সলিল চৌধুরী: অননুসারি প্রভিতার যাত্রাপথে – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

সলিল চৌধুরী—যিনি “আদিমে” শুরু হয়ে অন্তে যেতে যেতে “স্বর্গ” রচনা করে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। যিনি পৃথিবীর ডাকে সাড়া দিয়ে গুঞ্জন প্রেম, চাঁদ-ফুল-জোছনার গানকে থামানোর কথা বলেছিলেন।

১৯৪০ এর উত্তাল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সময়ে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে আসেন। যদিও, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা অনেক অল্পবয়সেই তৈরি হয়। বি.পি.এস.এফ-এ থাকাকালীনই লিখেছিলেন ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’, ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’, ‘ও আলোর পথ যাত্রী’, ‘হয়তো তাকে দেখেনি কেউ’, ইত্যাদি বিখ্যাত গানগুলি।

এর পর তেভাগার দিন গুলোয় তাঁর লেখনী থেকে বেরিয়ে আসে ‘হেই সামালো ধান হো’, ‘ভাইরে ও ভাইরে’, ‘ও মাঝি বাইয়ো’-র মতো গান।

এই সময়ে ‘শপথ’ এর মতো কবিতা, ‘গুনরাম গুঁই এর জীবনচরিত’ এর মতো কাহিনির স্রষ্টা সলিল রচনা করেছেন ‘গাঁয়ের বধূ’-র মতো কম্পোজিশন। সুর দিয়েছেন বন্ধু সুকান্তের লেখা ‘রানার’-এ।

১৯৪৮ সালে বটুকদা অর্থাৎ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর হাতে ধরে ফিল্মে আগমন হয় সলিলের সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ফিল্মে।

৪৬-এর উত্তাল দিনে যখন লিখেছিলেন ‘আজ হরতাল/ আজ চাকা বন্ধ’ তখনই বোঝা গিয়েছিল এক সুরকারের জন্ম হয়েছে; ‘রানার’, ‘গাঁয়ের বধূ’ পেরিয়ে বরযাত্রী ছায়াছবির ‘শিমুল শিমুল শিমুলটি’ গান থেকে অন্য স্বাদ পাওয়া গিয়েছিল। ‘পাশের বাড়ি’-র ‘রূপ সায়রেরও বুকে’ বা ‘ঝির ঝির ঝির ঝির ঝিরি বরষায়’ গান আক্ষরিক অর্থেই বাংলা গানের চলন পাালটে দেয় বৈপ্লবিক রূপে।
হারমোনি আর অবলিগেটোর ব্যবহার দ্বারা তিনি আসলে সুরের ক্ষেত্রে মার্কসীয় দ্বন্দ্বের প্রয়োগ ঘটান।


তাঁর পিতা ছিলেন আসামের চা-বাগানের ডাক্তার। তিনি চূড়ান্ত স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। একাধিকবার তিনি ইংরেজদের সঙ্গে গোলমালে জড়িয়েছেন। যাঁর নির্যাস সলিলের গানেও পড়েছিল—‘আমার বাবা বোকা ছিল/ আমি তো তাঁর ছেলে/ সে বিলিতি কাপড় পুড়িয়ে/ গিয়েছিল জেলে।’

দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বন্যাকে কেন্দ্র করে যে রিলিফের কাজ হত, সেই কাজেই জড়িয়ে পড়েন কিশোর সলিল। সেখান থেকেই শুরু হয় যাত্রা। সেখান থেকেই শুরু হয় প্রাথমিক সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা এবং সুর রচনা। যদিও বাবার নাটকে সুর দিয়েই প্রথম সুরারোপণের অভিজ্ঞতা।

এখনও পর্যন্ত যেটুকু জানা যায় ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে’ গানটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বন্যার রিলিফের সময় প্রচারের জন্য লেখা ও সুরারোপ।

এরপর বি এ পড়তে কলকাতা শহরে আসা এবং প্রায় হাতে ধরে বি পি এস এফ এর সংগঠন তৈরি, সঙ্গে চলতে লাগল সুরসৃষ্টি। বি পি এস এফের পাবনা সম্মেলনে তৈরি হয় ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যাঁরা।’

