অপূর্বের সংসার — অতনু চট্টোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

(১)

‘মরণোন্মুখতা’ শব্দটা পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল তাঁর বিখ্যাত ‘আত্মকথন’ কবিতায় ব্যবহার করেছিলেন। এর বিপরীত অর্থ খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই মাথায় আসে জীবনউচ্ছ্বাস। এ যে একেবারে জুতসই হল, তা বলা যাবে না। Eros-এর সেই সর্বগ্রাসী তৎপরতা এখানে কোথায়? আর তাছাড়া Eros-এর যৌনাভিমুখ এখানে বুঝিবা পথ হারিয়েছে। যাই হোক, শব্দদুটোর নিহিতার্থে যে আনন্দধারাকে টের পাওয়া যায়, তা যেন আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তির বাইরের কোনো মৌলভাব। যার সাক্ষাৎ মেলে সহসা, দৈবাৎ তা প্রকাশিত হয়।

দৈবাৎ শব্দে দৈবের যে প্রাধান্য তাকে অস্বীকার করে বরং ভাবের প্রাবল্যের দিকে আমি মন দিতে চাই। ধরুন, সিঁড়িতে দাঁড়ানো হিন্দিভাষী লোকটা ফোনে কথা বলছে। সম্ভবত তার স্ত্রীর ক্যানসারে আক্রান্ত জরায়ুটা বাদ দেওয়া হয়েছে, এরকম কিছু কথা। এই দৃশ্য বাদ দিলে, একেবারে O.T- র মুখ থেকে যতদূর চোখ পড়ে সম্পূর্ণ জনমনুষ্যহীন। আমার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে সম্ভাব্য সবরকম দুর্বিপাক মোকাবিলার প্রস্তুতি আর দুটো নাম—যা নিয়ে তখনও মনস্থির করা হয়নি। সময় চলেছে কচ্ছপের গতিতে এবং সেই কূর্মের ছ্যাতলা পড়া পিঠের উপর পৃথিবী যেন হড়কে যাচ্ছে ক্রমাগত। এইসব দুলুনি ও অনিশ্চয়তা ট্রলির কর্কশ শব্দে কেটে যায় ও দেখি O.T- র দরজা খোলে। প্রথমে চোখ, ক্রমশ লিঙ্গ, অন্ডকোষ। এর পরবর্তী কয়েক মুহূর্তে আমার সম্পূর্ণ মনোজগতের উপর যে আচমকা অনুভূতির হামলা টের পাই, তার স্বাদ অচেনা, একেবারে অভূতপূর্ব। এরকম হওয়ার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ সেই মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রথমত, এই ঘটনার উপলক্ষ আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম। প্রথম নয়। যদিও প্রথম জন হওয়ার সময় আমি ছিলাম চাকরিসূত্রে রাজ্যেরও বাইরে, তবু এই অনুভূতিকে পুরোপুরি নতুন বলা যাবে না। দ্বিতীয় কারণটা বেশ জটিল। সন্তানের লিঙ্গের উপর নির্ভর করে উচ্ছ্বাসের তারতম্য নিজের কাছেই অপার বিস্ময়ের। যদি ধরেও নিই, গভীরে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেখা দিয়েছে অতর্কিতে, আমার নিজের ক্ষেত্রেও তা অচেনা উপলব্ধি। আবার এও হতে পারে, সন্তানের মধ্যে নিজের আবছা প্রতিচ্ছবি চোখে পড়ায় স্নায়ুগ্রন্থির এই উৎসব। মহামারীর দীর্ঘ যে সময় পেরিয়ে এলাম আমরা, তার মুখে একাধিক প্রিয়জন বলি হতে দেখার যে বিয়োগ বেদনা, তার মধ্যে এই জন্ম তাজা বাতাসের জেহাদ। সাথেসাথে এ-ও সত্য, নতুনের আগমনে শাশ্বত যে ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়ে, তাকে অগ্রাহ্য করা, ঠেকিয়ে রাখা যায় না। তবে কারণ যাই হোক না কেন, এক নিমেষ কখনও-সখনও এত এত প্রশ্নের মুখে মানুষকে যে দাঁড় করিয়ে দেয়, উপলব্ধির নতুন কত দরজা খুলে দেয়, তা বিস্ময়ের বই-কি। অল্প আয়োজনের এই যে অপার পাওয়া, এই যে জলে পড়া ছায়া দেখে আত্মউন্মোচনের উপলব্ধি, এই বিস্ময় eros থেকে আমাদের ঠেলে দেয় thanatos- এর পথে। এই পরিক্রমায় যে আকস্মিককে আমরা ছুঁলাম, তার দেখা সাধারণত কবিতায় পাওয়া যায়।

