আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন – সৌম্য শাহীন, মৃন্ময় সেনগুপ্ত
গত ৫ই এপ্রিল, বুধবার রাজধানী দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী, সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক ও কর্পোরেটবান্ধব নীতিসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রামী শ্রমিক-কর্মচারী-কৃষক-ক্ষেতমজুরদের ডাকে এক বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জমায়েত হওয়া লক্ষাধিক খেটে খাওয়া মানুষের সুশৃঙ্খল মিছিল থেকে মুহুর্মুহু ডাক উঠল—‘মোদী হঠাও, দেশ বাঁচাও’। এর আগেও আমরা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলনের সময়ে দেখেছি যে দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে ফ্যাসিস্ট সরকারকেও তাদের আগ্রাসী নীতিকে বাস্তবায়িত করার বদলে দু পা পিছনে ফেলতে হয়। বর্তমানে সারা দেশজুড়ে নির্বাচনী রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিরোধী দল যখন বিজেপি-বিরোধী জোটের প্রশ্নে কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে, তখন গণআন্দোলনের এই সাফল্য সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত ও মসৃণ করবে।
প্রসঙ্গত, অখিল ভারতীয় কিষাণ সভার নেতৃত্বে কৃষিঋণ মুকুব, পেঁয়াজ সহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য সহ মোট ১৫ দফা দাবি নিয়ে গত ১২ই মার্চ মহারাষ্ট্রের দিন্দোরি থেকে নাসিকের উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল লাল ঝান্ডা কাঁধে ১০,০০০ কৃষকের লং মার্চ। তাঁদের অধিকাংশ দাবি মহারাষ্ট্র সরকার লিখিতভাবে মেনে নেওয়ায় ছয় দিন পরে থানে জেলার ভাসিন্দে শেষ হয় কৃষকদের এই যাত্রা। ততদিনে যাত্রায় যুক্ত হয়েছেন প্রায় ১৫,০০০ কৃষক। পেঁয়াজের দামে কুইন্টাল প্রতি ৩৫০ টাকা সহায়ক মূল্য ঘোষণা করতে বাধ্য হয় মহারাষ্ট্র সরকার। প্রসঙ্গত, অতি ফলনের জন্য পেঁয়াজের দাম ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় রক্ত-ঘামের বিনিময়ে ফলানো ফসল পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছিলেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা; ফলে সরকারের থেকে এই দাবি আদায় করার মাধ্যমে নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে এক পা হলেও এগোনো গেল। বিগত কয়েক বছর ধরেই টানা চাষে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের। কৃষিতে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কার্যত অমিল। তার ওপর ক্রমাগত সারের দামের ওপর থেকে সরকার ভর্তুকি তুলে নেওয়ার ফলে চাষের ক্রমবর্ধমান খরচ জোগাতে স্থানীয় মহাজন, মাইক্রো ফিন্যান্স সংস্থা ইত্যাদির কাছে চড়া সুদে চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। ঋণের ফাঁসে ক্রমাগত জড়িয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া তীব্র মানসিক অবসাদ এঁদের অনেককেই ঠেলে দিচ্ছে আত্মহত্যার পথে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২১ সালে ১,৬৪,০৩৩ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এদের অধিকাংশই ঋণের জালে জড়িয়ে নিজের হাতে নিজের জীবন শেষ করেছেন, গড়ে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় বারোজন মানুষ আত্মহত্যার শিকার। কোনো অতিমারীর থেকে এই সামাজিক অসুখ কম বিপজ্জনক নয়। সংখ্যতাত্ত্বিকভাবে এটা সরকারের দেওয়া হিসেব, বেসরকারি মতে সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি। বাকিরা কোনোমতে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছেন, বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজের জমি জায়গা বাসস্থান ছেড়ে দিনমজুরের কাজ নিতে বাধ্য হচ্ছেন ভিন রাজ্যে।
