এদেশ আমার হোক – অর্ক রাজপণ্ডিত

এদেশ আমার হোক – অর্ক রাজপণ্ডিত

শেয়ার করুন

আজাদির ৭৩ তম বছরে ‘লার্সেন অ্যান্ড টুবরো’-র রাম মন্দিরে আপনাকে স্বাগত!
লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর এই রামমন্দিরের চাতালেই আপাত-ধর্মনিরপেক্ষ, আপাত-গণতান্ত্রিক, আপাত-প্রগতিশীল– সব্বাই লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেলে উলঙ্গ হন।
বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে, অতএব সাধের রামমন্দিরও বেসরকারি কর্পোরেট হাতে।
আহমেদাবাদের মন্দির বেওসায়ী ‘সোমপুরা ব্রাদার্স’-রা রামমন্দিরের নকশা আঁকলেও ‘ফাইন প্রিন্ট’-এ হাত বুলিয়েছে ‘প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স’-ও।
‘লার্সেন অ্যান্ড টুবরো’-কে বরাত দিয়েছে ‘শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট’। ১৬১ ফুট উঁচু এই মন্দির বানাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার খরচা!
লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর রামমন্দির চাতালে শুধু মোদী ভূমিপুজো শেষে শুয়ে পড়েননি, রামের নামে লালা ঝরিয়ে, বিষ ঝরিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন তাবড় সেকুলার আর ডেমোক্র্যাটিকরাও।
জন্মলগ্ন থেকে আরএসএস-এর দুটি মেগা প্রোজেক্ট শুধুই সফল নয়, দুটি মেগা প্রোজেক্ট সম্মতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে আরএসএস-বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিরও। বিনা বাধায়। বিনা প্রতিরোধে। জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার আর রামমন্দির নির্মাণ, দুটি মেগা প্রোজেক্টের সঙ্গে সহমত বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। শুধু সেই আনন্দেই লাড্ডু বিতরণ করতে পারে বিজেপি! একমাত্র ব্যতিক্রম বামপন্থীরা।
বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কাউকে বলতে শুনেছেন, বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আমরা আসলে ৩৭০ ফিরিয়ে আনব? নাহ্, আমি তো শুনিনি।
৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পক্ষেই সংসদে ভোট দিয়েছে কংগ্রেস, আপের মতো ওই আপাত-সেকুলার, আপাত-ডেমোক্র্যাটিক দলগুলি। মাঝে ওই ছিঁচকাঁদুনি, এরকমভাবে না হলেই ভালো হত, মেহবুবা মুফতিকে ছাড়তে হবে, সৈইফুদ্দিন সোজকে নিয়ে কেন মিথ্যা বলা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। অতটুকুই।
আর মন্দির নিয়ে খুল্লামখুল্লা। সব মুখোশ খুলে রেখে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশবাসীকে ‘জয় সিয়ারাম’ লিখে।
কমলনাথ শুধু হনুমান চালিশা পড়েই থেমে থাকেননি, এক কদম এগিয়ে বলেছেন, ‘মন্দিরের জন্য চাঁদা তুলে অযোধ্যায় ১১টা রুপোর ইট পাঠিয়েছে মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস কর্মীরা’।
এখনও পর্যন্ত কমলনাথের বক্তব্যের বিরোধিতা আসেনি কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে।
তাহলে আর রাখঢাক না করে পরিষ্কার বলা যায় লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর রামমন্দিরে কংগ্রেসের পাঠানো ১১টা রুপোর ইট আছে।
আরেক কংগ্রেস নেতা মনীশ তিওয়াড়িও টুইট করে গদগদ হয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভূমিপুজোর দিনে।
আপ নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়াল ‘জয় শ্রীরাম, জয় বজরঙবলী’ লিখে টুইট করে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
একে একে সবাই উলঙ্গ রামমন্দিরের চাতালে। যেভাবে একবছর আগে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার নিয়ে এঁরা উলঙ্গ হয়েছিলেন।
এই সময়ে আবার বেশ কিছু ভালোমানুষ প্রগতিশীলরাও আছেন। তাঁদের লাইন আবার অন্য, ‘গুড ক্যাপিটালিস্ট ব্যাড ক্যাপিটালিস্ট’-এর মতো, ‘ভালো রাম’, ‘খারাপ রাম’ গোছের।
তাঁরাই আর কি করেন! তাঁরা বলছেন তুলসীদাসের রাম ভালো, মোদী-আদবানির রাম ভালো না। অমুক হিন্দি কবির লেখা রাম ভালো, উমা ভারতীদের রাম ভালো না। ওই মন্দিরে পাপ আছে তাই ঈশ্বর ওখানে থাকবেন ক্যামনে! প্রিয়াঙ্কা গান্ধিদের কায়দাতেই বলছেন ভালোমানুষরা, রাম তো সবার মনেই থাকে। রাম তো আছেই মনে মনে।
ওগো ভালোমানুষের দল, তাহলে তোমাদেরও মনের ভেতর সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রামই থাকে? একটাও মসজিদ, গির্জা, গুরুদওয়ারা, গুম্ফা থাকে না? মনের ভেতর সেই ভালো রামই থাকে? এই সব ভালোমানুষ প্রগতিশীলদেরও উলঙ্গ হওয়ার দিন আজ!
