স্মৃতি ও ইচ্ছে – শ্রাবণী দাশগুপ্ত

শেয়ার করুন

‘কতগুলো স্মৃতি’, গৌর পুরানো ডায়েরির পৃষ্ঠায় পেন দিয়ে আঁচড় কাটলো। বাইরে ঝলমলে রোদে দেখলো, ফুল নেই গাছটার, পাতাগুলো নাচছে। গাছটা যদি গোড়া থেকে কাটা হয়, মরে যাবে। গল্পগুলো বলতে পারবে না। গৌর তাড়াতাড়ি আর দু’খানা শব্দ পেড়ে আনলো- ‘…কতগুলো গল্প’, লিখে আঙুল টনটন করে উঠলো। সে পেন ছেড়ে দিলো।

ট্রেনে দরজার পাশে টাইট জামা-পরা, ঠোঁটে রঙমাখা, প্যাঁকাটির মতো একটা মেয়ে বসেছিলো। স্টেশন আসার আগেটায় গৌর ও আরো দু’য়েকজন সেখানে জমা হয়েছে। তাদের ট্রেন আপের এক্সপ্রেসটাকে সাইড দিতে দশ-বারো মিনিট দাঁড়িয়েছিলো। চোখের পলকে মেয়েটা দরজা খুলে ঝাঁপ দিলো। বিদ্যুতের মতো আলোর ঝলকানি ছিটিয়ে অন্ধকারে মাঠঝোপ পেরিয়ে এক্সপেসের লেজটুকুও মিলিয়ে গেল।কবেকার কথা! জল, ছাইয়ের স্বপ্ন আর গল্প ছিলো হয়তো মেয়েটার!

‘…জমা করে একেক জন’, প্রায় যুদ্ধ করে ক’খানা শব্দ লিখতে পারলো গৌর। পিঠের নীচের বালিশ ঘুরিয়ে রাখতে হাত ঘোরালো। হলো না, ফসকে গেলো। কুমুদমামার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল। কবে সে পণ্ডিত মানুষটি আপনমনে কোথাও চলে গেছে, খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার গল্পগুলোর হদিশ পেলে হতো!

‘…মরে যায় কিম্বা হারিয়ে যায়।’ বাক্যটা মনের জোরে শেষ করে পিছনে এলিয়ে দিলো ঘাড়।

মণিকাবউদির থ্রোট্‌ ক্যান্সারে স্বরযন্ত্র বাদ দিতে হয়েছিল। মিষ্টি, ফুরফুরে, বকবকানি বউদি বোবা হয়ে গিয়েছিলো। একদিন আড়াল দেখে ষড়যন্ত্রের মতো গৌর বলেছিল, ‘সব সেরে যাবে। চিন্তা করছো কেন? এখন লিখে লিখে কথা বলি, চলো।’ চোখের জল দিয়ে কথা বলেছিল বউদি। সেই প্রথম গৌর জেনেছিল, বউদি নিরক্ষর, লিখতে শেখেনি।

ইচ্ছে, গল্প, স্মৃতি, উড়ে যাবার আগে যতটা পারা যায় লিখে ফেলতে হবে। এতো লেখা যে তার ভারী তাড়া। নিজেরও প্রচুর কথা জমে গেছে। আঙুল অবশ, কাঁধ টনটন করে গৌরের। মাথা ঝিমঝিম করে। সে গা এলিয়ে দেয় বালিশে…

শেয়ার করুন

Similar Posts

  • জন্মদিন – বৈশালী সেন

    কাক ভোরে ওঠার অভ্যেস কোনোকালেই নেই ইমনের । ইস্কুলে পড়ার সময় দাদি অনেকদিন ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছেন । কিন্তু বই এর পাতা খোলার কিছু সময়ের মধ্যেই ইমনের চোখের পাতাও বুজে আসত । মন বলছে আজ যে তার জন্মদিন । ভোর থাকতে ইমন বেড়িয়ে পড়ে । ট্রেনের জানালা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া সবুজ মাঠ , মাটির…

  • লাল পিঁপড়া – মাহফুজ রিপন

    ছেলেটাকে নিয়ে সুলতানের খুব গর্ব। তাঁর সন্তান রাকিব আমদহ গ্রামে প্রথম এস এস সি পাশ করেছে। সুলতান খুশিতে বাপের কবরের কাছে গিয়ে মোনাজাত ধরে। সে স্বপ্ন দেখে তার সন্তান একদিন অনেক বড় হবে। আমদহ গ্রামে উন্নয়নের জোয়ার লেগেছে। গ্রামে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে। শহর থেকে বাস আসে নিয়মিত। বাসের হর্ণ বাজলে কাঁচা…

  • ভালো খারাপ – রিয়া মিত্র

    স্কুলের বাইরে ছাত্রীদের মায়ের একটি জটলা রোজই বসে। নিজের মেয়েদের স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে তারপরে বাড়ি ফেরে সকলে। অনেকে বাড়ি না ফিরে সারাদিনও অপেক্ষা করে। “তনিমার মেয়ে তানিয়াটা সত্যিই খুব ভালো, শান্ত, নম্র, ভদ্র স্বভাবের”। আজকের আলোচনায় নিজের মেয়ের প্রশংসা শুনে বেশ গর্বই হয় তনিমার। শেলী পাশ থেকে টোন কেটে বলে,…

  • বাঘ – সম্বিৎ চক্রবর্তী

    জঙ্গলে বাঘ ঢুকেছে। সে এক বিশাল, হিংস্র, ভয়ানক বাঘ। তাই জঙ্গলে যাওয়া নিষেধ। ঢুকতে তো পারেই না, উলটে জঙ্গলের বাইরে এখানে ওখানে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে রাখে ওরা সারারাত। ওরা সারারাত আগুনে, পাহারায় আটকে থাকে আর সারাদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বনের দিকে চেয়ে। ওখানে যে যাওয়া বারণ। কারণ—বাঘ। বাঘের আকার, আয়তন, বর্ণ, হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা নিয়ে নানা কথা…

  • রোকেয়া বেগম – অভিজিৎ চৌধুরী

    রোকেয়া বেগম -অভিজিৎ চৌধুরী ১ এতো গভীর কালো রং আমি খুব কম দেখেছি। ঠোঁট, চিবুক, হাতের নখগুলি, পায়ের পাতা সবটাই কালো।চুলও কালো, তবে অগভীর ও পাতলা। কোনদিন জবাকুসুম, কেয়োকার্পিনের গন্ধ পাইনি। নাকে নোলক নেই, কানে দুল অনেক দিনের রং ওঠা । হাতেও কখনও কোন কংকন দেখিনি। আমি বললাম, কি নাম যেন তোমার, ভুলেযাচ্ছি । নত…

  • বালিশ – প্রতিমা সেনগুপ্ত

    এখন রাত্রি সাড়ে বারোটা। লালবাজার সিকিউরিটি সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট থেকে, কয়েকজন সরকারী অফিসার এসেছিলেন। ওরা মা’র কলিগ। কিসব যেন সমস্যা হয়েছে। সামান্য কথাবার্তা হল নিচু গলায়। ওরা মা’কে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। আমি – সিদ্ধার্থ রায়। দক্ষিণ কলকাতার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। গল্ফগ্রিনের একটা বহুতলের চারতলার ফ্ল্যাটে মা’র সঙ্গে থাকি। আমার মা পেশায়…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *