দুটি দীর্ঘ কবিতা – অর্ণব রায়

শেয়ার করুন

এ ক্লিন ডেথ

  তারপর এক দুঃখ শেষ হইতে না হইতে অপর দুঃখ আসিলসে বুঝিল জগতে ঢেউ কাহাকে বলে। বা জগৎরূপী ঢেউ সে বুঝিলতাহার আতঙ্কের সম্মুখে দ্বিপ্রহরের ন্যায় মুখব্যাদান করিয়া সে গর্জন করিল, ‘চোপ্‌, চিৎকার করলে জ্যান্ত তুলে নিয়ে যাবো’। তখন তাহার পেছনে আরও তিন-চার লাইনের সেনা ছিল। আবছা অন্ধকার বলে তাদের পড়া যাচ্ছিল না। অবয়ব বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু স্বরূপ উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। তখন তার স্বপ্নের প্রতিটি কণা ভাষাময়। প্রতিটি আসবাবের অনু কথা বলতে পারে। আমরা সেই অনুবাদের কিছুটা এখানে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। রাস্তায় আসতে আসতে ইহাদের হাত পা খসিয়া গিয়াছে। কিছু বা বামনাবতার নিয়াছেন। তাহাদের জন্য কেহ দায়ী নহে। যেমন, আমাদের মৃত্যুর জন্য সমগ্র জড়প্রকৃতির আলো হাওয়া স্বপ্ন চৈতন্য মরমানুষ কেহ কোথাও দায়ী থাকেন না। 

জাগো, চারটি বৃষের কাঁধে সকাল এসেছে
জাগো, কালকের ভার আবার বইতে হবে
জাগো, আরও বহুবার ভূল করতে হবে
জাগো, এ প্রকৃতি সত্যি নয়, এ ইন্দ্রিয়জগৎ সত্যি নয়
যা ঘটছে, তা সত্যি নয় কিছুতেই

  বেশ, তবে এই জগতকে যা ভেবে এসেছিলাম, তা নয়। এখানে পয়া-অপয়া আছে। শালিখ-বেড়াল-টিকটিকি, আছে। দূরের দূরের উদাসীন সব বোবা গ্রহদের তারাদের নিজের মনে একটাই স্থির পথ ধরে ঘোরাঘুরি, তারও আমারই জীবনের ওপর একান্ত ছায়া বা ছায়ার চেয়েও স্পষ্ট কিছু টান বা প্রভাব রয়ে গেছে। করতলের ভাঁজগুলি আমারই চলার পথ, আমারই হৃদয়ের ওঠাপড়া। আমারই জীবনের সুদূর ও অদূর। 

  অন্ধপৃথিবীতে এতদিন চোখবুঁজে দুহাতে লিকলিকে তলোয়ার চালিয়েছি। মুহূর্তমাত্র যে কথার আয়ু, তারই বিদ্যুতের ল্যাজের দাগের আঁচড় বুকে নিয়ে এতটা আয়ু কেটে গেল। অন্ধকার আকাশের গায়ে যে দাগ, ক্ষণিকের হলেও কি বিপুল চমকায়! যেন আকাশ এক বিজ্ঞান নির্মিত পর্দা আর তার ওপারেই আলোর এক অপার জগত রয়েছে। 

নেই, জীবন এক স্থির ঘুনঘুনে গানের মত ক্রমান্বয় কিছু।
নেই, এখানে যুদ্ধের গৌরব কিছুমাত্র নেই।
নেই, নক্ষত্রদের পাদদেশে কোনও বসবার জায়গা রাখা নেই।
ওই নভোমন্ডলের চামড়া তুলে, হাড়-মাংস-মজ্জা খুলে
কাহারও শান্তিময় পদতলের চিহ্নমাত্র নাই।

এই যে রেলের দুখানা লাইন, চলছে চলছে
কখন যে তারই পাশ ধরে ধরে আমিও চলছি চলছি
চিন্তার ভারে মাথা যদি কাত হয়েই আসে
যেকোনও একধারে নিঃসাড়ে ঢলে পড়ে
আর তখনই কোম্পানির ধাতুর রেল আসে ঝমাঝম ঝমাঝম
তার গায়ে সকালের রোদ পড়ে চকচক করে
দিগবিদিক শব্দে ঢেকে যায় আর
কেউ আমাদের দেখতে পায় না,
আমি আর আমার দুশ্চিন্তা
আমি আর ঝমঝমে রেলগাড়ি
মাথা আর শরীর চিন্তার ভার
যদি সময়বুঝে একদিকে ঢলেই পড়ে

অথবা অন্যদিকে ঢলে গেল মাথা,
সে যে কি মধুর বিস্মরণ কিংবা
সারাক্ষণ যন্ত্রণা,
শরীরবোধ নেই
আলো ও তাপের বোধ নেই
পোশাক তো দূরের কথা
রাস্তার পিচ আর ধুলো চাখতে চাখতে হাঁটে
মানুষ গরুতে ভেদ নাই
মানুষ ও গরুর খাবারে ভেদ নাই আর—

যেন লিখিত অক্ষর খাতা থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরবে
যেন বিকেলের কাত হওয়া আলো মাথার ঘায়ে ঠান্ডা পটির মত পড়বে
যেন পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে আছে সেই ভাষা যাতে
কারা যেন মধুর আত্মীয়, পাশে বসিয়ে কথা বলতো,
যেন, অন্য কোনও জন্মের প্রিয়া
দূরের নক্ষত্রের সুতোর টানে এই মরজন্মে এসে পড়েছে,
যেন আমি নয় আমি নয়, এ জন্মের পথে
ঢিলে খোল পরে কেউ হাঁটছে, কথা বলছে হাসছে
আর কাজের নামে কী সব এবড়ো খেবড়ো শূন্য জড়ো করছে

এ লেখা আমার ভাষা নয়                                                                       এ লেখায় আমার শ্বাস নেই

কালো আকাশের গায়ে সন্ধ্যাকালে একটি সাদা প্যাঁচা পূর্ণ ডানা মেলে উড়ে গেল। আহা, সুকল্যান সুকল্যান যেন দুডানা মেলে উড়ে গেল পৃথিবীর কালো মাঠের সব কালো মাঠের ওপর দিয়ে। পৃথিবীর সন্ধ্যা যেখানে কালো, প্রতিটি ঘাসের আগাগোড়া যেখানে রক্ত দিয়ে ধুয়ে সবুজ আশ্বাস কালো কালো তেতো ধাতব অন্ধকার রূপ নিয়েছে। সাদা সে প্যাঁচার ওড়ার ধ্বনি এ জগতে হয় না। প্যাঁচার সাদা ওড়বার ধ্বনি অন্য জগতে আলোড়িত হয়। রাতের বাতাসে একজোড়া কুকুর নীরবে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলে। এ ওর মুখে মুখে কামড়ে কামড়ে বারবার খেলে। 

একটি সুষম মৃত্যু আমাদের প্রাপ্য
দেহের জন্য একটি সাদা পরিপূর্ণ নিভাঁজ চাদর
মনের জন্য দু-চারিটি অশ্রুজল
আত্মা বিশাল পক্ষী
তার ওড়বার গতিপথ ভাববার স্পর্ধা আমাদের নাই

ক্রমান্বয়ে লক্ষাধিক স্বর্ণালি বিস্ফোরণে তার জন্ম
জগতের বা জগতাতীত কোনও ভাষায় সেই ক্ষণসম্ভারের রূপ ধরা যায় না
যেন কালো শূণ্যের গায়ে সোনার অজস্র বসে থাকা মূর্তি
গুঁড়ো গুঁড়ো সোনায় ফেটে যাচ্ছে
আবার জোড়া লেগে অপার্থিব কারুকার্যময়
সোনার কপাট বক্ষকবচ তৈরি হচ্ছে
শূন্যের কালো রাজসভায়,
সূর্যের মত কিছু ওঠে কি ওঠে না এ জগতে
ঠিক নেই। নিয়মিত আলো হওয়া
ও সেই আলোর ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়া,
এ জগতে না।
ভয় যদি একটি রঙ হয়,
তৃষ্ণা যদি ঘ্রাণ হয়
— তাহলে এখানকার চারপাশ, আকাশ ও মাটি কিছুটা বোঝানো যায়।

সৎকারস্মৃতি আমাদের তাড়া করছে অথচ প্রকৃত সৎকারে সেভাবে দুঃখ টুঃখ ছিল না
প্রকৃত সৎকারে কিছুটা বিরক্তি শীত ঘিনঘিনে কাদা খাল মদ ও হাতি পেয়ে লুচি,
প্রকৃত সৎকারের স্মৃতি আসলে আর তাড়াও করে না,
বরং আমরা যাদের প্রতিদিন জীবন্ত পোড়াচ্ছি
একটু একটু করে ভুলে গিয়ে অনেক অনেক করে পোড়াচ্ছি
বৃদ্ধ হাতের থেকে জল না নিয়ে বৃদ্ধা হাতের থেকে কাঁপুনি না নিয়ে
প্রতিদিন তাদের থেকে দূরে থেকে
এক আধবার ফোন করে, অনেকখানি করে পোড়াচ্ছি।
প্রকৃত সৎকার, একবিন্দু আগুন, নিভাঁজ সাদা শেষবস্ত্রখানি
ছুঁয়ে বসে থাকা, তুলে নেওয়া, চুল্লিতে টেনে নেওয়া
নিম লোহা স্নান শোক
কবে যেন কবে যেন, নিজে নিজে, এইসব আবছা জীবন্ত কেঁপে যাওয়া মানুষের পাশে গিয়ে
চুপ করে বসে পড়েছে,
একা মানুষের সাথে একা একা অল্প অল্প পুড়ছে

সিনেস্থেশিয়া 

চিন্তা আয়ুকে খায়, আয়ু খায় সম্পর্কের মজ্জা।
সামান্য শরীর
এত এত ভার নিতে পারে!
ঝুঁকে আসতে আসতে পুরুষমানুষ
ঝুঁকে ঝুঁকেই মরে যায়,
কাঁচা বাঁশের মাচাতেও তাকে সাট করে শোয়ানো যায় না,
যাতে চিন্তা ছেড়ে পালিয়ে না যায়— তাকে বেঁধে রাখা হয়
যাতে তার বিড়বিড়োনি আর পাঁচজনের কানে গিয়ে অনত্থ না বাঁধায়— চতুর্দিকে হরিধ্বনি পড়ে,
লগা করে ঠেলে আগুনের মুখে ধাক্কিয়ে গুঁজে
তাকে নয়, তার চিন্তার অবশেষ পোড়ানোর চেষ্টা চলে,
কলসে নাভির সাথে সেগুলি জলে গিয়ে পড়ে,
ভেসে ভেসে এই পাড়ে আসে


আগুনের মূল্য দিতে দিতে যে জীবন আগুনে গেল
তৃষ্ণার মূল্য দিতে দিতে গেল মরুর আশ্রয়ে,
বেঁচে থাকা এক বৃত্ত মনে করে তাকে সম্পুর্ণ করার চেষ্টায়
গোনাগাঁথা শ্বাসকয়টা বয়ে গেল—

বিভুতিভূষণ হাঁটতে বেরিয়ে পাহাড়ের বাঁকে
নিজের মৃতদেহের মুখ দেখলেন,
তার কিছুদিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হল, না হলে আমরা ভাবতাম
বৃত্তটি যথাযথ গোল হল না,
আমরা মনে মনে হলেও চাইছি
সমস্ত মৃত্যুর ভবিষ্যৎবানী সত্যি হোক


মরা মানুষের মুখ দেখবার জন্য এত ভীড় কেন?
মরা মানুষের মুখ মনে রাখবার জন্য এত হুড়োহুড়ি কেন?
সকলে যখন সংসার গুছিয়ে নিচ্ছে, আমরা মরার খাট সাজাচ্ছি।
আমাদের সংগীত সর্বনাশধ্বনি, আমাদের আলো বজ্রপাত,
রাতের নিঃশ্বাস আমাদের গায়ে লেগে লেগে গাত্রবর্ণ কালো
দেখে মনে হবে, একত্র বসবাসের ক্লান্তিতে পুড়ে গেছি দুজনেই

আকাশ থেকে দেবতারা জ্বলতে জ্বলতে পড়ে যাচ্ছেন,
মাটি ফাটছে আর তলা থেকে আগুন লাভা জল, কিচ্ছুটি না,
গলগল করে কোটি কোটি মুখ বেরিয়ে আসছে,
কল্পনার অভাবে সেসব মুখে কোনও রূপ নেই
বাস্তবের চাপে সে সব মুখ ছাই রঙের হয়ে গেছে,
পৃথিবীর পিঠে কে কবে স্থিরভাবে বসবাস করেছে!

দূরে একটি বাড়িতে যেন কেউ জেগে আছে
তারই মায়ায় পুড়তে পুড়তে
চার ষোল চৌষট্টি তীর্থ হাঁটা হয়ে গেল,
খাওয়া দাওয়ার গল্পে শাড়ি কাপড়ের গল্পে
সন্ধ্যের ওপর ঘুম নামল,
জরুরী কাগজ ভাঁজ করে মানিব্যাগে রাখতে রাখতে শোয়া,
অর্ধেক গোছানো ব্যাগ পায়ের কাছে শীতল হাঁ-এর মত জেগে আছে,
বাড়ি ফেরার সময় কাল দুখানি জ্যান্ত নক্ষত্র কিনে আনতে হবে

মরা মানুষদের নিয়ে এ আমাদের কোন ব্রত!
যেন এই পৃথিবীর যাত্রাপথ এই আমাদের শেষ নয়
যেন পাতা মুড়ে রেখে যাওয়া বই
ফাঁসিটুকু গলায় পরে এসে আবার খুলে ঠিক
সেইখান থেকে শুরু করা যাবে,
যেন এইবার একটুখানি মরে যাই
কিছুদিন বই তো নয়
পরের বার সব ভুলচুক শুধরে নেওয়া যাবে খন—

সুধা আসলে শ্রাব্য।
নক্ষত্র গলে গলে যে রূপোলী সুর
মানুষের কানের সীমার বাইরে বাইরে নামে,
যে কোনও বাদ্যযন্ত্র তাকে ধারণ করতে পেলে ধন্য হয়ে যাবে,
যে কোনও মরমানব তার স্বরলিপি রচতে পারলে
তার জন্মচক্র বন্ধ হয়ে যাবে,
সে সুর ধরা দেবে না বলে মানুষের শ্রবণসীমা সীমিত,
তাকে বাক্যে ধরা যাবে না বলে ভাষায় ভাষায় এত বিভেদ

পৃথিবীর সব জানালা খোলা হয়ে গেলেও
কোনও কোনও প্রাণে কখনোই হাওয়া ঢোকে না,
এত আলো এত আলোয় ভেসেও তারা ভর সকালে
অন্ধকার নামিয়ে আনতে সক্ষম,
এসব শ্রাব্য সুধা তাদেরও প্রাণের পাশ দিয়ে বয়ে যায়,
চিন্তায় ক্ষয়ে যেতে যেতে তারা
আশঙ্কায় নিভে যেতে যেতে তারা
আতঙ্কে কাঁটা হতে হতে তারা—
এইসব সুর-ফুর, আলো-টালো, পাখি-টাখি মাড়িয়ে
ঘাড় ডাঁটো করে গট্‌গট্‌ কোনদিকে যেন এগিয়ে চলে যায়


যা দেবতাদের বস্তু, তা মানুষের হাতে এসে গেছে।
কিছু কিছু হাতিয়ার এমনকি আকাশ থেকে দেবতাদের পেড়ে আনতে সক্ষম।
নেহাত পরিবার নামক দুর্বলতাটি বহাল রয়েছে
তাই মানুষ মানুষ থেকে গেল।
প্রতিবার কথা বলার সাথে সাথে তাদের মুখমন্ডল থেকে
অল্প অল্প আলো কমে যায়,
মানুষের দেবত্ব ক্ষয়ে আসে, দেবতাদের মানুষলক্ষণ ফুটে ওঠে

কারা মরুর দেশে আলো হাতে নিয়ে হেঁটে গেল?
দূর থেকে তাদের জোব্বার আলো-আঁধার নড়ে,
দেহের দুর্বল অংশ যেমন বারবার ব্যথা পায়
উহাদের হেঁটে যাওয়াতেও অনুরূপ বেদনার সাক্ষর—
কে ওঁদের নাম স্থির করে?
কে ওঁদের হাত থেকে আলোটুকু নেয়?

যা দেবতাদের বস্তু, মানুষের হাতে এসে
আলো হয়ে যায়, সমস্ত ঐশী বিভার
মানুষের ভালোমন্দের ভার, বিপুল ক্রোধ ঈর্ষা
দিগ্বিজয়ী কাম, ইচ্ছার হেরফের
মানুষের হাতে এসে একটি লন্ঠনের স্থির শিখায়
উন্মুখ বদ্ধ সীমায়ত হয়ে পড়ে

  ট্রয় নগরীতে এনে রাখা বহুশ্রুত কাঠের ঘোড়াটির পশ্চাতে রয়েছে জঙ্গলের ইতিহাস। ঢ্যাঙা রোগা বেঁটে গাছেরা কি যুদ্ধের ধারণা করতে পারে? বিশ্বাস ও অন্তর্ঘাত। পেটের ভেতরে অসহ্য হিংসা নিয়ে কোনও অশ্ব কি নিজের জ্বলে যাওয়া আন্দাজ করতে পারে? গাছ থেকে কাঠ, কাঠ থেকে সুচতুর ঘোড়া হতে অভিনয়ের যতগুলি স্তর পার হতে হয়, মানুষ সংসর্গের শিক্ষা সেটুকুই। 

  সেই উৎসবের রাতে পাড়ায় পাড়ায় বর্ণমালা জ্বলছে। বাড়িতে বাড়িতে নিজের মুন্ডু ছিঁড়ে উল্লাস। সম্পর্কগুলি এতদিনের চেষ্টায় নিজেদের বুঝতে না পেরে অগনন সাপের বাচ্চা হয়ে কিলবিলিয়ে দলা পাকিয়ে বাস্তুটিকে গিলে নিচ্ছে। রাতের আকাশে আলোর অভাব নেই। দেবতাদের পদতল পুড়ে যাচ্ছে। 

  সাপ ও ঘোড়ার কাহিনীতে, গাছ ও ক্রুরতার কাহিনীতে মধ্যবিন্দু নারীটি বহুদিন হল রাজ্যের প্রজাদের আবাসের দিকে মুখ করে থাকা অলস ব্যালকনি থেকে পশ্চাদপটে সরে গেছেন। এই বীর্যবান কাহিনীতে তার আর কোনও স্থান নেই। সরে যেতে যেতে বোধকরি তিনি সেইসব গাছেদের বনে চলে গেছেন, যাদের ভাই-বোন-স্ত্রী-প্রণয়ী-সন্তান-বৃদ্ধা মাতাদের কেটে এনে এই ইতিহাসের খেলনা ঘোড়াটি বানানো হয়েছে। সরল পাড়ার ছেলেটি যেন শহরের প্যাঁচে পড়ে গেছে, এইভাবে অজানা বনের গাছগুলি তাকে বলেছিল—

  মানুষের প্রাণ যেরকম, গাছেদের প্রাণ সেরকম চট করে যায় না। গাছের প্রাণ দীর্ঘ। সম্পুর্ণ শেষ করতে গেলে এত বুলেট খরচ হবে, কোনও দপ্তরই তার হিসেব মেলাতে পারবে না। আর তাছাড়াও, কেটে-ছিলে-ফেঁড়ে, ঘোড়া-হাতি-খেলনা-আসবাব বানিয়ে, এমনকি পুড়িয়ে, কয়লা-উনুন-শেষে ছাই- কণা কণা প্রাণ, তবু থেকে যাবে, হাওয়ায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। হত্যা বস্তুত মানুষের, মৃত্যু মানুষেরই দুর্বলতা। 

দেখতে দেখতে জীব ও জড়ের ভেদ মিটে যাচ্ছে—
উৎক্ষেপন সফল হলে মানুষের সমবেত ইচ্ছেগুলি
এক-দুই-তিন-চার-একশত- শত হাজার
পৃথিবীতে ফেরার জন্য রোজ রাতে মাথা কোটে,
বাধ্য উপগ্রহদের সাথে শূন্যপথে
একবার করে পাক খায়,
এছাড়া—
মানুষের ভালোবাসা চেয়ে আবেদন করে বসে আছে বহু গ্রহ,
আকাশ পাখি চেয়ে, অন্ততঃ একটি দুটি লাট খাওয়া ঘুড়ি চেয়ে চেয়ে
ক্লান্ত হয়ে গেছে বেশ কিছু নীহারিকা, জল খুঁজে বেড়াচ্ছে
কয়েকটি তৃষ্ণার্ত শিশু ধুমকেতু,
যার যা পাওনা আছে পরিচ্ছন্ন মিটিয়ে পৃথিবী
নিজ কক্ষপথ, বনবন ঘোরা, দিন রাতের টান ফেলে রেখে
যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে।
মন্ত্রচ্চারণের মত কোনও পংক্তি আউড়েই
তখন আর তাকে ফেরত আনা যাবে না।

 দিনমানে যত শব্দ, কন্ঠস্বর, শাপ ও ষড়যন্ত্র, রাত হলে নিদ্রার দুয়ারে তারা খলখল খলখল নাচে। তখন তাদের রূপ স্থির থাকে না। ঘনকৃষ্ণ নেই শূন্যতায় বেপরোয়া কিছু আলোকবিন্দু। দৃষ্টি যত খাটো হয়ে আসে, তত তারা জগতমোহনরূপ ধরে। ময়ূরকন্ঠী উত্তরীয় তাদের অঙ্গে। উজ্জ্বল পীত অধোবাস। 

  আনন্দ যন্ত্রণায় তফাত করা যায় না। যা থাকে তা এক ধীরগতির মৃত্যু। অনুরূপ আকাশ যদি কোথাও থাকত, তাহলে ধরে রাখা পুরাতন দমটি একবার ফেলে বাঁচার কথা ভাবা যেত। 

  সকাল হল অথচ আলো এল না। শুধুমাত্র কিছু আওয়াজ ভেসে বেড়াল এলোমেলো কিছুক্ষণ। প্রাণ আসলে এই। 

  প্রেতপ্রাপ্ত কথারা উন্নাসীক গাছেদের জঙ্গলে বহুমুখী ধাক্কা খেয়ে বেড়ায়। অন্তরে প্রাণ না থাকায় তাতে মুখমন্ডলের স্থানে অবয়বশূন্য মানসপিন্ড। পরনে পুরাতন উপমার পোশাক। চুলে বহুজন্মের কৃতি। স্বভাবে পুরুষ বলে তাদের নারীদেহ কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। নারীবেশ ধরলে ভাবে লওন্ডা। 

  শ্রমে ও বিস্ময়ে শব্দদের আচরণ বদলে যাচ্ছে। ভাবনা থেকে উচ্চারণে যেতে যেতে তারা বেঁকে যাচ্ছে। বিকলাঙ্গ কিছু ধ্বনি জগতের মাঝে শ্বাসবায়ু ভর করে এসে পড়ে ভাবছে, কেন এলাম। যেন জনসমক্ষে নগ্ন। যেন প্রধান শো-এর রাতে স্টেজে উঠে মূল চরিত্র আগাগোড়া আচরণ অভিনয় ভুলে গেছে।     

  শব্দের অল্প অল্প বেঁকেচুরে যাওয়াকে প্রথম প্রথম রোগলক্ষণ ধরা হয় না। ক্রমে বাক্যে যখন পূর্বজন্ম পরজন্ম অসম্ভবজন্ম এসে ভর করে, বাক্য আর বাক্য থাকে না, ভাবনার কোমর অবধি ভেঙে যায়, তখন ‘প্রিয়জনদের’ হুঁশ আসে, তখন তারা পা ছড়িয়ে নিজেদের জন্য কাঁদতে বসে।   

ভাবনা দেহকে খায়, দেহে ধরে রোগের মুকুল
এই তো জন্মমাত্র, চোখবুঁজে নাকটিপে ভূল-
টুকু ডিং মেরে পার হয়ে যাওয়া।
আয়ুমাত্রে গ্লানি আর গ্লানিমাত্রে শতপত্রে বিকশিত
একটিমাত্র ধারণার ক্লান্তিনীল যন্ত্রণার ফুল।
নিদ্রা অপরদিকে অতিজাগ্রত রোমশ জন্তু
শতাধিক শ্বদন্ত থেকে টুপিয়ে পড়ছে বর্ণহীন রক্ত,
প্রাকৃতজনে তাকে লোভ বলে ভূল করে,
দেহবদ্ধ প্রাণ তাকেই ভয়ের প্রতিমা বলে ঠাউরে নেয়,
নিজে ভয় পায়, সন্তান সন্ততিকে ভয় পেতে শেখায়

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *