দেবমহিমা – দেবাশিস মুখার্জী

দেবমহিমা – দেবাশিস মুখার্জী

শেয়ার করুন

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে চললো, গাছের ছায়াগুলো কেমন লম্বা লম্বা হয়ে মন্দিরের গায়ে দুলছে…আকাশে মেঘ জমছে, দূরে হয়তো কোথাও বৃষ্টিও নেমেছে…হাওয়ায় কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভিজে ভাব। দিনের এই সময়টা এই বুড়ো শিবের মন্দির খালিই থাকে, গ্রামের এক প্রান্তে এই মন্দির, পাশের রাস্তা সোজা গেছে নদীর ঘাটে, ঘাটে নৌকো ভিড়লে কিছু লোক চলাচল করে এই পথে, নইলে একরকম খালিই থাকে এই চত্বর …..খালি মন্দিরের চাতালে বসে বৃদ্ধ তারাচরণ ঠাকুর ওদের তিন বন্ধুকে ঠাকুরের নাম মাহাত্ম্য শোনাচ্ছেন ….বাদল এই গ্রামেরই ছেলে, সুগত আর প্রতিম কলকাতার, দুদিনের জন্য বাদলের সাথে এসেছে ওদের গ্রাম দেখতে । তারাচরণ ঠাকুরের বয়েস প্রায় আশি, বয়েস অনুপাতে এখনো সক্ষম, দুবেলা এই মন্দিরের পুজোর দায় দ্বায়িত্ব সব ওনার, আজ কত বছর হলো উনি নিজেও বলতে পারেন না …সেই ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে আসা….পুরুষানুক্রমে এই মন্দিরের পুজোর ভার ওনাদের বংশের ওপর…উনি নিঃসন্তান….এর পর কে হাল ধরবে কে জানে । কথায় কথায় একটা অদ্ভুত কথা শোনালেন ঠাকুরমশাই ….মন্দিরের ঠাকুর যেমন শান্ত শিষ্ট ওনার গলায় পেঁচিয়ে থাকা নাগদেব কিন্তু বেশ তিরিক্ষি মেজাজের….না কাউকে কামড়েছেন তেমন শোনা যায় না আর পাথরের সাপ কামড়াবেই বা কি করে…কিন্তু বাবার অপমান বা অসম্মান সইতে পারেন না….কেউ এই ধৃষ্টতা দেখালে তার শিক্ষা উনি নিজের হাতেই দেন ….তখন দুচার দিন উনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন, কাজ শেষে আবার বাবার কণ্ঠহার।

বাদল এই গ্রামেরই ছেলে, ছোটথেকেই এই কথা শুনে আসছে, এর ঠিক ভুল, সম্ভব অসম্ভব….এ নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। সুগত নিজের পড়া আর ক্যারিয়ার …এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না , ঠাকুরমশাই বলছেন …তাহলে ঠিকই আছে…একজন বয়স্ক ভদ্রলোক কেনইবা বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাবেন…এমন তো অনেক ঘটনাই ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই..ইত্যাদি।

প্রতিম কিন্তু একটু অন্যরকম, এই সব আজগুবি গাঁজাখুরি … এই সবের বিরুদ্ধেই ওর দল যুক্তিবাদী মঞ্চের আন্দোলন । ওরা সব বিচার করে যুক্তি দিয়ে, প্রতিটা ঘটনা ঘটার পেছনে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজে….পাথরের সাপ শিবের গলা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে দু চার দিনের জন্য….এ কখনোই সম্ভব না যদি না কিছুদিনের জন্য মূর্তিটাই বদলে ফেলা হয়। মূর্তি বদল হয় কিনা সেটা শিবমূর্তি ভালো করে না দেখলে বলা সম্ভব না । আরো একটা সম্ভাবনা আছে….পাথরের সাপ মূর্তির গা থেকে নিশ্চই খুলে ফেলা যায়, অন্তত তেমন কোনো রাস্তা আছে….পাথরের সাপ আপনা আপনি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে…আবার ফিরে আসছে….না গালগল্পের একটা সীমা থাকা দরকার । ধর্মের নাম করে এই রকম সব আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে যুগযুগ ধরে মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা হয়েছে…তারাচরণ ঠাকুরের মতো কিছু স্বার্থান্বেষী লোক এই ভাবে ভুজুং ভাজুং দিয়ে সাধারণ লোককে আবহমান কাল ধরে বশে রেখেছে…সমাজের সর্বস্তরে এদের বিচরণ…।

