করোনাকালে চরম দুরবস্থা গৃহশিক্ষকদের – দীপক সাহা
পড়ন্ত বিকেল। লকডাউনে নিভৃতবাস যাপনে খোলা ছাদে পায়চারি করছি। বাড়ির সামনের প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছিমছাম প্যান্টজামা পরিহিত এক দোহারা সুঠাম যুবক সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে একটা ছোটো ভারী বস্তা চাপিয়ে কী যেন হাঁক পাড়তে পাড়তে চলেছেন। ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। মুখের মাস্কটি হালকা ঝুলে। আমাকে দেখেই সাইকেলের গতি কমিয়ে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। লোকালয়ের এদিকে পুলিশের তৎপরতা একদমই নেই।
—নেবেন। ভালো রসুন আছে। বাছাই করা।
ইশারায় ডাকলাম। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে দেখি বস্তা ততক্ষণে খোলা হয়ে গেছে। রসুন। পরিষ্কার নিটোল রসুন। পঞ্চাশ টাকা কেজি।
—আমার জমির রসুন।
কথার পিঠে কথা। যা শুনলাম মনটা খুব বিমর্ষ হয়ে গেল। যুবকটির নাম ফিরোজ। বাড়ি তিন গ্রাম পেরিয়ে জলঙ্গী নদীর পাশে, নিশ্চিন্তিপুর। করোনার হুমকিতে আজ আর অবশ্য কেউ নিশ্চিন্তে নেই সেই গ্রামের।
ফিরোজ রোজদিন সকালে চা-বিস্কুট খেয়ে সাইকেল নিয়ে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। বইপত্র ভর্তি একটা ব্যাগ বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে এ’পাড়া ও’পাড়া, এ’বাড়ি ও’বাড়ি ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে রোদ মাথার উপর উঠলে বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে। দুপুরে স্নান খাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন। বিকেল গড়িয়ে রাত। রোজনামচা ফিরোজের। বাড়ির মুখে প্লাস্টারহীন টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে ছেঁড়া মাদুরে বসে রাত ন’টা পর্যন্ত ছেলের জন্য হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করেন বাবা রাইহান সেখ। বয়সের ছোবলে চোখের দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা, শ্রবণশক্তিও ক্ষীণ। নিরক্ষর রাইহান পরের জমিতে দিনমজুর খেটে অতি কষ্টে বড়ো ছেলে ফিরোজকে এমএ পড়িয়েছিলেন। স্বপ্ন ছিল ছেলে স্কুলশিক্ষক হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে চাকরির দরজায় ঠকঠক করতে করতে কখন কীভাবে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেল! কিন্তু বর্তমানে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক চক্রব্যূহে চাকরির বাজারে শুধু মেধা বা ডিগ্রি থাকলেই হবে না, সঙ্গে কো-কারিকুলার আ্যকটিভিটিও দরকার। ফিরোজ সেই সমস্ত কৌশল রপ্ত করতে অপরাগ হওয়ায় সরকারি চাকরির বয়সসীমা হুস করে পেরিয়ে গেল। চলমান জীবনে বিয়েও হয়ে যায়। সংসারে স্ত্রী, তিন বছরের মেয়ে, দুই ভাইবোন, বৃদ্ধ মা-বাবা। বড়ো সংসারের জোয়াল এখন তাঁর কাঁধে। চোয়াল শক্ত করে জীবন সংগ্রামে লড়াই জারি রাখা।
অগত্যা ভরসা টিউশনি, বাড়ি বাড়ি ছাত্রছাত্রী পড়ানো। এই পেশায় দায় ও দায়িত্ব পরিপূর্ণ ভাবে আছে, কিন্তু না আছে সে অর্থে সামাজিক সম্মান, না আছে সরকারি স্বীকৃতি। যদিও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল ও সজীব রাখতে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের রাজ্যে ফিরোজের মতো এরকম কয়েক লাখ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী রাতদিন পরিশ্রম করে সংসারের হাল ধরেন। স্বপ্ন বিক্রি করার রাজনৈতিক ফেরিওয়ালাদের খপ্পরে পড়ে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখেন। ভোট উৎসবে মাতোয়ারা হন। ভোট মিটলেই ভোটজীবিরা ডুমুরের ফুল হয়ে যান। বেকার ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটে। আবার ভোট আসবে। আবার নতুন স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা।
সরকারি বিধিনিষেধ মেনে করোনাতঙ্কে ঘরে দোর দিয়েছে মানুষ। তাই লকডাউনে টিউশনিও বন্ধ। রেশনে চাল পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আনুষঙ্গিক দৈনন্দিন ও মাসিক অন্যান্য খরচখরচা! হাত ফাঁকা। কিন্তু সর্ষের তেলের জোগাড় করতে ফিরোজরা চোখে সর্ষেফুল দেখছেন। এদিকে দেশের চালকরা নাকে সর্ষে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। খুশির ঈদও এবার বড়োই সাদামাটা কেটেছে। মেয়ে ছাড়া বাড়ির আর কারোর নতুন পোশাক হয়নি। কোনোমতে পেটে গামছা বেঁধে আছেন ফিরোজরা। রাত পোহায়, আবার জানালায় এসে দাঁড়ায় রোদ। জীবন ও জীবিকার সাপ-লুডো খেলায় গুলিয়ে যায় সব। নাকি গুলিয়ে দেওয়া হয়! তাই বাধ্য হয়ে পেশায় গৃহশিক্ষক ফিরোজ নিজেদের একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি দশ কাঠা জমির ফসল রসুন নিয়ে শহরে ফেরি করতে বেরিয়েছেন। বিনিময়ে দুটো পয়সা পেলে বাবার জন্য সুগারের ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরবেন।
দেশের অভিভাবকরা চাকরির পরিসংখ্যান নিয়ে যতই জাগলারি করুন না কেন, বাস্তব চিত্র কর্মসংস্থানের আকাল বাজারে শিক্ষিত, যোগ্যতাসম্পন্ন বেকার যুবক-যুবতীদের এক বৃহত্তর অংশ কর্মহীনতার গ্লানি ঘোচাতে গৃহশিক্ষকতাকেই বেঁচে থাকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। করোনার করাল অভিঘাতে লকডাউনে সমাজের উচ্চ অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিরা আখের ভাঙিয়ে দিন গুজরান করছেন। সামর্থ্যহীনরা সরকারি-বেসরকারি সাহায্য পেয়ে কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধকে সঙ্গী করে শিক্ষিত সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশকে করোনামুক্ত করতে দায়বদ্ধতার মুকুট মাথায় নিয়ে সকল রকমের কোচিং তথা গৃহশিক্ষকতা বন্ধ করে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রীতিমতো আর্থিক দৈন্যদশায় ভুগছেন রাজ্যের অগণিত গৃহশিক্ষকরা।
অন্যদিকে বহু বেকার নৃত্য, সংগীত, অঙ্কন প্রভৃতি নান্দনিক বিষয়কে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। প্রচলিত স্কুল পাঠ্যের বাইরে সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাঁরা শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করতে সাহায্য করেন। গৃহশিক্ষকতা পেশার বৃহত্তর গণ্ডিতে এঁরাও পড়েন। লকডাউনের যাঁতাকলে এই সমস্ত শিক্ষকরাও আজ ঘরবন্দি। তাঁদের ঘরে বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদও বাড়ন্ত। উপরন্তু লকডাউনের ফলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এখন বন্ধ। স্বভাবতই সেই সমস্ত অনুষ্ঠান থেকে পারিশ্রমিক পাওয়ার রাস্তাও রুদ্ধ। নান্দনিক বিষয়কে যাঁরা পেশা হিসেবে নিয়েছেন তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা কোনো সাংস্কৃতিক সংস্থার ছত্রছায়ায় তাঁরা টিকে আছেন। কেউ কেউ অবশ্য সরকারি অনুদান যৎসামান্য পান।
অনেকেরই রুটি-রোজগারের প্রধান মাধ্যম হল গৃহশিক্ষকতা। করোনা ভাইরাসের অভিঘাতে, লকডাউনে গৃহশিক্ষকদের মাথায় বজ্রাঘাত। গৃহশিক্ষকরা পড়াতে যেতে পারছেন না, ছাত্রছাত্রীরাও পড়তে আসতে পারছে না। ফলে আয়ের ভাঁড়ার শূন্যের ঘরে। চক্ষুলজ্জায় কারও কাছে তাঁরা হাতও পাততে পারছেন না। অনেকেই নিজের বাড়িতে টিউশন পড়ান, আবার কেউ কেউ ঘর ভাড়া করে টিউশন পড়ান। সংসার সামলে, ঘর ভাড়া দিয়ে মাসের শেষে এখন উপার্জন শূন্য। অনেকেই হয়তো এই টিউশনির টাকায় নিজের পড়াশোনার খরচ চালান। টিউশন বন্ধ হওয়ার জন্য নিজেদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে না তো? এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে। সামান্য গচ্ছিত অর্থও তলানিতে ঠেকেছে। সবমিলিয়ে অধিকাংশ গৃহশিক্ষকরা পরিবার নিয়ে এখন কোনোরকমে দিনযাপন করছেন।
শহরাঞ্চলে শিক্ষকরা তবুও অনলাইন ক্লাস করে কিছু রোজগার করছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক এলাকার শিক্ষকরা চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। তাঁরা অনলাইন ক্লাস করতে পারছেন না। কারণ বহু শিক্ষক, পড়ুয়া অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। রাজ্যের প্রান্তিক এলাকায় নেটওয়ার্ক দুর্বল। আবার অনেক পড়ুয়ার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নেই। তাছাড়া অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকলেও নেট প্যাক ভরার ক্ষেত্রেও প্রান্তিক মানুষের ক্ষেত্রে এই দুঃসময়ে সেটা বিলাসিতা। অভিযোগ উঠছে, অনলাইন মাধ্যমে পড়াশোনা আসলে সুবিধাভোগীদের জন্যই।
রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আপাতত ৩০শে জুন পর্যন্ত ছুটি। জল্পনা করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে যেকোনো মুহূর্তে। ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীরতর হচ্ছে গৃহশিক্ষকদের। দুর্দশাগ্রস্ত গৃহশিক্ষকদের বাস্তব সমস্যাকে একটু মানবিক দৃষ্টিতে অনুধাবন করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো ভীষণ জরুরি। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অতি কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়ে ছোটো ছোটো ব্যাচ করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাঁরা পড়াতে পারেন। তাতে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক উভয় পক্ষই উপকৃত হবেন। এ ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার বিবেচনা করতে পারেন। পড়ানো শুরু করার অনুমতির পাশাপাশি তাঁদের উপস্থিত সরকারি আর্থিক সাহায্যেরও প্রয়োজন। নতুবা রাজ্যের কয়েক লক্ষ পরিবার চরম অনিশ্চিয়তার মুখোমুখি হতে চলেছে আগামী সকালে।