তথ্য নিছক তথ্য নয় – জয়ন্ত ভট্টাচার্য

তথ্য নিছক তথ্য নয় – জয়ন্ত ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

তথ্য নিয়ে কিছু কথা – তথ্য নিছক তথ্য নয়

রামায়ণের “সুন্দরকাণ্ড”-র অষ্টবিংশতি সর্গের ৬ নম্বর শ্লোকে আছে –

নূনং মমাংগান্যচিরাদনার্যঃ ।
শস্ত্রৈঃ শিতৈ ক্ষেৎস্যতি রাক্ষসেন্দ্রঃ ।।
তস্মিন্ননাগচ্ছতি লোকনাথে ।
গর্ভস্থজন্তোরিব শল্যকৃন্তঃ ।।
(সুন্দরকাণ্ড, ৫, ২৮।৬)

কলকাতা থেকে ১৮৯২ সালে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদে যে রামায়ণ (মহাকাব্য ও টেক্সট হিসেবে এর মূল রচনাকাল মোটামুটি ভাবে ৪০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে) প্রকাশিত হয় তাতে এর অনুবাদ দেওয়া আছে – “এক্ষণে রাম যদি না আইসেন, তাহা হইলে চিকিৎসক যেমন অস্ত্র দ্বারা গর্ভস্থ জন্তুকে ছেদন করে, সেইরূপ ঐ নীচ, শানিত অস্ত্রে শীঘ্রই আমারে খণ্ড খণ্ড করিবে।” একই বছরে মন্মথনাথ দত্ত রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “vile lord, of the Rakshasas, mince my limbs with his arrows like unto surgeon cutting of the limbs of an embryo.” এখানে মন্মথ দত্ত একটি নোট যোগ করেছেন, “এই অনুচ্ছেদটি পরিস্কারভাবে চিহ্নিত করে যখন রামায়ণ লেখা হচ্ছে তখন দক্ষ এবং প্রজ্ঞাবান শল্য চিকিৎসকেরা ছিলেন।” আমরা কয়েকটি প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রথম, রামায়ণের পাঠ ও অন্যান্য সূত্র থেকে যতোটুকু বুঝি যে সীতা যথেষ্ট শিক্ষিত কোন মহিলা ছিলেন না। কিন্তু শল্য চিকিৎসকেরা গর্ভস্থ ভ্রূণ কাটাছেঁড়া করে এরকম এক ধারণা তাঁর মাঝে আছে। তাহলে কি সত্যিই সেসময়ে এরকম প্র্যাকটিস বাস্তবে ছিল? দ্বিতীয়, রামায়ণের বাংলা এবং ইংরেজি অনুবাদের সময়কাল জুড়ে জাতীয়তাবাদী ধারণা সমাজে শেকড় বিস্তার করছে। এজন্য ইংরেজি অনুবাদককে একটি নোট যোগ করতে হচ্ছে প্রাচীন ভারতের উল্লেখযোগ্য সম্ভারের অস্তিত্ব বোঝানোর জন্য। তৃতীয়, সীতার বয়ানকে আমরা তথ্য হিসেবে কতোটা ভরসা করতে পারি? সীতার প্রাথমিক স্তরের যে ধারণা বা লোকশ্রুতি সম্পর্কে জ্ঞান তাকে এম্পিরিকাল নলেজ বলে বুঝতে হবে। এ পরিস্থিতিতে বিমলকৃষ্ণ মতিলাল থাকলে হয়তো বৈয়াকরণ ভর্তৃহরিকে উদ্ধৃত করে বলতেন – he recognized quite clearly the very significant role of language in the structure of empirical knowledge। (Matilal – Epistemology, Logic, and Philosophical Analysis)
প্রশ্নগুলো আরেকটু ভালো করে পরপর সাজালে এরকম হতে পারে – তথ্য কি? কি এর চরিত্র (ontology)? কিভাবে জন্ম নেয় তথ্য? কোন ঐতিহাসিক, আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে একটি নির্দিষ্ট তথ্যের বা তথ্যসমূহের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে? কিভাবে বিভিন্ন টুকরো টুকরো তথ্য একটি জ্ঞান কাঠামোর জন্ম দেয়? রামায়ণের এই নির্দিষ্ট তথ্যের যাথার্থ্য কতদূর? একে কি আমরা তথ্য না বলে proto-information বা প্রাক-তথ্য বলতে পারি (যেমন লুডভিগ ফ্লেক বলেছেন proto-idea)? তথ্য কি শুধুই তথ্য হিসেবে থেকে যায়? কিংবা একটি বিশেষ যুক্তি ও জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জ্ঞান হিসেবে সঞ্চিত হয় এবং স্বীকৃতি লাভ করে? জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভের এই ধরন ও প্রক্রিয়া কি সার্বজনীন? কিংবা, ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের ধরনের মাঝে ভিন্নতা আছে? ভারতীয় দর্শনে যেভাবে ধাপে ধাপে জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় অপরিমেয় তথ্য থেকে গড়ে ওঠা পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণা কি একইভাবে গড়ে উঠেছে? এখানে ভারি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এ কে রামানুজন। তাঁর Is there an Indian Way of Thinking? An Informal Essay-তে প্রশ্নগুলোকে এভাবে সাজিয়েছেন তিনি –