দেখতে দেখতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ভারতে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে লাল কেল্লায় বিচার শুরু করে ইংরেজ সরকার। এর বিরুদ্ধে মির্জাপুর স্ট্রিটের ছাত্র ফেডারেশন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে জমায়েতের ডাক দেয়। বি পি এস এফ কে না ডাকলেও তাঁরা যোগ দেয়। ওই দিন সন্ধে ছ’টায় পুলিশের গুলিতে মারা যান রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রক্তে ভেসে গিয়েছিল সলিলের দেহ। সেই সময় সলিল রামেশ্বর বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি ছোট্ট কবিতা লেখেন। ১৯৮৬ সালে এ আই এস এফের ৫০ বছর পূর্তির স্মারকগ্রন্থে সেটি পুনর্মুদ্রিত হয়।

২১শে নভেম্বরের এই ঝড়—অসমাপ্ত ভারতীয় বিপ্লব—২১শে ফেব্রুয়ারি অবধি চলেছিল। এই পর্বেই লেখা হয় ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে।’

এরপরেই ফ্লিটউড কমিশনের প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে কৃষক সভা আন্দোলন শুরু করে যার নাম ‘তেভাগা’। এই সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন একাধিক ছাত্র নেতৃত্ব। বহু স্থানে কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন ও কৃষক সভার সংগঠন একপ্রকার এঁদের হাতে তৈরি।

এই পর্বেই লেখা ‘ও মাঝি বাইয়ো’, ‘ভাইরে ও ভাইরে’, ‘হেই সামালো ধান হো’।

চল্লিশের শেষের দিকে একধরনের অতিবাম বিচ্যুতি দেখতে পাওয়া যায় বাম আন্দোলনে। সংস্কৃতিকে স্লোগান মুখর করে তোলা হয়। অভিযোগ ওঠে ‘গাঁয়ের বধূ’ গানে উত্তরণ নেই, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ গানে ‘বিধি’, ‘কপালগুন’ শব্দের প্রয়োগ করে কৃষকদের লড়াই বিমুখ করছেন।

১৯৫১ সালে গণনাট্যের পক্ষ থেকে সলিল ৫ই মে-র মহম্মদ আলি পার্কের ‘বিশ্ব শান্তি সম্মেলন’ এর জন্য লেখেন ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’। এটাই প্রথম পর্যায়ের গণনাট্যের জন্য লেখা সলিলের শেষ গান। ৪৬ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক পুডভকিন ও অভিনেতা চেরকাশভ এই গান গেয়েছিলেন।

ওই বছরেই বাবার মৃত্যু এবং পার্টি কর্তৃক বহিষ্কৃত হন।

সুধীবৃন্দের পূর্বোক্ত হাস্যকর অভিযোগের উত্তর তিনি এঙ্গেলসের ‘প্রকৃতির দ্বান্দিকতা’ থেকে তুলে দিয়েছিলেন এবং অবাক হয়ে ভেবেছিলেন ‘এরপর কি গানের সাথে মানে বই লিখতে হবে?’

এর কিছুদিন বাদেই বোম্বেতে রিলিজ হয় ‘দো বিঘা জমিন’। কাহিনি রচনা করেন সলিল নিজেই। এই কাহিনিতে কৃষক থেকে শ্রমিক হয়ে যাওয়া, সামন্তদের ফেলে যাওয়া সম্পদকে পুঁজিবাদের ব্যবহার ও একে অপরের হাত ধরা, শহরের হৃদয়হীনতা ও সর্বহারার এক অংশের লুম্পেন প্রলেতারিয়েতে পরিণত হয়ে যাওয়া, প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষি, আইন ও আদালতের শাসক পক্ষের তাঁবেদারি, শোষণ থেকে মুক্তি না পেয়ে ভগবানকে দোষারোপ, এই সবকিছু এক লহমায় উঠে এসেছে।

ভেবে দেখুন, “কী দেবো তোমারে/ নাই যে ধান খামারে মোর ‘কপালগুনে’”—আসলে এক কৃষক রমণীর কান্না, যেখানে ‘কপালগুন’ মানে ভাগ্য নয় বরং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ফল। একজন কৃষক রমণী তো সেই তত্ত্ব বোঝেন না আর গীতিকার ‘গান’ লিখেছেন, তার সাথে ‘মানে বই’ লেখার দায়িত্ব তাঁর নেই। স্বভাবতই এই সমালোচনার পরেও, সলিলের নিজের মতো কোথাও যেন কানহাইয়ার চুরি করে ফিরে আসার পর, মায়ের দুর্ঘটনার খবর শুনে ভগবানকে দোষারোপ করার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। ‘বিচারপতি’-কে ক্ষমা না চাওয়াতে পারার ফলই যেন কোর্টের রায় জমিদারের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। জমিদারের জমি কাড়াও আসলে সংগঠিত ভাবে গাঁয়ের যত জোয়ান মরদ’-এর হাতে লাঠি আর খুনে রাঙা ঝান্ডা কাঁধে না তুলতে পারার ফল হিসেবেই প্রতিভাত হয়। এটাই কি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাংস্কৃতিক দলিল না তৈরি করতে পারার সংকট?

