পথপ্রদর্শক – অম্বিকেশ মহাপাত্র

পথপ্রদর্শক – অম্বিকেশ মহাপাত্র

শেয়ার করুন

‘হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’ আজ থেকে প্রায় ২০৮ বছর আগে, ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল, পরাধীন ভারতের কলকাতা শহরে বসবাসকারী ইংরেজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অনিবার্যকারণে সেই সময় আজকের মত বাড়িতে বাড়িতে দূরদর্শন, হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিল না। দূরদর্শন কি বলছি! বৈদ্যুতিক আলো-পাখাও তখন আবিস্কৃত হয়নি। তখন বাঙালীঘরের শিশু-পাঠ্য ‘সহজ পাঠ’ ছিল না। কারণ ‘সহজ পাঠ’র লেখক, রবি ঠাকুর তখন জন্মগ্রহণ করেন নি। রবি ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে। অ, আ, .. ক, খ, .. বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ‘বর্ণ-পরিচয়’ও তখন ছিল না। ‘বর্ণ-পরিচয়’ যিনি প্রকাশ করবেন, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও তখন জন্মগ্রহণ করেন নি। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে। সেই সময়কালের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্তমান সময়কালে কল্পনা করুন। তখন জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, বহু-বিবাহ, কুলীন-প্রথা, সতীদাহ-প্রথা সবই সমাজ-জীবনের অঙ্গ। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে না হলে, সমাজে ঠাঁই নাই। তাই একজন কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজ-স্বীকৃত শতাধিক বিয়ে করতে পারতেন, করতেনও। স্বামী মারা গেলে, অল্প বয়সী সদ্য বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় বলপূর্বক স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করে, পুড়িয়ে মারা হ’ত। কেউ কী জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে মরতে চায়? ‘স্বামীর চিতায় পুড়ে মরলে পুন্যি হবে’- এইসব বলেও বেশীরভাগ সময়ে কাজ হ’ত না। তখন শাঁখা-সিন্দুর-আলতা পরিয়ে, সতী সাজিয়ে, মাদক-ধুতুরার রস খাইয়ে, ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গ-শৃঙ্গা-ইত্যাদি উচ্চৈ-স্বরে বাজাতে বাজাতে সতীর ক্রন্দনকে চাপা দিয়ে বলপূর্বক আগুনে নিক্ষেপ করা হ’ত। সেই সময়কালে এটাই ছিল সমাজের বিধান। এই বিধানই সতীদাহ প্রথা। ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতে তৎকালীন সমাজের বেশীরভাগ গন্যমান্য ব্যক্তিগণ এই সকল অমানবিক প্রথার পক্ষে ছিলেন।
 
১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের জন্য সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার, প্রমুখের চেষ্টায় কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। ১লা মে ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে, কবি এবং চিন্তাবিদ ডিরোজিও ঐ কলেজে মাত্র ১৭ বছর বয়সে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর ছাত্রদের বয়স ১২-১৬ বছর। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের বয়সের তফাৎ বিশেষ না থাকায়, ডিরোজিও ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধু’র মত মেলামেশা করতেন। কলেজের শেষে ছাত্ররা প্রায়ই ডিরোজিও’র বাড়ি চলে আসতেন। ডিরোজিও’র মা এবং বোন জলখাবারের ব্যবস্থা করতেন। কলেজের পড়ার বিষয়ের বাইরে সমাজের নানা কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, তার অমানবিক প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, বই আদান-প্রদান এবং তর্ক-বিতর্ক সবই হ’ত। এক পুত্র সন্তানের মা’কে ‘সতী’ সাজিয়ে জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করার আগেই ডিরোজিও’র ছাত্ররা একদিন  ‘সতী’কে ছিনিয়ে নিয়ে ডিরোজিও’র বাড়িতে চলে আসেন। ডিরোজিও, তাঁর মা এবং বোন ‘সতী’কে কয়েকদিন বাড়িতে যত্নের মাধ্যমে স্বাভাবিক করে তুলেন। এবং পরে তাঁর সন্তানের কাছে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ‘সতী’ বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় ডিরোজিও’র উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘আপনি নারীদের কাছে দেবতা, আপনাকে আমার প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ‘ম্লেচ্ছ-ফিরিঙ্গি’কে ছুঁলে আমার সমাজে ঠাঁই হবে না’।
 
স্বাভাবিককারণে ‘সতী’কে ছিনিয়ে এনে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া’র ঘটনায় সমাজে ভীষণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। সমস্ত রোষ গিয়ে পড়ে তথাকথিত ‘ম্লেচ্ছ-ফিরিঙ্গি’ ডিরোজিও’র উপর। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ বেজায় চটলেন। সর্বত্র ‘ম্লেচ্ছ-ফিরিঙ্গি’ ডিরোজিও’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলতে থাকে। ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কলেজ থেকে তাড়াতে হবে। একদিন ঋজু-ব্যক্তিত্ব ডিরোজিও কলেজের গেট দিয়ে ঢুকছেন, বিক্ষোভের ইঁটের টুকরো এসে পড়ল কপালে, কপাল ফেটে রক্ত ঝরলো, কপালের রক্ত হাত দিয়ে চেপে কলেজে ঢুকলেন এবং প্রিয় ছাত্রদের সামনে গিয়ে পড়ালেন। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন চলল না। সমাজের কর্তাব্যক্তিরা গভীর ষড়যন্ত্রে সামিল হলেন। ‘সতী’র সন্তানকে কেড়ে নিয়ে সতীর সামনে বেদম প্রহার করা হল এবং মাদক ধুতুরা’র রস খাইয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপ তৈরি করে সর্বসমক্ষে ডিরোজিও’র বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ আনা হল। এবং সর্বসমক্ষেই ডিরোজিও’কে জুতোপেটা ও জুতোর মালা পরিয়ে চরম অপদস্ত এবং অপমান করা হল। তারপর নানান অজুহাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ১৮৩১ সালে ডিরোজিও’কে বরখাস্ত করলেন। ৫ বছরেই শিক্ষক জীবনের ছেদ ঘটল।
 
ডিরোজিও ক্লাসে তাঁর প্রিয় ছাত্রদের সামনে যেতে পারছেন না। সে কষ্টতো ছিলই, তারসঙ্গে শুরু হল অর্থকষ্ট। অর্থকষ্ট চরম আকার ধারণ করে। ছাত্ররা কলেজ শেষে ডিরোজিও’র বাড়িতে আসতেন। জলখাবার জুটছিল না। সব বই বিক্রী করে সংসার চালানোর চেষ্টা হয়। মা ও বোনের অল্প গয়না, সেও বিক্রী হয়ে যায়। এরপর? বাড়িতে খাবার নেই। এমত অবস্থায় ডিরোজিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রথমে চোখের দৃষ্টিশক্তি চলে যায়। ছাত্ররা দেখা করতে এলে ছাত্রদের স্পর্শে চিনে কথা বলতেন। অল্পদিনের মধ্যেই অর্থাভাবে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু-সজ্জা নেন। সেই সংবাদে খুশী বিক্ষোভকারীরা। দ্রুত মৃত্যু কামনায় ডিরোজিও’র বাড়ির সামনে রোজদিন আনন্দ-নৃত্য! কুশ-পুতুল প্রস্তুত রাখা হল! মা ও বোন মৃত্যু-সজ্জার পাশে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছাত্ররা মৃত্যু পথযাত্রী শিক্ষকের শিয়রে অধোবদনে। শেষমেশ অর্থাভাবে ও চিকিৎসার অভাবে, ঐ বছর ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে ২৬ ডিসেম্বর, মাত্র ২২ বছর ৮ মাস ৮ দিন বয়সে পথপ্রদর্শক ডিরোজিও’র জীবনদীপ নিভে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু সংবাদে সারা কলকাতা শহর জুড়ে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি সহ বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আনন্দ-নৃত্য করেন। কুশ-পুতুল পোড়ায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যাঁরা ডিরোজিও কে ষড়যন্ত্র করে সর্বসমক্ষে অপমান এবং হিন্দু কলেজ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন, তাঁদের একজন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের মাথা রাজা রাধাকান্ত দেব ডিরোজিও কে চিকিৎসায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মৃত্যু শিয়রে জেনেও ডিরোজিও তৎক্ষণাৎ ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
 
ডিরোজিও’র অনুগামী ছাত্ররা; দক্ষিণারঞ্জন বসু, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখরা গড়ে তুলেছিলেন ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট। যা শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের আতংকিত করে তুলেছিলেন। একজন আদর্শ শিক্ষক কি অমিত শক্তি ধারণ করতে পারেন, ডিরোজিও তারই একজন প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ডিরোজিও, কিভাবে সংরক্ষিত প্রতিভার বিকাশসাধন, প্রাণের গভীরে অনুপ্রেরণার বীজবপন, আদর্শবোধে দীক্ষিত, কর্তব্যবোধে অনমনীয় করতে হয়, করে দেখিয়েছিলেন। ডিরোজিও বিশ্বাস করতেন- ‘নারীকে দাসী মনে করে যে সমাজ, তার ধ্বংস অনিবার্য’। এবং এর প্রতিকারে শত বাধা ও অপমান সত্ত্বেও সরব ছিলেন। অল্প জীবদ্দশাতেই সেকাজ করেছিলেন। যে সময়কালে নারীদের অবস্থান ছিল কেবলই অন্তপুরে। অন্তঃপুরবাসী নারীরা তথাকথিত ‘ম্লেচ্ছ-ফিরিঙ্গি’ ডিরোজিও বা গজুবাবু’কে মনে মনে শ্রদ্ধা করতেন, নিজের গর্ভের সন্তানসম মনে করে, গজুবাবু’র সুস্থ দীর্ঘায়ু কামনা করতেন। ডিরোজিও তাঁর প্রিয় ছাত্রদের প্রতি সর্বদা যে বার্তা দিতে চেয়েছেন- “সত্যের ছদ্মবেশে যাহা কিছু তোমার সম্মুখে আসিবে, সত্যকে যদি শ্রদ্ধা কর, তবে তাহাকে শত-সহস্র প্রশ্নে জর্জরিত না করিয়া কিছুতেই মানিয়া লইবে না”।
 
ইলেকট্রনিক অর্থাৎ e-বিশ্বে, হে মহান শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক, একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর সশ্রদ্ধ প্রণতি গ্রহণ করুন।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

3 Comments

  1. ডিরোজিও সর্ম্পকে এই কথাগুলিই বিশিষ্ট অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব উত্পল দও মহাশয় তাঁর পরিচালিত ” ঝড় ” চলচ্চিত্রটিতে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন / আগ্রহী ব্যক্তিগণ তা দেখলে উপকৃত হবেন /

  2. প্রনাম নেবেন স্যার। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম আপনার লেখা পড়ে। পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

  3. Sir আমার ধন্যবাদ নেবেন আপনার সাথে অনোক কথাই শেয়ার করার ইচ্ছে করে….

Leave a Reply to Tapan Banerjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২