|

স্বকাম – ইন্দু মেনন অনুবাদ: বিপ্লব বিশ্বাস

শেয়ার করুন

[লেখক-কথা: ইন্দু মেনন মালায়লি ছোটোগল্পকার। জন্ম, ১৯৮০ তে। তার ‘কথা’ অজস্র পুরস্কারে ভূষিত যথা উরুব পুরস্কার, কেরালা সাহিত্য অকাদেমি গীতাহিরন্নন পুরস্কার ও মাতৃভূমি সাহিত্য পুরস্কার। বর্তমান গল্পটি ‘ওরু লেসবিয়ান পশু’ নামে তার ‘কথাকাল ইন্দুমেনন’-এর অন্তর্ভুক্ত, লেখা হয়েছিল ২০০৩ সালে। ]

ধোঁয়ার মতো খেলে বেড়াতে বেড়াতে একটি আলোর রেখা ভেন্টিলেটরের কাচ গলে বাথরুমে ঢুকল। স্নানের সময় কখনও কখনও মেহেরুন্নিসা ছোট্ট শিশুর মতো পেছনে ফেরে। সেইসব মুহূর্তে, তার আগ্রহ বাড়িয়ে, এমন আলো-রেখা তার নাভিমূল ছুঁয়ে যায়—ঠিক যেন মায়ের নাড়ির সঙ্গে জঠরযোগ। 

অন্যথায় তা সাবমেরিনের উজ্জ্বল লেজের মতো হলদে বালতিটার ভেতর ডুবে যায়। তা যদি না হয় তবে ছাদের ভাঙা টালিতে পড়ে চকচকে আংটি হয়ে কাঁপতে থাকে। 

কখনও কখনও মেহেরুন্নিসা দুটি হাতের তালুতে তাকে ধরতে চেষ্টা করে; অথবা তার ভিজে চুল-গোছার দিকে তাকে ঘুরিয়ে দেয়, চুল থেকে তখন চুঁইয়ে পড়ে জলবিন্দু। যদি তাও না হয়, সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকবে কোটি কোটি আলোকণার দিকে যা তখন নেচে বেড়াচ্ছে আলোরেখার ভেতরে। এভাবে প্রায়ই তার স্নান সারতে দেরি হয়ে যায়। 

কিন্তু সেই দিনটিতে মেহেরুন্নিসার স্নান সারার তাড়া ছিল। সেদিন সূর্যের আলো-খেলার কথা ভাবার অবকাশ পায়নি সে। কিন্তু যে মুহূর্তে বালতি থেকে শেষবারের মতো মগভর্তি জল তুলছে, তার মনে হল, সূর্যের স্বচ্ছ আঙুলগুলি জলকে ছুঁতে নীচ অব্দি নামছে না। ভয়ে সে ভেন্টিলেটরের দিকে চোখ ফেলে। “আয়ো”। সে চেঁচিয়ে কাচাকুচির জন্য টাঙানো পোশাক সব টেনে বুকে চেপে ধরে। দুটো চোখ শান্তভাবে তাকে দেখছে। আস্তে আস্তে মুখের অর্ধেক সরে গিয়ে তা মিলিয়ে যায়। 

কাপড়চোপড় পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে মেহেরুন্নিসা কাঁপতে থাকল। ওতো সেই! সমকামী গাইটা! 

মেহমুদ খান যখন তার মোপেডে চেপে মেহেরের ভাড়াবাড়িতে এল তখন সে তার কাপড়চোপড় কাচাকাচি করছিল। গত তিন বছরে তার মেয়ের মধ্যে যেসব পরিবর্তন এসেছে তা দেখে মেহমুদ খান বেশ অবাক হয়েই ছিল। সে বুঝতে পারল তার মেয়ে যেন পোক্ত মহিলা হয়ে উঠেছে এবং সে এও বুঝল যে সময়ের ছোঁয়ায় মেয়ের শৈশবের সব চিহ্ন মুছে গেছে। 