প্রতিম একটু উদ্ধত স্বরেই জিজ্ঞেস করে ” একবার কাছ থেকে মূর্তিটা দেখা যায় ? পাথরের সাপ কোন পথে আসা যাওয়া করে সেটাও তো জানা দরকার ” । ওর কথার মধ্যে যে তাচ্ছিল্য , যে অবজ্ঞা…সেটা তারাচরণের নজর এড়ায়ে না …উনি স্থিতধী পুরুষ ….স্মিত হেসে বললেন ” বেশ তো , দ্যাখো এতো বছরের এই রহস্যর কোনো সমাধান করতে পারো কিনা ….একটাই কথা…ঠাকুরের অবমাননা না হয় …এ হলো বহু মানুষের বহু দিনের ভক্তি শ্রদ্ধার আধার…এর অসম্মান করো না , তোমরা শিক্ষিত, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা সেটাই যা অন্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়…মন্দিরের দরজা খোলাই আছে , তুমি ইচ্ছে হলে এখনই যেতে পারো “।

প্রতিম দেখে আলো বেশ কমে এসেছে , আর দেরী করলে আরো অন্ধকার হয়ে যাবে , যা করার এখনই করতে হবে । ও উঠে দাঁড়াতেই বাদল আর সুগত হাঁ হাঁ করে ওঠে ..” খেপেছিস নাকি ? দুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিস , এসব ছাড় …তোর কি ? ঠাকুর জাগ্রত হোক বা কল্পনা ….তোর কি আসে যায় ? একদম ঝামেলা বাড়াস না , চল চল সন্ধে হয়ে আসছে , এবার ফিরে যাই ” । প্রতিম জানতো এটাই হবে , ওরা সঙ্গে তো থাকবেই না উল্টে ওকেই আটকাবে …ঠান্ডা গলায় বললো ” ইচ্ছে হলে আয় নাহলে বস…আমি এক্ষুনি আসছি….আর যদি সাপের ভয় পাস…কেটে পড়…আমি না দেখে ছাড়বো না ….সাপ বাবাজি কি খেলা দেখায় দেখে আসি “।

মন্দিরের ভেতরটা কেমন যেন আলো আঁধারি…দরজা দিয়েই যা একটু আলো আসছে ….তাও দক্ষিণ মুখী দরজা তাই আলোটাও তেরছা হয়ে ভেতরে আসছে….মূর্তির এক পাশে টিমটিম করে একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে। অল্প আলোয় এই প্রথম মূর্তিটা ভালো করে দেখলো….শ্বেত পাথরের শিবমূর্তি, পড়নে বাঘছাল, ষাঁড়ের ওপর বসা …গলায় জড়ানো কালো সাপ…সাপের সারা গায়ে সাদা বরফির মতো নকশা কাটা ….প্রতিম আরো কাছে যায়…প্রদীপটা একটু তুলে ধরে….সাপটাকে খুব ভালো করে খেয়াল করে….নাঃ এটা নিশ্চই একটা গোটা পাথরের তৈরী না , নিশ্চই মাঝে কোনো জোড়া আছে , নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সাপটিকে ছুঁয়ে দেখে…..ফোঁস….আচমকা আওয়াজে চমকে ওঠে….কোথা থেকে আওয়াজটা এলো ? সাপটার গাটা কি একটু বেশি ঠান্ডা মনে হলো ? কাঁপা হাতে প্রদীপটা রেখে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসে । টের পায় ভেতরে ভেতরে ঘামছে….এটা কেমন করে সম্ভব ? পাথরের সাপ আওয়াজ করছে ? ধুস…অসম্ভব…মনে হয় মন্দিরের আলোআঁধারী পরিবেশ, তার সাথে হয়তো ওর অবচেতন মনের কোণে লুকিয়ে থাকা ভক্তি….এই সব মিলিয়েই এই ঘটনা….এটা মনের ভুল ছাড়া আর কিছুই না।

