পুজোর বাংলা গানের সেকাল ও একাল – প্রবীর মিত্র

পুজোর বাংলা গানের সেকাল ও একাল – প্রবীর মিত্র

শেয়ার করুন

খুব ছোটোবেলা থেকে আমার গান শোনার সঙ্গী ছিল রেডিও। মনে পড়ে প্রত্যেক শনিবার দুপুরে সঙ্গী হত রেডিওতে চলা ‘অনুরোধের আসর’। আমার বাবা একজন রবীন্দ্রসংগীত-শিক্ষক হওয়ায় বাড়িতে গানবাজনার একটা চল ছোটোবেলা থেকেই দেখে এসেছি। বাবার মতো রবীন্দ্রগায়ক হতে না পারলেও মনে মনে একটা ইচ্ছে সেই ছোট্টবেলা থেকে মনের মধ্যে লালিত হয়ে এসেছে সেটা হল বিভিন্ন ধরনের গান শোনা ও তা সংগ্রহ করা। আমি মনে করি সুর-ছন্দ মানুষের জন্মগত ভালোলাগার জিনিস। বোল ফোটারও আগে শিশু উপভোগ করে মায়ের ঘুম পাড়ানি গান। মাথা দোলায় হাততালি দেয় কোনও ছন্দের সঙ্গে। সংগীতই জানে দ্রবণের যাদু, জানে মানুষের অন্দরের গভীরতম রসায়ন। তাই পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষকে বশীকরণের কোনও মন্ত্র যদি কারও কাছে থাকে, সেটা একমাত্র সংগীতেরই আছে। ইতিহাস এর বারবার সাক্ষী। কত-না বিপন্ন সময়ে মানুষের বিচ্ছিন্নতা বোধকে ধূলিসাৎ করে সম্প্রীতির রাখিবন্ধন করেছে এই সংগীত। কাজেই, নিজে নাই-বা গাইলাম গান। কিন্তু গানের ইতিহাস ও সেটা সংগ্রহ করা আজও ভীষণ ভালো লাগার। মনে আছে প্রথম টিউশনের টাকা পেয়েই কিনে ফেলেছিলাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সম্পাদিত বাংলা গানের সংকলন ‘আবার বছর কুড়ি পরে’। ততদিনে অবশ্য শুনে ফেলেছি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তোমাকে চাই’, নচিকেতার ‘এই বেশ ভালো আছি’ ও অঞ্জন দত্তর ‘শুনতে কি চাও’ অ্যালবামটি। বাবার ব্যক্তিগত সংগ্রহের পছন্দের তালিকায় ছিল হেমন্ত, মান্না, সতীনাথ, মানবেন্দ্র, অখিলবন্ধু, লতা মঙ্গেশকর প্রমুখ শিল্পীদের ক্যাসেট। আমাদের বাড়ির একতলায় সম্পর্কে এক কাকুর ছিল ক্যালিপসো রেকর্ড প্লেয়ার। তখনকার বাঘা বাঘা শিল্পীদের সব লং প্লে রেকর্ড ও ছোটো রেকর্ড তাতে বাজত। কেন জানি না আমাদের ঘরের টেপ রেকর্ডারে চালানো গানের থেকে কাকুর রেকর্ডে চালানো গানগুলো যেন আমাকে বেশি টানত। মনে হত যেন সেই ঘুরন্ত কালো চাকতির ভিতরে কোথাও যেন বসে বসে সুর আর কথার মায়াজাল বুনে চলেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে বা শচীনদেব বর্মন। মনে আছে, ‘হিজ মাস্টার ভয়েস’-এর সেই ‘নিপার’ নামক কুকুরটির মতো আমিও রেকর্ড প্লেয়ারের সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে গান শুনতাম। আর একটা আকর্ষণও অবশ্য ছিল। কাকুর সংগ্রহে ছিল এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত কিছু পুরোনো সংখ্যার ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা। আসলে ‘পুজোর গান’ মানে তো শুধু দুটি শব্দ নয়, এটি আসলে একরাশ অনুষঙ্গ নিয়ে আসে। দুর্গামূর্তি একই সঙ্গে মাতা এবং শক্তিরূপের সংস্করণ হয়ে আছে বাঙালির মননে। তাই প্রত্যেক বছর ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকার মলাটে দুর্গামূর্তির ছবিসহ ভিতরে পাতার বামপাশে অথবা ডানপাশে শোভা পেত শিল্পীর দুইরঙা ছবি স্বাক্ষরসহ এবং ছবির পাশে সেই শিল্পীর গাওয়া গানের লিরিক এবং সেইসঙ্গে সেই গানের গীতিকার ও সুরকারের নাম। আর থাকত নানা ধরনের রেকর্ড প্লেয়ারের বিজ্ঞাপন, দামসহ। বিভিন্ন শিল্পীর প্রকাশিত লং প্লে ও ছোটো ই. পি. (Extended play) রেকর্ডও সুদৃশ্য কভারের ছবি এবং দামসহ বিজ্ঞাপিত হত। এর পাশাপাশি থাকত নাটক, কবিতাপাঠ, গীতিনাট্য, কৌতুকনক্সা ইত্যাদির রেকর্ডের কভার এর ছবি। একটা সময় এমনও হয়েছে, ছোটো ইপি রেকর্ডে হয়তো শচীনদেব বর্মনের গাওয়া ‘শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি’ গানটি বাজছে আর আমি ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা থেকে সেই গানের লিরিকটা মিলিয়ে নিচ্ছি। পরে বাবাকে দেখেছি হেমন্ত বা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গানের লিরিকগুলো ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা থেকে ডায়েরিতে লিখে নিতে।

ক্যালিপসো রেকর্ড প্লেয়ার
‘শারদ অর্ঘ্য’তে রেকর্ড প্লেয়ারের বিজ্ঞাপন

১৯১৪ সালে ‘পুজোর গান’-এর রেওয়াজ চালু হয়। ‘শারদীয়া’ নাম দিয়ে সে বছর পুজোয় গ্রামোফোন কনসার্ট থেকে ১৭টি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ‘পুজোর গান’– এই শব্দবন্ধটি তখনও চালু হয়নি। সেই সময় যে ১৭টি রেকর্ড বের হয় তাতে মানদাসুন্দরী, বেদানা দাসী, অমলা দাস, নারায়ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কে মল্লিক, কৃষ্ণভামিনী প্রমুখ শিল্পীদের গান ছিল। সে সময়ে গৃহস্থ বাড়ির মহিলারা কিন্তু প্রকাশ্যে গান গাইতেন না। রেকর্ডে যারা গাইতেন তাঁরা ছিলেন মূলত বাইজি শ্রেণির মহিলা। মানদাসুন্দরী, বেদানা দাসী, কৃষ্ণভামিনীরা ছিলেন তৎকালীন সমাজের নামকরা বাইজি। তখন রেকর্ডের লেবেলে এঁদের পরিচয়ও গোপন করা হত না। লেখা হত অমুক জায়গার খ্যাতনামা বাইজি। যেমন ইন্দুবালা দাসীর গানের রেকর্ডে লেখা হত ‘রামবাগানের ইন্দুবালা’। এঁদের গাওয়া আগমনি, কীর্তন, বিজয়ার গান কিন্তু দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন অমলা দাশ বা মিস্ দাশ। তিনি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ছোটোবোন। ১৯১৪ সালে শারদীয়া রেকর্ডে অমলা দাশ গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের দুটি গান। অপরদিকে পুরুষশিল্পীরা কিন্তু কোনো অংশে কম ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে কে. মল্লিক নামে এক শিল্পীর কথা বলা যেতে পারে। উনি অসাধারণ কিছু আগমনি গান রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ইনি কিন্তু হিন্দু ছিলেন না। বর্ধমান জেলার কুসুমপুর গ্রামের এক মুসলিম চাষি পরিবারের ছেলে হলেন এই কে. মল্লিক। আসল নাম মহম্মদ কাশেম। কিন্তু আসল নাম রেকর্ড লেবেলে লেখা থাকলে এবং সেটা পুজোর আগমনি গান হলেও তৎকালীন হিন্দু সমাজ সেটা মেনে নেবে না এবং রেকর্ডও বিক্রি হবে না। তাই গায়কের নাম পালটে রেকর্ড কভারে ছাপা হল ‘আগমনী গানে কে. মল্লিক’ ।

মানদা সুন্দরী দাসীর রেকর্ডের কভার
আব্বাসউদ্দীন আহমেদ
‘রামবাগানের ইন্দুবালা’ খ্যাত ইন্দুবালা দেবী


ধীরে ধীরে শারদীয়াতে গান করাটা একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি আঙ্গুরবালা, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, শচীনদেব বর্মন প্রমুখ শিল্পীদের যাদের পুজোর গানের রেকর্ড গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশ হয়েছে এবং দারুণ সাফল্য পেয়েছে। তারপর গানের ধারা আস্তে আস্তে পালটাতে লাগল। কীর্তন, আগমনি, বিজয়ার গান কিংবা রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে আধুনিক গান। একে একে রেকর্ড হতে থাকল কে এল সায়গল, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো শিল্পীদের গান এবং সে গানও হল সুপারহিট। ১৯১৭ সালের শারদীয় রেকর্ড মারফত বাংলা গানে কৃষ্ণচন্দ্র দে বা কানাকেষ্ট-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ। সেই সময়েই গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড বিক্রি বাড়ানোর জন্য প্রকাশিত গানের কথাসহ ‘শারদীয়া’ নামে একটি ছোটো পুস্তিকা প্রকাশ করা শুরু করে। রেকর্ড কেনার সময় ক্রেতা রেকর্ডের সঙ্গে এই বইটি ফ্রি কপি হিসাবে পেতেন। বলাই বাহুল্য সংগীতপ্রিয় বাঙালির কাছে এটি ছিল একটা বাড়তি পাওনা। এর কয়েক বছরের মধ্যেই এইচ এম ভি-র দেখাদেখি অন্যান্য রেকর্ড কোম্পানিগুলি যেমন কলম্বিয়া আর মেগাফোনও তাঁদের প্রকাশিত গানের তালিকার আলাদা বই বের করা শুরু করে।

সেই রকমই ১৯৩৮ সালের ‘শারদীয়া’ নামে একটি পুস্তিকার ভূমিকায় লেখা হয়েছে, “সুর নিয়ে আমাদের কারবার– সেই সুরের ডালি ‘শারদীয়া’ সাজিয়ে আমরা উপহার দিই শারদীয়ার প্রতি বৎসর বাংলার সংগীত রসজ্ঞদের”। ‘শারদীয়া’-র লেখক তালিকায় সেই সময় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, নলিনী সরকার, হিমাংশু দত্ত, আব্বাসউদ্দিন প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ। তার সাথে প্রকাশিত হত সেই বছর পুজোয় প্রকাশিত গানের বিস্তারিত বর্ণনাসহ রেকর্ডের তালিকা ও প্রকাশিত রেকর্ডের নম্বর। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যূথিকা রায়ের দুটি গানের বিজ্ঞাপনের কথা। ‘বনের তাপস কুমারী আমি’ এবং ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে’, এই গানদুটির বিষয়ে উল্লেখ ছিল “সুকণ্ঠী কুমারী যূথিকার এই নতুন গান বনের তাপসিনীর মতোই শুচি-সুন্দর ও শ্রীময়ী”। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, স্বর্ণকণ্ঠী যূথিকা রায়ের গান দিয়েই পুজোর গানের রমরমা শুরু। ইতিমধ্যে প্রণব রায়ের কথায় ও কমল দাশগুপ্তের সুরে যূথিকা দুটি গান গেয়েছিলেন যা সেই সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত ‘আমি ভোরের যূথিকা’ এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি’। শুধু গানই নয় বাদ্যযন্ত্রে কীর্তন ও ভাটিয়ালির সুর, হাস্যকৌতুক ও প্যারোডি-গানের রেকর্ড বেরত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। তৎকালীন কৌতুকশিল্পী রঞ্জিত রায়ের হাস্যকৌতুক ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এর পাশাপাশি থাকত নাটক, যাত্রাপালা, কীর্তন ইত্যাদি সব রেকর্ড। রেকর্ডের কভারে লেখা থাকত “আজি শরতের দিনে আমরা এনেছি নব পূজা-সম্ভার” কিংবা “কথা ও সুরের কুসুমে রচিত নতুন গানের হার”।

১৯৪৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পুজোর গান সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা অবলম্বনে সলিল চৌধুরী সুরারোপিত ‘রানার’ গানটি। শোনা যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা মাথায় রেখেই সলিলবাবু এই গানের সুরারোপ করেছিলেন, আর এটা বলা বাহুল্য গানটি বাংলা গানের জগতে একটা মাইলস্টোন। “রানার গ্রামের ডাক হরকরা, রাতের পর রাত, ক্লান্তিহীন মানুষের সুখ দুঃখের খবরের বোঝা বয়ে সে পৌঁছে দেয় দূরে দূরে কিন্তু তার খবর কে রাখে?”, এই ভাষ্যপাঠের পর গানটি যখন শুরু হয় তখন মনে হয় এক সাধারণ গ্রাম্য ডাকহরকরার কথা এত অসাধারণভাবে আর কি কেউ উপস্থাপিত করতে পেরেছে? এর বেশ কিছু পরে লতা মঙ্গেশকরের মতো শিল্পীও তাঁর ‘অবাক রাতের তারারা’ এ্যালবামে ‘রানার’ গানের রিমেক করেছেন, কিন্তু সে গানটি মূল গানের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। ‘রানার’ গানের সাফল্যের হাত ধরে সলিল চৌধুরী পরবর্তী বছরে আবার কবি সুকান্তের আর একটি কবিতায় সুরারোপ করলেন এবং এবারও সেই হেমন্তবাবুর ডাক পড়ল রেকর্ডিং-এ। ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। ওই একই বছরে অর্থাৎ ১৯৫০ সালে যূথিকা রায় পুজোয় রেকর্ড করলেন, ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’ (কথা: প্রণব রায় ও সুর: কমল দাশগুপ্ত) এবং সেই বছর গানটি হেমন্তবাবুর গাওয়া ‘অবাক পৃথিবী’-র পাশাপাশি একেবারে সুপার হিট। ১৯৫৩ সাল নাগাদ এইচ এম ভি তাঁদের পূর্ব প্রকাশিত ‘শারদীয়া’ বইটি আমূল বদলে দিল এবং নতুন নাম হল ‘এইচ এম ভি শারদ অর্ঘ্য’। দাম ঠিক হল ৩ আনা। আর ঠিক এই সময় বাংলা গানে আর এক বলিষ্ঠ গায়কের উদয় হল। ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’ এবং ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ – গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখায় প্রবোধচন্দ্র দে (মান্না দে) প্রথম বাংলা গানে প্রবেশ করলেন। গানদুটির সুরও তার। তখন অবশ্য মান্না দে-র পরিচিতি ছিল কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ভাইপো হিসাবে। ১৯৫৪ সাল ছিল ভারতীয় রাজনীতিতে একটা অশান্ত সময়। কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। সেই সময় সলিল চৌধুরী সৃষ্টি করলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ এবং সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সুরসৃষ্টি করলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত ছন্দকবিতা ‘ছিপখান তিনদাঁড় তিনজন মাল্লা’য়। প্রথম গানটি গাইলেন হেমন্তবাবু এবং পরবর্তী গানটি গাইলেন শ্যামল মিত্র। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি সলিল চৌধুরী তাঁর ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ গানটির হিন্দি ভার্সন ১৯৫৬ সালে ‘আওয়াজ’ ছবিতে ব্যবহার করেন এবং সেখানে এই গানটি ছিল ডুয়েট। গেয়েছিলেন হেমন্ত ও লতা।

১৯৫৭ সালে পুজোয় প্রকাশিত মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গানটি শোনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শ্যামল গুপ্তের কথায় মানবেন্দ্র এই গানের সুর করেন। তবে এর পিছনে একটি গল্প ছিল। মানবেন্দ্রবাবুর কথায় জানা যায়, বন্ধু শ্যামল যখন গানটি তাঁর কাছে নিয়ে আসে সুরসৃষ্টির জন্য, তখন তিনি গানের লাইন পড়ে ভেবে পাচ্ছিলেন না কীভাবে এত গভীর বাণীর সহজ সুর তিনি তৈরি করবেন। এদিকে আর কিছুক্ষণ পরেই রেডিওতে তাঁকে গান গাইতে হবে। একেবারে ঘেঁটে গেলেন তিনি। একটা সিগারেট খাবার জন্য তিনি স্টুডিয়োর অন্ধকার সিঁড়ি ধরে ছাতে ওঠার সময় হঠাৎ শুনতে পেলেন পাশের একটা অন্ধকার ঘর থেকে পিয়ানোটা কেমন যেন আপনা-আপনি বেজে উঠল। সবাই জানত গার্স্তিন প্লেসের ওই বাড়িতে আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায় আর নিজে থেকেই হঠাৎ হঠাৎ পিয়ানো বেজে ওঠে। মানবেন্দ্রর তখন ওসব কিছুই মনে নেই। সেই ভৌতিক পিয়ানোর শব্দ থেকে উনি গানের চলন ও প্রথম সুরটাই পেয়ে গেছেন তখন। দৌড়ে নেমে এসে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়লেন গানের স্বরলিপি করতে। সেইদিনই রাতের আসরে রেডিওতে মানবেন্দ্র গাইলেন সেই কালজয়ী গান ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। এই গানটির মধ্যে যেন একটা haunting ব্যাপার আছে আর শ্যামলবাবু চেয়েছিলেন মানবেন্দ্র যেন প্রেমের সংলাপের মতো করে গানটির উপস্থাপনা করেন। মানবেন্দ্র বন্ধুর কথা রেখেছিলেন সেটা আজও বোঝা যায় গানটি শুনলে। আর এই গানের গীতিকার শ্যামল গুপ্তের আরেকটি পরিচয়ও আছে, ইনি গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী।

এর বেশ কিছু বছর পর ১৯৬৫ সাল নাগাদ গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে রাহুলদেব বর্মন সুরারোপ করলেন পুজোর গানে। ‘আমি বলি তোমায় দূরে থাকো তুমি কথা রাখো না’ এবং ‘আমার মালতীলতা কি আবেশে দোলে’ গানদুটি গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। সেই শুরু, এরপর রাহুলদেব বর্মনের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি কালজয়ী কিছু বাংলা পুজোর গান। প্রায় প্রতি বছর রাহুল-আশা জুটি তো পুজোর গানে একটা সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৬৭ সাল নাগাদ প্রথম কিশোর কুমারকে দিয়ে পুজোর বাংলা গান গাওয়ালেন রাহুলদেব। গীতিকার মুকুল দত্তের কথায় কিশোর গাইলেন ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’। আর এর হিন্দি ভার্সনও ১৯৭৩ সালে কিশোর গেয়েছিলেন ‘অনামিকা’ ছবির জন্য সেটা সবার জানা।

১৯৬৯ এ প্রথম নিজের সুরে নিজেই গান রেকর্ড করলেন রাহুলদেব বর্মন। প্রথমে গানটি কিশোরকুমার গাইবেন ঠিক হয়েছিল। কিশোর মন দিয়ে শুনলেন কিন্তু খুব একটা পছন্দ হল না। তখন রাহুল ঠিক করলেন গানটি তিনি নিজেই গাইবেন। সুর তো তৈরি কিন্তু গানের কথা কে যোগাবেন? রাহুল ধরে বসলেন তাঁর বন্ধু শ্রী শচীন গুপ্তকে। সেই সময় শচীনবাবু বোম্বাই-এর বেশ কয়েকটি ছবিতে চিত্রনাট্য লেখার কাজে ব্যস্ত। শচীন গুপ্ত তো কোনোদিন গান লেখেননি। এদিকে রাহুল নাছোড়বান্দা, যেমন করেই হোক পুজোর জন্য একটা গান তার চাই-ই চাই। তখন শচীনবাবু তাঁর স্কুলজীবনের বান্ধবী ছবি রায় (হয়তো শচীন গুপ্ত-এর প্রথম প্রেমিকা যার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন তিনি) -এর কথা স্মরণ করে লিখে ফেললেন সেই বিখ্যাত গান ‘মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি’। শচীন গুপ্ত-এর কলমের আঁচড়ে ছবি রায় হয়ে গেলেন রুবি রায়। কিরওয়ানি রাগের আধারে সুর করা সেই ট্র্যাজিক প্রেমের গান আধুনিক বাংলা গানের জগতে শুধু এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল তাই নয় সেই গান বাংলার সব কলেজ-পড়ুয়াদের বুকে ঝড় তুলে দিয়েছিল একেবারে। এর বহু বছর পর গায়ক রূপঙ্কর ‘রুবি রায়’-কে নতুন ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই একজন করে রুবি রায় হয়তো আছেন যিনি পুরুষও হতে পারেন আবার মহিলাও, যাকে নীরবে ভালোবাসা যায়, শ্রদ্ধা করা যায়। এর ঠিক চার বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে ‘রুবি রায়’ গানের সুর বসিয়ে রাহুলদেব বর্মন ‘অনামিকা’ ছবির জন্য তৈরি করলেন ‘মেরি ভিগি ভিগি সি’। বলা বাহুল্য রাহুলদেব বর্মনের গাওয়া সেই প্রথম পুজোর গান ‘রুবি রায়’ গত বছর সুবর্ণজয়ন্তীতে পা দিয়েছে।

আসলে সেই সময় আড্ডার ছলে সৃষ্টি হত অসাধারণ সব বাংলা গান। এক-একটা গান সৃষ্টির নেপথ্যে থাকত বেশ কিছু মজার ঘটনা। সেগুলি নিয়ে আর একদিন লেখা যাবে। দুর্গাপুজোর পরপরই এইচ এম ভি প্রকাশ করত ‘শ্যামাসংগীত’-এর রেকর্ড, যা কালীপুজোর একটা আবহ সৃষ্টি করত। আর এই ব্যাপারে সব সময় এগিয়ে থাকতেন শান্ত মিঠে গলার অধিকারী পান্নালাল ভট্টাচার্য ও রামকুমার চট্টোপাধ্যায়।

১৯৭৬ সালের এইচ এম ভি-এর অপর একটি কালজয়ী শারদ অর্ঘ্য ‘আয় খুকু আয়’, পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখনী ও ভি বালসারার অপূর্ব সুরসৃষ্টিতে এই গানটির সার্থক চক্ষুদান করেছিলেন শ্রদ্ধেয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদার যা আজও আপামর বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। বাবা ও মেয়ের মিষ্টি সম্পর্কের এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পুলকবাবু কয়েকবছর পর আবার সৃষ্টি করলেন মা ও মেয়ের মিষ্টি সম্পর্কের আর একটি গান, ‘তুমি আমার মা আমি তোমার মেয়ে’, ভি বালসারার অসুস্থতার জন্য গানে সুর দিতে এগিয়ে এলেন পরিমল দাশগুপ্ত আর মায়ের ভূমিকায় কণ্ঠদান করেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর মেয়ের ভূমিকায় আবার কণ্ঠদানে আসেন শ্রাবন্তী, তবে মা-মেয়ের জুটির এই গান বাবা-মেয়ের জুটির গানের জনপ্রিয়তার রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।

সেই সময়ের পুজোর গানে আজও নস্টালজিক হয়ে পড়েন সংগীত শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। ১৯৭২ সালে সুরকার শৈলেন মুখোপাধ্যায় প্রথম হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘এত কান্না নয় আমার’ এবং ‘ময়ূর নাচে দেখবি আয়’। হিন্দুস্থান কোম্পানি থেকে রেকর্ড বেরনোর কিছুদিন পরেই ডাক এল এইচ এম ভি থেকে। এরপর হৈমন্তী গাইলেন তাঁর সেই কালজয়ী গান ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘নয়নে আবির ছড়ালে’— পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও মান্না দে-র সুরে এবং ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না’ গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে। সেই সময় বাংলার শিল্পীদের পাশাপাশি বোম্বাইয়ের ও বাংলার কিছু অভিনেতা ও অভিনেত্রীর গাওয়া বাংলা গান ও কৌতুকনকশা পুজোয় এইচ এম ভি প্রকাশ করেছিল। অভিনেতা বিশ্বজিৎ গাইলেন ‘তোমার চোখের কাজলে’, হেমা মালিনী গাইলেন ‘কাঁদে মন পিয়াসি’, ‘গুনগুন গুন করে যে মন’, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় গাইলেন ‘এই আশা-নদীর কূলে’, ‘সেই পলাতক পাখি’ আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুকনকশা তো সর্বজনবিদিত। অপরদিকে ছিল লোকসংগীতের রেকর্ড রিলিজ। কবীর সুমনের ভাষায় বলা যেতে পারে, ‘ছিল নির্মলেন্দু চৌধুরি তার গলার আওয়াজ মুক্ত দেদার নদীর মতো’, সেই নির্মলেন্দু গাইলেন ‘সুজন রে, জীবনের আর হদিস পাইলাম না’ এবং ‘একদিন তোর হইবে রে মরণ হাসন রাজা’। এর পাশাপাশি ১৯৭৬ সালে অন্য একটি অনামী রেকর্ড কোম্পানি একটি ই.পি রেকর্ডে স্বপ্না চক্রবর্তী নামক এক নতুন শিল্পীকে নিয়ে প্রকাশ করল দুটি গান ‘বড়োলোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল’, এবং ‘বলি ও ননদি আর দু-মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে’। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে বীরভূমের এই অভাবী শিল্পী, স্বপ্না চক্রবর্তী গানদুটি রেকর্ড করেছিলেন। গানদুটি প্রকাশ হয়েই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছায়। শুনেছি, সেই বছর পুজোর সময়ে সারা বাংলায় এমন কোনো প্যান্ডেল ছিল না যেখানে এই গানগুলি বারে-বারে বাজেনি। অন্য সব নামীদামি শিল্পীর পুজোর গান ম্লান হয়ে গিয়েছিল এ-দুটির জনপ্রিয়তার কাছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেইসময় শিল্পীর সাথে চুক্তি না থাকায় সেই কোম্পানি এই বিপুল লাভের লভ্যাংশের কোনো অংশই শিল্পীকে দেননি। পরে তিনি আরও কয়েকটি গান রেকর্ড করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো আর সেভাবে বাজার পায়নি। ‘বড়োলোকের বিটি লো’ গানটির গীতিকার রতন কাহার ও সুরকার চন্দ্রকান্ত নন্দী এবং ‘বলি ও ননদি’ এটির গীতিকার আশানন্দন চট্টরাজ এবং সুরকার চন্দ্রকান্ত নন্দী।

বড়লোকের বিটি লো সিডি কভার


’৮০ এর দশকের শুরু সময় থেকে রেকর্ডের জায়গা দখল করে বসল ক্যাসেট। অলিতে-গলিতে বিভিন্ন ক্যাসেট কোম্পানি গজিয়ে উঠতে লাগল। রেকর্ড ব্যবসা এবার একটা বড়ো রকমের ধাক্কা খেল। দামে অনেকটা কম কিন্তু সাউন্ড কোয়ালিটি খারাপ থাকা সত্ত্বেও অনেকে তখন ক্যাসেট কেনার দিকে ঝুঁকল কারণ একটা ক্যাসেট থেকে অনায়াসে অন্য ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে গান রেকর্ডিং করা যায়। অনেক কোম্পানি আবার পুরোনো প্রকাশিত রেকর্ড থেকে গান ক্যাসেটে রেকর্ডিং করে বাজারে রিলিজ করতে লাগল এইচ এম ভি-র কোনো অনুমতি না নিয়েই। মিউজিক পাইরেসি শব্দটা অবশ্য তখনও জনসমক্ষে আসেনি। তখন বলা হত নকল ক্যাসেট। আর এতে নামীদামি রেকর্ড কোম্পানিগুলির ব্যবসা মার খেতে শুরু করল। তখন এইচ এম ভি বাধ্য হয়ে আস্তে আস্তে রেকর্ড বানানো বন্ধ করে শুরু করল বিভিন্ন শিল্পীর ক্যাসেট প্রকাশ। বিগত বছরগুলিতে প্রকাশিত গানের রেকর্ডগুলি থেকে নির্দিষ্ট কিছু গান বেছে নিয়ে সেগুলি ক্যাসেটে রেকর্ড করে এইচ এম ভি ও মেগাফোন বাজারে ছাড়তে থাকে। শুরু হল ক্যাসেটের যুগ কিন্তু সেই সাউন্ড কোয়ালিটি যেন খুঁজে পেল না সংগীত-রসিক জনগণ। পুরোনো রেকর্ড কেনার জন্য তারা ছুটল ধর্মতলায় ফ্রি স্কুল স্ট্রীট অথবা ওয়েলিংটন রোডে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু নামকরা শিল্পীর মৃত্যু এবং গানের জগত থেকে অবসর নেবার কারণে বাংলা গানে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হল। ১৯৮৮ সাল নাগাদ এইচ এম ভি তাদের শেষ ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা প্রকাশ করে। সেখানে ব্যাক-কভারে লেখা ছিল “সংগীত বাঁচান, নকল হটান”। নয়ের দশকের শুরুর দিকে আবির্ভাব হয় জনপ্রিয় শিল্পী কুমার শানুর (কেদারনাথ ভট্টাচার্য), তাঁর ‘সুরের রজনীগন্ধা’, ‘প্রিয়তমা, মনে রেখো’ ইত্যাদি অ্যালব্যামের গান প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে না বাজলে যেন পুজোর আমেজটাই আসে না।

কুমার শানু’র প্রিয়তমা মনে রেখো সিডি ইনলে

সুমনের তোমাকে চাই অ্যালবামের ক্যাসেট ইনলে


ইতিমধ্যে আশির দশকের শেষ নাগাদ খবর এল বোম্বাইয়ের মিউজিক ইন্ডিয়া লিমিটেড ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে বানিয়ে ফেলেছে এক ধরনের অডিও লেজার ডিস্ক যেখানে তারা দাবি করছে রেকর্ড বা ক্যাসেট-এর সাউন্ড কোয়ালিটির থেকে প্রায় ১০০ গুণ ভালো সাউন্ড কোয়ালিটির অডিও তারা এই ডিস্কের মাধ্যমে পরিবেশন করতে চলেছে, কিন্তু সেটা বেশ দামি এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বিখ্যাত গজল গায়ক পঙ্কজ উধাস তাঁর ‘শগুফতা’ অ্যালবামের মাধ্যমে মিউজিক ইন্ডিয়া লিমিটেড তাদের এই ডিজিটাল এক্সপেরিমেন্ট। ভারতবর্ষের সেই প্রথম প্রকাশিত হওয়া কম্প্যাক্ট ডিস্ক স্রেফ দামি হবার কারণে ভালো বাজার পেল না। ক্যাসেটের রমরমা চালু রইল বেশিরভাগ লোকের হাতে। অবশেষে Windows 95 অপারেটিং সিস্টেম বাজারে আসার পর এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে রেকর্ডিং ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সব রেকর্ডিং কোম্পানি তখন ক্যাসেটের পাশাপাশি বাজারে নতুন নতুন শিল্পীদের নিয়ে কম্প্যাক্ট ডিস্ক রিলিজ করতে লাগল। পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে এই কথাটা মাথায় রেখে বেশ কিছু নতুন কোম্পানি যেমন প্রাইম মিউজিক, আশা অডিও, সাগরিকা ইত্যাদি কোম্পানি নতুন শিল্পীদের নিয়ে পুরোনো শিল্পীদের গাওয়া গান অত্যাধুনিক যন্ত্রসংগীত সহযোগে আবার রি-রেকর্ডিং করে বাজারে ছাড়তে শুরু করল। অনেকে একে আবার বলেন রিমেক-এর যুগ। দুটি ক্যাসেট খুবই জনপ্রিয় ছিল একটি ইন্দ্রনীল সেন-এর ‘দূরের বলাকা’ সিরিজ আর শ্রীকান্ত আচার্যের ‘মনের জানালা’ এবং অবশ্যই এর পাশে উল্লেখ করতে হয় ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ মৌলিক অ্যালবামটি। এরপর কম্প্যাক্ট ডিস্কের দামও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। বিদায় নেয় অডিও ক্যাসেট। ইতিমধ্যে এইচ এম ভি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামটি প্রকাশ করে একটা সাড়া ফেলে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের তখন শুধু সুমন-কেই চাই। এরপর একে-একে সুমনের মতো নতুন ধরনের গান নিয়ে গানের বাজারে এলেন নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ, রূপম ইসলাম ও আরও প্রতিভাবান কিছু তরুণ তুর্কির দল। বাংলা ব্যান্ড সংগীত-এর জন্ম হল। মিডিয়া তখন এইসব গানগুলোর মাথায় ‘জীবনমুখী’ তকমা লাগিয়ে দিল। ইতিমধ্যে রেডিওতে গান শোনারও একটা আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। নয়ের দশকের শেষের দিকে রেডিও তখন অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল সম্প্রচারে আসার মাধ্যমে এনে ফেলেছে এফ এম। বেশ কিছু বেসরকারি এফ এম চ্যানেল তখন নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের গানগুলির প্রচার করতে থাকল। কিন্তু তখন গানের মান নিয়ে কেউ একটা মাথা না ঘামিয়ে বেশ কিছু উঠতি শিল্পী রীতিমতো নিজেদের টাকা খরচ করে কম্প্যাক্ট ডিস্ক বাজারে ছাড়তে লাগল। আর কিছু এফ এম চ্যানেলগুলি অর্থের বিনিময়ে সেগুলি বাজাতে থাকল কিছুদিনের জন্য। এর সাথে সাথেই এসে গেল সিডি পাইরেসির যুগ, কম্পিউটার থেকে একটার পর একটা অডিও সিডি এম পি থ্রি ফরম্যাটে কপি হতে লাগল। দেখা গেল একটি এম পি থ্রি প্রযুক্তিতে তৈরি একটি সিডি প্রায় ২০০ এর অধিক গান ধরে রাখতে সক্ষম। কম্পিউটার বা সিডি প্লেয়ারে সেগুলি চালিয়ে দিব্যি গান শুনতে শুনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের কাজ করা যায়। মিউজিক পাইরেসির অত্যাধিক বাড়াবাড়ির কারণে বন্ধ হয়ে গেল প্রচুর নামীদামি মিউজিক কোম্পানি। শিল্পীরা তাঁদের প্রাপ্য রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত হতে থাকলেন। এইচ এম ভি তখন বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রকাশ করতে থাকল বিভিন্ন শিল্পীর এম পি থ্রি অডিও সিডি। মাত্র ৫০টাকার বিনিময়ে ৫০টি গান শোনার ব্যবস্থা করে দিল নামীদামি সিডি কোম্পানিগুলি। এইভাবে আস্তে আস্তে শারদীয়া বাংলা গান অস্তমিত হতে থাকল। তবে আশার কথা এই যে এখন শিল্পীরা তাদের একটি কি দুটি গান এখন ইউটিউব, মিউজিক স্ট্রিমিং সাইট বা কোনো মিউজিক কোম্পানির ওয়েবপোর্টালে প্রকাশ করছেন। এই বছর পুজোয় চাই নতুন গান এই দাবিতে অনলাইনে কিছু শিল্পীর গান বর্তমানের এই অতিমারীর আবহেও রিলিজ হয়েছে। রূপঙ্কর বাগচি গাইছেন ‘সময় থমকে দাঁড়ায়’ মিনিস্ট্রি অফ মিউজিক-এর পরিবেশনায়। অন্য দিকে, আশা অডিও থেকে পুজোর আবহে মুক্তি পাচ্ছে তিনটি অ্যালবাম। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে ‘এই কথাটি মনে রেখো’ গেয়েছেন জয়তী চক্রবর্তী ও দুর্নিবার সাহা। মনোময় গেয়েছেন ‘জানে মন’ এ্যালবামে। শুভমিতা এবং রূপঙ্কর যৌথভাবে করেছেন ‘মেঘলা মন’। আশা ভোঁসলে গেয়েছেন ‘এবার পুজোয় এলাম ফিরে আমার কলকাতায়’। এই বছর পুজোর সময় একেবারেই ঘরবন্দি তাই ঘরে বসে এমন সব গানে পুজোর আনন্দ কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে আশা অডিও সেই আশাই রাখে। আর যদি মনে করেন যে না, পুরোনো গানই ছিল ভালো তাহলে মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে ইউটিউবে সার্চ করে শুনে নিন আপনার পছন্দের পুজোর গান। কারণ এটা ভুলে গেলে চলবে না ইতিমধ্যেই আমরা পেরিয়ে এসেছি তিন দিকপাল শিল্পীর জন্মশতবর্ষ— মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও অখিলবন্ধু ঘোষ। ইতিহাসের কি পরিহাস দেখুন, পুজোর গানে এ-বছর আবার ফিরে এলো ‘বড়োলোকের বিটি লো’ র‍্যাপগায়ক বাদশা ও বিক্রম ঘোষের হাত ধরে। ভিডিওটি মিলিয়ন ভিউ পেলেও বীরভূমের বিটি স্বপ্না চক্রবর্তী কিন্তু আর বড়োলোক হতে পারল না।

শ্রীকান্ত আচার্য্যের মনের জানালা ক্যাসেট ইনলে

ইন্দ্রনীলের দুরের বলাকা ক্যাসেট ইনলে

পরিশেষে এ-কথাই বলার যে, সর্বাঙ্গে আঞ্চলিক অভিজ্ঞান নিয়েও বাংলা সংগীত বারবার ভেঙে দিয়েছে মানচিত্রের সীমারেখা। পেরিয়ে গেছে ভৌগোলিক বিধিনিষেধের সব বেড়াজাল। প্রাচ্যের বাউল তার ঘরছাড়া উদাসী প্রাণের ডাক পৌঁছে দিয়েছে সাগরপারে প্রতীচ্যের আঙিনায়। এ যে কি রসায়ন, সেটা অতি বড়ো বিজ্ঞানীরও রহস্যভেদের বাইরে।

উপরে আলোচিত কিছু গানের লিংক

মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর – ইন্দুবালা দেবী ( রামবাগানের ইন্দুবালা) (১৯৩১)
এত জল ও কাজল চোখে – আঙুরবালা দেবী (১৯২৮)
মানদা সুন্দরী দাসীর গান
বনের তাপস কুমারী – যূথিকা রায় (১৯৪০)
হায় হায় গো রাত যায় গো – মান্না দে (১৯৫৩)
রানার – লতা মঙ্গেশকর
তোমার চোখের কাজলে – বিশ্বজিৎ
গুন গুন গুন করে যে মন – হেমা মালিনী
আশা নদীর কূলে – শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়
https://www.youtube.com/watch?v=e8jgUIPjbS8
ছিপ খান তিন দাঁড় – শ্যামল মিত্র

ঋণস্বীকার: পুরোনো কিছু ‘শারদ অর্ঘ্য’ সংখ্যা, সুখী গৃহকোণ পত্রিকা, বর্তমান পত্রিকা, আজকাল পত্রিকা, সা রে গা পত্রিকা, এই সময়, মাসিক কৃত্তিবাস পত্রিকা ও ইন্টারনেটের কিছু ওয়েবসাইট।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

7 Comments

Leave a Reply to Probir Mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২