একই সময়ে মেহেরের বড়ো বোন ইদ আব্বা মেহমুদ খানের সামনে আরও যেন দুষ্টু আর বালখিল্য হয়ে উঠেছে যা তার বয়সোচিত নয়। 

এমনকি বিয়ের দশ বছর বাদেও ওর মধ্যে কোনও সন্তানসম্ভাবনার লক্ষণ দেখা দিল না। যেহেতু রাভুথার পরিবারে মাতৃকুলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উত্তরাধিকার অনুসরণ করা হয় সেহেতু ইদ কামালের স্বামী ইদের সঙ্গেই মেহমুদ খানের স্ত্রীর বাড়িতে থাকে। এমনকি লোকে যদিও বলাবলি করে যে রাফতাস জুনিস ইদকে তালাক দেয়নি কারণ সে বিবির ঘরেই থাকে, তবু্ও ঘটনা হল, তাদের প্রেম, জ্বর জাতীয় শারীরিক তাপমাত্রার মতোই অচ্ছেদ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেহমুদ খান তার এই মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা না হবার ঘটনাটিকে পরিবারের ওপর অভিশাপ বলেই মনে করে। 

কিন্তু ছোট্ট মেয়ে মেহেরুন্নিসা, যে কিনা তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছিল, তার অন্তঃসত্ত্বা হবার খবরটা মেহমুদের সব রাগে জল ঢেলে দিল। 

কাপড়চোপড় চিপে কাঁধে ফেলে যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখনই মেহের তা লক্ষ করল। চমকে গেল সে। প্রথম দর্শনে ভেবেছিল এটা সেই স্বকামী গাইটা যে কিনা গত পাঁচ-ছদিন ধরে ঢুকতে চেষ্টা করছে। শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ বাইরে আছে জেনে সে বাড়তি সাহস দেখাচ্ছে।

মেহেরুন্নিসা তো অবাক। ছ-ফুটের পাথরে কোঁদা চেহারা নিয়ে আব্বু মোপেডের পাশটিতে দাঁড়িয়ে। মেহের তার পরনের শাড়ি নামিয়ে পরে। তিন বছর বাদে আব্বু তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এ যেন দিবাস্বপ্ন! মেহেরও ফিরে হাসে। বাদামি চোখদুটি বড়ো করে, সুন্দর চোখের পাতায় নাচন লাগিয়ে হাস্যরত মেহেরের মুখ হাঁ হয়ে যায়। 

আব্বুকে সে ভেতরে আসতে বলে। সে লক্ষ করে তাদের ভাড়াবাড়িতে ঢোকার সময় শ্রীহরি ভেঙ্কটেশের টেনে দিয়ে যাওয়া তিন দিনের পুরনো লক্ষণরেখাকে পাড়িয়ে আব্বু ঢুকল। তিন বছর পর সে শিশুর মতো অভিযোগ করে উঠল, ‘আব্বু, সরে যাও’।

সুলাইমানি (কেরালার বিশেষ প্রক্রিয়ার চা)-তে চুমুক মেরে লেবুর জোরালো টক স্বাদ পাওয়ায় আব্বুর চোখ কুঁচকে উঠল। আব্বু যখন মনে করিয়ে দিল, যে উচ্চতায় রাভুথার মেয়ে যাক না কেন, যদি সে ভালো সুলাইমানি বানাতে না পারে তবে তার কোনও দাম নেই, তখন মেহের কান্না জুড়ে দিল। 

—সে কি ছবিটবি আঁকে? 

মেহেরের চোখের জলে মজা পেয়ে মেহমুদ খান চালগুঁড়ো দিয়ে আঁকা কোলামের (এক জাতীয় শুভ আলপনা) দিকে তাকিয়ে জানতে চায়। 

—না। 

—ওর নাম কী? 

—শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ পাই। 

—সে কখন আসবে? 

—সন্ধে নাগাদ।     

মেহমুদ খান গম্ভীর ঢঙে মাথা নাড়ে। বলে:

—ওর কোনও ছবিটবি আছে? 

—না। 

—তোমাদের বিয়ের অ্যালবাম নেই? 

