এন আর সি কি একটি ধর্মীয় উদ্যোগ? – বিমল লামা
এন আর সি, যেন কোনও মারণ রোগের ভাইরাস। এইচ ১ এন ১ কি ইবোলা কি তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু। চোখে দেখা যায় না। কিন্তু তার আতঙ্ক সর্বদা ঘিরে রাখে প্রাণটাকে। মনে হয় ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে দিনে রাতে। কামড়ে ধরাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এমনই এক উৎকট আবহ এখন দেশের ঘরে ঘরে। গ্রামে শহরে। বিশেষ করে সেই সব রাজ্যে যেখানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার প্রকাশ্য হুমকি দিচ্ছে কিছু ক্ষমতাবান মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা…।
শিক্ষিতরা ফেসবুক ছেড়ে এন আর সি পড়ছেন গুগুলে। হোয়াটস অ্যাপ ভরে যাচ্ছে এন আর সি-র কোপ থেকে বাঁচার টোটকা সংক্রান্ত ছোটবড় পোস্টে। পিছিয়ে নেই ইউটিউবও। আর যাদের সেসব নেই কাজের ফাঁকে ঘাম মুছতে মুছতে জানতে চাইছে—কী কী কাগজ লাগবে একটু বলে দাও না মাস্টার।
উৎস অসম। সেই বিহুর দেশ, যার মাদকতা বিহ্বল করে রাখে বৈশাখে, শরতে, মাঘে। অথচ সেই বিহু প্রেমীদেরই একাংশ নওগাঁ জেলার নেল্লিতে চোদ্দটা গ্রামে ছ’ঘন্টায় ২১৯১ জন মানুষকে খুন করেছিল। যেন কোনও বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল ওরা। বিশ্ব রেকর্ডই। কারণ হিটলারের ইহুদী নিধন এর পর দ্বিতীয় সবচেয়ে ঘৃণ্য জাতি দাঙ্গা হিসাবে বিবেচিত ঘটনা এটি। যার শিকার সেই বাঙালি মুসলমান। মূলত শিশু নারী বৃদ্ধ যারা দৌড়ে ওদের হারাতে পারেনি।
তো সেই ‘কৃতিত্বের’ পারিতোষিক হিসাবেই ওরা পেয়েছিলেন এন আর সি, যা ১৯৫১ তে শুরু হলেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল ততদিন। অল অসম স্টুডেন্টস উইনিয়নের বিদেশী হটাও আন্দোলনের জেরেই আবার তা পুনরুজ্জীবিত হয়। সে ১৯৮৩ এর কথা যা এখন স্মৃতির ঘরে ধুলোয় ঢাকা পড়েছে।
তারপর থেকে ঘুমন্ত এন আর সি জেগে উঠলেও নড়াচড়া তেমন করেনি। অনুকূল পরিবেশ জলহাওয়া আর সেবকের অভাবেই হয়তো। ২০১৩ সালে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে আবার সক্রিয় হয় এন আর সি। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, যিনি ঘটনাচক্রে অসমেরই ভূমিপুত্র, তারই নেতৃত্বে। প্রতীক হাজেলার তত্বাবধানে।
তারপর ছয় বছর ধরে পঞ্চাশ হাজার কর্মী ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে বানালেন সেই তালিকা যার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসেছিল মানুষ। কেউ দুরু দুরু বুকে। শুকনো মুখে। কেউ আবার চওড়া হাসি নিয়ে। গলায় উত্তরীয় টাঙিয়ে আঙুল আকাশে তুলে।
কিন্তু তালিকা যখন প্রকাশ্যে এলো সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। যাকে বলে ঘেঁটে ঘ। প্রথম খসড়ায় তিন কোটি ঊনত্রিশ লক্ষ আবেদনকারীর অর্ধেক বাদ। ছ’মাস পর দ্বিতীয় খসড়ায় বাতিল মানুষের সংখ্যা কমে হল চল্লিশ লক্ষ। তার এক বছর পর ৩১ আগস্ট ২০১৯ এর চুড়ান্ত তালিকায় বাতিলের সংখ্যা কমে দাঁড়াল উনিশ লক্ষ। এরা সকলেই ঘোষিত অনুপ্রবেশকারী বিদেশী।
দেখে শুনে বিভ্রান্ত গোটা দেশ। সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত দেশের সরকার নিজেই। বিভ্রান্ত অসম রাজ্য সরকারও। দু’জায়গাতেই আবার ক্ষমতায় বিজেপি। যারা ভীষণভাবে অসমে এন আর সি চেয়েছিল। যদিও আদতে এন আর সি তাদের ইস্যু ছিল না। মাঝপথে নেপোমি করে তারা শুধু সুবিধা নিতে চেয়েছিল। এখনও চাইছে। বাংলাসহ সমগ্র দেশেই চাইছে। সেই তাদেরও বিভ্রান্তির শেষ নেই তালিকা দেখে। কারণ তাদের হিসাব ছিল চল্লিশ লক্ষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাস করছে অসমে। বলাই বাহুল্য তারা সবাই বাঙালি মুসলমান। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় দেখা যাচ্ছে বাতিল হয়েছেন মাত্র উনিশ লক্ষ মানুষ। তাদেরও আবার বড় অংশই হিন্দু। মানে তাদেরই ভোটার। অর্থাৎ অন্তত ত্রিশ লক্ষ বাঙালি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে নাগরিক পঞ্জীর নিরাপদ খাতায়। দাঁড়িয়ে বসে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি বিজেপি।
তার ওপর বাদ পড়েছে লাখ খানেক গোর্খা যারা বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিল বাংলায়। এমনকি অসমের ভূমিপুত্ররাও আছে। আছে আদিবাসীরা পর্যন্ত। তার চেয়েও বড় পরিহাস বাদ পড়েছেন মদন মল্লিকের স্ত্রী ও পুত্র যিনি কি না সেই অসম আন্দোলনের ৮৫৫ জন শহীদদের একজন। অর্থাৎ বিদেশী হটাও আন্দোলন করতে গিয়ে যিনি প্রাণ দিলেন তাকেই বিদেশী ঘোষণা করে দিল এন আর সি।
সব দেখে শুনে তালিকা প্রকাশের দিনেই তার কপি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। বিক্ষোভ মিছিল করেছে এ বি ভি পি। এন আর সি-র বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, রঞ্জিত কুমার দাসের মতো বিজেপি নেতারা। হাজেলার বাপান্ত করেছেন এমন ধর্ম নিরপেক্ষ আর ভুলে ভরা তালিকা বানানোর জন্য।
এত সবের পরেও বিজেপি কিন্তু সমানে হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছে সারা দেশে এন আর সি লাগু হবে। তাতেই তো ভাইরাসের মত লাগছে এন আর সি কে। আর ওরাই যেন তার বাহক।
তাহলে রহস্যটা কি। অসমে এন আর সি তে মুখ পুড়িয়েও এই আচরণ! এদিকে সামাল দেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পুনরুত্থাপনের কথা বলছে। যা কিনা আবার নতুন সংকট ডেকে আনার হুমকি দিচ্ছে। কারণ এই বিল পাশ হয়ে গেলে পাকিস্তান আফগানিস্তান আর বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুরা ভারতে সাত বছর থাকলেই নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। একই সুবিধা পাবেন শিখ খ্রীস্টান বৌদ্ধ জৈন আর পারসিরা। বাদ শুধু মুসলমান।
স্বাভাবিক ভাবেই এই বিল উত্তর পূর্বাঞ্চলের কোনো রাজ্যই মানতে চাইবে না। কারণ এতে তাদের ৩৭১ ধারায় প্রাপ্য সুবিধা খর্ব হবে৷ অনুপ্রবেশ বেড়ে যাবে। হয়তো অনুপ্রবেশকারীর ধর্ম বদলে যাবে। কিন্তু জাত বদলাবে না। জাত ধর্মের এই রাজনীতিতে জাত আর ধর্মের সূক্ষ্ম অসমীকরণটা বিজেপি হয়তো আগে খেয়াল করেনি। যেমন ঘটেছিল সেই ১৯৮৩ তেই। নেল্লিতে ছ’ ঘন্টায় ২১৯১ জন বাঙালি মুসলমান নিধনের পাঁচ দিন পরেই খৈরাবাড়িতে এক রাতে শ’ পাঁচেক বাঙালি হিন্দু খুন হয়েছিল। তখন অসমের আর এস এস বিভ্রান্ত হয়ে ভেবেছিল হিন্দু কেন হিন্দুকে মারছে! তারা বুঝতেই পারে নি অসমীয়ারা ধর্মের লড়াই লড়ছে না। লড়ছে জাতের লড়াই। সঙ্গে ভাষা। সেই বিভ্রান্তি আর এস এস আর বিজেপি এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে। নাহলে এন আর সি-র ঘায়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পুলটিস দেওয়ার কথা ভাবত না।
এখন প্রশ্ন হল মুসলমানকে বাদ দেওয়ার অপচেষ্টা অসমে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা সারা দেশে এন আর সি-র পক্ষে সওয়াল করে যাচ্ছে? আবার একই সঙ্গে কেনই বা বলে যাচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনার কথা! এই বিল পাশ হলে তো এন আর সি ব্যাপারটাই অর্থহীন হয়ে পড়বে।
হয়তো তাদের ইচ্ছে আসলে এন আর সি কে একটা ধর্মীয় উদ্যোগ করে তোলা যা একমাত্র মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
তবে কিনা এমন কথাও শোনা যাচ্ছে বিজেপি আসলে এন আর সি বন্ধ করতেই চায়। বদলে লাগু করতে চায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। কিন্তু গোড়ায় এত সমর্থন দিয়ে এখন ফট করে প্রজেক্ট বাতিল বললে কেমন দেখায়। তাই তারা ইচ্ছে করেই এন আর সি ভাইরাসের ভয় দেশবাসীর মনে ঢোকাচ্ছে যাতে দেশ জুড়ে একটা গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে এন আর সি-র বিরুদ্ধে। আর তারা জনমতকে লোক দেখানো সম্মান জানিয়ে বাতিল ঘোষণা করতে পারে এন আর সি কে। আর কৌশলে বাঁচাতে পারে একূল ওকূল দু’কূল।