এই প্রসঙ্গে আমাদের ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে অধিকাংশ চাষিই রাজ্য সরকারের কৃষকবন্ধু, কেন্দ্রীয় সরকারের কিষাণ নিধির মতো প্রকল্পের সুযোগ পাচ্ছেন না। নিয়ম অনুযায়ী সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেতে গেলে চাষের জমির বৈধ পরচা, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ও নিজের নামে ‘আপডেট’ করা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। ভাগচাষিকে সে সুবিধা পেতে হলে, পরচায় তাঁর নামের উল্লেখ থাকতে হবে। সেখানে কী চুক্তিতে ভাগ চাষ হচ্ছে, তার উল্লেখও থাকতে হবে। অভিযোগ উঠেছে যে বর্তমানে জমির মালিকদের একটা বড়ো অংশ ভাগচাষিদের বৈধ নথিপত্র দেন না। চাষ হয় মৌখিক চুক্তিতে। সেই কারণে ভাগচাষিদের একটা বড়ো অংশ ওইসব প্রকল্পের সুবিধার বাইরে থাকেন। জমি-মালিকদের একাংশও আবার ঠিকঠাক পরচা না থাকায় প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একই কথা প্রযোজ্য শস্য বিমা বা কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রেও। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির ক্ষেত্রে অনেকসময় বর্তমান প্রজন্মের কৃষক পর্চায় নাম পরিবর্তন করতে পারেন না। শিক্ষার অভাব, নিয়মকানুন সম্বন্ধে অজ্ঞতা, পঞ্চায়েতের অসহযোগিতা ও সর্বোপরি সরকারি দফতরে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বহু চাষির কাছেই তাই জমির যথাযথ নথি নেই। ফলে তাঁরা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পান না। কিন্তু নথি থাকলেও বহু প্রান্তিক চাষি অপেক্ষাকৃত কম দামে অভাবী বিক্রয় করতে বাধ্য হন। অনেক ক্ষেত্রে ভাগচাষি জমির মালিক বা মহাজনের কাছে ধান বিক্রি করতে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ থাকেন। ফলে এ রাজ্যেও কৃষকের পিঠ ক্রমে দেওয়ালে গিয়ে ঠেকেছে।
এবছর আলু চাষেও সেই সঙ্কট। হুগলী জেলার খানাকুল ১ ব্লকে ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া চাষের খরচের হিসেব:
জ্যোতি আলু চাষে বিঘা প্রতি গড় খরচ:
সামগ্রী | দাম |
---|---|
বীজ | ৪২০০ টাকা |
সার ১০ঃ২৬ঃ২৬ ( বস্তায় দাম ১৭০০ থেকে ২৩০০ টাকা, এমআরপির থেকে অনেক বেশি, গড় ২০০০ টাকা বস্তা ধরে) | ৬০০০ টাকা |
ইউরিয়া | ৪০০ টাকা |
অনুখাদ্য ও অন্যান্য | ৩০০০ টাকা |
মোট সারের খরচ | ৯৪০০ টাকা |
সেচ | ১৪০০ টাকা |
ট্রাক্টর | ২০০০ টাকা |
মজুরি | ৭০০০ টাকা |
মোট | ২৪০০০ টাকা |
চন্দ্রমুখীতে বিঘে প্রতি ৩০০০-৪০০০ টাকা বেশি খরচ।
চন্ডীতলা ১ ব্লকে জ্যোতি আলুর ক্ষেত্রে এই খরচ বিঘে প্রতি ৩২০০০ টাকার বেশি।
এবার গড় ফলন বিঘেতে ৬০-৭০ বস্তা (৫০ কেজিতে এক বস্তা)।
এর ওপর রয়েছে ঋণে সুদের হার। সরকারি প্রকল্পে ঋণ না পেলে সুদের হার মারাত্মক বেশি। সাধারণত মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানির থেকে ধার নিলে ২০% এর বেশি। মহাজনের থেকে নিলে ৩০% এর বেশি। ভাগ, চুক্তি, লিজ চাষিদের বাড়তি খরচ।
নিজের জমিতে চাষ করলে, সরকারি ঋণ পেলেও খানাকুলে জ্যোতি আলুতে খরচ বস্তা পিছু গড়ে ৪০০ টাকার বেশি। চন্ডীতলায় ৫০০ টাকার বেশি। চন্দ্রমুখীতে কমপক্ষে লেগেছে আরও ৫০ টাকা। অন্যের জমিতে চাষ করলে স্বাভাবিক ভাবেই খরচ আরও বেশি। যেমন ধরা যাক, ভাগ চাষির বিঘে প্রতি ফলন হয়েছে ৬০ বস্তা। এক চতুর্থাংশ ভাগে জমির মালিককে দিতে হলে হাতে থাকবে মাত্র ৪৫ বস্তা। জমি লিজ নিলে বহন করতে হয় বাড়তি খরচ। নিজের জমি না থাকায় উচ্চ সুদের হারে ঋণ নিতে হয়।