এ কথায় মেহেরুন্নিসা অস্থিরভাবে আঙুল মুচড়ে বলে,

—আমাদের বিয়ে হয়নি। 

মেহমুদ খান মাথা নাড়তে থাকে যেন এমন কিছু অস্বাভাবিক কথা শোনেনি সে। বলে: 

—তুমি কি তোমার ধর্ম পালটেছ?   

—না।      

মেহেরুন্নিসা লক্ষ করল, তার আব্বু মেহমুদ খানের মুখখানা হঠাৎই ধিকিধিকি জ্বলন্ত কাঠকয়লার মতো লাল হয়ে উঠল। তার ধূসর দাড়িগোছা বুকে যেন পটবাড়ি মারছে। 

তোমার উচিত ছিল ধর্ম বদলে ফেলা। তা তুমি এখন যা করেছ তার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার বিষয় হত। 

সে সুলাইমানির কাপটি জানলার গোবরাটে (sill) রেখে দিল। 

আমি জানতাম না তুমি এমন করুণ পরিবেশে বাস করছ। 

—————

চা পানের সময় শ্রীহরি মেহেরকে একটি প্রশ্ন করতে মনস্থ করল কেন-না সে চিহ্নাদিতে বিশ্বাস করত। বাড়িতে ঢোকার সময় যে সমস্ত চিহ্ন সে দেখেছে তাতে তিনজন মানুষের উপস্থিতি সে টের পেয়েছে। 

—কারা এসেছিল? 

—আব্বু। 

—আব্বু!  শ্রীহরি লজ্জা পেল। সে জানত, মেহেরুন্নিসার আব্বু শহরের ধনী রত্ন ব্যবসায়ী। তার ধারণা হল, মেয়ের এই দুর্দশাগ্রস্ত ভাড়াবাড়ি দেখে বাপে বকাঝকা করেছে।

———–

শ্রীহরি মেহেরের বাবার কুশলাদি বিষয়ে কোনও খোঁজখবর নিল না। নারী-পুরুষের স্বাভাবিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কথাবার্তা তারা সব সময় এড়িয়ে যেত যেন তা কোনও অদৃশ্য আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। শ্রীহরি কিছু জিজ্ঞেস করে ওঠার আগেই মেহের তার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলতে লাগল। 

শ্রীহরি অবাক হয়ে মাথা চুলকোতে শুরু করল। তাদের সহবাসের শুরু থেকে এই প্রথম মেহের নিজের স্বপ্ন-অভিজ্ঞতা তার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে। 

—তুমি যা ভাবছ, এটা কোনও স্বপ্ন নয়। 

—তাহলে কী মেহেরু, দিবাস্বপ্ন? প্লেটে চা ঢেলে মেহেরকে দিতে দিতে শ্রীহরি জানতে চায়। 

—না, আমার মনে হয় এটা শুরু হয়েছিল গত পরশু। আমার মধ্যে এক অস্বাভাবিক অস্থিরতা তৈরি হল। বমি করলাম। শেষে গতকাল সকালে বমিভাব একটা অঙ্গভঙ্গিতে পরিণত হল। যেন হালকা হলদে তরল ছাড়া আর কিছু বেরিয়ে আসবে না। শুধুই ওয়াক উঠতে লাগল। কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে মুখ ধুচ্ছিলাম। সেই মুহূর্তে গাইটা আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আমি জ্ঞান হারালাম। ওই স্বপ্নটাই অচৈতন্য অবস্থায় আমি দেখলাম।

মেহেরুন্নিসা…, শ্রীহরি নাছোড় ঢঙে ডাক দিল। সে তার খুশি চাপতে পারছিল না। পাগলের মতো মেহেরুর কপালে, চোখের পাতায় চুমু খেতে লাগল। 

জীববিজ্ঞানসম্মত ঘড়ির মতো মেহেরুন্নিসা বিছানায় শুয়ে পড়ল। ডিজিটাল ঘড়ির মতো চিকচিক করে উঠল ওর চোখদুটি। 