বিস্ময় যখন উপলব্ধির দরজা খুলে দেয়, তখন তা গভীর হয়ে ওঠে৷ প্রাচীন শোক তার মধ্যে সঞ্চার করে সমীহ। এই আবহ কবিতার শ্রীবৃদ্ধির সহায়ক। কবিতা তখন মাতৃভাষায় কথা বলে। আমাদের মনে হয় যেন, কলকাতার মতো প্রাচীন শহরের রাস্তায় আমরা মেতে আছি। গলির রচিত অন্ধকারে পথ হারাতে পারি বটে, তবু দেওয়াল থেকে নেমে আসা পুরোনো শিকড়, বাতাসের গন্ধ, আমাদের জন্ম থেকে চেনা। তুলনায় বিস্ময়ের সঙ্গে আনন্দ উচ্ছ্বাসের সম্পর্কটা আপাতভাবে তরল। গভীর দার্শনিক উপলব্ধি ব্যতিরেকে শুধুই কবিতার স্বধর্মে পাঠককে ধরে রাখা কঠিন কাজ। যেহেতু এর রস বিরল প্রকৃতির, ফলত তা সৃষ্টি করাও শ্রমসাধ্য বলে আমার ধারণা। এ ধরনের কবিতা কখনও-সখনও চোখে পড়লেই মনে উত্তেজনা হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অতিপরিচিত একটি কবিতা এই মুহূর্তে উদাহরণ হিসাবে মাথায় আসছে।

‘সারঙ্গ, যদি ঝর্না ফোটাই তুমি আসবে কি তুমি আসবে কি

সন্তর্পণে পল্লব দোলে এত অজস্র বন্ধু হাওয়া

গাছের শিরায় ফেটেছে নূপুর অমন নূপুর জলে ভাসবে কি।

পাহাড়খণ্ড পাহাড়খণ্ড ওর নৃত্যের দোষ নিয়ো না হে।’

এই কবিতাটির চিত্তাকর্ষক দিক অন্তত আমার কাছে এর অল্প আয়োজন এবং অবশ্যই বিরাট দর্শন দিয়ে কবিতাকে আক্রান্ত না করার সংযম। যেন দিকচক্রবাল—নদী, পাহাড়, ঝরণা, সমতল একই রঙের নরম আলোয় রাঙা। চরাচর যেন তারই অপেক্ষা করছে। ব্যস আর কিছু নয়।

‘ও ঝর্না ওগাে ঝর্না তাহাকে ভালােবাসবে কি ভালোবাসবে কি।’

এর পরের উদাহরণ তুলনায় আরও স্বতন্ত্র। কারণ, এবার বিষয় যৌনতা। এরকম নৈব্যর্ক্তিকতায় যৌন আচারকে বাংলা কবিতায় কবে আর দেখা হয়েছে, জানা নেই। বিনয় মজুমদারের ‘আমার ভুট্টায় তেল’

সবটুকু উদ্ধৃত করবার লোভ সামলাতে পারলাম না, তাই—

“আমার ভুট্টায় তেল মাখতে মাখতে চাঁদ বলল

‘তোমার ভুট্টাটি ভীষণ মোটা’ আমি তার জবাব না দিয়ে

অন্য কথা বললাম — ‘ভুট্টার মাথায় একটু তেল মাখো’ তবে

চাঁদ কিন্তু ভুট্টাটিকে ফুটিয়েও ভুট্টার মাথায়

তেল মাখল না শুধু চারপাশে গায়ে মাখে, তেল মাখা হলে

চাঁদ মেঝে থেকে হেঁটে বিছানায় এসে শোয়, বিছানা মেঝেই পাতা থাকে।

বালিশে মাথাটি রেখে পা দু’টিকে তুলে ধরে শুয়ে পড়ে, আমি

হাঁটু গাড়ি, দু’হাঁটুর নিচে দিই খুলে রাখা গরম প্যান্ট ও জামাটিকে।

তার পরে গুহা দেখি গুহাটি বন্ধই আছে, দু’পা ফাঁক করলেও গুহা

সম্পূর্ণ বন্ধই থাকে, চাঁদ শোয়া অবস্থায় হাত দিয়ে ভুট্টাটিকে ধরতে গেলেই

আমি তাকে বললাম ‘দাঁড়াও ভুট্টাটি আমি নিজেই ঢোকাতে পারি কিনা

দেখা যাক’ বলতেই ভুট্টাটিকে চাঁদ আর ধরল না, ভুট্টার মাথাটি

গুহার বোজানো মুখে চেপে ধরে ঠেলা দিই সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি

ভুট্টাটি সহজভাবে ঢুকে গেল সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা শুরু করি।”

এই সিরিজ জুড়ে বিনয়ের একাধিক কবিতায় সবচেয়ে ঈর্ষণীয় দিক হল, বিষয় বৈচিত্র‍্যে না যাওয়া। সঙ্গে সামান্য আয়োজনে বিষয়ের প্রাবল্যকে ক্রমশ প্রকট করে তোলা। যা বাংলা কবিতায় বিরলতম।

এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা একটামাত্র কারণে। প্রীতম বসাকের লেখা ‘শুশ্রূষা ও মেঘের পাৎলুন’-এর পাঠ অভিজ্ঞতা ও সে বিষয়ে কয়েকটা অনুভূতি ভাগ করে নিতে চাই এই পরিসরে।

প্রথমেই বলা যাক, বিস্ময় নিয়ে। এ বিষয়ে প্রীতম যে দুয়েকটি কথা আমাদের শুনিয়েছেন, সেগুলি হল—

‘বিস্ময়ের কাছে হাত পাতি। এ সম্পর্কে সমীহকে কিছু জানাবো না। ওর সবেতেই

অভিধানের তাৎপর্য। আমার শ্রমজীবী ঠোঁট এখন কয়েকটা হতবাক চায়।

কয়েক ফালি চুম্বন। অদ্য বয়স আততায়ী। বাদাম রঙের রোদ তাহাকে

ডাকিতেছে। চাঁদের ব্রাউজার খুলিয়া দিতেছে স্তনের আলপথ। আমি তার গায়ে

একটু অত্যাশ্চর্য রাখি। কিছু যৌনকুটুম। চকিত ভাঙে। পাখি খোলে। আর স্মিত

ফড়িং উড়ে যায় বৃক্ষের জটিলতায়। বিস্ময়কে আমি আঁকড়ে ধরে বাঁচি।

খুন চাপে।’

খুব সাবধানে আভিধানিক সমীহকে বিস্ময় থেকে প্রাথমিকভাবে দূরে রেখেছেন প্রীতম। প্রকৃতির মতো চিরায়ত যে বাতাবরণ, আততায়ীর দক্ষতায় তিনি তাহার ভিতর পুরে দিচ্ছেন, সাধুভাষার ক্রিয়াপদ, বাকরীতি। এ যেন এক বিচিত্র মোজাইক, যার পদে পদে তৈরি হয় ভাষার বিচিত্র প্যাটার্ন, অত্যাশ্চর্য। অবলীলায় তিনি লেখেন, ‘আমার শ্রমজীবী ঠোঁট এখন কয়েকটি হতবাক চায়।’ শিশুর মতো আমরা হাততালি দিয়ে উঠি। কিন্তু খেয়াল করি না কখন তার হাতের বিস্ময়ের ফড়িংটা উড়ে গেছে বৃক্ষের জটিলতায়।

(২)

