দ্রৌপদী – মহাশ্বেতা দেবী
নাম দোপ্দি মেঝেন, বয়স সাতাশ, স্বামী দুলন মাঝি (নিহত), নিবাস চেরাখান, থানা বাঁকড়াঝাড়, কাঁধে ক্ষতচিহ্ন (দোপ্দি গুলি খেয়েছিল), জীবিত বা মৃত সন্ধান দিতে পারলে এবং জীবিত হলে গ্রেপ্তারে সহায়তায় একশত টাকা…..
দুই তকমাধারী ইউনিফর্মের মধ্যে সংলাপ।
এক তকমাধারী: সাঁওতালীর নাম দোপ্দি, ক্যান? আমি যে নামের লিস্টি লইয়া আসছি তাতে ত এমুন নাম নাই? লিস্টিতে নাই এমুন নাম কেউ থুইতে পারে?
দুই তকমাধারী : দ্রৌপদী মেঝেন। ওর মা যে বছর বাকুলির সূর্য সাহুর (নিহত) বাড়িতে ধানভানারী ছিল, সে বছর ওর জন্ম। সূর্য সাহুর বউ ওর নাম দিয়েছিল।
এক তকমাধারী : অহনকার অপিচাররা জানে ক্যাবল ফশফশাইয়া ইংরাজী লিখতে। হেয়ার নামে এত লিখছে কি?
দুই তকমাধারী : মোস্ট নটোরিয়াস মেয়েছেলে। লং ওআনটেড ইন মেনি…..
ড্যসিয়ের : দুলন ও দোপ্দি দাওয়ালি কাজ করত, বিটুইন বীরভূম-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ-বাঁকুড়া, রোটেট করে ঘুরত। উনিশশো একাত্তর সালে বিখ্যাত অপারেশন বাকুলিতে যখন তিনটি গ্রাম হেভি কর্ডন করে মেশিনগান করা হয় তখন এরা দুজনও নিহতের ভান করে পড়ে থাকে। বস্তুত এরাই মেইন ক্রিমিনাল। সূর্য সাহু ও তার ছেলেকে খুন, ড্রাউটের সময়ে আপার কাস্টের ইঁদারা ও টিউবওয়েল দখল, সবেতেই এরা মেইন, সেই ছেলে তিনটেকে পুলিসের হাতে সারেণ্ডার না করাতেও। এবং অপারেশন বাকুলির আর্কিটেক্ট ক্যাপটেন অর্জন সিং প্রভাতে লাশ গণনা করতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে না পেয়ে তাৎক্ষণিক ব্লাডসুগারে আক্রান্ত হয়ে পুনর্বার প্রমাণ করে বহুমূত্র সত্যই দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের ব্যাধিও বটে। বহুমূত্র বারোভাতারী। তার এক ভাতার অ্যাংজাইটি।
দুলন ও দোপ্দি দীর্ঘদিন নিয়নডারথাল অন্ধকারে নিখোঁজ থাকে এবং বিশেষ বাহিনী সে অন্ধকারে সশস্ত্র সন্ধানে বিদ্ধ করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু দাওয়ালী সাঁওতাল সাঁওতালনীকে তাদের অনিচ্ছায় সিংবোঙার কাছে যেতে বাধ্য করে। ভারতের সংবিধানে জাত-ধম্মো নির্বিশেষে সকল মানুষই পবিত্র,তা সত্ত্বেও এহেন অঘটন ঘটে যায়। কারণ দ্বিবিধ: এক—নিখোঁজ দম্পতির আত্মগুপ্তিতে অসামান্য দক্ষতা। দুই—বিশেষ বাহিনীর চোখে সাঁওতাল কেন, অস্ট্রো-এশিয়াটিক মুণ্ডা গোষ্ঠীর সকল সস্তানকেই এক চেহারা মনে হওয়া।
বস্তুত বাঁকড়াঝাড় থানার আণ্ডারে (এ ভারতে কেন্নোটিও কোনো না কোনো থানার আণ্ডারে) অবস্থিত কুখ্যাত ঝাড়খানী জঙ্গলের চতুষ্পাশে, এমন কী অগ্নি ও নৈঋত কোণেও থানা আক্রমণ, বন্দুক অপহরণ (যেহেতু ছেনতাইপাটি নির্বিশেষে সুশিক্ষিত নয় সেহেতু বন্দুকের বদলে তারা “চেম্বারটা দিয়ে দিন”ও বলে)—গোলদার-জোতদার-মহাজন-শান্তিরক্ষক কাগুজে বাবু ও খোঁচোড় ইত্যাদিতে অপরাধী বলে যাদের সন্দেহ করা হয়,তাদের সম্পর্কে সংগৃহীত প্রত্যক্ষদর্শীয় বিবরণীতে জানা যায় বহু পিলে চমকানো কথা। দুই কৃষ্ণাঙ্গ নরনারী ঘটনার আগে সাইরেন চীৎকারে “কুলকুলি’ দিয়েছে। কতকগুলি অসভ্য, সাঁওতালিদের কাছেও দুর্বোধ্য ভাষায় তারা নিহতদের ঘিরে উল্লাস সংগীত গেয়েছে। যথা:–
“সামারে হিজুলেনাকো মার্ গোয়েকোপে”
এবং
“হেনদে রামব্রা কেচে কেচে
পুনডি রামব্রা কেচে কেচে।”
এতে নিঃসংশয়ে প্রমাণ হয় এরাই ক্যাপটেন অর্জন সিংয়ের বহুমূত্রের কারণ। প্রশাসনিক কার্যরীতি সাংখ্যের পুরুষ, মা মাকড়া দর্শকের চোখে আন্তোনিওনির আগেকার ফিলিমের মতোই দুর্বোধ্য বলে প্রশাসন পুনর্বার অর্জন সিংকেই অপারেশন ফরেস্ট ঝাড়খানিতে পাঠায় এবং বুদ্ধিবৃত্তি দপ্তরের কাছে উক্ত কুলকুলে ও নৃত্যশীল দম্পতিই যে পলাতক লাশদ্বয় তা জেনে অর্জন সিং কিছুক্ষণ “জোমবি’ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষে তার এমন অহেতুক ভীতি জন্মায় যে, নেংটিপরা কালো মানুষ দেখলেই সে “জান লে লি” বলে অবসন্ন হয়ে ঘন ঘন জল ফেরায় ও জল খায়। কী ইউনিফর্ম কী গ্রন্থসাহেব, কেউই তাকে এ অবসাদ থেকে উদ্ধার করতে পারে না। তারপর প্রিম্যাচিওর ফোর্সড রিটায়ারমেন্টের জুজু দেখিয়ে তবে তাকে বাঙালি প্রৌঢ়, সমর ও বামপন্থী উগ্র রাজনীতি স্পেশালিস্ট সেনানায়কের টেবিলে হাজির করা যায়। সেনানায়ক প্রতিপক্ষের কাণ্ডবাণ্ড ও এলেমের দৌড় প্রতিপক্ষের চেয়েও ভাল জানেন। তাই তিনি অর্জন সিংকে প্রথমে শিখ জাতির সমর প্রতিভা সম্পর্কে স্তুতি জানান। পরে বুঝিয়ে দেন, শুধু কি প্রতিপক্ষের বেলাই বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস ? অর্জন সিংয়ের ক্ষমতাও তো বন্দুকের মেল অর্গান থেকে বেরোয়। হাতে বন্দুক না থাকলে এ যুগে “পঞ্চ ক’ আদি বিকল ও ব্যর্থ। এ সকল বক্তিমে তিনি অন্যদের কাছেও করেন, ফলে যুধ্যমান বাহিনীর মনে পুনর্বার “আমি হ্যান্ডবুক” কেতাবে আস্থা ফেরে। কেতাবটি সাধারণের জন্য লয়কো। তাতে লেখা আছে, আদিম অস্ত্রাদি নিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ সব চেয়ে ঘৃণ্য ও নিন্দার্হ। উক্ত পদ্ধতির যোদ্ধাদের দর্শন মাত্রে নিধন হল সেনামাত্রের পবিত্র কর্তব্য। দোপ্দি ও দুল্ন উক্ত যোদ্ধাদের ক্যাটেগরিতেই পড়ে, কেননা টাঙি-হেঁসো-তির-ধনুক ইত্যাদি নিয়ে নিধনকার্য চালায়। বস্তুত তাদের আক্ষেটি-ক্ষমতা বাবুদের চেয়ে বেশি। সকল বাবু চেম্বার স্ফোটনে বিশারদ হয় না, তারা ভাবে বন্দুক ধরলেই ক্ষমতা আপ্সে বেরোবে। কিন্তু দুল্ন ও দোপ্দি নিরক্ষর বলে অস্ত্র অভ্যাস করেছে জন্ম পরম্পরায়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই সেনানায়ককে প্রতিপক্ষ তুচ্ছ মনে করে বটে, কিন্তু এ সামান্যি মানুষ নয়। ইনি প্র্যাকটিসে যাই করুন, থিওরিতে প্রতিপক্ষের আদর্শকে শ্রদ্ধা করেন। এই জন্য শ্রদ্ধা করেন যে, ‘ও কিসসু নয়,চেংড়ারা বন্দুক লইয়া খেলে’ মনোভাব নিয়ে এগোলে ওদের বোঝা যাবে না ও বিনাশ করা যাবে না। ইন অডার টু ডেস্ট্রয় এনিমি, বিকাম ওয়ান। তাই তিনি ওদের একজন (থিওরিতে) হয়ে ওদের বোঝেন। এবং ভবিষ্যতে এ নিয়ে লেখালিখির বাসনা রাখেন। তখন (সেই লেখায়) বাবুদের ডিমোলিশ করে দাওয়ালিদের বক্তব্যটিকে হাইলাইট করবেন, এও তিনি ঠিক করে রেখেছেন। তাঁর মনের এ সকল প্রসেসকে আপাতজটিল মনে হতে পারে কিন্তু আসলে তিনি খুবই সরল এবং কাউঠার মাংস খেয়ে তাঁর সেজ ঠাকুরদার মতোই তিনিও আনন্দ পান। আসলে তিনি জানেন, প্রাচীন গণনাট্যগীতির মত করভটে বদল হোগা জমানা। এবং সকল জমানাতেই তাঁর সসম্মানে টেকার মত টিকিটপত্তর চাই। দরকার হলে ভবিষ্যৎকে তিনি দেখিয়ে দেবেন তিনিই ব্যাপারটি কত ঠিক পারস্পেকটিভে বুঝেছিলেন। আজ যা যা করছেন তা ভবিষ্যতের মানুষ ভুলে যাবে তাতে তাঁর তিলেক সন্দেহ নেই এবং জমানা হতে জমানায় সবার রঙে রং মেশাতে পারলে তিনি সংশ্লিষ্ট জমানার প্রতিনিধি হতে পারবেন এও তিনি জানেন। আজকে ‘অ্যাপ্রিহেনশন অ্যাণ্ড এলিমিনেশন’ করে তিনি তরুণদের নিকেশ করছেন বটে কিন্তু মানুষ রক্তের স্মৃতি ও শিক্ষা অচিরে ভুলবে এ তিনি জানেন। এবং একই সঙ্গে তিনিও শেএক্সপিয়রের মত তরুণের হাতে পৃথিবীর লিগেসি তুলে দেওয়াতে বিশ্বাসী। তিনিও প্রস্পেরো।