এই পোড়া দেশে, এই সব ‘সেকুলার’ আর এই সব ‘ডেমোক্র্যাটিক’-দের দেশে, এই সব ‘প্রগতিশীল’-দের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার দায় শুধু সংখ্যালঘুদের। তাঁদের প্রতি মুহূর্তে, প্রতিদিন প্রমাণ দিতে হবে তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ, তাঁদের বলতে হবে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া পাঁচ একর জমিতে হাসপাতাল হোক, শিক্ষা কেন্দ্র হোক, সংস্কৃতি কেন্দ্র হোক।
আর বাকি সবাই উলঙ্গ হবেন লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর মন্দিরের চাতালে।
২৮ বছর হয়েছে মসজিদ ভাঙা হয়েছে। পাক্কা ২৮ বছর। এখনও শাস্তি হয়নি আদবানি, উমা ভারতী, মুরলী মনোহর যোশী, কল্যাণ সিংদের। মসজিদ ভাঙার ফৌজদারি মামলার শুনানির সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে বার বার। অযোধ্যা থানায় এফআইআর-এ নাম থাকা ব্যক্তিরা আমন্ত্রিত হয়েছেন মন্দিরের চাতালে।
আগামী ৩১ আগস্ট অযোধ্যার মসজিদ ভাঙার ফৌজদারি মামলার অভিযুক্তদের সাক্ষ্যগ্রহণ জমা দেওয়ার শেষ দিন। ইতিমধ্যেই ৩২জন অভিযুক্ত ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
বলাই বাহুল্য, আদবানি, যোশী, উমা ভারতীরা একযোগে বলেছেন, ‘আমরা কিছু করিনি, সব চক্রান্ত’।
চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় এদেশের বিশেষ সিবিআই আদালত, মাথায় থাকা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস করে দেবেন মসজিদ-ভাঙা দাগি অপরাধীদের।
এখনও যাঁরা লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর মন্দিরের চাতালে উলঙ্গ হননি, যাঁদের আজ সারা দিনমান লজ্জায়, ঘেন্নায় গা ঘিনঘিন করেছে তাঁদের প্রত্যেকের উচিত নিয়ম করে গলা ফাটিয়ে বলা। একলা পোস্টার হাতে বলা। মিছিলে সংগঠিত ভাবে বলা।
আদবানির সশ্রম কারাদণ্ড চাই।
উমা ভারতীর সশ্রম কারাদণ্ড চাই।
মুরলী মনোহর যোশীর সশ্রম কারাদণ্ড চাই।
আর কাশ্মীরে ফেরত চাই ৩৭০ ধারা।
আর স্বাধীনতার ৭৩ তম বছরে যদি এখন থেকে আমি-আপনি বলতে না পারি, যদি এখনও জিভের, মেরুদণ্ডের আড়মোড়া না ভাঙে তাহলে আমাদেরও মনের মধ্যে বাস করেন এক একজন মোদী, অশোক সিঙ্ঘল, প্রবীণ তোগাড়িয়ারা।
স্বাধীনতা দিবসের দিন খবর নেওয়া তাই জরুরি। স্বাধীনতা দিবস পাশের মানুষের খবর রাখার দিন।
কেমন আছে সরফুরা জাগরের পেটের মধ্যে থাকা বাচ্চাটা, যে জেল পেরিয়ে এসেছে?
স্বাধীনতার এই সকালে যখন ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে তেরঙ্গা তুলবেন অনুরাগ ঠাকুর, কপিল মিশ্ররা, তখন জেলের কুঠুরিতে কেমন আছে জামিয়া মিলিয়ার পড়ুয়ারা?
খবর রাখা জরুরি, এই আজাদির দিনে কেমন আছেন ভারভারা রাও, সাইবাবা, গৌতম নওলাখারা? কেমন আছে শ্রীনগর, অনন্তনাগ, কুলগাম থেকে দিল্লির খাজুরি খাস, জাফরাবাদ, মৌজপুর?
কেমন আছে লকডাউনে বহুদূর হেঁটে আসা পরিযায়ীর ক্লান্ত পা? কাজ-হারানো, মজুরি-খোয়ানো মানুষগুলোর খবর রাখব কি স্বাধীনতার সকালে?
স্বাধীনতার ৭৩ বছরেই আত্মনির্ভরতার নামে দেশ বিক্রি হচ্ছে। ইস্পাত, কয়লা, অরণ্য, পর্বত, খনিজ, আকাশ– সব কিছুই।
যারা আমাদের সংবিধান উপড়ে ফেলতে চায়, যারা জনগণের আগে মুনাফা বসায়, যারা জিডিপি-র নামে লুটতরাজ চালায় দেশের সম্পদে তাদের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইকে জয়ের নিশান ছোঁয়ানোর লক্ষ্য হোক আমাদের।
এবছরের ১৫ আগস্টও কাদা-বর্ষায় থইথই ইটভাটার মাঠে, বস্তির একচিলতে জমিতে, রেললাইনের ধারে, পোড়ো কারখানার কঙ্কালসার মাঠে ফুটবল খেলতে নামবে কি সেই হাড়-জিরজিরে ছেলেগুলো? তাদের কানে কানেই এই স্বাধীনতার দিন সকালে কবিতা পড়ুন নবারুণ ভট্টাচার্যের–

‘রেলস্টেশনে, হাসপাতালের
বাজার খোলা, খাস চাতালে
শহর নগর রেল পাতালে
কাহার দিবস রাত্রি হয়
জেলহাজতে, হাড়িকাঠে
দুইবেলা যার মুণ্ডু কাটে
চিতা যাহার জ্বলছে মাঠে
শ্মশানে চোখ অশ্রুময়
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে— এদেশ তোমার নয়’

নবারুণ ভট্টাচার্য

লালকেল্লার লাইভ নয়। এদেশ আমার-আপনার করবার শপথে কাটুক আজকের সকাল।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

5 Comments

Leave a Reply to নাগরিক ডট নিউজ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২