বন্ধুদের কিছু বলে না প্রতিম , ওদের ও তেমন জানার আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না । ওদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই ওর ছেলেমানুষি বা একগুঁয়েমি। তারাচরণ ও কোনো কথা জানতে চাইলেন না । ওর চোখের দিকে চেয়ে কি যেন খুঁজছেন ….শুধু বললেন ” ঠাকুরকে না ছুঁলেই পারতে বাবা , স্নান করে শুদ্ধ কাপড়ে ওনাকে ছুঁতে হয় , তোমরা বলবে এ আমাদের অন্ধ বিশ্বাস ….আমি বলি এ আমাদের মনের ভক্তি….আজীবন কাল এই গাঁ সুদ্ধু লোক এটা মেনে আসছে….বাবার কাছে প্রার্থনা করি…উনি যেন তোমার কোনো অপরাধ না নেন “। প্রতিম চমকে ওঠে …ঠাকুরমশাই কি করে জানলেন ও মূর্তির গায়ে হাত দিয়েছে ? উনি তো ভেতরে যান নি ? এরাও কেউ যায় নি …তাহলে ? তারাচরণ যেন ওর মনের কথা পড়তে পারেন , বলেন ” পৃথিবী বড় বিরাট জায়গা বাবা , বিচিত্র তার রহস্য ….কি করে কি হয়….সব উনিই জানেন ” । তারাচরণ আস্তে আস্তে উঠে ধীর পায়ে মন্দিরে ফিরে যান , ওরা বাদলের বাড়ির পথ ধরে।

পরের দিনটা এদিক ওদিক ঘুরে কাটে, প্রতিমের খুব ইচ্ছে একবার মন্দিরে যায় কিন্তু বাকি দুজনের এক কথা …”ঢের হয়েছে , আর না”। সন্ধের মুখে প্রতিম আর পারে না , একা এক।ই মন্দিরে চলে যায়…তারাচরণ যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, মুখে সেই অদ্ভুত স্মিত হাসি , বলেন ” এস বাবা, আজ দুপুর থেকে নাগ বাবাজি উধাও , ভয় পেও না , উনি কারো ক্ষতি করেন না …খালি একটু চোখ কান খোলা রেখো , আমার স্থির বিশ্বাস তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পাবে”।

মন্দির থেকে বাদলদের বাড়ির রাস্তায় খুব সাবধানে দেখে শুনে পা ফেলে প্রতিম । একে বর্ষাকাল তার ওপর গ্রামের রাস্তা …আলোর কোনো ব্যাপারই নেই , ওর কাছেও কোনো আলো নেই…এই অবস্থায় সাপের দেখা পাওয়া … সেটা কোনো অলৌকিক ঘটনা মোটেই হবে না বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক ….কিন্তু মাঝখান থেকে সাপ বাবাজি নাম কিনে বেরিয়ে যাবেন …সেটা হতে দেওয়া যাবে না ….লড়াই যখন শুরু হয়েছে , প্রত্যেকটি পা দেখে ফেলতে হবে।

প্রতিম চিন্তা করে দেখে ও প্রায় জিতেই গেছে ….রাতটা বাদলদের বাড়িতে কাটাতে পারলে পরের দিন ভোরেই কলকাতা….সাপ বাবাজিকে যা করার করতে হবে এই গ্রামেই, একবার শহরে চলে গেলে ওনার পক্ষে ব্যাপারটা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে । রাতে খাবার পর মশারি ভালো করে গুঁজে শুলো…যদি রাতে উঠতে হয়…মাথার কাছে রইলো তিন ব্যাটারির টর্চ।

সকালে ট্রেনে ফেরার পথে পুরো ব্যাপারটাই প্রতিমের কাছে খুব হাস্যকর বলে মনে হলো । ওর উচিত ছিল পরের দিন মন্দিরের ভেতরে গিয়ে দেখে আসা সত্যি সত্যি সাপ গায়েব না কি পুরোটাই ভাওঁতা…যাক গে…ঠাকুরমশাই ওনার মন্দির আর ঠাকুর পুজো নিয়ে থাকুন…একটাই আফশোষ….চালাকিটা ধরার সময় বা সুযোগ পাওয়া গেলো না । চুলোয় যাক সব, এবার আবার পুরোনো জীবনে ফেরার পালা।

