পাঠ প্রতিক্রিয়া : মোজাফ্ফর হোসেনের গল্পগ্রন্থ “অতীত একটা ভিনদেশ” – ত্রয়ী চ্যাটার্জী

পাঠ প্রতিক্রিয়া : মোজাফ্ফর হোসেনের গল্পগ্রন্থ “অতীত একটা ভিনদেশ” – ত্রয়ী চ্যাটার্জী

শেয়ার করুন

গৃহস্থবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশের আগে পেরোতে হয় সদর, উঠোন, দালান। বৈঠকখানায় কিছুক্ষণ বসলে আঁচ পাওয়া যায় পর্দার অপরপ্রান্তে ভিতরমহলের কিছু কিছু কার্যকলাপ। একইভাবে কোনো সুসজ্জিত বইয়ের অন্তর্লোকে পৌঁছতে পেরোতে হয় বেশ কিছু ধাপ। যেমন বইয়ের প্রচ্ছদ, বইয়ের নাম, উৎসর্গ পত্র, ভূমিকা ইত্যাদি। এই সময়ের কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেনের ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ এমনই একটি সুসজ্জিত বই। ‘বেহুলা বাংলা’ প্রকাশনা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই বইতে আছে মোট চোদ্দোটি ছোটোগল্প। তবে গল্পের জগতে প্রবেশের আগে মনোযোগ আকর্ষণ করে নেয় চারটি বিষয়। প্রথমত বইটির নাম, দ্বিতীয়ত উৎসর্গ পত্র, তৃতীয়ত পাঠকথন আর চতুর্থত আমার গল্পভাবনা। পাঠকথন ও আমার গল্পভাবনা প্রসঙ্গে অবকাশ মতো বলা যাবে। প্রথমেই আসি বইটির নাম ও উৎসর্গ পত্রের কথায়। ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ নামটি প্রথমেই পাঠককে কাল সচেতন করে তোলে। অতীতের দিকে ফিরে তাকানো এবং অতীতকে নতুন করে আবিষ্কার করা, নামের মধ্যেই লেখক সেই ইংগিত রেখেছেন স্পষ্টত। আর সেইসঙ্গে খুব সংগতভাবে সাজিয়েছেন উৎসর্গ পত্রটিকে। পিতা, পিতামহ, প্রপিতা—নিকট অতীত থেকে সুদূর অতীতের উদ্দেশ্যে তাঁর এই স্মৃতিতর্পণ।

প্রথম গল্প ‘বাঁশিওয়ালা মজ্জেল’। মৃত্যুর পনেরো বছর পর অতীত হয়ে যাওয়া মজ্জেলের সাথে দেখা হয় গল্পকথকের। বাস্তব জগৎ থেকে অন্যতর জগতের সীমারেখাটি ঠিক কোনখানে তা দৃষ্টিগোচর হয় না পাঠকের। মজ্জেলের বাঁশিতে সুরের টান এমনই। তাত্ত্বিকেরা কেউ বলবেন এ গল্পের আধার হলো পরাবাস্তব জগৎ। কেউবা বলবেন জাদুবাস্তবতার কথা। কারণ গল্পের কথক মৃত। আর গল্পটির কেন্দ্রে আছে দুই মৃত ব্যক্তির কথোপকথন। অতিলৌকিক বিস্তার ছাড়া এমন গল্পবয়ন তো সম্ভব নয়! এই আয়োজন একটি চরম বাস্তবকেই প্রকট করেছে— “দেহহীন ইচ্ছা বড়ো অকেজো।” পনেরো বছর পর দেখা হওয়া দুটি মানুষের আলাপচারিতা শেষ হয়েছে এইভাবেই। মজ্জেলকে হত্যার সময় কথকের প্রতিবাদহীন নিশ্চুপ ভূমিকাই এই গল্পভাবনার সূত্র।

‘একটি নদীর গল্প’ আরেকটি অতীতমুখীনতার আখ্যান। এই গল্পে গোমতী নদী গল্পকথকের স্মৃতিতে হয়ে উঠেছে একটি জীবন্ত চরিত্র। নদী গতিময়, নদী সভ্যতা গড়ে তোলে, উর্বরতা দান করে, আবার বন্যার সঅময় সবকিছু গ্রাস করেও নেয়। এই নদীর সঙ্গেই নাড়ির টান ছিল সোবহান মণ্ডলের। ‘৪৭-এর দাঙ্গার সময় তাঁকে ভারত ছেড়ে চলে আসতে হয় বাংলাদেশের হরিরামপুরে। গল্পের শেষে যখন এ তথ্য উপস্থাপিত হয় তখন এ গল্প আর শুধু নদীর গল্প থাকে না। নদী আসলে হয়ে যায় কাঁটাতারের ওপারে ফেলে আসা দেশভাগের স্মৃতি। অতীত যে ধীরে ধীরে কীভাবে ভীনদেশ হয়ে যায় তার সাক্ষাৎ নিদর্শন এই গল্পটি।

আরেকটি গভীর মনস্তত্ত্বের গল্প হলো ‘ছুঁয়ে দেখা জীবন’। সৈয়দ রহমান মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অর্ধচেতন অবস্থায় তলিয়ে যাচ্ছেন তাঁর অবচেতন মনের গভীরে। যেখানে তিনি সঞ্চয় করে রেখেছেন শৈশব-কৈশোরের একমুঠো উজ্জ্বল স্মৃতি। এই বইয়ের সব গল্পই অতীত জীবনকে কেন্দ্র করে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই গল্পগুলিতে চেতনাপ্রবাহ রীতির স্পর্শ পাওয়া যায়। তবে গঠনগত দিক থেকে কিছু গল্প বেশ চমকপ্রদ এবং অন্য মাত্রা লাভ করেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে ‘মৎসজীবন’ গল্পটি। শুরু থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত গল্পটি লেখা হয়েছে বর্তমান কালকে কেন্দ্র করে। উত্তম পুরুষের বাচনে গল্পটি রচিত। প্রথম থেকে মনে হয় একটি নিখাদ প্রেমের গল্প। ইরার প্রেমে পড়েছেন গল্পকথক। প্রথম সাক্ষাৎ বাজারে। বাজার করার মতো একটি রুটিনমাফিক প্রয়োজনীয় কাজে তাই উৎসাহ এসেছে। কিন্তু উৎসাহ, ভালোলাগা, অপেক্ষা এসবের সীমা লঙ্ঘন করে যখনই দুজন নারী পুরুষের এই অনুভূতি একটি সম্পর্কের অবয়ব পেতে চায় তখনই ইরার চিঠি কথকের বিবেক জাগিয়ে তোলে। এই চিঠিই সাময়িক মোহভঙ্গ ঘটিয়ে কথককে ফিরিয়ে দেয় তাঁর অতীত জীবনের ধারাবাহিকতায়। “দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর প্রেম করার পর সাথীকে বিয়ে করেছি—ভুলেই গিয়েছিলাম…” এই কথাটাই শুধু সত্যি হয়ে থেকে যায়। আমরা পাঠকরা বুঝতে পারি প্রেমের পাশাপাশি এ একক অপ্রেমের গল্পও বটে।

মোজাফ্ফর হোসেনের গল্পগুলির বিশিষ্টতা এখানেই যে একরকম বৈঠকী চালে তিনি গল্পগুলি লিখেছেন। গল্পগুলিতে তাঁর লেখক সত্তার থেকে কথক সত্তাই অধিক প্রকট। গল্পগুলি যেন এক অখণ্ড সময়ের টুকরো টুকরো কিছু ছবি। তাই কোনো গল্প শুরু বা শেষের তেমন আলাদা প্রস্তুতি নেই। কোনো একটি বিন্দু থেকে শুরু হয়ে আরেকটি বিন্দুতে সাবলীলভাবে শেষ হয়ে গেছে গল্পগুলি। মোজাফফর যে একজন সময়সচেতন গল্পকার এই বইয়ের নামকরণ তার সাক্ষাৎ প্রমাণ। অন্যান্য প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘দ্বিধা’ (২০১১), ‘আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ’ (২০১২) বইগুলিতে তাঁর সময়সচেতন লেখনীর পরিচয় পাওয়া যায়।

‘অতীত একটা ভিনদেশ’ বইটির শুরুতে ‘আমার গল্পভাবনা’ অংশে লেখক একটি ভুঁইফোড় চরিত্রের কথা বলেছেন, যার নাম, প্রকৃত পরিচয় কেউ জানে না। লেখক তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রপিতা’। সম্পুর্ণ অপরিচিত অথবা কাল্পনিক একটি অস্তিত্বকে পিতামহের পিতার স্থানে বসিয়ে তিনি শিকড়ের সাথে একাত্ম করে নিয়েছিলেন। আর সেইজন্যই নিজের প্রজন্মের সাথে সাথে অতীত প্রজন্মের এতো বাস্তব রূপায়ণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে। তাঁর গল্পের সোবহান মণ্ডল, সৈয়দ রহমান, ভ্যাদা কবি, সুবীরের বাবা এইসব চরিত্রায়নে যেন সেই প্রপিতারই ছায়াপাত ঘটেছে। এই বইয়ের গল্পগুলি যেমন অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর গল্প, একইভাবে অতীতের চোখ দিয়ে বর্তমানকে দেখারও গল্প।

বই : অতীত একটা ভিনদেশ
লেখক : মোজাফ্ফর হোসেন
প্রকাশক : বেহুলা বাংলা
প্রকাশ কাল : ২০১৬
সংস্করণ : দ্বিতীয়
মূল্য : ২২০ টাকা

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

2 Comments

  1. কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেনের ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ বইয়ের পাঠক প্রতিক্রিয়ায় ত্রয়ী চ্যাটার্জীর প্রতিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যটি বেশ বিশিষ্ট। নাম, উৎসর্গ পত্র, পাঠকথন আর গল্পভাবনা। আলোচনাটি হয়েছে চমৎকার । অন্য পাঠকের পাঠে আগ্ৰহ জাগাবে।

Leave a Reply to চিরঞ্জিত তা Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২