—————

বিয়ে না করেও স্বামী-স্ত্রী হিসাবে যখন মেহেরুন্নিসা আর শ্রীহরি সহবাস করতে শুরু করল তখন গ্রামবাসীরা খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিল। প্রথামাফিক বিয়ে না করে একই বাড়িতে দুই ভিন্নধর্মী নারী-পুরুষের এমন বসবাসের ঠিক-ভুল নিয়ে লোকজন তর্কাতর্কি জুড়ে দিল। হাসপাতাল থেকে ভাড়াবাড়িতে স্থানান্তরের সময় মেহেরুন্নিসা আর শ্রীহরি চিঠি লিখে জানিয়েছিল যে তারা একত্রে বসবাস করতে চলেছে। 

আয়ুর্বেদ হাসপাতালের অভিযোগ প্রত্যধিকার কমিটিতে ষোলো বছরের মেহেরুন্নিসার সঙ্গে শ্রীহরি ভেঙ্কটেশের প্রথম দেখা হয়। সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার আধিকারিক হওয়া ছাড়াও সে ছিল সুঠাম যুবক, মুখটা নীলচে। অতিরিক্ত তৈলাক্ত হওয়ায় তার মুখের নীল-সবুজ শিরাগুলি চকচক করছিল। 

সমস্যা ছিল জটিল। মেহেরুন্নিসার ছোট্ট দাঁতের পাটি আর খোলা হাসি শ্রীহরিকে নাড়িয়ে দিল। সেই সময় ওর বয়স ছিল মোটামুটি ছত্রিশ। 

অপরপক্ষে অভিযুক্ত নার্সটি হিংস্র গাভীর ঢঙে শ্রীহরির দিকে তাকিয়েছিল। মেহেরুন্নিসার দিকে শ্রীহরির তাকিয়ে থাকা নার্সটির সহ্য হচ্ছিল না। 

প্যারালিসিসে আক্রান্ত হয়ে মেহেরুন্নিসা এই হাসপাতালে এসেছিল। এমনকি হাসপাতালের অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রক্রিয়াতেও বিচলিত হয়নি মেহেরুন্নিসা। কিন্তু এই অভিযুক্ত নার্স যখন তার চিকিৎসা শুরু করল, মেহেরুন্নিসা বুঝতে পারল, নার্স মেয়েটা তার যথাযথ চিকিৎসা না করে গা, হাত, পা ডলাডলি করে মজা লুটছিল। তার দেওয়া লিখিত অভিযোগটি শ্রীহরি পড়েছিল:

‘স্যার, ওই নার্স মহিলার গা থেকে গাভীর গন্ধ বের হয়। আকারেও গাভীর মতো। গাভীর খুরের মতো এবড়োখেবড়ো ওর পায়ের পাতা। সব সময় হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনি কি জানেন এমনটা করবার কারণে ওই প্রাণীটাকে আমি কতটা ঘৃণা করি?’

‘ঘৃণা’ শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নার্সের মুখ শক্ত হয়ে উঠল। শ্রীহরি অভিযুক্তকে লক্ষ করল। ওর চোখদুটি ছিল প্রাচীন যুদ্ধজাহাজের মতো। বন্দুকের ধোঁয়া আর গর্জনরত কামানের চলাচলের ঢঙে ওর চোখ থেকে ছলকে পড়তে লাগল জল। একটা বুলেট, সমুদ্রের একটা ঢেউ, একটা গলে যাওয়া গ্লাস টুকরোর মতো তা আটকে থাকল ওর গালে।   

‘সে লোহার জুতো-তলি দিয়ে আমার বুকে জোর লাথি কষিয়েছে’, এই বলে মেহেরুন্নিসা বুকে হাত রাখে। 

‘প্রথম থেকেই আমার কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকত। মেয়ে যখন ঘুমাত ও তাকে চুমু খেত। কিন্তু সে কীভাবে আমার অসুস্থ মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ করে?’