ট্যাক্সিটা লাল বাতিতে অনেকক্ষন হলো দাঁড়ানো, চারিদিকে গাড়ির হর্ন মানুষের হট্টগোল….এতো কিছুর মধ্যেও ট্যাক্সির জানালায় বসে ঢুলছিলো প্রতিম, হঠাৎ ….ফোঁস….চমকে ওঠে …গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে পুজোর থালা হাতে দুটো ছোট মেয়ে…থালায় সিঁদুর মাখা ঠাকুরের ছবি…আর…একটা জলজ্যান্ত সাপ…কালো রং….সারা গায়ে সাদা চাকা চাকা নকশা…মন্দিরের সাপটার সাথে কি অদ্ভুত মিল…. চেরা জিভটা লকলক করছে…..এক দৃষ্টে চেয়ে আছে প্রতিমের দিকে । বাতি সবুজ হতেই গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো ….প্রতিমের মনে হলো সাপটা যেন থালা থেকে মাথা তুলে ওর দিকেই চেয়ে আছে…সাবাশ বাবাজি…একটু অন্যমনস্ক হয়েছি…ব্যাস এক গোল দিয়ে দিলে…।

একটা অস্বস্তি নিয়ে বাড়ি ঢোকে প্রতিম ….না সে যে ভয় পেয়েছে তা নয় । কলকাতার ট্রাফিক সিগনালে হামেশাই এরকম দেখা যায়….ঠাকুরের ছবির থালায় একটা জলজ্যান্ত সাপ নিয়ে বাচ্চা মেয়েরা ভিক্ষে করছে । সাপের চেহারার মিল…এটা নিছকই একটা কাকতালীয় ব্যাপার।

একটু বই পত্তর নেড়েচেড়ে এটুকু বোঝা গেলো বাবাজি নির্বিষ ….এমন অসংখ্য নির্বিষ সাপ বাংলার মাঠে ঘটে পাওয়া যায় নইলে ওই এক রত্তি মেয়েগুলো এইসব কায়দা করতে পারতো না । প্রতিম ঠিক করে এই নিয়ে আর চিন্তা করবে না …তিন দিন বাড়ি ছাড়া, অনেক কাজ পড়ে আছে।

রাতে ঘুমটা আচমকাই ভেঙে গেলো, জানালায় চোখ পড়তে চমকে ওঠে ….বৃষ্টির ভয়ে কাঁচের জানালা বন্ধ, সেই জানালায় একদম স্পষ্ট একটা সাপের অবয়ব…বন্ধ জানালার ওপারে ….লেজের ওপর দাঁড়িয়ে দুলছে …যেন ঘরে ঢুকতে চাইছে । প্রতিম মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে…ঘুম চোখে চমক লাগাটা অস্বাভাবিক না ….তিনতলার ঘরের জানলা দিয়ে সাপ ঢুকতে চাইছে….না এ সম্ভব না । উঠে ঘরের আলো জ্বালে…সোজা গিয়ে জানালা খুলতেই….ও হরি….গাছের ডালের ছায়া পড়েছে জানালার কাঁচে .. সাপ টাপ কিচ্ছু না । জানালাটা খোলাই রেখে দেয় প্রতিম, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে এই ভাবেই না জানি কত লোকের মনে অলৌকিকের প্রতি আস্থা জাগে, সবাই যে আগেই এগুলোকে দেবমহিমা বলে বিশ্বাস করে বসে । সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন আবার ঘুমিয়ে পড়ে ।

সকালে ঘুম ভাঙতেই , কেন কে জানে , জানালার পাশের টেবিলটার দিকে নজর পড়ে ….কি একটা কালো মতো টেবিল এর ওপর ? সামনে গিয়ে চমকে ওঠে ….একটা সাপের খোলস….ইনি জাতসাপ …খোলসের গায়ের নকশা তাই বলে….কালকেই বইয়ে দেখেছে এই ছবি….লাল পিঁপড়ের দল এর মধ্যে ছেঁকে ধরেছে খোলসটা …। প্রতিম স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে …ওর বিশ্বাসের দেয়ালে এই প্রথম ফাটল ধরা পড়েছে …।

ওদিকে গ্রামের শিবমন্দিরে আজ মহা ধুমধাম ….নাগবাবাজি কাল রাতে ফিরে এসেছেন….নবকলেবরে …।

 

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

2 Comments

  1. অসাধারণ গল্প । অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করব কি না দোটানায় পরে যাই।

Leave a Reply to শুভাশিস ঘোষ রায় Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২