যে-বছর চের্নোবিল – কুশান গুপ্ত (পর্ব ২)

শেয়ার করুন

আগের পর্ব : যে-বছর চের্নোবিল – কুশান গুপ্ত (পর্ব ১)

   

সত্যটিয়াও আদতে এই পুরাতনপন্থী দলেরই অলিখিত মার্কামারা সদস্য। তিনি ছিলেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও সংসদ অনুমোদিত সেই মফস্‌সল গঞ্জের সুপ্রাচীন ইশকুলের ইতিহাসের শিক্ষক। যে সময়ের কথা কহিতেছি তখন তাঁহার বয়েস আনুমানিক পঞ্চান্ন। উচ্চতা অন্যূন ছয় ফুট। গড়পড়তা বাঙালিদের এইরূপ উচ্চতা হয় না। সে কারণে তাঁহার বিশেষ গর্ব ছিল। অপর গর্বের কারণ তাঁর ত্বকের অত্যুজ্জ্বল গৌরবর্ণতা। কিন্তু, তাঁহার কৃশতাও ছিল পাশাপাশি লক্ষণীয়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরিয়া তাঁহার ধবল পদযুগল নিতান্ত প্যাঁকাটির ন্যায় লাগিত। গাল ছিল অতীব তোবড়া ও চিমসে গোছের। চিলে শকুনে যেন সমূহ গালের মাংস খুবলাইয়া খাইয়া গেছে।

কিন্তু তাঁহার নাসিকা ছিল দর্শনীয় এবং এই বিরল প্রকৃতির নাসিকা, প্রকৃত প্রস্তাবে, দ্রষ্টব্য। ইহা খাড়া, উন্নত; কিন্তু সামনের দিকে বাঁক লইয়া, দ্বিতীয়বার এক অদ্ভুত বক্রচাপকরত নাকটি ভিতরের দিকে অন্তর্হিত হইয়া নিজেকে সম্পূর্ণ রচনা করিয়াছে। ইহা ভাষা দিয়া বিবরণ করা কার্যত অসম্ভব। এই সম্পূর্ণ জটিল গড়ন, রহস্যময় নাসিকার প্রকৃত গঠন সামনে হইতে বোঝা যাইত না, বরং প্রোফাইল ভিউতে বোঝানো কিছু বা সম্ভব। সেই নাক আঁকিবার দক্ষতাও কেবলমাত্র ছিল হাসুর। হাসুর প্রকৃত নাম চন্দ্রহাস দাস মাল। উক্ত স্কুলের নবম ক এর রোল নম্বর ২৯। এটুকু বলিলে হাসুর বৰ্ণনা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। তাছাড়া গল্পের গরু গাছে না উঠুক, চাট্টি জাবনা তো খাক, না হইলে গল্প কি হয়? তাই, হাসুর প্রসঙ্গে অবশ্যই ফিরিব। এখন সত্যটিয়ার কথাই বলি।

সত্যবাবুর সারা মুখের অন্তর্গত জাগিয়া থাকা এই যে দৃশ্যমান দুর্বর্ণনীয়-দুর্ধর্ষ-অতিরঞ্জিত নাক, তাহা, সংক্ষেপে, টিয়াপাখির ঠোঁটের ন্যায়। সত্যটিয়ার প্রকৃত নাম সত্যমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, ছাত্ররা কখনও-কখনও নিজেদের মধ্যে সংক্ষেপে তাঁহাকে টিয়া বলিত। কখনও-বা সত্যটিয়া। সত্যমাধবের সত্য ও নাকের টিয়া এই যুগলবন্দিতে তাঁহার নাম হইল সত্যটিয়া। ইহাকে সন্ধিসমাস প্রয়োগ করিয়া দেখিবারও হরেক রকমের রীতি ছিল। প্রথম পর্যায়ের পণ্ডিত বা মুনির মত এই ছিল যে, সত্যটিয়ার নামের আসল কারণ এই টিয়া-নাক।

দ্বিতীয় ও অন্যান্য কারণ একেবারে উড়াইয়া দেওয়া যায় না। সত্যবাবুর চার পুরুষের পৈতৃক গৃহ শহরের পুরাতন অংশে ‘মহাবীর সঙ্ঘ’ ক্লাবের সংলগ্ন কুণ্ডু মিলের পাশেই ও জগন্নাথ মন্দির চক এলাকায়। উক্ত জগন্নাথ মন্দির অত্যন্ত পুরানো, ওই স্থলে একটি রথ থাকিত এবং বর্ষাকালীন রথযাত্রা ওখান হইতেই শুরু হইত। কংসাবতী নিকটেই, অদূরেই পালবাড়ি অঞ্চলে গাছগাছালি ও পাখপাখালির অভাব নাই। পাখিদের সাম্রাজ্য বলা যায়। টিয়া, শালিক, চড়ুই, ময়না, বুলবুলি, টুনটুনি সহ বাংলার নানাবিধ পাখি আশ্চর্যভাবে বিরাজমান। ব্যাপার এই যে, উক্ত পুরানো সুউচ্চ মন্দিরটি এবং উহার গায়ে যে ছোটো ছোটো অজস্র আয়তাকার খোপ, সেই খোপে দলবদ্ধ টিয়াসকল থাকিত। বিকাল হইলেই যূথবদ্ধ টিয়ারা কিচকিচ করিয়া ফিরিত এবং খুপরিগুলি সবুজ হইয়া থাকিত। কেন মরিতে এত গাছ থাকিতে টিয়ার দল উক্ত মন্দির বাছিয়া লইয়াছিল তাহা বলা মুশকিল। এত টিয়ার কাছাকাছিই সত্যবাবু থাকেন, তিনিও এক টিয়া, এরূপ সওয়াল কোনো কোনো মুনি রগ ফুলাইয়া করিত।

অপর এক শক্তিশালী মতও বিদ্যমান ছিল। সত্যবাবুর বাড়ির বাহিরের বারান্দায় ঝোলানো খাঁচায় একটি টিয়া ছিল, দালানে কিছু পায়রা চরিত। টিয়াটি কথাটথা বিশেষ বলিত না, মাঝে মধ্যে বড়োজোর মিঠু মিঠু করিত। ছোলা খাইবার কালে যথেচ্ছ খোসা উগরাইয়া দিত, বিষ্ঠা ত্যাগ করিত এবং অত্যুৎসাহী কেউ খাঁচার নিকট হাত বাড়াইলে খাঁচার ফাঁক দিয়া মুণ্ডু গলাইতে সচেষ্ট হইত, মুণ্ডু কিছুটা বাহির করিয়া রক্তিম ও বঙ্কিম চঞ্চু লইয়া হিংস্র ভঙ্গিতে আক্রমণ করিবার প্রয়াস লইত। সে টিয়া এতই হিংস্র যে আঙুলে দুই-চারিজনের আঘাতপূর্বক রক্তও ঝরিয়াছে। কে বা কাহারা সত্যবাবুর গৃহসংলগ্ন পাঁচিলের গায়ে গোটা গোটা করিয়া সবুজ কালিতে লিখিয়া দিয়াছিল: ‘টিয়া হইতে সাবধান।’ নীচে ইংরাজি ক্যাপিটালে লেখা: ‘BEWARE OF PARROT’ । ইহা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিত। অনেকে ইহা লইয়া হাসাহাসি করিত। নতুন কোনো অভ্যাগত গৃহে প্রবেশ করিলে ইহ-প্রসঙ্গ তুলিতেন। কেহ কেহ টিয়ার হিংস্রতা লইয়া ব্যাপারটা জাস্টিফাই করিতেন। কিন্তু, সত্যমাধব ইহা স্পোর্টিংলি লইতে পারেন নাই। কেন-না, তিনি মনে করিতেন তাহাকে জব্দ করিবার ইহা এক দুষ্টকৌশল। তাঁহার নিকনেম যে টিয়া, তা তিনি ভালোই জানিতেন এবং ইহা তাঁহাকে যারপরনাই পীড়িত করিত। অন্যান্য বহু শিক্ষকেরও বিবিধ নিকনেম ছিল। কেউ বিশেষ গায়ে মাখিতেন না, সত্যবাবুও আপ্রাণ চেষ্টা করিতেন এসকল উপেক্ষা করিতে, কিন্তু চেষ্টা করিলেও পারিতেন না। প্রথমবার পাঁচিলের গায়ে ‘টিয়া হইতে সাবধান’ লেখার অব্যবহিত পরেই তিনি চুন লেপিয়া তাহা মুছিয়া দেন। কিন্তু দুই চারিদিন পরে আবার কেউ রাতের অন্ধকারে একই কথা লিখিয়া দিল। উপরন্ত, ইংরাজি ক্যাপিটালে লেখা কথাটিও যোগ করিল। দুই মাস পরে সত্যবাবু আবার মুছিলেন। গৃহের দিকে কড়া নজর রাখিলেন। কিন্তু মাত্র দুই সপ্তাহ পরে আবার পূর্বের লেখাগুলি ফিরত আসিল, সঙ্গে মড়ার খুলি ও হাড় মার্কা গুণিতক চিহ্নের সাবধান-সংকেত, 440 ভোল্ট। ইহার পরে সত্যবাবু দমিয়া যান। লেখাগুলি থাকিয়াই গেল।

সংবাদে প্রকাশ, চের্নোবিল বিস্ফোরণের কিছু ঘণ্টার মধ্যেই কর্মরত একজন ব্যক্তি অস্বাভাবিক রেডিয়েশন ডোজের তীব্রতায় মারা যান। বাকি অনেকে কিছুদিন পরে, কিছু মাস পরে, যাইবেন। জনশ্রুতি, নিকটবর্তী কিছু আস্তাবলের ঘোড়ার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড রেডিও-আয়োডিন প্রভাবে ফাটিয়া যায়। পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে গাছের পাতা রঙ বদলাইয়া বাদামী হইয়া যায়। সমস্ত পাইন অরণ্য যেন বিচিত্র বর্ণ ধারণ করে। কিছু গুজবও চলিতে থাকে। ইউএসএসআর বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করে। পৃথিবী জুড়িয়া তখন চের্নোবিল, চের্নোবিল ও চের্নোবিল, এমত পারমাণবিক হাহাকার। ভারত তথা বাংলার নানান সংবাদপত্রেও এ সকল কিছু সংবাদ নানান মালমশলা মিশাইয়া পরিবেশিত হইল।

সত্যটিয়ার গুপ্ত ডায়ারির তারিখ সাক্ষ্য দেয়, বিচিত্র স্বপ্নটি তিনি ওই রাতেই দেখিতে পান। যদিও চের্নোবিল সম্বন্ধে তিনি পরে জানিতে পারেন। তিনি ডায়ারিতে মাত্র কিছু শব্দ লিখিতেন, কোনো বাক্য লিখিতেন না। গুপ্ত ডায়ারিতে স্বীয় হস্তাক্ষরে ‘টিয়া’, ‘ঠাকুমা’ ও ‘আসান ফকির’ এই ক-টি শব্দের সঙ্গে ‘চের্নোবিল’ শব্দটিও আলগোছে লিখিত ছিল।

সত্যটিয়ার স্বপ্নটি এইরূপ: তাঁহার অতি প্রিয়, দুই দশক আগে পরলোকগত, পিতামহী দাঁড়াইয়া ক্রন্দনরত, ‘টিয়া, টিয়া’ করিয়া চিৎকার করিতেছেন। আর কিছু নয়, কেবলই ‘টিয়া, টিয়া’ হাহাকার শোনা যাইতেছে এবং পিতামহী নয়নজলে ভাসিয়া যাইতেছেন। স্বপ্নের তীব্রতায় সত্যবাবুর ঘুম ভাঙিয়া গেল। দেখিলেন ঘামে গেঞ্জি ভিজিয়া গেছে, গলা শুকাইয়া গেছে। তিনি উঠিয়া জল খাইলেন। অনেকক্ষণ ঘুম আসিল না। স্বপ্নের কথা চিন্তা করিলেন। জাগিল এক দশক আগের এক অভিশপ্ত স্মৃতি। একটা অমঙ্গলচিন্তা আসিয়া বারবার ঘিরিয়া ধরিতে লাগিল। ইহার পরে ঘুম আসিল না।

সত্যমাধব কাকভোরে উঠিতেন। প্রাতঃকৃত্য ও আহ্নিক সারিয়া পালবাড়ির মাঠে মর্নিং ওয়াক করিতেন। ভোরে মূল দরজা খুলিয়া দীর্ঘ বারান্দায় আসিয়া একটি দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার স্নায়ুর আঁধার অবধি কাঁপিয়া উঠিল।

টিয়ার খাঁচাটি মেঝেতে পড়িয়া আছে। মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা তাজা রক্তের দাগ। টিয়ার ধড় খাঁচার মধ্যে রহিয়াছে, কিন্তু মুণ্ডটি নাই। কে যেন মুণ্ডটি কাটিয়া লইয়া গেছে।

(ক্রমশ)

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

6 Comments

  1. ভালো লাগছে। পড়ার আগ্রহ তৈরী হচ্ছে।পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম ।

    1. গল্প এগোচ্ছে চমৎকার গতিতে . পরের সংখ্যার অপেক্ষায় থাকবো.

  2. গল্প এগোচ্ছে চমৎকার গতিতে . পরের সংখ্যার অপেক্ষায় থাকবো.

Leave a Reply to Sampad Roy Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২