নিহাদ বেগম সাক্ষ্য হিসাবে এই তথ্য দেয়। 

‘অতিরিক্ত ডলাডলিতে আমার শরীরটা কাদার চেয়েও ঢিলেঢালা হয়ে গেল। মানুষের মাংস তেলে ভাজলে যেমন হবে প্রতিটি পা-মাসাজের পর আমার যেন সেই রকম অবস্থা হল; আমি যেন ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর অবস্থায় চলে গেলাম। সেই সময় সবকটি নার্স মিলে আমাকে পরিষ্কার করতে লেগে যেত। কিন্তু তারা আমাকে সেই করুণা ও সম্মান দেখাত যা এক অসুস্থ রোগীকে দেখানো উচিত। একমাত্র ওই নোংরা গাভীটা ছাড়া।’

‘আমি তোমার শরীরটিকে ভালোবাসতাম মেহেরু’, 

বেপরোয়া প্রেমের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নার্স মেহেরকে বলল, ‘ঠিক যেমন একটা গাই অন্য গাইকে ভালোবাসে।’

এই নির্লজ্জ বয়ান শুনে এমনকি শ্রীহরিও হতভম্ব হয়ে গেল। 

ওর নাম নন্দিনী গোমাতা যে ছিল গোমাতা পরিবারের অংশ। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ওকে তিন মাসের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছিল আর মেহেরুন্নিসার ওয়ার্ডে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

‘এরপর থেকে সে চুপিসারে আমার ঘরে আসত। ঘুম থেকে জেগে উঠলে সে আমাকে একরোখা দৃঢ়তায় চুমু খেয়ে যেত।’

‘শ্রীহরি’, মেহেরুন্নিসা চোখ মেলে বলল, ‘আমার জ্ঞান ফিরলে ওই নোংরা গাইটা আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়।’ শ্রীহরি ভুরু কুঁচকে সোজা হয়ে বসে। সেই ছিল তৃতীয়জন যে এখানে এসেছিল।    

আকাশজুড়ে আগুনপাট তারা আর উজ্জ্বল জ্যোৎস্না দেখা দিলে শ্রীহরি জেগে ওঠে। সে সাধারণত জানলা খুলেই ঘুমোয়। ভয়টয় পায় না। কিন্তু ঝুঝকি অন্ধকারে সে যেন গাভীর ঝোলা কান আর যুদ্ধজাহাজি চোখের উপস্থিতি বুঝতে পারল। কাগজে মোড়া একটা ফল তার সামনে এসে পড়ল। কেউ যেন পাঁচিলের পেছনদিকে দৌড়ে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ডেয়ারি ফার্মের গোরুগুলি হাম্বা হাম্বা জুড়ে দিল। কাগজ-টুকরোয় লেখা, ‘মেহেরুন্নিসাকে ফেরত দাও।’ 

পরদিন যখন মেহমুদ খান, নিহাদ বেগম, ইদ কামাল আর রাফতাস জুনিস তাদের ঘরে এল, শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ লজ্জায় তাদের বসার কথা বলতেই ভুলে গেল। 

—————

খান খোলাখুলি শ্রীহরিকে বলল, মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করতে। খান আরও বলল, বারবার, দানধ্যানের কথা, যেমন মোটা রকমের পণ, ঐতিহ্যমণ্ডিত পাঠানি জুয়েলারি, সঙ্গে অন্যান্য বস্তুটস্তু। শ্রীহরি কিন্তু ভিন্ন ঢঙে উত্তর দিল। সে সোজাসুজি বলল, যতদিন পর্যন্ত সে নারীজাগরণের সমর্থক ততদিন পর্যন্ত বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে মেনে নিতে পারবে না। 

‘মেয়েদের সর্বাধিক স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। মেহেরুন্নিসা তার যোগ্য।’