যা হোক, এরপর জানা যায় বহু যুবক-যুবতী ব্যাচ বাই ব্যাচ জিপগাড়ি আরোহণে থানার পর থানা হানা দিয়ে অঞ্চলটিকে যুগপৎ সন্ত্রস্ত ও উল্লসিত করে ঝাড়খানির জঙ্গলে বিলীন হয়। যেহেতু বাকুলি থেকে নিখোঁজ হবার পর থেকে দোপ্দি ও দুল্ন প্রায় সকল জোতদার ঘরে কাজ করেছে, সেহেতু তারা হন্তব্যদের বিষয়ে হন্তাদেরকে টপাটপ খবর দেয় এবং সগর্বে ঘোষণা করে তারাও সেনানী, র্যা ঙ্ক অ্যান্ড ফাইল। অবশেষে দুর্ভেদ্য ঝাড়খানি জঙ্গল সেনানী দিয়ে চক্রব্যূহে বেড়ে ফেলা হয়, আর্মি ভেতরে ঢোকে ও রণভূমি চিরে চিরে পলাতকদের খোঁজে। একই সঙ্গে কার্টোগ্রাফার বনের ম্যাপ আঁকতে থাকেন ও সেনারা জলপানের অবলম্বন ঝর্না ও কুণ্ডীগুলি পাহারা দেয় আড়ালে থেকে, আজও দিচ্ছে, আজও খুঁজছে। তেমনই এক তল্লাশকালে সেনাদের খোঁজিয়াল দুখিরাম ঘড়ারী দেখতে পায় চ্যাটাল পাথরে উপুড় হয়ে শুয়ে এক সাঁওতাল যুবক মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে। সে অবস্থায় তাকে গুলিবিদ্ধ করা হয় ও ৩০৩-র আঘাতে ছিটকে পড়ে যেতে যেতে সে দু হাত ছড়িয়ে ভীষণ গর্জনে ‘মা-হো’ বলে সফেন রক্ত উদ্গিরণ করে নিশ্চল হয়।পরে বোঝা যায় সেই কুখ্যাত দুল্ন মাঝি।
এই ‘মা-হো’ শব্দটির মানে কি? এটি কি আদিবাসী ভাষায় উগ্রপন্থী স্লোগান ? এর মানে কী তা ভেবে শান্তিরক্ষক-দপ্তর বহু চিন্তা করেও হালে পানি পান না। আদিবাসী-বিশেষজ্ঞ দুই মক্কেলকে কলকাতা থেকে উড়িয়ে আনা হয় এবং তাঁরা হফম্যান জেফার, গোল্ডেন-পামার প্রমুখ মহাশয় রচিত অভিধান নিয়ে গলদ্ঘর্ম হতে থাকেন। অবশেষে সর্বজ্ঞসেনানায়ক চমরুকে ডাকেন। ক্যাম্পের জলবাহী সাঁওতাল চমরু দুই বিশেষজ্ঞকে দেখে ফুচফুচিয়ে হাসে, বিড়ি দিয়ে কান চুলকোয় ও বলে, ‘উটি মালদ’র সাঁওতালরা সেই গাঁধীরাজার সময়ে লড়তে নেমে বলেছিল বেটে! উটি লড়াইয়ের ডাক। তা হেথা কোন বেটা ‘মা-হো’ বলল বেটে? মালদ’ হতে কেউ এল ?
সমস্যা ফরসা হয়। তারপর দুলনের শবদেহ উক্ত পাথরে ফেলে রেখে সেনারা সবুজ উর্দির কামুফ্লাজে গাছে গাছে চড়ে দেবতা প্যানের মত গাছের সপত্র ডাল আলিঙ্গনে বেঁধে অসভ্য জায়গায় কাঠপিঁপড়ের সন্ধানী কামড় খেতে খেতে অপেক্ষা করে। দেখে, মৃতদেহ নিতে কেউ আসে কি না। এটি শিকার-পদ্ধতি যেমন, যুদ্ধের পদ্ধতি তেমন নয়। কিন্তু সেনানায়ক জানেন, কোন চেনা-জানা পদ্ধতিতেই এ খচড়াদের নিকেশ করা যাবে না। তাই তিনি মড়ির টোপ দেখিয়ে শিকারকে টেনে আনতে বলেন। তিনি বলেন, সব ফরসা হয়ে যাবে। যে সব গান গেয়েছে দোপ্দি তার মানেও বের করে ফেললাম বলে।
তাঁর কথা শিরোধার্য করে সেনারা তৎপর হয়। কিন্তু দুলনের মৃতদেহ নিতে কেউ আসে না। উপরন্তু রাতের আঁধারে খচরমেচর শুনে সেনারা গুলি ছুড়ে নেমে এসে দেখে তারা শুকনো পাতার বিছানায় সঙ্গমরত শজারু-দম্পতিকে মেরেছে। জঙ্গলে সেনাদের পথ চেনাবার খোঁজিয়াল দুখিরাম ঘড়ারি অসংসারীর মত দুলন-সংশ্লিষ্ট বকশিশ না নিয়েই কার যেন হেঁসোতে গলা দেয়। দুলনের লাশ বয়ে আনতে আনতে সেনারা লাশভক্ষণে বাধাপ্রাপ্ত কাঠপিঁপড়েদের কামড়ে আশীবিষের যন্ত্রণা পায়। লাশ নিতে “কোই না আয়া’’ শুনে সেনানায়ক পেপারব্যাকের আন্টিফাসিস্তু “ডেপুটি” কেতাবটি চাপড়ে “হোআট” বলে চেঁচিয়ে ওঠেন এবং তখনই একজন আদিবাসী বিশেষজ্ঞ আর্কিমিডিসের মত ন্যাংটো ও শুভ্র আনন্দে ছুটে এসে বলে ওঠেন, ‘সার! ওই হেন্দে রামব্রা কথাগুলোর মানে বের করে ফেলেছি। ওগুলো মুণ্ডারি ল্যাংগোয়েজ।
অতএব দোপ্দির খোঁজ চলতে থাকে। ঝাড়খানি জঙ্গল বেলটে অপারেশন চলেছে—চলছে—চলবে। ওটি প্রশাসনের নিতম্বে দুষ্ট ফোঁড়া। সিদ্ধ মলমে সারবার নয়, তোকমারিতে ফাটবার নয়। প্রথম ফেজে পলাতকরা জঙ্গলের টোপোগ্রাফি না জানায় পটাপট ধরা পড়ে ও সম্মুখ সংঘর্ষের নিয়মে তাদের শরীরের চক্ষুগোলক-পৌষ্টিকনালী-পাকস্থালী-হৃৎপিণ্ড-জননস্থান প্রভৃতি শেয়াল-শকুন-হায়না-বনবিড়াল-পিঁপড়ে ও কৃমির খাদ্য হয় এবং নির্মাংস শুভ্র কঙ্কাল নিয়ে ডোমরা সানন্দে বেচতে যায়।
পরবর্তী ফেজে তারা সম্মুখ সংঘর্ষে ধরা দেয় না। তাতে এখন মনে হচ্ছে তারা কোনো একজন বিশ্বস্ত কুরিয়ারকে পেয়েছে। সে যে দোপ্দি, সে সম্ভাবনা টাকায় নব্বই পয়সা। দোপ্দি দুলনকে রক্তাধিক ভালবাসত। এখন সেই ওদের বাঁচাচ্ছে নিশ্চয়।
“ওদের” কথাটিও হাইপোথেসিস।
কেন ?
ওরিজিনালি কতজন গিয়েছিল ?
উত্তর নীরবতা। সে বিষয়ে বহু গল্প উড্ডীয়মান, বহু কেতাব যন্ত্রস্থ। সব কথা বিশ্বাস না করাই ভালো।
ছয় বছরে কতজন সম্মুখ সঙ্ঘর্ষে নিহত ?
উত্তর নীরবতা।
সম্মুখ সঙ্ঘর্ষের পর কঙ্কালসমূহের হাত ভাঙা বা কাটা কেন ? নুলোরা কি সম্মুখ সঙ্ঘর্ষ করতে পারে? কণ্ঠাস্থি লটরপটর পা ও পাঁজরের অস্থি চুর্ণিত কেন?
উত্তর দুরকম। নীরবতা। চোখে অভিমানী তিরস্কার, ছিঃ ! এসব কথা কি কইতে আছে? যা হবার তা তো…এখন কত
এখন কতজন জঙ্গলে আছে ?
উত্তর নীরবতা।
তারা কি এক লিজিয়ন? তাদের কারণে করদাতাদের খরচে একটি বড় বাহিনী হামেহাল ওই জঙ্গলের বন্য পরিবেশে মোতায়েন রাখা কি জাসটিফায়েড ?
উত্তর: অবজেকশন। “বন্য পরিবেশ” কথাটি ঠিক নয়। মোতায়েন বাহিনী সুষম খাদ্য-চিকিৎসা ব্যবস্থা, যথাধর্ম মতে অনুষ্ঠানের সুবিধা, বিবিধ ভারতী শোনা ও “ইয়ে হ্যায় জিন্দ্গী” ফিল্মে সঞ্জীব কুমার ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মুখোমুখি দেখার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। না, পরিবেশ ‘বন্য’ নয়।
কতজন আছে ?
উত্তর নীরবতা।
কতজন আছে? অ্যাট অল কেউ আছে কি ?
উত্তর দীর্ঘ।
যথা : ওয়েল, অ্যাকশন হচ্ছে। মহাজন-জোতদার-গোলদার শুঁড়ি-বেশ্যালয়ের বেনামী মালিক-অতীতের খোঁচড়, এরা আজও সন্ত্রস্ত। নিরন্ন ন্যাংটারা আজও উদ্ধত ও অনমনীয়। দাওয়ালরা কোনো কোনো পকেটে বেটার ওয়েজ পাচ্ছে। পলাতকদের প্রতি সহানুভূতিশীল গ্রামগুলি আজও নীরব ও বিদ্বেষী। এইসব ঘটনা থেকে মনে করার কারণ আছে….
এ ছবিতে দোপ্দি মেঝেন কোথায় বসে ?
সে নিশ্চয় পলাতকদের সঙ্গে শামিল আছে। ভয়ের কথা অন্যত্র। যারা আছে, তারা দীর্ঘদিন জঙ্গলের আদিম জগতে আছে। সাহচর্য করছে দরিদ্র দাওয়াল ও আদিবাসীদের সঙ্গে। এই সাহচর্যের ফলে তারা নিশ্চয়ই কেতাবি শিক্ষা ভুলে মেরে দিয়েছে। যে মাটিতে থাকছে, তার সঙ্গে হয়তো কেতাবি শিক্ষা ওরিয়েন্টেশন করে নতুন করে সংগ্রাম-পদ্ধতি ও বাঁচবার নিয়ম শিখছে। বাইরের কেতাবি শিক্ষা ও অন্তরের উদ্যম এইমাত্র যাদের সম্বল, তাদের গুলি করে নিকেশ করা চলে। হাতেকলমে কাজ করছে যারা, তারা অত সহজে নিকেশ হওয়ার নয়।
অতএব অপারেশন ঝাড়খানি ফরেস্ট থামতে পারে না। কারণ, আর্মি হ্যান্ডবুকের সাবধারবাণী।
দুই
দোপ্দি মেঝেনকে ধর। সে ওদের ধরিয়ে দেবে।
দোপ্দি পেটকাপড়ে ভাত বেঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে চলছিল। মুসাই টুড়র বউ ভাত রেঁধে দিয়েছে। মাঝে মাঝে দেয়। ভাত জুড়োলে দোপ্দি পেটকাপড়ে ভাত বাঁধে ও ধীরে ধীরে চলে।
চলতে চলতে ও মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে ডাঙর বের করে মারছিল। একটু কেরোসিন পেলে মাথায় ঘষে দিলে উকুন নিকেশ হয়। তারপর সোডা দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলা যায়। কিন্তু হারামিরা ঝর্নার বাঁকে বাঁকে খেপ মারে। জলে কেরোসিনের বাস পেলে ওরা গন্ধে গন্ধে চলে আসবে।
দোপ্দি!
দোপ্দি সাড়া দিল না। স্বনামে ডাকলে কখনোই সাড়া দেয় না ও । ওর নামে বখশিশ ঘোষণার কাগজটা আজই পঞ্চায়েত আপিসে দেখে এসেছে। মুসাই টুডুর বউ বলছিল, ‘উ কি দেখিস ? কুথাকার কে দোপ্দি মেঝান! তারে ধরা করলে টাকা!’
–কত টাকা ?
–দু—শো!
–হাই গ!
বেরিয়ে এসে মুসায়েব বউ বলল। ‘ইবার সাজসাজন খুব। স—ব লতুন পুলুস!’
–হাঁ।
–তু আসিস না আর।
মুসাইয়ের বউ চোখ নামিয়ে বলল। ‘টুডু বলে সি সাহেবটো আবার এসেছে। তোরে ধরলে গাঁ-বসত..’.
আবার জ্বালাই দিবে।
–হ্যাঁ। আর দুখিরামের কথাটো….
–সাহেব জেনেছে?
–সোমাই আর বধুনা হারামি করল।
–তারা কুথা?
–ট্রেনে চেপে পালাল।
দোপ্দি কী ভেবে নিল। তারপর বলল, ‘ঘর যা। কী হবে জানি না, মোরে ধরলে তুরা মোরে চিনবি না।’
–তু পালাতে পারিস না ?
–নাঃ । কতবার পালাব বল ? ধরলে বা কী করবে বল? কাঁউটার করে দিবে, দিক।
মুসাইয়ের বউ বলল, ‘মোদের আর কুথা যাবার নাই।’
দোপ্দি আস্তে বলল, ‘কারো নাম বলব না।’
দোপ্দি জানে, এতদিনে শুনে শুনে শিখেছে, কেমন করে নির্যাতনের সঙ্গে মুকাবিলা করা যায়। যদি নির্যাতনে শরীর ও মন ভেঙে পড়ে তখন দোপ্দি নিজের জিভ দাঁতে কেটে ফেলবে। সেই ছেলেটা কেটে ফেলেছিল নিজের জিভ। তাকে কাঁউটার করে দিল। কাঁউটার করে দিলে তোমার হাত থাকে পেছনে বাঁধা। শরীরের প্রতিটি হাড় থাকে চূর্ণ, যৌনাঙ্গে ভীষণ ক্ষত। কিলড বাই পোলিস ইন অ্যান এনকাউন্টার… আননোন মেল .. এজ টুয়েন্টি টু…
এইসব ভাবতে ভাবতে পথ চলতে চলতে দোপ্দি শুনল কে তাকে ডাকছে, দোপ্দি!
সাড়া দিল না ও । স্বনামে ডাকলে ও সাড়া দেয় না। এখানে ওর নাম উপী মেঝেন। কিন্তু কে ডাকে ?
ওর মনে নিরন্তর সন্দেহের কাঁটা গুটিয়ে থাকে। “দোপ্দি” শুনে সন্দেহের ধারাল কাঁটা শজারুর কাঁটার মত দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে ও মনে মনে চেনা মুখের ফিল্ম রোল খুলে চলল। কে? সোম্রা নয়, সোম্রা পলাতক। সোমাই আর বুধনা পলাতক, অন্য কারণে। গোলক নয়, সে বাকুলিতে আছে। এ বাকুলির কেউ? বাকুলি ছেড়ে বেরোবার পর থেকে তার ও দুল্নর নাম হয়েছিল উপী মেঝেন, মাতং মাঝি। এখানে এক মুসাই আর তার বউ ছাড়া আসল নাম কেউ জানে না। বাবু ছেলেদের মধ্যে আগেকার ব্যাচের সবাই জানত না।
সে সময়টা বড়গোলমেলে। দোপ্দির ভাবতে গেলে গোলমাল লাগে। বাকুলিতে অপারেশন বাকুলি। সূর্য সাউ বিড্ডিবাবুর সঙ্গে ষড় করে দু বছরে বাড়ির চৌহদিতে দুটো টিউবয়েল বসাল, কুয়ো খুঁড়ল তিনটে। কোথাও জল নেই, বীরভূমে খরা। সূর্য সাউয়ের বাড়িতে অথই জল, কাকের চোখের মত নির্মল।
কানাল টেক্সো দিয়ে জল লাও, জ্বলে গেল সব।
টেক্সোর জলে চাষ বাড়িয়ে আমার কি লাভ ?
জ্বলে গেল সব।
যাও, যাও। তোমাদের পঞ্চায়েতী বদমাসি আমি মানি না। জল নিয়ে চাষ বাড়াব। আধা ধান আধিয়ার লিবে। উনো ধানে সবাই বশ। তখন ধান বাড়ি দাও, টাকা দাও, যাঃ তোদের তরে ভালো কাজ করে আমার শিক্ষা হয়েছে।
–কি ভাল কাজ করলা তুমি ?
–জল দিই নাই গ্রামকে ?
–ভগুনাল বিয়াইকে দিয়েছ।
–তোরা জল পাস না ?
–নাঃ। ডোম চাঁড়াল জল পায় না।
এই কথা থেকে ঝগড়া। খরায় মানুষের ধৈর্যসহ্য সহজে জ্বলে। গ্রামের সতীশ-যুগল-সেই বাবু ছেলেটা, বুঝি রানা তার নাম, তারা বলল, জোতদার মহাজন কিছু দিবে না, খতম কর ।
সূর্য সাউয়ের বাড়ি রাতে ঘেরাও। সূর্য সাউ বন্দুক বের করেছিল। গরুর দড়িতে পাছমোড়া বাঁধা সূর্য। চোখের ডিম সাদাটে, ঘুরছে, কাপড় নষ্ট হচ্ছিল। দুল্ন বলেছিল, আমি আগে কোপ দিব হে। আমার বাপের বাপ ধান বাড়ি নিয়াছিল সে ধার শুধতে আজও বেগারী দেই।
দোপ্দি বলেছিল, মোর পানে চেয়ে লাল গড়াত মুখে, ওর চোখ আমি উপড়াব।
সূর্য সাউ। তারপর সিউড়ি থেকে টেলিগ্রাফিক মেসেজ। স্পেশাল ট্রেন। আর্মি। জিপ বাকুলি অব্দি আসেনি। মার্চ-মার্চ-মার্চ। নালপরা বুটের নিচে কাঁকরের ক্রাঁচ-ক্রাঁচ-ক্রাঁচ। কর্ডন আপ। মাইকে আদেশ। যুগল মণ্ডল-সতীশ মণ্ডল-রানা অ্যালায়াস-প্রবীর অ্যালায়াস দীপক-দুল্ন মাঝি-দোপ্দি মেঝেন সারেণ্ডার, সারেণ্ডার। নো সারেণ্ডার সারেণ্ডার। মো—মো—মো ডাউন দি ভিলেজ। খটখট—খটখট—বাতাসে কর্ডাইট—খটখট—রাউণ্ড দি ক্লক—খটখট। ফ্লেম থ্রোআর। বাকুলি জ্বলছে। মোর মেন অ্যান্ড উইমেন, চিল্ডরে… ফায়ার —ফায়ার। ক্লোজ কানাল অ্যাপ্রোচ। ওভার-ওভার-ওভার বাই নাইটফল। দোপ্দি আর দুল্ন বুকে হেঁটে পালিয়েছিল।
বাকুলির পর পলতাকুড়িতে ওরা পৌঁছতে পারত না। ভূপতি আর তপা নিয়ে যায়। তারপর ঠিক হয় দোপ্দি ও দুল্ন ঝাড়খানি বেলটের আশে পাশে কাজ করবে। দুল্ন দোপ্দিকে বুঝিয়েছিল, এই ভালো রে! এতে আমাদের ঘর-সংসার ছেলেমেয়ে হবে না! কে বলতে পারে একদিন জোতদার-মহাজন-পুলিস সব নিশ্চিহ্ন হবে না?
কিন্তু আজকে ওকে পিছন থেকে কে ডাকল ?
দোপ্দি হাঁটতে থাকল। গ্রাম-প্রান্তর-ঝোপঝাড় ও খোয়াই-পি. ডব্লুডির খাম্বা— পেছনে ছুটে আসার শব্দ। একজনই আসছে। ঝাড়খানির জঙ্গল এখনো ক্রোশখানেক। এখন ওর মনে হল জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারলে বাঁচে। ওদের বলতে হবে পুলিস আবার তার নামে লুটিস দিয়েছে। বলতে হবে সেই হারামি সাহেব আবার এসেছে। হাইড-আউট পালটাতে হবে। তা ছাড়া, সান্দারাতে খেতমজুরদের টাকা দেওয়া নিয়ে যে গণ্ডগোল হয়, তারপর সেখানে লক্ষ্মী বেরা, নারান বেরাকে সূর্য সাউ করে দেবার প্ল্যানও নাকচ করতে হবে। সোমাই ও বুধনা সবই জানত। দোপ্দির বুকের নিচে ভীষণ বিপদের আর্জেন্সি। ওর এখন মনে হল সোমাই ও বুধনা যে হারামি করবে তাতে সাঁওতাল হয়ে ওর লজ্জার কিছু নেই। দোপ্দির রক্ত চম্পাভূমির পবিত্র কালো রক্ত, নির্ভেজাল। চম্পা থেকে বাকুলি, কত লক্ষ চাঁদের উদয়াস্তের পথ। রক্তে ভেজাল মিশতে পারত, দোপ্দির পূর্বপুরুষদের জন্যে গর্ব হল। তারা কালো কুঁচের কুচিলায় মেয়েদের রক্ত পাহারা দিত। সোমাই ও বুধনা জারজ। যুদ্ধের ফসল। শিয়নডাঙার মার্কিন সৈন্যদের উপহার টুওআর্ডস্ রাঢ়ভূমি। নইলে কাক যদি বা কাকের মাংস খায়, সাঁওতাল সাঁওতালকে ধরাতে হারামি করে না।
পেছনে পায়ের শব্দ। শব্দ ও দোপ্দির মাঝে ব্যবধান এক থাকছে। কোঁচড়ে ভাত, কষিতে গোঁজা তামাক পাতা। অরিজিৎ, মালিনী, শামু, মন্টু কেউ বিড়ি সিগারেট চা খায় না। তামাক পাতা ও চুন। কষিতে কাগজের মোড়ক গোঁজা আলকুলির বীজ থেঁতো। বিছে কামড়ালে অব্যর্থ ওষুধ। কিছুই দেওয়া যাবে না।
দোপ্দি বাঁ দিকে ঘুরল। এদিকে ক্যাম্প। দু মাইল দূরে। বনের পথ নয় এটা। কিন্তু পেছনে খোঁচোড় নিয়ে দোপ্দি বনে যাবে না।
জান কসম। জা—হান কসম দুল্ন, জান ক—সম। কিছুই বলা হবে না।
পায়ের শব্দ বা দিকে ঘুরল। দোপ্দি কোমরে হাত দিল। হাতের তেলোয় বাঁকা চাঁদের আশ্বাস। হেঁসোর বাচ্চা। ঝাড়খানির কামাররা গড়ে ভালো। এমন শা—হান দিয়ে দিব উপী, যে শত দুখিরামরে—। দোপ্দি ভাগ্যে বাবু হতে যায় নি। বরঞ্চ ওরাই বুঝেছে সব চেয়ে ভালো কাস্তে-হেঁসো-টাঙি-ছুরি। নীরবে কাজ সারে। দূরে ক্যাম্পের আলো। দোপ্দি সেদিকে বা যাচ্ছে কেন? দাঁড়া তুই, ফিন বাঁক ঘুর্যেে যায়। আঃ—হা! রাতভোর আমি চক্ষু মুদে ঘুর্যেয বুলতে পারি। জঙ্গলে যাব না, পথ হারাব না। দম ছুটবে না। তুই শালো খোঁচোড়, জাহানের মায়ায় মরিস, তু ঘুরবি ? দম ছুট্যোয়ে তোরে গাঢ়ায় ফেলে নিকাশ করে দিব ।
কিছুই বলা হবে না। নতুন ক্যাম্প দেখে এসেছে দোপ্দি বাস স্টেশনে বসে গল্প করে বিড়ি টেনে জেনে এসেছে কত কনভয় পুলিস এল, কটা ওয়্যারলেস ভ্যান। ডিংলা চার, পিঁয়াজ সাত, লঙ্কা পঞ্চাশ সিধা হিসাব। কিছুই জানানো যাবে না। ওরা নিশ্চয় বুঝে নেবে দোপ্দি মেঝান কাঁউটার হয়ে খেলছে। তখন পলাবে। অরিজিতের গলা, যদি কেউ ধরা পড়ে, টাইম বুঝে অন্যরা হাইড-আউট চেঞ্জ করবে। কমরেড দোপ্দি যদি দেরি করে আসে, আমরা এখানে থাকছি না। কোথায় যাচ্ছি, নিশানি থাকছে। কোনো কমরেড নিজের জন্যে অন্যদের ডেসট্রয়েড হতে দেবে না।
অরিজিতের গলা। জলের কুলকুল শব্দ। পাথর তুলে নিচে রাখা কাঠের টুকরোর তিন ফলা-মুখ যেদিকে, সেদিকের হাইড আউটে যাওয়া হয়েছে।
এটা দোপ্দির পছন্দ, বোধায়ত্ত। দুল্ন মরে গেল, কারুকে মেরে মরেনি বাবা। প্রথম থেকে এ সব মাথায় জারায়নি বলে এ ওর জন্যে হামলাতে গিয়ে কাঁউটার হতিস। এখন অনেক নির্মম নিয়ম, সহজ ও বোধ্য। দোপ্দি ফিরল–ভালো, ফিরল না–ব্যাড। চেঞ্জ হাইড-আউট। নিশানি এমন হবে, অপোজিশন দেখতে পাবে না, দেখলে বুঝবে না।
পেছনে পায়ের শব্দ। দোপ্দি আবার ঘুরল। এই সাড়ে তিন মাইল বিস্তীর্ণ ডাঙা ও খোয়াই জঙ্গলে ঢোকার প্রকৃষ্ট পথ। দোপ্দি সে পথ পেছনে রেখে এসেছে। সামনে খানিকটা সমতল। তারপর আবার খোয়াই। এত উঁচুনিচুতে কখনো আর্মি ক্যাম্প ফেলেনি। এদিকটা নির্জন। ভুলভুলাইয়া। বাঘাগুগগুলি ইটা বেটে, সকল ঢিবার সকল মত দেখতে। ঠিক নামে বলি দেওয়া হয়েছিল।
অ্যাপ্রিহেন্ড!
ঢিবাগুলির একটা উঠে দাঁড়াল। আরেকটা। আরেকটা। প্রৌঢ় সেনানায়ক যুগপৎ আনন্দিত ও নিরাশ। ইফ ইউ ওয়ান্ট টু ডেস্ট্রয় দি এনিমি, বিকাম ওয়ান। তিনি তা হয়েছিলেন। ছ বছর আগেও উনি ওদের প্রতিটি মুভ অ্যান্টিসিপেট করতে পারতেন, এখনও পারছেন, আনন্দ। সাহিত্যের সঙ্গে যোগ রাখার ফলে ‘ফার্স্ট ব্লাড’ পড়ে তিনি তাঁর চিন্তা ও কাজের সমর্থন দেখেছেন।
দোপ্দি তাঁকে ধাপ্পা দিতে পারল না, দুঃখ ও নিরাশা। কারণ দ্বিবিধ। ছ বছর আগে মস্তিষ্ক-কোষে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে লেখা তাঁর প্রবন্ধ বেরিয়েছে। তিনি প্রমাণ রেখেছেন, তিনি এ সংগ্রামের সমর্থক, দাওয়ালিদের পরিপ্রেক্ষিতে। দোপদি দাওয়ালী। ভেটেরান ফাইটার। সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়। দোপ্দি মেঝেন অ্যাপ্রিহেন্ডেড হতে চলেছে। ডেস্ট্রয়েড হবে। দুঃখ।
হলট!
দোপ্দি থমকে দাঁড়াল। পেছনের পদশব্দ ঘুরে সামনে এসে দাঁড়াল। দোপ্দির বুকের নিচে কানালের বাঁধ ভাঙল। সর্বনাশ। সূর্য সাহুর ভাই রোতোনী সাহু। সামনের ঢিবা দুটি এগোল। সোমাই ও বুধনা। ওরা ট্রেনে পালায়নি।
অরিজিতের গলা, যখন জিতছ– তা যেমন জানবে, যখন হারলে– তা মানবে এবং পরের স্টেজ থেকে কাজ করবে।
দোপ্দি এখন দু হাত ছড়িয়ে আকাশপানে মুখ তুলে জঙ্গলের দিকে ঘুরে গিয়ে সর্ব সত্তার শক্তি দিয়ে কুলকুলি দিল। একবার, দুবার, তিনবার। তৃতীয় কুলকুলিতে ঝাড়খানি জঙ্গলের আঁচলের গাছে পাখিগুলো রাতের ঘুম ভেঙে ডানা ঝাপটে ডেকে উঠল। কুলকুলির প্রতিধ্বনি বহুদূর যায়।
তিন
সন্ধ্যা ছটা সাতান্নতে দ্ৰৌপদী মেঝেন অ্যাপ্রিহেন্ডেড হয়। ওকে নিয়ে ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছতে লাগে একঘণ্টা। ঠিক একঘণ্টা জেরা চলে। কেউই তার গায়ে হাত দেয় না এবং তাকে ক্যাম্বিসের টুলে বসতে দেওয়া হয়। আটটা সাতান্নতে সেনানায়কের ডিনার টাইম হয় এবং ‘ওকে বানিয়ে নিয়ে এস। ডু দি নীডফুল’ বলে তিনি অন্তর্ধান করেন।
তারপর এক নিযুত চাঁদ কেটে যায়। এক নিযুত চান্দ্র বৎসর। লক্ষ আলোকবর্ষ পরে দ্রৌপদী চোখ খুলে, কী বিস্ময়, আকাশ ও চাঁদকেই দেখে। ক্রমে ওর মস্তিষ্ক থেকে রক্তাভ আলপিনের মাথা সরে সরে যায়। নড়তে গিয়ে ও বোঝে এখনো ওর দু হাত দু খুঁটোয় এবং দু পা দু খুঁটোয় বাঁধা। পাছা ও কোমরের নিচে চটচটে কী যেন। ওরই রক্ত। শুধু মুখের ভেতর কাপড় নেই। ভীষণ তেষ্টা। পাছে ‘জল’ বলে ওঠে, সেই ভয়ে ও দাঁতে নিচের ঠোঁট চাপে। বুঝতে পারে যোনিদ্বারে রক্তস্রাব। কতজন ওকে বানিয়ে নিতে এসেছিল?
ওকে লজ্জা দিয়ে চোখের কোল থেকে জল গড়ায়। ঘোলাটে চাঁদের আলোয় বিবর্ণ চোখ নিচের দিকে নামাতে নিজের স্তন দুটি চোখে পড়ে এবং ও বোঝে হ্যাঁ–ওকে ঠিকমত বানানো হয়েছে। এবার ওকে সেনানায়কের পছন্দ হবে। স্তন দুটি কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত, বৃত্ত ছিন্নভিন্ন। কত জন ? চার-পাঁচ-ছয়-সাত—তারপর দ্রৌপদীর হুঁশ ছিল না।
পাশে চোখ ফিরিয়ে ও সাদা কি যেন দেখে। ওরই কাপড়। আর কিছু দেখে না। সহসা দৈবকৃপা আশা করে ও । সম্ভবত ওকে ফেলে গেছে ওরা। শেয়াল ছিড়ে খাবে বলে। কিন্তু ওর কানে আসে পায়ের ঘষটানি । ঘাড় ঘোরায় ও, বেয়নেটে ভর দিয়ে দাঁড়ানো সান্ত্রি ওকে দেখে হাসে। চোখ বোজে দ্রৌপদী। অপেক্ষা করতে হয় না বেশীক্ষণ। আবার বানিয়ে নেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়। চলতে থাকে। চাঁদ কিছু জ্যোৎস্না বমি করে ঘুমোতে যায়। থাকে শুধু অন্ধকার। একটি বাধ্য হয়ে পা ফাঁক করে চিতিয়ে থাকা নিশ্চল দেহ।
তার ওপর সক্রিয় মাংসের পিস্টন ওঠে ও নামে, ওঠে ও নামে।
তারপর সকাল হয়।
তারপর দ্রৌপদী মেঝেনকে তাঁবুতে আনা হয় ও খড়ের ওপর ফেলা হয়। গায়ের ওপর কাপড়টা ফেলে দেওয়া হয়।
তারপর ব্রেকফাস্ট, কাগজ পাঠ, রেডিও মেসেজ ‘দ্রৌপদী মেঝেন অ্যাপ্রিহেন্ডেড’ খবর পাঠানো ইত্যাদি হয়ে গেলে দ্রৌপদী মেঝেনকে নিয়ে আসার হুকুম যায়।
কিন্তু এখন হঠাৎ গণ্ডগোল শুরু হয়।
‘চল’ বলতেই উঠে বসে দ্রৌপদীোও জিজ্ঞাসা করে, কুথাক যেতে বলছিস ?
–বড় সাহেবের তাঁবুতে।
–তাঁবু কুথাক ?
–হুই।
দ্রৌপদী লাল চোখ ঘোঁচ করে অদূরে তাঁবু দেখে। বলে, চল, যেচ্ছি আমি।
সান্ত্রী জলের ঘটি এগিয়ে দেয়।
দ্ৰৌপদী উঠে দাঁড়ায়। জলের ঘটি মাটিতে ঢালে উপুড় করে। কাপড়টি দাঁতে ধরে টেনে টেনে ছেঁড়ে। সান্ত্রী এবম্বিধ আচরণ দেখে বাউরা হো গিয়া—বলে ছুটে হুকুম আনতে যায়। সে নিয়ে যেতে পারে কয়েদীকে, কিন্তু কয়েদী দুর্বোধ্য আচরণ করলে কী করবে তা সে জানে না। তাই ওপরওলাকে শুধোতে যায়।
জেলে পাগলা ঘণ্টি পড়লে যেমন হয়, ছুটোছুটি লেগে যায় এবং সেনানায়ক বিস্মিত হয়ে বেরিয়ে এসে দেখেন সূর্যের প্রখর আলোয় উলঙ্গ দ্রৌপদী সোজা মাথায় হেঁটে তাঁর দিকে আসছে। সন্ত্রস্ত সান্ত্রীরা তার কিছু তফাতে।
এ কি ? বলতে গিয়ে তিনি থেমে যান।
দ্রৌপদী তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। উলঙ্গ। উরু ও যোনিকেশে চাপ চাপ রক্ত। দুটি স্তন দুটি ক্ষত।
এ কি ? তিনি ধমকাতে যান।
দ্রৌপদী আরো কাছে আসে। কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়, হাসে ও বলে, তুর সাঁধানের মানুষ, দোপ্দি মেঝেন। বানিয়ে আনতে বলেছিলি, তা কেমন বানিয়েছে দেখবি না?
–কাপড় কই ওর, কাপড়? —
–পরছে না সার। ছিড়ে ফেলেছে।—
দ্রৌপদীর কালো শরীর আরো কাছে আসে। দ্রৌপদী দুর্বোধ্য, সেনানায়কের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য এক অদম্য হাসিতে কাঁপে। হাসতে গিয়ে ওর বিক্ষত ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরে এবং সে রক্ত হাতের চেটোতে মুছে ফেলে দ্রৌপদী কুলকুলি দেবার মত ভীষ আকাশচেরা, তীক্ষ গলায় বলে, কাপড় কী হবে, কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?
চারদিকে চেয়ে দ্রৌপদী রক্তমাখা থুথু ফেলতে সেনানায়কের সাদা বুশ শার্টটি বেছে নেয় এবং সেখানে থুথু ফেলে বলে, হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কি করবি? লেঃ কাঁউটার ক্, লেঃ কাঁউটার কর—?
দ্রৌপদী দুই মর্দিত স্তনে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে এবং এই প্রথম সেনানায়ক নিরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয়।
One Comment