ভেড়ার বয়স জানার জন্য আমি টিনবাজারের চা দোকানে লোকটার গায়ে গা লাগিয়ে ভেড়ার পাশে বসে থেকেছি। দেখেছি লোকটার গায়ে ভেড়ার গন্ধ। আমি ভেড়ার গায়ে গা লাগিয়ে টিনবাজারের বকুলগাছটার নিচে লোকটার পাশে বসে থেকেছি। দেখেছি ভেড়ার গায়ে লোকটার গন্ধ।
কিন্তু এতে ভেড়ার বয়স জানা যায় নি।
আমরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলিনি। ভেড়াটাও আমার দিকে তাকায়নি। তাতে টিনবাজারের কোন অসুবিধে হয়নি।
টিনবাজার। ভোজপুরি ভাষায় কথা বলে, এমনি লোক বেশি। পেচ্ছাপখানার পাশে একটি হল আছে এখনও। সিঙ্গল স্ক্রিন। ভোজপুরি সিনেমা চলে। বাইরে উত্তেজক পোস্টার। সকলে খুব চিল্লে কথা বলে। সকলেই খুব ব্যস্ত। খিস্তি-মারদাঙ্গা খুব স্বাভাবিক।
বাজারের পিছনে বস্তি।
সবটাই নাকি সরকারি জমি ছিল এককালে। এখন সব দখল। এদের পরিবার এসেছিল জুটমিলে খাটতে। মিল বন্ধ। কেউ ফল বেচে, কেউ লেবার। কেউ ভেড়ার পাল পোষে। লোকটার ভেড়া একটাই।
ফলে কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না, ভেড়াটা এই বছরে কত বছরে পা দিল।
ভেড়াটাকে কখনও দেখিনি গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে।
লোকটাকেও দেখিনি কোর্ট চত্বরে বা থানার আশেপাশে।
মাঝে মাঝে ভেড়াটাকে একা থাকতে দেখি। এক বন্ধ দোকানের সামনে সেটা বাঁধা; তার সামনে কিছু শুকনো কাঁঠালপাতা। ও নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে টিনবাজারের প্রতি।
ঠিক হল, আমাদের অফিসে একদিন ভেড়ার মাংসের উৎসব হবে।
ভেড়ার মাংস চারশ টাকা কিলো।
সিনিয়র পার্থদা বলে, ভেড়া যত বুড়ো হবে, মাংস তত কচি হয়, জানিস?
অরূপ বললে, সাতজনের জন্য দুই কেজি—ঠিক আছে না?
বারোশো টাকা চাঁদা তুলে দুই কেজি ভেড়ার মাংস ও ঝরঝরে সাদা ভাত—এক দুপুরে আমরা খাব অফিসের ছাদে বসে। হিসেব হয়ে গেল।
পার্থদা বলে, জ্যোতি, মাংসভাত রেঁধে দিস। সেদিন তুইও আমাদের সাথে খাবি।
জ্যোতি কুমারী অফিস পরিস্কার করে। সে পরিস্কার বাংলায় বলে, ভালো করে কষে ঝাল ঝাল করে রেঁধে দেব, দেখে নিও।
জ্যোতি বিধবা। এখন ছেলে খুঁজছে ওর বাড়ির লোক। বিয়ে দেবে।
হাফ ছুটি করে ফিরছি।
ঝড়জল আসবে। এর ভয়ে আজ পার্থদা অফিসে আসেনি।
এখন ঝড়জল মানেই তার একটা নাম থাকে। যেমন- হুদহুদ, ফণী। ইত্যাদি। আর এই জল-ঝড় ধেয়ে আসে গভীর সমুদ্র থেকে।
জোর বৃষ্টি এসে গেল। এই বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটা যায় না। মাথায় ছাতা থাকলেও সেই ছাতা কেবল মাথাই বাঁচায়। ছাতা আবার বাতাসের ধাক্কায় উল্টেও যায়।
বাধ্য এক চালার নিচে দাঁড়াই। বৃষ্টি কখন থামবে কেউ জানে না। আবার এমন বাতাস ও বৃষ্টির পতন—যাওয়াও যায় না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, ভেড়ার মাংসের স্বাদ কেমন। লাল মাংস মানেই যে পাঁঠার মাংসের স্বাদ বয়ে আনবে, তার কোন মানে নেই।
প্রবল বৃষ্টিতে টিনবাজার ধুয়ে যাচ্ছে।
রক্ত ও চামড়ার একটা ভ্যাপসা গন্ধ মিশছে বৃষ্টিতে।
এলোমেলো বাতাস। টিনবাজারের প্রবাদঃ ঝড় উঠলেই তার ছিঁড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ।
কেবল ছেঁড়ে না টিনবাজারের বড় কোম্পানির ফ্লেক্সগুলি।
বৃষ্টি বাড়তে থাকায় কুকুরগুলোও চলে গেল সাউ মীট শপের পলিথিনের আড়ালে। কোত্থাও কেউ নেই।
এই সময় দুটি ভেড়া বৃষ্টি মাথায় হাঁটতে হাঁটতে টিনবাজার পেরিয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল।
One Comment