খান অস্থিরভাবে পা দোলাতে থাকল আর গালে গড়িয়ে পড়া ঘামের লম্বা রেখাটিকে হাত দিয়ে আড়াল করল। ‘মানুষের প্রতিটি অঙ্গেরই একটা করে ঘড়ি আছে।’ শ্রীহরি বাবাকে স্মরণ করল যিনি তাকে এই কথা শিখিয়েছিলেন। সে মেহমুদ খানের পা ছুঁয়ে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন বাবা। সমস্যাটি হচ্ছে আমার নীতির। এটাকে বিদ্রোহের প্রকাশ হিসাবে নেবেন না।’

ইতোমধ্যে ভেতর-ঘরে নিহাদ বেগম উদ্‌বেগের সঙ্গে স্বকামী গাভীটার বিষয়ে জানতে চাইছিল। কার্যত ভাড়াবাড়িতে পৌঁছনোর পর মেহেরুন্নিসা কখনোই আর তার কথা মনে আনেনি। কাছাকাছি পাঁচ একর জমিতে যে গো-খামার আছে আর তার বাড়ির গেটের ভেতরে যেসব বড়ো বড়ো গাভীরা সাদা সাদা ফুল খেতে আসে তারা কখনোই তাকে নন্দিনী গোমাতার কথা মনে করিয়ে দেয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ওই স্বকামী গাইটি অন্যান্য গাভীদের সঙ্গে ভেতরে এসে লালসার চোখে বাথরুমে উঁকি দিয়েছে, ঠিক যখন মেহেরুন্নিসা স্নানে ঢুকেছে। 

‘এসো, আমরা বিয়ে করি’, এই ছিল তার প্রস্তাব। 

নিহাদ বেগম তো শুনে সিঁটিয়ে কাঠ। সে শুনেছিল সেইসব পুরুষের কথা যারা প্রেমের পাগলামিতে মেয়েদের পিছু নিয়েছে; আরও শুনেছে একাকী প্রেমিকপ্রবরের কথা যে কিনা তার প্রেমিকার যে মাটিতে ছায়া পড়েছে সেখানেই গড়াগড়ি গিয়েছে। কিন্তু এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কেন প্রেম আর কামনার টানে একটি মেয়ে অন্য মেয়ের পিছু নেবে!  

‘কোনও কোনও রাতে গো-খামারের একদম ওপরতলায় তার ঘর থেকে নন্দিনী আমাদের এই ভাড়াবাড়ির দিকে নজর রেখেছে। জানলা বন্ধ করার সময় আমি লক্ষ করেছি তার গায়ের চামড়া গোরুর চামড়ার মতো পুরু আর শক্ত; আর তার মুখের চামড়া দস্তানার শুকনো চামড়ার মতো কোঁচকানো।’

‘শোন মেহের, সে কোনও মায়াবী হতে পারে…’—এ কথায় মেহের ও ইদ, দুজনেই ঘাবড়ে যায়।

‘কিন্তু এ নিয়ে ভাবিস না মেহের। তোর আব্বু আর আমি একটা গ্রামে মাসপাঁচেক ছিলাম যেখানে এ রকম অনেক ছিল। লোকে এদের পানান বলে ডাকত। গ্রামবাসীরা এদের পশু ভাবত যেহেতু এরা গোমাংস খেত। সেই গ্রামে গোরুকে পবিত্র প্রাণী হিসাবে পুজো করা হত। পানান গোরুদের দেখভাল করত। কোনও গোরু মারা গেলে এই দেখভালের লোকগুলি তাদের কুঁড়েতে গো-শব টেনে এনে উৎসবে মাতবে। তাকে আগুনে ঝলসিয়ে খাবে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি যারা এই মাংস খেতে চায়নি গ্রামবাসীরা তাদের বেত দিয়ে মেরেছে।’

মেহেরুন্নিসার শরীর অবশ হতে থাকে। 

‘আমার মনে হয় এই পানানরা মৃত গোরুর স্বর্গীয় সুবাস পায়। তাই তারা মায়াবী আর জাদুকর হয়ে ওঠে। তারা এমন এক বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে যার বলে তারা ছুটে গিয়ে পাতলা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। তখন তারা যে কোনো রূপ ধারণ করতে পারে। কিন্তু তারা উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। এদের বেশির ভাগ গো-রূপে ছুটে যায়। “ওডিয়ান” (এরা পরম্পরাগত মায়াবী যারা রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় আর ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে জাদু দেখিয়ে ক্ষতি করে বেড়ায়) সেইসব মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেয় যারা তাকে আঘাত করে।’ 

মেহেরুন্নিসার মনে হল যেন তার মাথাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। তার কানের ভেতরে জোরালো চিৎকার বাজ পড়ার মতো শোনাচ্ছে। এটা জোরালো এক ‘হাম্বা’-রব। 

‘জাদুকর মায়াবীরা গাভীরূপে ভালোবাসার মেয়েদের তাড়া করে। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের পাকস্থলীতে লাথ কষিয়ে প্রতিশোধ নেয়।’ 

মেহেরুন্নিসা জোর করে মানতে চেষ্টা করে যে এসব গাঁজাখুরি কুসংস্কারের গল্প; আর জাদুকর বিষয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প সব মিথ, অতিকথা। একদিন শ্রীহরি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে এই উগ্র স্বকামী গাই যেভাবে বাড়ির গেট নাড়াতে লাগল তাতে সে ভয় পেল খুব। ওর কপালে কি দুটো পিণ্ড? যেখানে চামড়ার খাপে ধারালো শিং লুকনো আছে?    

সেই সন্ধেয় বাজার থেকে দুধ কিনে ফেরার পথে গাভীর শব্দময় অলঙ্কৃত পদচারণা তাকে তাড়া করে। সেই স্বকামী গাভী! শ্রীহরি সতর্কভাবে তাকে লক্ষ করে। তার পরনের পোশাক যেন গাভীর উজ্জ্বল চামড়া। গাভীর কানের ঢঙে দোপাট্টার প্রান্ত কাঁপছিল। পায়ে লোহাতলির হাইহিল জুতো। চোখদুটি যেন যুদ্ধজাহাজ। গায়ের চামড়া হালকা লাল। তা সতেজ নরম মাখনের মতো চকচক করছে। 

‘মেহেরুন্নিসাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। তোমার তাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। যেহেতু তোমাদের চুক্তি-বিবাহ হয়নি তাই তাকে ত্যাগ করা সহজ হবে। এমন কি সে তো তোমার বউও নয়।’

শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ রেগে গিয়ে বলল, ‘ধিক তোকে। মেহেরুকে বিরক্ত করা ছাড়। নইলে পুলিশ ডাকব।’

‘দেখো শ্রীহরি, রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। আমার কথা শোনো। ওর ওপর আমার হক তোমার চাইতে অনেক বেশি। তুমি যেমন, আমিও তেমনই ওর বুকের ছোঁয়া নিয়েছি। দু দু-বার। আমার আঙুলের ছোঁয়ায় ওর শরীরে ফুটে ওঠা প্রতিটি বুনন আমি মনে করতে পারি’, লালসার রস মিশিয়ে সে বলে। 

‘দূর হ এখান থেকে!’ শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ চেঁচিয়ে বলে। সে মেয়েটিকে ঠেলে বের করতে চায়। হঠাৎই মেয়েটির মুখের চেহারা পালটে যায়। লালসার ওম সরে গিয়ে সেখানে বিকৃতির সঙ্গে চেপে বসে ভয়ংকর ক্রোধ। দেহের শিরা থেকে বয়ে যাওয়া রক্ত জমা হয় মুখের জমিতে। বন্দুক-বারুদের গন্ধ পায় সে। 

‘তবে রে!!’, এই বলে জোর চিৎকারে সে মাথা দিয়ে ঢুঁসিয়ে শ্রীহরির বুকে আঘাত করে। গোলাকার খুরের লম্বা পা দিয়ে জোর লাথি কষিয়ে দেয়। জোরের সঙ্গে শ্রীহরির মুখটা পা দিয়ে চেপে দেয়। ‘তোকে আজ মেরেই ফেলব’, উন্মত্ত চিৎকার করে ওঠে মেয়েটি। 