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। কোথায় জোর পড়ছে তার ওপরে নির্ভর করছে প্রশ্নটিকে কিভাবে দেখছি। অর্থাৎ, যে দেখছে (যাকে আমরা বিষয়ী বলবো) তার ওপরে নির্ভর করছে প্রশ্নটির চারটে আলাদা অংশের গুরুত্ব। একইভাবে যে বিষয়ী তার ওপরে নির্ভর করবে যে বিপুল তথ্যরাজি তার সামনে রয়েছে সেখান থেকে জ্ঞানের এবং ধারণার নির্মাণ কি পদ্ধতিতে একজন করবে। তাহলে প্রসঙ্গ চলে এলো পদ্ধতির, জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির, যাকে দিয়ে তথ্যের অপরিমেয় জগত জ্ঞানের বিশেষ জগতে রূপান্তরিত হবে। যখন Is-এ জোর পড়ছে তখন was-ও গুরুত্ব পাচ্ছে, আগে ছিল কিন্তু এখন নেই। যখন an-এ জোর থাকে তখন চিন্তার বহুত্বের প্রসঙ্গ এলো, কোন একটি ধরনে ভারতীয় চিন্তন বাঁধা পড়ে আছে বা নেই। যখন Indian-এ জোর দেওয়া হল তখন মৌলিক যে প্রশ্ন উঠে এলো তাহল, আদৌ ভারতীয় চিন্তন বা চিন্তাপদ্ধতি বলে কিছু আছে? নাকি এ চিন্তন প্রাক-শিল্প, প্রাক-ছাপাখানা, গ্রামীন ও তদুপরি নাগরিক ডিসকোর্সবিহীন একটি ফেনমেনোলজিকাল অস্তিত্ব? কিন্তু thinking-এর ওপরে যখন জোর দেওয়া হল তখন গোড়া ধরে মারো টান গোছের এক অবস্থা তৈরি হল – আদৌ ভারতীয়রা কি চিন্তা করতে পারে? খানিকটা রামানুজনের উত্থাপিত প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শেল্ডন পোলক প্রবন্ধ লিখলেন – Is There an Indian Intellectual History? Introduction to “Theory and Method in Indian Intellectual History”। এ প্রবন্ধে পোলক মন্তব্য করছেন, বিশেষ করে প্রাক-আধুনিক মুহূর্তে, “represents a challenging and, in global-historical terms, crucial sphere of study.”
আমরা ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থেকে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করবো। কেনেথ যিস্কের (Kenneth Zysk) মূল্যবান গবেষণাকর্ম Religious Medicine: The History and Evolution of Indian Medicine এবং Asceticism and Healing in Ancient India: Medicine in the Buddhist Monastery গ্রন্থে যিস্ক দেখিয়েছেন কিভাবে বৌদ্ধ মনাস্টারিগুলো থেকে আয়ুর্বেদের চিকিৎসাপদ্ধতি উল্লেখযোগ্যভাবে আহৃত হয়েছিলো। ফলে, আয়ুর্বেদের জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির মাঝে লীন হয়ে আছে বৌদ্ধ দর্শন এবং ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের ছাপ। এমনকি কোথাও কোথাও চার্বাক দর্শনের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। এগুলো সবই দৃশ্যমান বা ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আহরিত তথ্যের চিকিৎসার জ্ঞানে রূপান্তরিত হবার এক একটি অধ্যায়। বিস্তৃত আলোচনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্কলারের মধ্যে বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সতীশ চন্দ্র বিদ্যাভূষণ, জে এন মোহান্তি এবং দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দ্রষ্টব্য।
বৌদ্ধ পুঁথি “মহাভাগ্গ” থেকে দুটি-একটি ঘটনার উল্লেখ করি। নিরাময় লাভ করার সাপেক্ষে সেসময়ের কিংবদন্তী চিকিৎসক জীবক এক শ্রেষ্ঠীকে বলছেন – যখন তুমি সেরে উঠবে তখন তুমি আমাকে যা ইচ্ছে করবে দেবে। (মহাভাগ্গ, ৮.১।১০) আমরা বুঝতে পারি সেসময়ে কেবল in kind বা দ্রব্যের বিনিময়ে পারিশ্রমিক ছিলনা, নগদ অর্থে in cash-ও ছিল। জীবকের পারিশ্রমিকের মূল্যমান সেসময়ের মুদ্রায় ১০,০০০ কহাপন পর্যন্ত ছিল (যদিও কহাপনের সঠিক মান পাওয়া যায়না, কিন্তু একটি হিসেব বলে ১০০ কহাপনে একজন ক্রীতদাসকে কেনা যেত। এ ঘটনা পরে রাজগহ-তে এক শ্রেষ্ঠীর গৃহে জীবক যান। সে শ্রেষ্ঠী ৭ বছর ধরে মাথার যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। “মহাভাগ্গ”-র ইংরেজি অনুবাদ থেকে হুবহু তুলে দিই – Then Jivaka Komarabhacca, having made the householder, the merchant lie down on a couch, having strapped him to the couch, having cut open the skin of his head, having opened a suture in the skull, having drawn out two living creatures, showed them to the people, saying : “Do you see, masters, these two living creatures, the one small, the other large ? This large living creature was seen” … And having closed the suture of the skull, having sewn up the skin of the head, he applied an ointment. অস্যার্থ, জীবক খুলির চামড়া কাটলেন, খুলির হাড়কে পৃথক করে দুটি বড়ো কৃমিকে বের করলেন এবং আবার চামড়া সেলাই করে দিলেন। সেলাই-এর ওপরে তাঁর জানা ঔষধি ব্যবহার করলেন যাতে তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে। শ্রেষ্ঠী ৭ বছর ধরে ভোগ করা মাথার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেন। জীবক পেলেন উপযুক্ত পারিশ্রমিক। (মহাভাগ্গ, ৮.১।১৮) এ এক অসামান্য সার্জারি তথা শল্যচিকিৎসার জ্ঞান সেকালের বিচারে, এমনকি একালের বিচারেও। এরকম প্রেক্ষাপটে সেসময়ে জ্ঞানের এই বিশাল সম্ভার কি করে গড়ে উঠলো, আজকের ভাষায় যাকে big knowledge বলবো, সে তো অবশ্যই বুঝতে হবে। যদিও বর্তমান প্রবন্ধের পরিসরে এটা সম্ভব নয়।
আমরা একটু বাদে আয়ুর্বেদে এসে চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্য কিভাবে বিবেচিত হচ্ছে তা দেখবো। তার আগে অন্য একটি তথ্য বা প্রাক-তথ্য দেখে নিই। “দিব্যদান” হল বুদ্ধের জীবন সংক্রান্ত প্রথম যুগের বিভিন্ন উপকথা বা কিংবদন্তির সংগ্রহ। প্রথম সংকলিত করেন ই বি কাওয়েল এবং আর এ নিল, প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে। সেখানে সম্রাট অশোকের উপপত্নি তিষ্যরক্ষিতা (অশোকের পুত্র কুণালের প্রতি অনুরক্ত) কিভাবে গুরুতর অসুস্থ সম্রাটকে সারিয়ে তুলেছিলেন তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। এ তথ্যটিই সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত Eugene Burnouf-এর Introduction to the History of Indian Buddhism গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে। তিষ্যরক্ষিতা রাজদরবারের সমস্ত চিকিৎসককে আদেশ করেন সম্রাটের অসুস্থতার সাথে মেলে এরকম একজন মানুষকে গোটা সাম্রাজ্য থেকে খুঁজে বের করতে হবে। অভীর অর্থাৎ গোয়ালা সম্প্রদায়ের একজনকে পাওয়া যায় যার এ অসুখ হয়েছে। একে আলাদা কক্ষে নিয়ে হত্যা করা হয়। তার পেট চিরে দেখা যায় একটি বড় কৃমি রয়েছে। কৃমিটি যখন ওপরের দিকে উঠছে তখন খাদ্যনালীর যাবতীয় সামগ্রী উঠে আসছে এবং বমি হয়ে যাচ্ছে। আবার কৃমিটি যখন নীচের দিকে যাচ্ছে তখন খাদ্যনালীর যাবতীয় সামগ্রী নীচে চলে যাচ্ছে। এখানে এম্পিরিকাল বা অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে, তাহলে কি ব্রাহ্মণ-আধিপত্যবাদী সমাজের আনাচেকানাচে ব্রাত্য শল্য চিকিৎসা বা অননুমোদিত ঔষধির ব্যবহার চালু ছিল?
এর পরের অংশটুকু আরো কৌতুহলজনক। প্রথমে লঙ্কার গুঁড়ো এবং আদা দিয়ে দেখা হয়। ব্যর্থ হয় কৃমিটিকে মেরে ফেলতে। শেষে টাটকা পেঁয়াজ দিলে কৃমিটি মারা যায়। তিষ্যরক্ষিতা সম্রাটকে তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও (যেহেতু তিনি ক্ষত্রিয় ছিলেন) পেঁয়াজ খাওয়াতে সফল হন এবং সম্রাট সুস্থ হয়ে ওঠেন। লক্ষ্যণীয়, যেসময়ে এ ঘটনা ঘটছে তখন অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। Burnouf মন্তব্য করছেন – “in a period when king Aśoka was already entirely converted to Buddhism; and nonetheless the prejudice based on the existence of caste still exerted such a powerful control over his mind!” (p. 179) সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এ ভার ও অভিঘাত বর্তমান ভারতেও প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ঘটে চলেছে। চলেছে বিশ্বজুড়ে। ঐতিহ্যের এই অভিঘাত বহমান সামাজিক মনস্তত্ত্বের জগতে (social psyche) অত্যন্ত যত্ন নিয়ে উৎপাদন করা হয়। একেই ঐতিহাসিক হবসবম বলেছেন “inventing traditions”। আমরা খেয়াল করলে বুঝবো তিন ধরনের acculturation বা সাংস্কৃতিকীকরণের প্রক্রিয়া চলে। প্রথম, দৃশ্যগত বা কল্পজগতের (ভিসুয়াল) – মেডিক্যাল কলেজে শবদেহ ব্যবচ্ছেদের আগে নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন এবং সংস্কৃত কলেজের চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগে শবদেহের সাথে পরিচিত করানো, পশুদেহের ব্যবচ্ছেদ দেখানো এ কাজটি করেছিল। আবার ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসে মুনিঋষিদের নিজস্ব চার্টার্ড প্লেনে এক আশ্রম থেকে আরেক আশ্রমে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী পরিবেশন কল্পজগতের acculturation ঘটায়। দ্বিতীয়, শব্দগত বা শ্রাব্য (ভার্বাল) – এখানেও উদাহরণ হিসেবে মেডিক্যাল কলেজের পাঠ শুরু হবার আগে হিন্দু কলেজ বা অন্য বিদ্যায়তনে নতুন ধরণের ইংরেজি ও লাটিন শব্দ, ইডিয়ম এবং ভাবপ্রকাশের সাথে পরিচয় এ কাজটি সফলতার সাথে সম্পন্ন করে। অধুনা ভারতে জাতীয় সংগীতের প্রবল ব্যবহার বা যোগের অনুশীলনের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ বিভিন্ন শব্দবন্ধের ক্ষমতাশালী প্রকাশ ও প্রয়োগ একই উদ্দেশ্য সাধন করে। তৃতীয়, মনস্তাত্ত্বিক বা সাইকোলজিকাল – এর সুন্দর উদাহরণ পাওয়া যাবে সুধীর ককরের Shamans, Mystics and Doctors গ্রন্থে। ককর জানাচ্ছেন কিভাবে তাঁর ছোটবেলা থেকে ব্যবহার করা নিমের দাঁতন একদিন নিঃসাড়ে খসে পড়ে যায় – “the twig from the neem tree with which I brushed my teeth as a child and which I later sacrificed at the altar of modernization to the brush and the paste did more than just clean the teeth.” (p. 220) অর্থাৎ, একটি বা একধরণের তথ্য আরেক ধরণের তথ্যের দিকে যাত্রা শুরু করে। অংক দিয়ে বোঝালে t+1>t+2>t+3>t+n …. infinity। লক্ষ্য করতে হবে তথ্যের যাত্রাপথে সময় বা t একটি ফ্যাক্টর। কিন্তু শেষ অব্দি অসীমের দিকে যাত্রা বাস্তবে ঘটেনা। প্রতিটি ধাপে নির্দিষ্ট জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রবেশ করে এবং একটি বিশেষ সামাজিক, আর্থ-রাজনৈতিক এবং সমাজ মনস্তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে তথ্য রূপান্তরিত হয় কোন এক বিশেষ সময়ের প্রেক্ষিত নির্ভর বিশিষ্ট জ্ঞানে।
আমরা এবার ফিরে আসি জীবকের খুলি থেকে কৃমি বের করার চিকিৎসায়। জীবকের তথ্য চরক এবং সুশ্রুতের সংহিতায় এসে বদলে যায়। দুটি সংহিতাতেই খুলিতে শল্য চিকিৎসার পরিবর্তে nasal therapy বা নাসা-চিকিৎসার কথা বলা আছে। সুশ্রুত-সংহিতায় নাসা প্রক্ষালনের জন্য হ্রস্বশ্রীগুক গাছ বা নীল গাছের কথা বলা রয়েছে (বটনিকাল নাম – Indigofera tinctoria)। (দ্রষ্টব্যঃ যিস্ক – Studies in Traditional Indian Medicine in the Pali Canon: Jīvaka and Āyurveda) একই দেশে সময়ের পরিবর্তনের সাথে তথ্যের এই পরিবর্তন হল কেন? এর উত্তর রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। আমরা আলোচনার সুবিধের জন্য সংক্ষেপে বিষয়টি উপস্থাপনা করছি। সামাজিক এবং রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক স্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদের সর্বব্যাপী আধিপত্য শরীর ও সমাজ সম্পর্কে নতুন codification তৈরি করে। পরিণতিতে heterodox আয়ুর্বেদ চিকিৎসা orthodox মেডিসিনে রূপান্তরিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের পর্যবেক্ষনে ৬০০ খৃষ্টাব্দ থেকে শল্য চিকিৎসা সম্পূর্ণভাবে ব্রাত্য হয়ে যায় (History of Indian Philosophy, vol 2)। বরেণ্য নৃতাত্ত্বিক ফ্রান্সিস জিমারম্যান দেখিয়েছেন আয়ুর্বেদে বহুল ব্যবহৃত “পঞ্চকর্ম” পদ্ধতিতে প্রথম দিকে পঞ্চম পদ্ধতি হিসেবে blood-letting বা রক্তমোক্ষণ ছিল। কিন্তু, সময়ের সাথে “since bloodletting (the fifth of the evacuant therapies) has fallen into disuse, it was removed from the set of pañcakarman, and replaced by oily enemas.” (Zimmerman : Terminological Problems in the Process of Editing and Translating Sanskrit Medical Texts) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বর্তমান সময়ের আয়ুর্বেদের জীবন্ত বিশ্বকোষ হিসেবে স্বীকৃত মিউলেনবেল্ডের গবেষণাকর্মে। তাঁর “The constraints of theory in the evolution of classifications: A study on the position of blood in Indian medicine” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন আয়ুর্বেদের সাধারণভাবে স্বীকৃত ত্রি-দোষ তত্ত্বের শুরুতে রক্ত একটি উপাদান বা চতুর্থ দোষ হিসেবে ছিল। কিন্তু সামাজিক ও দার্শনিক বিভিন্ন টানাপোড়েনের ফলে রক্তকে আর “দোষ” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়না, একে ধরে নেওয়া হয় “দূষ্য” হিসেবে। এখানেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অভিঘাত রয়েছে। রক্ত-মোক্ষণ যেমন নিষিদ্ধ হয়েছিল তেমনি রক্ত নিজেই ত্রি-দোষবাদ থেকে চিরতরে পরিত্যতক্ত হল।
অথচ সমাজে তথ্য এবং জ্ঞানের সচল প্রবাহ থাকলে একেবারে ভিন্ন একটি চিত্র তৈরি হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মধ্য-উনবিংশ শতাব্দীতে লুই পাস্তুর যখন সংক্রামক রোগের কারণ হিসেবে জীবাণুকে আবিষ্কার করলেন তখন সমাজকে আর শুধু ধনী-দরিদ্রের দ্বিত্ব বিভাজনের মাঝে ভাবা সম্ভব হলনা। বরঞ্চ অনেকগুলো গ্রুপের ভিন্ন লিস্ট হিসেবে সমাজকে দেখা শুরু হল – অসুস্থ এবং সংক্রমণকারী মানুষ, সুস্থ কিন্তু জীবানুর বিপজ্জনক বাহক, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, টীকা দেওয়া হয়েছে এমন মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। (দ্রষ্টব্যঃ ব্রুনো লাতুর – The Pasteurization of France এবং Science in Action) লাতুরের মন্তব্য – for some decades between the Franco-Prussian War and World War One, it seemed reasonable to expect the sciences to eliminate political dispute. (Pasteurization of France, p. 8) অস্যার্থ, বিজ্ঞান ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনের কাজে। ভারতের ইতিহাসে এরকম কোন তথ্য পাওয়া দুর্লভ। বরঞ্চ বিজ্ঞান এখানে রাজনীতির হাতিয়ার বা নামান্তর হয়ে ওঠে। এর উৎস কিছু পরিমাণে নিহিত বিজ্ঞানের নিজের গড়ে ওঠার মাঝে। দর্শনের দিক থেকে বিচার করলে বিজ্ঞানের দুটি প্রধান ধারার একটি হল জার্মান ভাষায় An sich বা thing in itself বা intrinsically, আরেকটি হল লাটিনে inter se বা between or among themselves। অর্থাৎ, বিজ্ঞানকে নিজেতে নিজে সম্পূর্ণ হিসেবে ধরা যেতে পারে এবং একই সাথে সমাজতত্ত্বের আলোতে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানে ব্যবহৃত তথ্যকে বিচার করা যেতে পারে। আবার etymology বা ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে ধরলে science শব্দটির ভিন্ন ব্যঞ্জনা পাওয়া যাবে। লাটিন scientia (জ্ঞান বা জানা) থেকে science শব্দটি এলেও আরো কতগুলো অর্থ এবং এদের টানাপোড়েন এর মাঝে আছে। লাটিন sciender, to split, cleave, জার্মানে schezein, to split. এ ব্যঞ্জনাসমূহ সবই ধরা আছে science শব্দটির ব্যঞ্জনায়। জার্মানে schizein থেকে জন্ম নিয়েছে সর্বজ্ঞাত schizophrenia, যার আক্ষরিক অর্থ বিভাজিত মন বা split mind। “Science, scire, scindere, schizein, schizophrenia. A mind split into pieces.” (Derrick Jensen and George Draffan: Welcome to the Machine, p. 25)
সামাজিকভাবে তথ্য এবং জ্ঞানের প্রবাহ না থাকা অবস্থা একধরনের সামাজিক stasis বা নিশ্চলতা তৈরি করে। এরও ভালো উদাহরণ চরক ও সুশ্রুত সংহিতা। দুটি গ্রন্থেই ঔষধি সংগ্রহের ক্ষেত্রে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে – ছাগপালক, মেষপালক ও গোপালক এবং অপরাপর বনবাসীরাও ঔষধি সকলের নাম এবং রূপ জানেন। কিন্তু নাম এবং রূপ জানলেই যে ঔষধির সম্যক জ্ঞান লাভ হয়, তা নয়। যিনি ঔষধি সকলের নাম ও রূপ জানেন এবং গুণ ও কর্মানুযায়ী এদেরকে প্রয়োগ করতে সক্ষম, সেই যোগ্য ব্যক্তিকেই ঔষধির তত্ত্ববিদ বলা যায়। এবং যে ভিষক সর্বপ্রকারে ঔষধির তত্ত্ব অবগত আছেন; যিনি তাদের নাম এবং রূপ অবগত হয়ে দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করে এদেরকে প্রয়োগ করতে সক্ষম, তাঁদেরকেই বৈদ্যরাজ বলা যায়। (চরক-সংহিতা, সূত্রস্থানম, ১.১২০-১২৩; সুশ্রুত-সংহিতা, সূত্রস্থানম্, ২৬.১০) এখানে লক্ষ্যণীয়, ছাগপালক, মেষপালক ও গোপালক-এর উদ্ভিদের ধারণা সংক্রান্ত তথ্য বা প্রাথমিক জ্ঞান রূপান্তরিত হচ্ছে ভিষকের ঔষধির তাত্ত্বিক জ্ঞানে। শুধু তাই নয়, এর পরবর্তীধাপে দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করে যোগ্য বৈদ্যরাজ নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা রোগীর ক্ষেত্রে এদেরকে প্রয়োগ করতে সক্ষম। এখানে আরেকটি স্তরের তাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটে গেল। এ বিষয়ে বিমল মতিলাল, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এবং সতীশ বিদ্যাভূষণ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। মতিলালের মতে চরকের তথা ভারতীয় যুক্তিশাস্ত্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে – (১) পাশ্চাত্যের বিপরীতে ভারতে যুক্তিশাস্ত্রের প্রাথমিক ভিত্তি ব্যাকরণ, পাশ্চাত্যের মতো অংকশাস্ত্র নয়। (২) যেকোন তত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতীয় পদ্ধতিতে “certain epistemological issues are found to be included in the discussion of what we wish to call “Indian logic”…. Epistemological questions, however, are deliberately excluded from the domain of modern logic.” (Matilal, The Character of Logic in India, p. 14) কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় যে বিষয়টি তাহল ভারতীয় জ্ঞানতাত্ত্বিক যুক্তিপদ্ধতির মাঝে মানস বা mental events-এর স্থান আছে। এ কারণে একে “psychologized epistemology” বলা যেতে পারে। (দ্রষ্টব্য – মতিলাল, Logic, Language and Reality; J. N. Mohanty, Explorations in Philosophy: Indian Philosophy, Vidyabhusana, A History of Indian Logic) Psychologuzed epistemology-র একটি ভালো উদাহরণ, আমার বিচারে, রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন সংলাপ। আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে বলছেন মানুষ নিরপেক্ষভাবে সত্য কি থাকতে পারেনা? রবীন্দ্রনাথের উত্তর – না। আইনস্টাইন বলছেন – If there were no human beings any more, the Apollo Belvedere no longer would be beautiful? রবীন্দ্রনাথের উত্তর – না। এরপরে তিনি বলছেন সত্য তো মানুষের মধ্য দিয়ে বাস্তবে আসে। আইনস্টাইনের জবাব – I cannot prove my conception is right, but that is my religion. অস্যার্থ, রবীন্দ্রনাথ যখন জ্ঞানতত্ত্বে মানস বা মনের অবস্থানকে বোঝাতে চাইছেন, আইনস্টাইন সে বক্তব্যকে অপ্রমাণিত না করে “that is my religion” বলে তাঁর অবস্থানকে বোঝান।
আয়ুর্বেদের মতো “বিদ্রোহী” চিকিৎসাশাস্ত্র কিভাবে ধাপে ধাপে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে নির্বিষ নিরাময় প্রক্রিয়া হয়ে উঠলো বৌদ্ধিক আলোচনার জগতে সে এক উদ্দীপক অনুসন্ধানের বিষয়। আলোচিত দুটি সংহিতাতেই ভিন্ন ভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে রোগীর প্রকৃতি অনুযায়ী কুক্কুট মাংস থেকে শুরু করে ছাগ, মেষ, ময়ূর, গোসাপ, সজারু, গরু, মোষ, শূকর, শশক ইত্যাদি প্রায় সমস্ত দৃশ্যমান পশু ও পাখীর মাংস খাবার অনুমোদন ও প্রেসক্রিপশন রয়েছে। (চ।স, সুত্রস্থানম, ২৭.৬৩-৮৭; সু।স, সুত্রস্থানম, ৪৬) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় একটি গোড়ার প্রশ্ন করেন – Can a physician – with a medical scruple as strong as to declare all this – be prevented by religious or other scruples to recommend the flesh of the cow in cases where he is convinced of its efficacy? (Science and Society in Ancient India, p. 389) কিন্তু বাস্তবে এটাই ঘটেছে। এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ এখনো ঘটে চলেছে, যে কারণে ইতিহাসের এই তথ্য বর্তমান রাষ্ট্রকেন্দ্রিক hegemonic জ্ঞানের প্রতিস্পর্ধী প্রসারিত কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে এখানে একটি কথা আমাদের বোধে রাখা দরকার – আয়ুর্বেদের সমগ্র টেক্সট-এ এবং পরিকল্পনায় নারীর কোন স্থান নেই, রয়েছে পুরুষের অকম্পিত দৃষ্টি (unwaveringly male gaze)। স্ত্রীর ব্যাপারে বলা হয়েছে – গূহ্য কথা শোনাবেনা, অতি বিশ্বাস করবেনা, কিংবা অধিকারিণী অর্থাৎ তাকে সর্বেসর্বা করবেনা। (চ।স, সুত্রস্থানম, ৮.২২)
এর পরিণতিতে, যেমন জিমারম্যান পঞ্চকর্মের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন তেমন করে রাষ্ট্রের কল্পিত ভাষ্যের সাথে অসংগতিপূর্ণ আয়ুর্বেদের অংশগুলো যদি ছেঁটে দেওয়া যায় কিংবা ভদ্রদুরস্ত বানিয়ে ফেলা যায় তাহলে এই টেক্সটগুলোকেই সামাজিক রীতিনীতি নিয়ন্ত্রণের কাজে সহজেই ব্যবহার করা সম্ভব। তথ্যকে কে ব্যবহার করছে, কোন প্রেক্ষিতে ব্যবহার করছে, কি জন্য ব্যবহার করছে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে। আয়ুর্বেদের দৃশ্যমান (surface) দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোকে রক্ষা করেও এ কাজটি করা সম্ভব। বর্তমান আধুনিক আয়ুর্বেদের শিক্ষায় এ পন্থাটিই সফল ও দৄঢ়ভাবে অনুসৃত হচ্ছে।
১৭৯৪ সালের অক্টোবর মাসের Gentleman’s Magazine-এ পুণার এক কুমোর পরিবারের করা কাটা নাক পুনর্গঠিত করার (rhinoplasty) বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। বারাক লংমেট (B. L) নামে এক সাংবাদিক এরকম চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লন্ডনে পাঠায়। এ খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছনোর পরে ডঃ কারপু (Carpue) প্রায় ৩৫টি rhinoplasty করেন এবং ওদেশে সফল rhinoplasty-র জোয়ার আসে। আমরা লংমেটের চিঠিটি হুবহু তুলে দিচ্ছি।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে এদেশের কুমোর পরিবারের কাছে যা একটি স্বাভাবিক পারিবারিক ক্র্যাফটের (craft) ঘটনা ছিল সেটা অষ্টাদশ শতাব্দীর সাংবাদিকতা, ন্যারেটিভ এবং মেডিসিনের হাতে পড়ে case-এ রূপান্তরিত হল। সর্বোপরি, এখানকার অভিজ্ঞতালব্ধ নিজস্ব পারিবারিক জ্ঞান স্রেফ তথ্য হিসেবে পৌঁছলো জ্ঞানের “কেন্দ্র” পাশ্চাত্যে। ওখানে পরিস্রুত হবার পরে তা নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে রূপান্তরিত হল এবং আবার ফেরত এলো “প্রান্তে”। অর্থাৎ, জ্ঞান ও তথ্যের মাঝে এক reverse flow বা বিপরীত প্রবাহ শুরু হল। লাতুর একে immutable and convertible mobiles বলেছেন। তাঁর বয়ানে – “additional work was to be done inside the centres to mop up the inscriptions and reverse the balance of forces once more.” (Latour, Science in Action, p. 233) ঐতিহাসিক বেইলি ডাক্তার জড্ড্রেলের ক্ষেত্রে সমধর্মী বিষয় দেখেছেন – “Joddrell quizzed brother surgeons from different stations (in India) and acted as conduit of information in both directions between Britain and India.” (C. A. Bayly, Empire and Information, 2007, p. 269)। বেইলির বিবরণ অনুযায়ী এদেশের ইউরোপীয় এবং ভারতীয় ডাক্তাররা বৈজ্ঞানিক তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী ছিল। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপীয়দের বুদ্ধিবৃত্তির তুলনায় অ-ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতির বুদ্ধিবৃত্তি কত ন্যূন এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়। লন্ডনের ডাক্তার জর্জ মারে প্যাটারসন ফ্রেনলজি বা খুলিবিদ্যা নিয়ে এরকম গবেষণা জোরকদমে করছিলেন। Transactions of the Phrenological Society বলে একটি জার্নাল ১৮২০ থেকে কয়েক বছর প্রকাশিতও হয়। এদেশের তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে রামমোহনের একটি চিঠির সন্ধান আমরা পেয়েছি। ১৮২২ সালে রামমোহন ১০টি হিন্দু খুলি এদেশ থেকে প্যাটারসনকে পাঠিয়েছিলেন, এবং প্রয়োজনে আরো পাঠাতে প্রস্তুত ছিলেন। সেসময়ের ভারতবর্ষে কেঊ ১০খানা হিন্দু খুলি (অন্য জাতি নয়) পাঠাচ্ছে, এ এক অস্বাভাবিক ঘটনা। কিভাবে সংগ্রহ হল এই খুলিগুলো? ১৮২৪-এর জার্নালে প্যাটারসন রামমোহনের এক চিঠি প্রকাশ করেন। সেটা হুবহু এরকম।


লন্ডা শিয়েবিংগার (Londa Schiebinger) তাঁর Plants and Empire গ্রন্থে জানিয়েছেন – The Indians (Red Indians), who are not treated well by their Dutch masters, use the seeds (of Peacock plant) to abort their children, so that their children will not become slaves like they are – রেড ইন্ডিয়ান মহিলারা তাদের সন্তানদের ওলন্দাজদের হাতে ক্রীতদাস হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য কৃষ্ণচূড়া ফুলের বীজ খেয়ে গর্ভপাত ঘটায়। বটানির ইতিহাস ও তথ্য জড়িয়ে যায় জনজাতির বিশেষ ধরণের প্রতিরোধের উপাখ্যানের সাথে। “[T]he exact knowledge of nature was key to amassing national wealth, and hence power.” (Schiebinger, Plants and Empire, p. 5) একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে বলা যায়, ইউরোপে ১৭৩৫ সালটি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ – প্রথমত, ক্যারোলাস লিনিয়াসের যুগান্তকারী গ্রন্থ Systema Naturae (The System of Nature) প্রকাশিত হল; দ্বিতীয়ত, ইউরোপের প্রথম সংহত আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক অভিযান শুরু হল। এর ফলশ্রুতিতে, মারি লুই প্র্যাটের ভাষায়, ইউরোপে এক “planetary consciousness”-এর জন্ম হল। শুধু কেনাবেচার বাণিজ্যের বাইরে উপনিবেশের অভ্যন্তরে অভিযান চালানো শুরু হল অভ্যন্তরকে জানার জন্য। একটি contact zone তৈরি হল – এর আগে যেমন বলেছি যে তথ্য ও জ্ঞানের reverse flow-র পাশাপাশি অবস্থানের অঞ্চল। এসময় দিয়ে গোটা পৃথিবীতে ১৬০০রও বেশি বটানিকাল গার্ডেন তৈরি হল উপনিবেশের উদ্ভিদকুল এবং বাণিজ্যিক ও মেডিসিনের জগতে এদের গুরুত্ব বুঝে নেবার জন্য। প্রসঙ্গত, ভারতের মালাবার অঞ্চলের ২৫০-এরও বেশি ঊদ্ভিদ Systema Naturae-র শ্রেণীবিভাগ করতে সাহায্য করেছে। (Mary Louis Pratt, Imperial Eyes, 2nd edn.) রিচার্ড গ্রোভ মন্তব্য করেন – Indigenous European notions about nature were gradually transformed, or even submerged, by a plethora of information, impressions and inspiration from the wider world.” (Grove, Green Imperialism, p. 3) একইসাথে “agnotology” বলে একটি নতুন ধরণের জ্ঞান প্রক্রিয়াও গড়ে ঊঠতে লাগলো। Agnotology-তে সচেতন এবং অসচেতনভাবে সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবিত অজ্ঞতা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে এলো। উপনিবেশ এবং পুঁজির প্রয়োজনে প্রেক্ষিত-নির্ভর অজ্ঞতা ক্রমোৎপাদিত হতে শুরু করলো। (দ্রষ্টব্যঃ Robert N. Proctor and Londa Schiebinger, eds., Agnotology) আরেকটি বিষয়, “planetary conscious” বা “contact zone”-এর মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবী যখন বিজয়ীর করায়ত্ত্ব হল তখন ভাষা এবং জ্ঞানের জগতে নতুন এক পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। ফুকোর ভাষায়, যে observing gaze দেখছে তার প্রকাশের উপযোগী করে “to bring language as close as possible to the observing gaze, and the things observed as close as possible to words.” (The Order of Things) শুধু তাই নয়, অসুখের ক্ষেত্রে উপনিবেশের জন্ম হবার ফলে বিভিন্ন নতুন ক্যাটিগরির উদ্ভব হল – মেট্রোপলিটান এপিডেমিওলজির নিশ্চয়তা ভেঙ্গে hybrid disease landscape তৈরি হল। এক্ষেত্রে আবার জ্ঞানের বিপরীত প্রবাহ প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের দিকে যাত্রা করলো। (Alan Bewell, Romanticism and Colonial Disease) আরো একটি তথ্য আমাদের সাহায্য করতে পারে। ১৯১০-১১ সালে গ্যালটন ও ড্যাভেনপোর্টের হাত ধরে ইউজেনিকসের সূচনা হয়েছিল আমেরিকাতে – by 1941 some sixty thousand individuals in the United States had duly been sterilized, half of them in California alone. (James Watson, DNA: The Secret of Life, p. 28) কিন্তু ফ্যাসিস্ট জার্মান রাষ্ট্র যখন holocaust শুরু করলো তখন বিশ্ববাসী আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে গেল। তথ্যের দুটি ভাগ হল – আমেরিকাতে সংগুপ্ত, জার্মানিতে ব্যক্ত, অস্তিত্বগতভাবে বীভৎসতম।
কিন্তু তথ্য ও জ্ঞানের চেনা প্যাটার্ন ও ছক ভেঙ্গে যায় “গুজব”-এর মুখোমুখি হয়ে। লুডভিগ ফ্লেক তাঁর বিখ্যাত Genesis and Development of a Scientific Fact গ্রন্থে বিজ্ঞান গবেষণায় সক্রিয় বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীর মধ্যে এক নির্দিষ্ট thought style এবং thought collective-এর কথা বলেছিলেন। দেখিয়েছিলেন কিভাবে বহুক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক তথ্যের সংহত চেহারার আগে প্রোটো-আইডিয়া থাকে যেখান থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্যের যুগান্তকারী উন্মেষ ঘটে। রণজিৎ গুহের কৃষক চৈতন্য নিয়ে মূল্যবান গ্রন্থ Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India-তে গুজব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় গুজবকে বলেছেন “anonymous speech in its classic form” এবং “immediate unpremeditated utterance”। প্রাক-আধুনিক কৃষিনির্ভর অশিক্ষিত জনসমাজে শব্দের লেখ্য রূপ (grapheme) থাকেনা। গুজবের শ্রাব্য কাহিনী (phoneme) নিত্যনতুন সিগনিফায়েড (signifies) তৈরি করতে থাকে। ফলে উপনিবেশের শাসকদের তথ্য সংগ্রহ এবং একে সাজানোর যে চালু ছক থাকে তা ভেঙ্গে যায়, তথ্যের শৃংখলার মাঝে irruption/subversion ঘটে। তথ্যকে এখানে হটিয়ে দেয় গুজবের মতো প্রোটো-ইনফরমেশন। আমার বিচারে, ফ্লেকের ব্যবহৃত প্রেক্ষাপটের বাইরে এক সম্পূর্ণত ভিন্ন প্রেক্ষিতে প্রাক-আধুনিক কৃষিনির্ভর অশিক্ষিত জনসমাজে ফ্লেকের thought style এবং thought collective-এর যুগপৎ উপস্থিতি ও সক্রিয়তা নতুন ভূমিকা পালন করতে পারে, এবং করেও। দাবানলের মতো দ্রুত সামাজিক প্রবাহের মাধ্যমের তথ্যের সাজানো বাগান তছনছ করে দেয় গুজবের মতো প্রোটো-ইনফরমেশন। (দ্রষ্টব্যঃ Gordon W. Allport and Leo J. Postman, The Psychology of Rumor) এ গ্রন্থেই অ্যালপোর্ট এবং পোস্টম্যান মন্তব্য করেছেন – No riot ever occurs without rumours to incite, accompany and intensify the violence. আমরা ভারতের সাথে একবার মিলিয়ে নিই, বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। জোয়েল বেস্ট তাঁর More Damned Lies and Statistics: How Numbers Confuse Public Issues গ্রন্থে দেখিয়েছেন উপকথাগুলো বেঁচে থাকে কারণ “they arouse fear, disgust, or other other powerful emotions that make the tales memorable and repeatable”। একেবারে হাতে গরম বাবা রাম রহিম ও তার বাহিনীর তান্ডবের সাক্ষী রয়েছি আমরা।
তথ্যের থেকে জ্ঞানে রূপান্তরিত হবার পাশাপাশি বৃহৎ শক্তিধরের তৈরি/নির্মাণ করে নেওয়া তথ্যের একেবারে মৌহূর্তিক ও বিপুল ব্যবহার বর্তমান দুনিয়ায় ঘটছে পোস্ট ট্রুথ নামে, যার ব্যবহার রাষ্ট্রকে আরো বৈধতা দেয়, সত্যমিথ্যের বিভাজন মুছে রাষ্ট্রিক হিংসাকে সার্বিক করে তোলে। য়ুভাল হারারি তাঁর Sapiens গ্রন্থে বলছেন – সহিষ্ণুতা সেপিয়েন্সের ট্রেডমার্ক নয়। যদি সেপিয়েন্সরা নিয়ান্ডার্থালদের ব্যাপারে সহিষ্ণু হত তাহলে “the first and most significant ethnic cleansing in history” হতনা। সেটা স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ হলেও বিবেচনায় রাখা জরুরি। কিন্তু প্রোটো-ইনফরমেশন এবং প্রোটো-আইডিয়া যে একই সাথে সামাজিক কাঠামোতে অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারে তা দেখিয়েছে গুজব – তথ্য হয়ে ওঠার পূর্বরূপ। এবং সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানের জগতের thought style এবং thought collective-এর এক নতুন ধরনের অভিনব ব্যবহারও শুরু হয় mutated চরিত্র নিয়ে। সে আরেক কৌতুহলোদ্দীপক অনুসন্ধানের অঞ্চল।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

Leave a Reply to জয়ন্ত ভট্টাচার্য Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২