সব লেখার রাজনীতি থাকে। এখন ‘শুশ্রুষা ও মেঘের পাৎলুন’-এর দিকে যদি আমরা মুখ ফেরাই, প্রথমেই কী চোখে পড়ে? অন্তত আমার চোখ আটকে যায়, অভাবনীয় কিছু শব্দ ব্যবহারের দিকে। যেমন, ‘যে কৃষক তার মেধাময় চুম্বন রাখে মাঠে আমি তার অশ্রু আমি তার লিঙ্গে লেগে থাকা বিভূতিভূষণ।’ এখানে ‘বিভূতিভূষণ’ শব্দটির ব্যবহার আমাকে স্তম্ভিত করে রাখে। প্রীতমের লেখার ছত্রে ছত্রে এরকম ঐশ্বর্যের সন্ধান আমরা পেয়েই থাকি। প্রাথমিক আশ্চর্যের ঘোর কিছুটা কাটলে আমাদের সামনে যে ছবিটা ফুটে ওঠে, তা থেকে এটুকু স্পষ্টভাবে বলা চলে—এইসব কবিতার দৃষ্টি ঔপনিবেশিক কলকাতাকেন্দ্রিক চর্চাকে ছাপিয়ে চলে যায় এক চিরকালের বাংলার দিকে। যেখানে তিনি রোজা ভাঙবার শব্দ শুনে ফেলেন, প্রার্থনাবাক্যের পাশে এসে দাঁড়ায় মধুর বিভ্রম। তার মাথার জঙ্গলে অনবরত পাখি ওড়ে। কোনো বনদেবী আদিম অন্ধকার কাল থেকে তাদের ধারণ করেছে। কোনো বুড়িগঙ্গার জলে, অথবা তিস্তা, তোর্সা নাকি আমাদের মজে যাওয়া সরস্বতীর স্রোতে তাঁর কাছে ভেসে আসে এইসব বিচিত্র উপমা, তা আমি জানি না। তবে এই উপমাগুলিকে ছাই মাখিয়ে তিনি মাছ কাটেন এবং কেটে চলেন সাম্প্রতিককেও, এক চিরায়ত বঁটি দিয়ে। এই মুন্সিয়ানা প্রীতমের নিজস্ব।

কথা শুরু হয়েছিল তাঁর রাজনীতি নিয়ে। এই রাজনীতির দু’টি মাত্রা যদি আমাকে নির্ধারণ করতে বলেন, তবে তার প্রথমটি নির্দ্বিধায় অপূর্বের আর দ্বিতীয়টি অবশ্যই ভাতের। তিনি খুব সরাসরিই বলেন, ‘আমি মাকে ভাত আর

ভাতকে মাতৃভাষা বলে মনে করতাম

ওই যে অন্নদা উঠে আসছেন আখ্যানের ক্রোমোজম ভেঙে, দু-হাতে কাঁসার থালা — তাতে বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ’

এই বইয়ের পরতে পরতে ফিরে আসে, কৃষিভিত্তিক বাংলার আদি ও অকৃত্রিম রূপ। কখনও সে আলুখেতের ইমাম হয়ে বসে, কখনও লাঙলের কঠিনে তুলে ধরে নরম ভোর, কখনও বা শিশুর হাত ধরে পেরিয়ে যায় ধানজমি। অথচ প্রত্যেক চিত্রকল্প যাপিত জীবনে আটপৌরে আবহাওয়া থেকে উঠে আসার ফলে কখনও বিশ্বাসযোগ্যতার কোনো সমস্যা তৈরি হয় না। এইসব কবিতার দেহে দূর থেকে দেখা বা বানিয়ে তোলা নেই। আর সেজন্য বুঝি-বা নিঃশব্দে এরই পাশে সহাবস্থান করে, মিড-ডে-মিল, উচ্ছেদ থেকে পুনর্বাসন না পাওয়ার কাহিনি। এডিট, লুব্রিকেন্ট, মলিকিউল-এর মতো সব শব্দ ছড়িয়ে থাকে এর পথেঘাটে, পুরোনো ইটের পাঁজায়। ‘Age of spectacle’-এর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রান্তিক জনপদগুলোর এমন সর্বাত্মক চিত্র এই যাত্রাপথের এক বিশেষ অর্জন।

একটা কথা মনে এল। যদিও কাকতালীয়, তবু এখানে উল্লেখ থাক—যখন প্রথমবার ‘শুশ্রুষা ও মেঘের পাৎলুন’ নামটা শুনি, হঠাৎই মনে পড়ে সিদ্ধেশ্বর সেনের অনুবাদে পড়া মায়াকভস্কির ‘ট্রাউজার পরা মেঘ’ কবিতাটার কথা। যদিও মেজাজে ও ভঙ্গিতে এই কবিতা ‘শুশ্রুষা ও মেঘের পাৎলুন’ থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরের বাসিন্দা, তা সত্ত্বেও আত্মীয়তা কি কোনোখানে সামান্যও নেই—ভেবে দেখবেন।

‘বেঁচে থাকার মতো একটা চলনসই পাৎলুন

কয়েকহাত আলুখেত

এবং

একফর্মা হাসপাতাল 

এই নিয়েই আমরা পরস্পরের স্বপ্নে

গীতবিতান রেখে দিয়েছি 

শ্মশানবন্ধু রেখে দিয়েছি’

(৩)

এই লেখা শুরু করেছিলাম সন্তান জন্মের গল্প ফেঁদে। তখনই ভেবে রেখেছিলাম লেখার শেষেও থাকবে কাহিনির ভেজাল। অতএব স্বীকার করি, স্টিফেনসন-কে আমি চিনি না। তবে ঠাউর করতে পারি, প্লাতেরো নামক যে গাধাটিকে আমি চিনতাম, তার কোনো এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় এই স্টিফেনসন। অবশ্য যার কথা বলতে চাইছি, সে প্লাতেরো অথবা স্টিফেনসন নয়, বরং কৌলিন্যহীন দেশি এক রোগেভোগা কুকুর। এবারের কড়া শীতের মধ্যে সে সহসা এসে জোটে, বাড়ির গেটের বাইরে। মা স্নেহবশত বেডকভারের একটা টুকরো পেতে দিলে সে পুরোটা জুড়ে বসে পড়ে। তাতে তার দু’বেলা, সকাল বিকেল খাবারের ব্যবস্থা পাকা হয়। সমস্যা শুরু হল এর কিছুদিন পরে। হঠাৎই আমাদের কোনো এক সুহৃদ প্রতিবেশী ভালোবেসে কুকুরটার গায়ে গরম জল ঢেলে দেয়। তার চামড়া জুড়ে লাল, ঝলসানো এক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এরপর করণীয় যেটুকু থাকে, তা আমি করবার চেষ্টা করেছিলাম। ঘায়ে বিটাডাইন লাগাই। অবাক হয়ে দেখি, ছটফট করা ব্যথার মধ্যেও সে বাধা দিল না। এরপর প্রাণীটা বেপাত্তা হয়ে যায়, বেশ কিছুদিন। ফলে আপদ বিদেয় হয়েছে ভেবে, আমরা নিশ্চিন্ত হই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, কুকুরটা ফিরে আসে একদিন—ঘা ভর্তি বিড়বিড় করছে পোকা, দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। আর ঠিক আমার ঘরের জানলারই নীচে সে শয্যা নেয়। এরপর টানা তিনরাত্রি তার একঘেয়ে গোঙানি, মৃত্যুচিৎকার আমাকে অসহ্য করে তোলে। কানে হেডফোন গুঁজে, তুলো ঢুকিয়ে এর থেকে মুক্তি আমি পাইনি। এই কয়েকঘণ্টায় প্রতি সেকেন্ডে, আমি মনেমনে চেয়েছি ও মরে যাক। ওর মুক্তির জন্য নয় বরং নিজের শুশ্রূষার জন্য। পরে ভেবে দেখেছি, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে, ঘুমন্ত স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে আমি পাইনি, যা সেই মৃত্যুর পরবর্তী কয়েক মুহূর্তে আমি পেয়েছিলাম। সুতরাং শুশ্রুষা একটি বিষম বস্তু—কে যে কোথায় কুড়িয়ে পায় বলা মুশকিল। তবু তাকে খুঁজতে গিয়ে যে ভ্রমণ, তার বৃত্তান্ত লেখা হয়ে চলে—এই আমাদের ভবিতব্য।

‘পুথি সংগ্রহে বেরিয়ে আমরা যে এত প্রাচীন শোক পেলাম, হনন পেলাম

দেখো — তবু — তবুও জ্যোৎস্নার পেট থেকে কীরূপ অসংখ্য নদী নেমে আসছে

ঝোলা থেকে বের করে আনো প্রাপ্ত ফলাফল — আলাপচারিতা

নারীর প্রফুল্ল বাক্ – মানুষের হাত থেকে খসে যাওয়া নদনদী

আধখাওয়া চাঁদ আর ঢাকা দেওয়া কান্না —পিপাসাপূর্ণ অধর

পাতো স্টিফেন অশ্রুপিঁড়ি — চিত্রকল্প — সেলাই করা দিবস-রজনী

আমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ঋণ আছে — নমস্কার বাকি আছে

বিদায়-ভাষণ দেওয়ার আগে আমরা পরস্পরকে বেড়ে দিই অনন্তে’

বই : শুশ্রূষা ও মেঘের পাৎলুন
লেখক : প্রীতম বসাক
প্রকাশক : তবুও প্রয়াস
মূল্য : ১৫০ টাকা ( ভারতীয় )

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *