আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় – অমিতাভ গুপ্ত

আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় – অমিতাভ গুপ্ত

শেয়ার করুন

সুকান্ত ভট্টাচার্যের অকালপ্রয়াণের পরে বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়, কবি মর্মস্পর্শী সম্পাদকীয় রচনা করেছিলেন। রচনার প্রথমেই ছিল এই পংক্তিটি, ‘সুকান্তকে আমি ভালবাসতুম’ এবং এই ভালোবাসা যে নিছক কথার কথা নয়, এ যে কর্তব্যনিষ্ঠ দায়িত্বপরায়ণ অনুরাগ– যেমনটি হওয়া উচিত অনুজ কবির প্রতি একদল অগ্রজ কবির তেমনটি প্রদর্শন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতি। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাও তিনি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন তাঁর পত্রিকায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও তিনি প্রথম প্রকাশ করেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসামুখর আলোচনা প্রকাশ করে বুদ্ধদেব বসু অনুরূপ কর্তব্যপরায়ণতার দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন।

এ সিদ্ধান্ত তর্কাতীত যে বুদ্ধদেব বসু একজন শ্রেষ্ঠ সম্পাদকের মতোই সর্বতোভাবে কবিপ্রতিভার সুবিচারক ছিলেন এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিপ্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে তাঁর দ্বিধা–বিলম্ব হয়নি। প্রতি-তুলনায় একালের, বিশেষত বিশ-শতকের শেষদিকে বা একুশ-শতকের প্রথমদিকে (যেমন, মণীন্দ্র গুপ্ত – সম্পাদিত) বাংলা কবিতা সংকলনে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার অনুপস্থিতি অত্যন্ত বিসদৃশ লাগে। একালে অনেকেই সুকান্ত–নজরুলকে কবি বলে মান্য করেন না। একালে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রবল স্বৈরাচার অনেক শুভকে, অনেক মঙ্গলকে তমসাচ্ছন্ন করে ফেলতে পেরেছে।

তবু সুকান্ত আজও রয়েছেন আমাদের সঙ্গে। যেভাবে আবির্ভাব লগ্নেই তিনি প্রকৃত কবিতা পাঠকের চিত্ত জয় করেছিলেন, এখনও সেভাবেই ― বলা সঙ্গত, তার চেয়ে একটু অধিকতরভাবে তিনি দীপিত করে চলেছেন।
অনুভবের অন্ধকার পেরিয়ে আমাদের চেতনাকে যারা তমসাকীর্ণ করে, তারা শিউরে উঠেছে সেই দীপ্ৰ ঝলকে:

‘আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায়
কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায়
ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়,
জানে না কেউ।
উদ্যমহীন মূঢ় কারায়
পুরোনো বুলির মাছি তাড়ায়
যারা, তারা নিয়ে ফেরে পাড়ায়
স্মৃতির ফেউ।’

শুধুমাত্র তীব্রোজ্জ্বল বক্তব্যের জন্য নয়, ছন্দে, অন্তমিলে, অনুপ্রাসে এই ক্ষুদ্র কবিতাটি ভাবার্থের সঙ্গে এমনই সুসমঞ্জস যে অনায়াসে বলা চলে এখানেই নান্দনিকতার পার্বতীপরমেশ্বর, এখানেই উক্তি ও অলংকার পরস্পরের যথার্থ পরিপূরক। আর একটি কথাও মনে রাখতে হবে। যে-কোনো পাঠক এই কবিতাটি একবার মাত্র পড়েই চিরস্মৃতিধার্য করে নিতে পারেন। মনে পড়ছে সেই মহৎ ঘটনার কথা। সত্তর হাজার শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কবিতা শোনাতে শোনাতে মায়াকভস্কি হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলেন, তৎক্ষণাৎ সত্তর হাজার কণ্ঠ থেকে সমুদ্র গর্জনের মতো উচ্চারিত হল হারিয়ে ফেলা সেই পঙ্‌ক্তিটি।
সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে মাত্রাবৃত্তের দোলা আছে কিনা তা নির্ণয় করা সহজ নয়। আবার ট্রাম্পেটের ধ্বনি, বিপ্লবের বিষাণধ্বনি বা নজরুলের অগ্নিবীণার রাগিনী যে ষষ্ঠ মাত্রায় চরণ ফেলে, তা রবীন্দ্রনাথই দেখিয়েছেন–

‘জয় ভূলোকের, জয় দ্যুলোকের, জয় আলোকের জয়’।

মাত্রাবৃত্তের বাক্-স্পন্দের বঙ্গভাষার স্বাধিকার স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণ করেছেন পরবর্তী সকলেই। সুকান্ত ভট্টাচার্যও ব্যতিক্রম নন। এমনকি একথাও বলা যেতে পারে তাঁর মুক্তক ছন্দে রচিত কবিতাগুলির (‘একটি মোরগের কাহিনী’, ‘দেশলাই’ ) কোনও কোনও কবিতার চেয়ে ছ-মাত্রায় রচিত কবিতাগুলিই অধিকতর আকর্ষক অর্থাৎ প্রাণশক্তিতে অধিকতর উদ্দীপ্ত। যেখানে ছন্দমিশ্রণ ঘটিয়েছেন (যেমন ‘বোধন’ কবিতায়), সেখানে ভিন্নতর আয়োজনে ষষ্ঠ মাত্রায় যতিপাতের দরকার হয়েছে–

‘শোন্ রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়—
হিসাব কি দিবি তার?’

‘বোধন’ কবিতার শেষ কয়েকটি ছত্রও ছ-মাত্রায় রচিত। অভিশাপের মতো যেন বর্ষিত হয়েছে এই অন্তিম পঙ্‌ক্তিটি কোনো এক মহামানবের উদ্দেশে :

‘তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর ;
তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি তো মানুষ নও—
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।।’

তথাকথিত মহামানবদের উদ্দেশে আজ সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো স্পষ্ট উচ্চারণে এই কথাটি জানিয়ে দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন যে এদেশে নয়াউপনিবেশবাদীদের বা নয়াসাম্রাজ্যবাদীদের আর কোনো ঠাঁই নেই।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

3 Comments

Leave a Reply to Shampa banerjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২