গত কয়েকদিন যাবৎ অকালবর্ষণের ফলে এখন যেসব কৃষক ইতিমধ্যেই খেত থেকে আলু তুলে নিয়ে কোল্ডস্টোরেজজাত করতে পেরেছেন, তাঁরা বস্তা প্রতি জ্যোতি আলুর দাম পাচ্ছেন ৭০০ টাকার আশেপাশে। কারণ বাজারে আলুর জোগান কমে গেছে, ফলে চাহিদাজনিত কারণে আলুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। চন্দ্রমুখীর ক্ষেত্রে কমবেশি বস্তাপিছু দাম আরও শ-খানেক টাকা বেশি। অপরদিকে, যাঁরা ইতিমধ্যে আলু গুদামজাত করতে পারেননি, অকাল বৃষ্টি তাঁদের জন্য অভিশাপ ডেকে এনেছে। এমনিতেই এবছর বিঘে প্রতি গড় উৎপাদন কম হলেও মোট যে জমিতে আলুচাষ হয়েছে, তা অন্যান্য বছরের থেকে অনেকটাই বেশি। ফলে বাজারে মোট জোগান বেড়েছে, অতএব অতি উৎপাদনের ফলে আলুর দাম হ্রাস পেয়েছে। ফলে ব্যক্তি কৃষক উৎপাদন করেছেন কম, একইসাথে দাম পেয়েছেন কম। অথচ খরচ ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। সরকার ক্রমাগত সারের ওপর থেকে ভর্তুকি কমাচ্ছে, চাষের অন্যান্য খরচও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এমনকি নিজের জমি থাকলেও লোকসান হচ্ছে। ভাগ, চুক্তি, লিজ চাষির ক্ষেত্রে লোকসানের পরিমাণ লাগামছাড়া। কিছুদিন আগেই কৃষক আরও কম দাম পেয়েছেন (বস্তাপ্রতি ৫০০ টাকার আশেপাশে)। অকালবর্ষণ বন্ধ হলেই দাম আবারও আগের জায়গায় স্থিত হবে। আসলে, আলুর দাম শেয়ার বাজারের মতোই অনিশ্চিত। আড়তদার, হিমঘরের মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। অতএব আলুকে কেন্দ্র করে চলে ফাটকা কারবার। কৃষক, ক্রেতা দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই বছর বিঘে প্রতি ফলন অনেক কম হলেও, বেশি পরিমাণ জমিতে চাষ হওয়ায় মোট ফলন কমেনি। ফলে দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। বস্তুত, আলুচাষ পুরোপুরি বাজারের নিয়ন্ত্রণে। ফড়ে, মহাজন, আড়তদার, হিমঘরের মালিকদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। মজার কথা, এ বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকার আলুতে সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে। পরিমাণে যা বাজারদরের থেকেও অনেক কম- কুইন্টাল পিছু সাতশো টাকা মাত্র। কার্যত স্বামীনাথন কমিশন রিপোর্টের প্রস্তাবকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হয়েছে, অন্যদিকে আলু চাষের খরচ ও দাম সম্পর্কে অজ্ঞ জনগণের কাছে কৃষক দরদি মনোভাবের বিজ্ঞাপন করা গেছে। সবটাই ভোটের হিসেবকে মাথায় রেখে।
রাষ্ট্রীয় অবহেলা ছাড়াও এ-কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে জলবায়ুর পরিবর্তনে অকাল নিম্নচাপ হলে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর ফলে ক্রমশ ধ্বসে যাবে কৃষি অর্থনীতি, তীব্র হবে খাদ্য সংকট। সরকারের তরফে স্থায়ী সমাধানের পরিকল্পনা নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে হয়তো কিছু ক্ষতিপূরণ ঘোষণা হবে, চলবে তা নিয়ে সরকারি তথা শাসক দলের প্রচার। কিন্তু ক্ষতিপূরণ কারা পাবেন? জমির মালিক, ভাগচাষীরা নন। সরকারি নানা প্রকল্পে বড়ো জোতের মালিকের উপকার, এমনকি নিজে চাষ যদি নাও করেন, তাও সরকারি সাহায্য মেলে। ভাগচাষী, ক্ষুদ্রচাষীদের সমস্যা মেটে না।
ব্যাঙ্কে নানা প্রকল্পের কথা বলা হলেও গরিব চাষিদের কাজে সেসব আসে না। ঝোপ বুজে কোপ মারছে মাইক্রোফিনান্সের কারবারিরা। কৃষির সর্বনাশে ওদের পৌষমাস। জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশের অবনতি এভাবেই সর্বনাশ ডেকে আনতে চলেছে। সম্প্রতি আমরা উত্তর ভারতের কৃষি আন্দোলনের প্রভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে পিছু হটতে দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলনের প্রভাব ছিল সীমিত। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও এ রাজ্যের কৃষি সংকট নিয়ে তুলনামূলকভাবে নিশ্চুপ। এই পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের আন্দোলনের রেশ ধরে বাংলার কৃষক সংগঠনগুলোকে ছোট চাষি, ভাগচাষি ও ভূমিহীন কৃষকদের সমস্যা নিয়ে ব্যাপক আন্দোলনে নামতে হবে এবং জনমত গঠন করতে হবে। এই কাজে তাঁরা কতটা সফল হবেন, তার দিকেই তাকিয়ে আজ বাংলার কৃষিসমাজ।
লেখক: সৌম্য শাহীন (অর্থনীতির অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়) এবং
মৃন্ময় সেনগুপ্ত (সমাজকর্মী)