গোবর আর চোনার উৎকট গন্ধযুক্ত বাজারের বিফস্টলের করিডরে মরা মাংসের মতো পড়ে থাকতে থাকতে শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ স্থির করল মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করবে। এর মধ্যেই সেই স্বকামী গাভী ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়। তার পাট করা পাতলা চুল গোরুর লেজের মতো মনে হল। 

এরপর শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ হিন্দু-মুসলমান উভয় রীতি মেনেই মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করল। ওইদিনই স্বকামী গাইটা গো-খামারের দেওয়াল সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল। খামারের ভাঙা গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দু হাজারেরও বেশি গাভী গ্রামে ঢুকে পাগলের মতো সব তছনছ করে দিল। গুজব রটল, পাগলা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে গোরুগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামবাসীরা সব ইতিউতি পালাতে লাগল। শিশুরা স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিল। যুদ্ধ-পরবর্তী ভূখণ্ডের মতো গোটা গ্রাম শুনশান হয়ে গেল। লাঠির ডগায় পেরেক পুঁতে কিছু যুবক ঘুরে বেড়াতে লাগল আর গ্রামের ওপর দিয়ে যে বিপর্যয়ের ঝড় বয়ে গেল সেজন্য হায় হায় করতে লাগল। পাথর আর টিন ছুঁড়ে তারা গোরুদের আক্রমণ করে মেরে ফেলতে লাগল। 

সেই বিকেলেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে শ্রীহরি আইনমাফিক মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করল। রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে ফেরার সময় রাস্তায় গাদা গাদা গরু মরে পড়ে থাকতে দেখল। 

শ্রীহরি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার আশঙ্কা করল। দাঙ্গা-কবলিত ভূখণ্ডের মতো রাস্তাঘাট পরিত্যক্ত। অর্ধমৃত, মাথা থেঁতলানো ছেঁড়াখোঁড়া গাভীর দল রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে হামাগুড়ি দিচ্ছে। 

গো-খামারের পশ্চিম দিকে শ্রীহরি আর মেহেরুন্নিসা একটা জটলা দেখতে পেল। গাড়ি থামিয়ে শ্রীহরি অস্থির মনে সেখানে গেল। স্বকামী গাইটা রাস্তায় পড়ে আছে। উলঙ্গ অবস্থায়। তার বুক থেকে রক্ত বেরিয়ে রাস্তায় গাঢ় পিচের ওপর পড়েছে এবং তা শুকোনোর বদলে ফুটছে। 

তার মনে হল জায়গাটা থেকে গোরুর দুধের গন্ধ আসছে। 

‘একটা পাগলা গোরু শিং গুঁতিয়ে ওকে তেড়ে নিলে ক্ষিপ্ত মানুষ পাথর আর পেরেক লাগানো লাঠি দিয়ে ওকে মেরে ফেলেছে।’

শ্রীহরি ভেঙ্কটেশ স্বস্তি- শ্বাস ফেলে, ‘যাক, তাহলে সে মরেছে।’ সে এমন ঢঙে কথাটি বলে যেন একটা গরু মরেছে। 

‘তুমি কার কথা বলছ?’, মেহেরুন্নিসা জানতে চায়। 

‘ও কিছু না, লোকেরা একটা পাগলা গাই মেরে দিয়েছে। সেটাই আর কি…’

শ্রীহরি গাড়ির দরজা বন্ধ করে। 

পরদিন সকালে শ্রীহরি মেহেরুন্নিসাকে খবরের কাগজ পড়তে বাধা দেয় কেন-না সেখানে খবর ছিল, ‘ক্ষিপ্ত মানুষ ডাইনি ভেবে গো-খামারের মালকিনকে খুন করেছে।’

‘যাও, এক কাপ কফি নিয়ে এসো’, এই বলে সে হাতল-চেয়ারে হেলান দেয় আর শরীরময় ছড়িয়ে পড়ে একজন স্বামীর ঔদ্ধত্য আর অহংকারের গোটা। 

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *