যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা – অর্ণব ভট্টাচার্য

যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা – অর্ণব ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

২০১৭ সালের ভারতবর্ষে উগ্র জাতীয়তাবাদী আস্ফালন আর যুদ্ধ জিগির জনগনের এক উল্লেখযোগ্য অংশের মনের দখল নিয়েছে। ট্রেনে বাসে আলোচনার মাঝে, ফেসবুক-হোয়াট্‌সঅ্যাপ-ট্যুইটারে এই উন্মাদনার প্রকাশ ঘটছে প্রায়ই। উত্তেজনার পারদ চড়ানোর কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে একাংশের মিডিয়া। টিভি চ্যানেল ও মুদ্রন মাধ্যমে সংঘাতের মনোভাবকে সুকৌশলে উৎসাহিত করা হচ্ছে। উগ্রজাতীয়তাবাদী হুঙ্কারে অনেক সময়েই চাপা পড়ে যাচ্ছে যুক্তির কন্ঠস্বর। যেকোন রকম বিরোধীতা বা ভিন্নমতকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে ‘দেশদ্রোহিতা’ বলে। ক্রমাগত সঙ্কুচিত করা হচ্ছে মুক্তচিন্তার পরিসর। আক্রান্ত হচ্ছে বহুত্ববাদ। ‘বহিঃশত্রু’ আর ‘আভ্যন্তরীন শত্রু’ নির্মানের কাজ চলছে পূর্বনির্ধারিত মতাদর্শগত সূত্র মেনে।

সংসদীয় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রে এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ক্ষমতা দখল করবার পর হিন্দূত্ববাদী শক্তি যুদ্ধোন্মাদনা ও সংঘাতমূলক মনোভাব জাগিয়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দু’দশক আগে ১৯৯৮ সালে প্রথম পারমাণবিক বোমার ভূগর্ভস্থ পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ থেকে সাম্প্রতিক কালে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নিয়ে বাগাড়ম্বর এক সূত্রে গাঁথা।

বিজেপির মতাদর্শগত চালিকাশক্তি আর এস এস স্বাধীন ভারতকে সর্বদাই উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং যুদ্ধোন্মুখ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছে যেখানে সংখ্যাগুরুদের প্রাধান্য বলবৎ থাকবে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে যখন ভারত পারমাণবিক শক্তি উৎপন্ন করবার ক্ষমতা অর্জন করে তখন থেকেই আর এস এস পারমাণবিক বোমা তৈরীর পক্ষে সওয়াল করে এসেছে। এর ফলে উপমহাদেশে যে উত্তেজনা তৈরী হবে তা আর এস এস কাছে শুধু প্রত্যাশিত নয়, কাঙ্খিত। কেন না এর ফলে যুদ্ধ জিগির তোলার কাজ সহজ হয়ে যাবে।

১১ই মে, ১৯৯৮ পোখরাণে পরমানু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পরই চাগাই-এ ঐ বছরেরই জুন মাসে পাকিস্তান পরমাণূ বোমার ভূগর্ভস্থ বিষ্ফোরণ ঘটায়। সম্পূর্ণ হয় বৃত্ত। যে ভারতবর্ষের পক্ষ থেকে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসংঘে পরমাণু শক্তির কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যবহার নিশ্চিন্ত করা এবং সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংসের দাবী জানানো হয়েছিল সেই ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা অনায়াসে পাঁচদশকের গৌরবময় যুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে নস্যাৎ করে দেশের আত্মমর্যাদার এক বিপজ্জনক মডেল তুলে ধরেন যার মাশুল দিতে হয়েছে আমজনতাকে। পাকিস্তানের জনগনকেও ভুগতে হয়েছে শাসকের হঠকারিতার জেরে।

ভুটান-চীন সীমান্তের ডোকলাম এলাকা নিয়ে গত মাসখানেক যাবৎ চলা চীন-ভারত বিতর্কের আগে থেকেই ভারতবর্ষে চীন বিরোধী জিগির লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চীনা পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া, ডোকলাম ইস্যু নিয়ে সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত সহ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের চড়া সুরে মন্তব্য সবটাই হচ্ছে পূর্বনির্ধারিত চিত্রনাট্য মেনে এবং আর এস এস এর চিরাচরিত অবস্থানের সাথে সঙ্গতি রেখে। ১৯৬৫ সালে আর এস এস প্রধান গোলওয়ালকর চীনকে ‘সমগ্র মানবতার শত্রু’ বলে চিহ্নিত করেন এবং তিনি সে দেশকে ধ্বংসের ভাবনা পোষণ করতেন। এ সময়েই তিনি বলেন, “The possession of atom bomb by communist China has made it imperative for us to manufacture the same …… No doctrinaire or academic inhibitions should be allowed to come in its way.”

চীনের সাথে আলোচনার পথে হাঁটবার বদলে সংঘাতের মনোভাব কিংবা পোখরাণে পরমাণূ বোমা বিষ্ফোরণের কারন হিসেবে চীনের সামরিক শক্তিকে উল্লেখ করে বিল ক্লিন্টনকে বাজপেয়ীর চিঠি লেখা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী যা সমন্বয়, সহনশীলতা, জোট নিরপেক্ষতা ও স্বাধীন অবস্থানের নীতিতে একেবারেই আস্থাশীল নয়।

আজ যেমন দেশের শাসকদলের ঘোষিত অবস্থানের প্রতি প্রশ্ন তুললেই তাকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, ১৯৯৮ সালেও সমস্ত বিরোধী স্বরকেই দেশদ্রোহী বা Unpatriotic বলে আখ্যা দেন অধুনা এ দেশের উপ-রাষ্ট্রপতিপদে শাসকজোটের প্রার্থী, বিজেপি দলের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক এম বেঙ্কাইয়া নাইডু। অর্থাৎ সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

সংখ্যাগুরুবাদ বা মেজরিটিয়ানিজ্‌ম এর স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে উগ্রজাতীয়তাবাদী উন্মাদনায়। চীন এবং পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটবার পেছনে এদেশের শাসকদের দায় কতটা তার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা দরকার। কেন ভারত প্রতিবেশীদের থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তার পর্যালোচনা দরকার। শুধু সীমান্ত বিবাদ নয়, দেশের সীমানার অভ্যন্তরে কাশ্মীরে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হওয়ার পেছনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের নেতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের অসংবেদনশীল ও আক্রমণাত্মক মনোভাবও যে ভীষণভাবে দায়ী তা নিয়ে চর্চা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।

উগ্র জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসীরা সর্বদাই ‘অপর’এর নির্মান করে। ভিন্নতাকে বৈরিতা বলে প্রতিপন্ন করে আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহন করতে প্ররোচনা দেয়। এই ‘অপর’ কখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কখনও তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ। কখনও বা সীমান্তপারের প্রতিবেশী। এটা ঠিক যে সন্ত্রাসবাদের আগুনে আমাদের দেশ পুড়ছে। তবে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় আগ্রাসী হিংসা নয়, বরং সুরক্ষার বন্দোবস্ত জোরদার করবার সাথে সাথে চাই বস্তুগত পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে উগ্রপন্থা, সন্ত্রাসবাদ বিকশিত হওয়ার সুযোগ না পায়। বহিঃশত্রুর মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা মজবুত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। কিন্তু সীমান্তে সৈনিকের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের দোহাই দিয়ে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে বিতর্ককে স্তব্ধ করে দেওয়া, স্বৈরাতন্ত্রী কায়দায় দেশ চালানোর প্রচেষ্টা আমাদের কষ্টার্জিত গণতন্ত্রের মূলে আজ আঘাত হানছে। যে দরিদ্র কৃষকের ছেলে দেশের সীমানার অতন্দ্র প্রহরী তার যেমন একদিকে প্রয়োজনমতো খোরাক, গরম জামা এমনকি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট সব সময় জোটে না, তেমনি সৈনিকের কৃষিজীবি পিতা যখন ফসলের দাম না পেয়ে ধূঁকতে থাকে তখন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে সরকারী উপেক্ষা কিংবা উদ্যত ব্যাটন অথবা গরম সিসে।

অর্থনৈতিক সংকট থেকে নজর ঘোরানোর উপায় হিসেবে যুদ্ধের আস্ফালন অনেক পুরানো কৌশল – জনতা যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য / সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য । তবু এখনও এই কৌশলের কার্যকারীতা সবটা যে ফুরিয়ে যায় নি তা সোস্যাল মিডিয়া, খবরের কাগজ, টিভির চ্যানেলের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়। যারা যুদ্ধের উত্তেজনা আর শত্রু(কাল্পনিক বা বাস্তব)-র প্রতি ঘৃণায় ফুটতে থাকে তাদের সম্পর্কে একটি প্রাচীন ল্যাটিন বাক্য উচ্চারণ করা যায়, যার ইংরেজী তর্জমা করলে দাঁড়ায় – “War is sweet to those who haven`t experienced it”

জনতা যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য
সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য

তবু যুদ্ধ হয়। দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর পরিণতির পরও স্বার্থ আর লোভের সংঘাতের ফলে গত সাত দশকে কয়েকশত ছোট, মাঝারি, বড় যুদ্ধ হয়েছে। নাপাম বোমায় ঝলসে যাওয়া ভিয়েতনামের জনপদ থেকে ইরাক – আফগানিস্তান-সিরিয়ার হিংসা বিধ্বস্ত অঞ্চল – মানবতা শিউরে উঠছে বারবার। কত হাজার আইলান নৃশংসতার বলি হয়ে গেল। তবু প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করতে, ক্ষমতাকে আরো সুদৃঢ় করতে যুদ্ধ চলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একমেরু বিশ্ব তৈরী করতে মরীয়া মার্কিন যুক্তরাস্ট্র গত আড়াই দশকে বারে বারে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। তার অর্থনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করার হাতয়ার হয়েছে যুদ্ধ। সে কাজে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও জাতিবিদ্বেষ্কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। টমাস ফ্রিডম্যানের ভাষায় – “The hidden hand of the market will never work without a hidden fist-McDonald’s can not flourish without McDonnell Douglas, the builder of the F-15. And the hidden fist that keeps the world safe for Silicon Valley’s technologies is called the United States Army,Air Force, Navy and Marine Corps.”

এহেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সখ্যতাকে আরো নিবিড় করে, জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে কার্যতঃ বিসর্জন দিয়ে দেশের বিদেশনীতিকে যেভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে তা আগামী দিনে আমাদের দেশের পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলু খাগড়ার প্রাণ যায় – এটা সত্য; তবু প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে হিংসা আর বিভেদের পক্ষে সম্মতি নির্মানের কাজ চলছে তীব্র গতিতে। যুক্তি দিয়ে ধৈর্য ধরে এর প্রতি তীব্র অসম্মতি জানানোর কাজও তাই আমাদের করে যেতেই হবে।

All I have is a Voice
To undo the folded lie
The romantic lie in the brain
Of the sensual man -in-the-street
And the lie of Authority
Whose buildings grope the sky

W.H. Auden/September 1, 1939
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

Leave a Reply to Suman Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২