যদিও সুযোগ পেলে যে পূর্ণ মাত্রার ‘বাণিজ্যিক’ জগতের অভিনেতারা অন্যধারার ছবি করতে পারেন সলিলের এই মনোভাবের সূত্রপাতও এই ফিল্ম থেকে।

গানের দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে একটি গান যা সলিলের প্রথম হিন্দি সুর তা যেন অনাগত ভবিষ্যতের সলিলকে তুলে ধরে। মান্না দে ও লতা মঙ্গেশকর এর গাওয়া (কোরাস সহ, ঠিক IPTA-এর ধাঁচে) ‘আপনি কহানি ছোড় যা/ কুছ তো নিশানি ছোড় যা’ আক্ষরিক অর্থেই যেন সলিলকে ‘নিশানি’ রেখে যেতে বলছিল। গানটির ‘মওশম বিতা যায়’ লাইনটি সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘লাল ফৌজ’-এর গান ‘পলুলিউস্কা পোল্যে’ গানের একটি লাইন যার ‘মেজর থার্ড’-কে ‘মাইনর থার্ড’ করে সলিল আসলে ‘ভৈরবী’-র সামান্য ছোঁয়া এনেছিলেন।

ফিল্মে আর একটি অনবদ্য গান ছিল ‘মতোয়ালা শাওন ঢোল বাজাতা আয়া’ যা আসলে IPTA এর ‘উর তাক তাক তাক তাকে তাঘিন তাঘিন ঘিন ঘিন রে’ গানের হিন্দি।
দল থেকে সরে গেলেও তিনি প্রকাশ্যে অযথা বিরোধিতা কোনোদিন করেননি।

যদিও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সমালোচনা তিনি কম করেননি। সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন কেন বিপ্লব সম্পন্ন হল না? কেন হাজারে হাজারে অহল্যাবাইদের মৃত্যুর কোনো ঋণ শোধ হল না? কেন শহরের সুস্থ আবহাওয়ায় থাকা ব্যক্তিদের লাঠি ঘোরানো সংগ্রামী নেতাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করল? কেন বারংবার মৃত্যুর মুখোমুখি পৌঁছে যাওয়া ব্যক্তির ডিসিপ্লিন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল।

এই কারণেই কি তিনি লিখেছিলেন,

‘এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে
অনেক কিছু জীবনে যোগ দিলাম…’


যদিও শেষ জীবনে আবার ফেরার ইচ্ছে বোধহয় হত। তাই শিশির সেনের কাছে ইচ্ছেপ্রকাশ করেছিলেন ছাত্র বা সাংস্কৃতিক সম্মেলনকে দেখার। আবার বলেছিলেন যে, সারা বছর আন্দোলনে না থেকে সম্মেলন দেখে কীই বা বোঝা যাবে!

এই কারণে লিখেছিলেন

‘যাই হারিয়ে মিলেমিশে এবার
ওই আবার জনসমুদ্রে একজনা।’

কিংবা

‘ওগো ঝড়াপাতা
যদি আবার কখনও ডাকো
সেই শ্যামল হারানো স্বপন মনেতে রাখো
যদি ডাকো যদি ডাকো
আমি আবার কাঁদব হাসব
এই জীবন জোয়ারে ভাসব
আমি বজ্রের কাছে মৃত্যুর মাঝে
রেখে যাবো নিশানা।’

এছাড়াও ‘এ জীবন বেশ চলছে’, ‘যদি সবারই জন্যে সূর্য চন্দ্র তারা সাগর নদী’, ‘আমি সবার আগে মানুষ’ কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ‘সোভিয়েত নিয়েত নিয়েত’ কবিতা বা ১৯৮২ সালে ‘সাক্ষরতা আন্দোলনের জন্য লেখা গান’ প্রমাণ করে বিচ্যুত তিনি হননি।


সামনেই শতবর্ষ আসছে সলিল চৌধুরীর। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দায়িত্ব তাঁর ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। শিল্প ও শিল্পীর সৃষ্টি যদি আন্দোলনমুখি হয়েও যায়, তাঁকে কালোত্তীর্ণ করে তোলাই হল লক্ষ্য।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *